Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ২১, ২০২৪

ভোর ভয়ি । পর্ব ২

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি । পর্ব ২

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 

       বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

♦ দ্বিতীয় পর্ব ♦

গোপাললাল ঠাকুর রোড থেকে সাড়ে ন-টা নাগাদ বাসে ওঠা কঠিন ছিল ৷ প্রথমত বাস কম ৷ তার ওপর অফিস টাইমের ভিড়৷ শ্যামলস্যারের সঙ্গে হেঁটে চলে আসতাম বিটি রোডে৷ এখানে বাসের সংখ্যা বেশি ৷ শ্যামবাজারের বাস বেশ কয়েকটা ৷ বলা দরকার, তখন বেসরকারি বাসের এত ছড়াছড়ি ছিল না৷ হালকা ভিড়ের শ্যামবাজারগামী বাস ধরে চলে আসতাম দু-জনে ৷ বসবার জায়গা মিলত খুব কম, তবে পাশাপাশি দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল ৷ শ্যামবাজার ট্রামডিপো থেকে ফার্স্ট ক্লাসে সিট পাওয়া যেত সহজেই ৷ এক ও পাঁচ নম্বর ট্রাম ৷ স্পষ্ট মনে করতে পারি, এই রাস্তাটুকু শ্যামলস্যার আমার পড়ার কাজে লাগাতেন ৷ 
 
   ইংরেজি বাক্য লিখবে ছোটো ও সরল ৷ জটিল করে তুলবে না৷ দ্যাট, হুইচ, হোয়্যার ইত্যাদি দিয়ে লম্বা করলে সামলাতে পারবে না ৷ ভাষার ওপর যখন দখল আসবে, তখন জটিলের দিকে যাবে ৷ বিজয়বাবু তো ছুটির পর কয়েকজনকে পড়ান৷ তুমিও সেখানে পড়বে৷ অসুবিধে কী? 
 
    বিজয়বাবু মানে বিজয় কাঞ্জিলাল ৷ ইংরেজির শিক্ষক৷ স্কুলছুটির পর দোতলায় টিচার্স রুমের উলটোদিকে একটা ক্লাসঘরে পাঁচ-সাতজনকে ট্রানস্লেশন, ডায়ালগ বা কনভারসেশন, লেটার রাইটিং শেখাতেন ৷ আমি কখনও যাইনি ৷ কারণ অনিলদা (দপ্তরি) ছুটির ঘণ্টা বাজানোর আগেই আমার কানে বেজে উঠত পার্কসার্কাস মাঠের হইহই কিংবা গড়ের মাঠের রাম্পার্টের চিৎকার৷  আরও একটা কারণ ছিল৷ আমার ধারণা ছিল, ওরা বেতন দিয়ে কোচিং পড়ে৷ বাবার কাছে বেতন চাইতে পারব না ৷ পাটোয়ারবাগানে এক বাড়ির দোতলায় বাংলার শিক্ষক অপূর্ব রায় ও নেপালস্যার (পদবি মনে নেই), অঙ্কের শিক্ষক সুরেশবাবু (পদবি মনে নেই), অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক (নাম মনে নেই) এবং আরও কয়েকজন মিলে কোচিং খুলেছিলেন ৷ ভরতি হয়েছিলাম ৷ তখন ভারত-পাক যুদ্ধ আসন্ন ৷ সাল ১৯৬৫৷ হঠাৎ হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠে ৷ স্ট্রিটলাইট থেকে ঘরের লাইট সব টুপি-পরা ৷ ব্ল্যাক আউট বা নিষ্প্রদীপ ৷ বোমারু বিমান হানা দিতে পারে ৷ মনে আছে, যুদ্ধের জন্য জনগণের কাছে অর্থসাহায্য চেয়ে জনসভা অ্যান্টনিবাগানের কাগজপট্টিতে৷ মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন বক্তৃতা করছেন ৷ যার যা সাধ্য দান করার আবেদন জানাচ্ছেন ৷ পার্থ-বিষ্ণু আর আমি কোচিং পড়ে সভার পাশ দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম ৷ সন্ধে হবার আগেই কোচিংয়ে ছুটি করে দেওয়া হয়৷ রাত হলে পথ ফাঁকা হয়ে যায়, গাড়ি কমে যায় ৷ সেই কোচিংয়ে দু-মাসের ফি বকেয়া পড়ে৷ দিতে পারিনি৷ সেখানে আমার পড়া বন্ধ হয়েছিল৷  
 
   শ্যামলস্যার বলেছিলেন, বিজযবাবুকে বলে দেব ৷ ইংরেজিতে তুই বেশ কাঁচা ৷ পিকে দে সরকারের বইটা আছে? হেরম্ববাবুর (আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার হেরম্ব চক্রবর্তী) বইটা (গাইড টু গুড ইংলিশ) তেমন কাজের নয় ৷
 
   লেখাপড়া যার একেবারে ভালো লাগে না এমন ছেলেকে যাঁরা লেখাপড়ায় সামান্য হলেও ফিরিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বিজয় কাঞ্জিলাল ৷ সাড়ে চার ফুট উচ্চতার সদাপ্রসন্ন অনুচ্চভাষী মানুষটির ভাবনার উচ্চতা মনের গভীরতা মাপার সাধ্য আমার নেই ৷ তাঁর শারীরিক খর্বতা নিয়ে পরিহাস করেছি ৷ তাঁর প্রসন্নতাকে ঠাট্টা করেছি ৷ মুখের সামনে হাত রেখে তাঁর নিচু গলায় কথা বলার সভ্যতা নিয়ে রগড় করেছি ৷
 

বরানগরে স্যারের বাসায় বসে শুনেছি ৷ শুনেছি, ভাইকে তিনি এনেছিলেন ৷ মাসখানেক এখানে ছিল ৷ বইপত্তর কিনে দিয়েছিলেন ৷ স্কুলে ভরতি করার প্রস্তুতি চলছিল ৷ এমনকি নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনও করা হয়েছিল সরকারের কাছে ৷ হঠাৎ ভাই উধাও ৷ বোঝা গেল পালিয়েছে ৷ দিনসাতেক বাদে খবর এল, সে ফিরে গেছে পূর্ববঙ্গের বাড়িতে ৷ বইপত্তর নাকি কোথায় কোন নদীজলে ভেসে গেছে

 
   শ্যামলস্যার আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ভবঘুরে ভাইকে ৷ পূর্ববঙ্গে দাদার পরিবারে থাকে ৷ লেখাপড়ার ধারে-কাছে নেই ৷ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ সারাদিন বাউন্ডুলেপনা ৷ স্যার চেয়েছিলেন ভাইকে ভারতে নিয়ে এসে নিজের কাছে পাকাপাকি রাখতে ৷ যদি কোনোভাবে মানুষ করে তোলা যায় ৷ এই ভাইয়ের গল্প শুনতে আমার দারুণ লাগত ৷ বরানগরে স্যারের বাসায় বসে শুনেছি ৷ শুনেছি, ভাইকে তিনি এনেছিলেন ৷ মাসখানেক এখানে ছিল ৷ বইপত্তর কিনে দিয়েছিলেন ৷ স্কুলে ভরতি করার প্রস্তুতি চলছিল ৷ এমনকি নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনও করা হয়েছিল সরকারের কাছে ৷ হঠাৎ ভাই উধাও ৷ বোঝা গেল পালিয়েছে ৷ দিনসাতেক বাদে খবর এল, সে ফিরে গেছে পূর্ববঙ্গের বাড়িতে ৷ বইপত্তর নাকি কোথায় কোন নদীজলে ভেসে গেছে ৷ 
 
   হুবহু এরকম নয় হয়তো, প্রায় ৬০ বছর আগেকার স্মৃতি হাতড়ে অবিকল বলা সত্যি অসম্ভব, তবে একটা কথা বলতে পারি, এখানে একটিও প্রসঙ্গ, একটিও উচ্চারণ বানানো নয় ৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ট্রাম থেকে নামতাম আমরা ৷ কলেজ স্কোয়ারের গা দিয়ে সূর্য সেন স্ট্রিট (তখন মির্জাপুর স্ট্রিট নামটা বেশি চালু ছিল) উত্তর-পূর্ব দিকে হাঁটতাম৷ ফুটপাথ তখন পথচারীদের ছিল ৷ এ শহর ভদ্র বসবাসের ছিল ৷ খানিকটা পথ গেলে আমহার্স্ট স্ট্রিট ৷  ডানদিকে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ৷ আরও খানিকটা হাঁটলে হ্যারিসন রোড বা এমজি রোড ৷ আর আর কিছুটা গেলেই আমাদের স্কুল ৷ 
 
  ট্রাম থেকে নেমে হয়তো শ্যামলস্যার আবৃত্তি করলেন, যদাশ্রৌষং ভীষ্মমত্যন্তশূরম হতং পার্থেনাহবেষ্বপ্রধৃষ্যম/ শিখণ্ডিনং পুরতঃ স্থাপয়িত্বা তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়৷ ‘ধৃতরাষ্ট্রবিলাপ’ থেকে বললেন ৷ গুরুগম্ভীর গলায় প্রতিধ্বনিময় উচ্চারণ নয় ৷ স্যারের কোমল গলায় মিহি কথা বলার চেনা আদলে৷ ছন্দের দোলা পেয়েছি তাঁর বলার মধ্যে ৷ ‘ধৃতরাষ্ট্রবিলাপ’ আমাদের পাঠ্য ছিল ৷ যতদূর মনে পড়ে, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর অংশও পড়তে হয়েছে ৷ 
 
   স্যার জিজ্ঞেস করলেন, শিখণ্ডী কে? কে তাকে সামনে রেখে যুদ্ধ করেছিল? কার বিরুদ্ধে? কে আর বিজয়ের আশা করেনি? কেন? উত্তরগুলো তৈরি করতে হবে ৷ সন্ধিবিচ্ছেদ দেখতে হবে ৷ ঠিক হলে অঙ্কের মতো নম্বর ৷ পার্থেনাহবেষ্বপ্রধৃষ্যম ৷ অপ্রধৃষ্যম মানে কি? এই তো পড়বার সময়, শেখবার সময় ৷ অনেক ফাঁকি দিয়েছ, বাবু ! রেজাল্ট ভালো না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার ৷ নাশংসে বিজয়ায় ৷ জয়ের আশা নেই ৷
 
   ‘পূরবী’ সিনেমার মোড় পেরিয়েই মিত্র ইনস্টিটিউশন ৷ হলুদ প্যান্ট আর সাদা শার্টের ইউনিফর্ম পরা ছেলেরা স্কুলে ঢুকছে ৷ আরেকটু এগিয়ে মধ্য কলকাতা বালিকা বিদ্যালয়৷ সেখানেও ইউনিফর্ম আছে ৷ যতদূর মনে পড়ে, সবুজ আর সাদা ৷ আমাদের নেই ৷
 
   ধৃতরাষ্ট্র বিজয়ের আশা কেন ছেড়ে দিয়েছেন? নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয় ৷ যখন শুনলাম, অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে মহাবীর অজেয় ভীষ্মকে যুদ্ধে বধ করেছে, সঞ্জয়, তখন আমি আর জয়ের অশা করিনি ৷ পার্থেন আহবেষু অপ্রধৃষ্যম৷ অপ্রধৃষ্যম মানে অজেয়, অপরাজেয় ৷ ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপের মধ্য দিয়ে মহাভারতের ঘটনাবলি, কৌরবপক্ষের অনিবার্য পরাজয়ের চিহ্নগুলি আমরা জেনে নিতে পারি ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুরু-পাণ্ডব আছে? আমি দেব৷ পড়ে নিয়ো ৷ যদাশ্রৌষং জাতুষাদ্বেশ্মনস্তান্ মুক্তান্ পার্থান্ পঞ্চ কুন্ত্যা সমেতান্/ যুক্তঞ্চৈষাং বিদুরং স্বার্থসিদ্ধৌ তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয় ৷ জতুগৃহ থেকে পাঁচ পুত্র সহ কুন্তী বেরিয়ে এসেছে৷ পুড়ে মরেনি ৷ ধৃতরাষ্ট্র যেন তাতে অখুশি ৷ যুক্তং চ এষাং বিদুর— আবার বিদুর ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে৷ পড়তে হবে৷ পড়বার মতো আনন্দ আর কোথায়? ছবির মতো ফুটে ওঠে সব ৷
 

বড়ো হয়ে শুনেছি: ‘সেই যে পাশা খেলার সভায়, দ্রৌপদী সয়েছিল তো সেই অপমান ৷ পাগল তো হয়ে যায়নি ! কেশের মুঠি ধরে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল সভায় ৷ তাকে বিবস্ত্রা করবার…৷ আচ্ছা, ঐ অন্তঃপুরে কি সভায়— কোনো কৌরব-রমণী কি এমন ছিল না, যে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারে— ‘না, আমাকে বধ করে তবে এই অপমান ঘটাতে পারবে

 
   হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হবার তিন মাস পর রেজাল্ট ৷ এই লম্বা সময়ে বইপড়া কীভাবে নেশা হয়ে যায় ৷ স্কুলে আসতাম শ্যামলস্যারের ডাকে ৷ তিনি পড়তে দেন ‘জাগরী’৷ এবং ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’৷ সত্যি বলতে কী, ‘জাগরী’ বুঝেছিলাম অল্পস্বল্প, বারদুয়েক পড়ে৷ ‘ঢোঁড়াই’ মোটে বুঝিনি ৷ কেমন যেন হাঁফ ধরত৷ সে বোঝা হল অনেক পরে ৷ এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা আমার বরাবরের ভালোলাগা হয়ে গেল৷ ভুলব না, প্রথম পড়িয়েছিলেন শ্যামলস্যার ৷
 
   বড়ো হয়ে পড়েছি শঙ্খ ঘোষের ‘অন্ধবিলাপ’৷ ‘শেষের সে রোষ ভয়ংকরী সেই কথাটা বুঝতে পারি/ কিন্তু তবু অন্ধ আমি, ব্যাসকে তো তা বলেইছিলাম/ বলেছিলাম এটাই গতি, ভবিতব্য এটাই আমার/ আমার পাপেই উশকে উঠবে হয়্তো-বা সব ক্ষেত ও খামার৷’ ধৃতরাষ্ট্র কার কাছে প্রথম পড়েছি? শ্যামলস্যার৷
 
    আরও বড়ো হয়ে শুনেছি: ‘সেই যে পাশা খেলার সভায়, দ্রৌপদী সয়েছিল তো সেই অপমান ৷ পাগল তো হয়ে যায়নি ! কেশের মুঠি ধরে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল সভায় ৷ তাকে বিবস্ত্রা করবার…৷ আচ্ছা, ঐ অন্তঃপুরে কি সভায়— কোনো কৌরব-রমণী কি এমন ছিল না, যে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারে— ‘না, আমাকে বধ করে তবে এই অপমান ঘটাতে পারবে ৷’ কেউ আসেনি তখন, কে-উ না ৷’ শাঁওলী মিত্রের ‘কথা অমৃত সমান’৷ সে এখ অম্লান মুগ্ধতা ৷ কিন্তু কে প্রথম পড়তে বলেছিলেন মহাভারত? শ্যামলস্যার ৷
 
   যেখানেই থাকুন আমার প্রণাম নেবেন হে চিরশিক্ষক!   

 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১

ধারাবাহিক: ভোর ভয়ি । পর্ব ১


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!