- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ১৬, ২০২৪
ভোর ভয়ি। পর্ব ৯: নীল আকাশের নীচে প্রেসিডেন্সি
যান্ত্রিক গোলযোগে ৯ জুন এই ধারাবাহিকটি প্রকাশ করা যায়নি। এজন্য পাঠকদের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।এবার থেকে আবার প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে ভোর ভয়ি...
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।
♦ নবম পর্ব ♦
সেদিন কীরকম ছিল অশান্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ ? এই জানতে চাওয়াটা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না৷ কমবেশি ষাট বছর আগের ঘটনা, যা ছাত্র-যুব বিদ্রোহের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে৷ আমি নিজে ওই কলেজের পড়ুয়া ছিলাম না, এবং অন্য কলেজের ছাত্র হিসেবে সামান্য সংযোগ ছিল সেই আন্দোলনে৷ কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি অনেকটাই আবছা৷ তাই দুটো লেখার সহায়তা নিয়ে সেই সময়টা আরেকবার জানবার চেষ্টা করব৷ একটি লেখা দীপাঞ্জন রায়চৌধুরীর, অন্যটি সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায়ের৷ এঁরা দুজনই প্রেসিডেন্সির সেই স্পন্দিত পর্বের যোদ্ধা৷
দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী লিখছেন, ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের ভেতর ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত সংগঠন গড়ার ও কাজ করার অধিকার ছিল না৷ সম্ভবত এক সেন্ট জেভিয়ার্স ছাড়া অন্যান্য কলেজে অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না৷ ১৯৬৬-র প্রেসিডেন্সির আন্দোলনকে পশ্চিমবাংলার ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের পছন্দমতো রাজনৈতিক মত পোষণ ও সেই মতো সংগঠন তৈরি করার অধিকার প্রসঙ্গে রক্ষণশীলদের শেষ ও সবচেয়ে শক্ত দুর্গ দখলের লড়াই বলা চলে৷ এই আন্দোলনের পর কোনো কলেজে কোনো কর্তৃপক্ষ এই অধিকারে হাত দিতে সাহস করেনি৷
একটা সংগঠন অবশ্য ছিল৷ পিসিএসও৷ প্রেসিডেন্সি কলেজ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন৷ বাইরে অরাজনৈতিক পোশাক থাকলেও খোলাখুলি পশ্চিমি মতাদর্শের পক্ষে প্রচার করত৷ পি সি এস ও-কে উৎসাহ দিতেন কমিউনিস্ট-বিরোধী বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী৷ তাঁদের কারও কারও সঙ্গে সন্দেহজনক ধরনের বিদেশি যোগাযোগও ছিল৷
১৯৬৫-৬৬র বহুস্তরীয় সংকট বাংলাকে তোলপাড় করে৷ চারদিকে ছাঁটাইয়ের খবর, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফসলের উৎপাদন কম, তার ওপর মজুতদারি ও কালোবাজারি, চালের দাম লাগামছাড়া, রেশনেও চাল-গমের আকাল, কেরোসিন নেই, চাকরির বাজারে মন্দা, ট্রামভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আন্দোলন৷ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগরে ছাত্ররা যখন কেরোসিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল, পুলিশের গুলিতে মারা যায় স্কুলছাত্র নুরুল ইসলাম৷ তার প্রতিবাদ আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে হাবড়া, বাদুড়িয়া, কৃষ্ণনগর, ব্যারাকপুর, রানাঘাট, চাকদহ, আসানসোল, ধুবুলিয়া, বহরমপুর সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রান্তে প্রান্তে৷ স্কুল-কলেজে ধর্মঘট থেকে শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে৷ প্রায় একমাস ধরে চলে গণবিক্ষোভ (১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ)৷ প্রথম পাঁচদিনে মারা যায় ৪০ জন, আহত কয়েক হাজার৷
এই মার্চ মাসেই ওয়েস্টবেঙ্গল বোর্ডের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হয়৷ আমিও ছিলাম পরীক্ষার্থী৷ ফল বেরয় সম্ভবত মে মাসের শেষের দিকে৷ জুনে ভরতি হই বঙ্গবাসীতে৷
দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী লিখছেন, ‘দেশজুড়ে মানুষের উত্তাল আন্দোলনের এই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল প্রেসিডেন্সি কলেজে৷ কিছু সাহসী ছাত্রছাত্রী এগিয়ে এল কলেজের এস এফ-কে (স্টুডেন্ট ফেডারেশন) একটা সংগঠিত রূপ দিতে, ইউনিট তৈরি করতে, এদের পুরোভাগে ছিল অসীম চট্টোপাধ্যায়৷ কলেজে তখন সে পরিচিত ‘কাকা’ নামে৷ নানা অসুবিধা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল আন্দোলন৷ ১৯৬৬-র ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সংগঠিত এস এফ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল৷ টনক নড়ল শিক্ষাবিভাগের৷ আমলা ও বশংবদ বুদ্ধিজীবী তৈরির কেন্দ্রে এ কী উপদ্রব? আটজন সক্রিয় ছাত্র-সংগঠককে কর্তারা বহিষ্কার করলেন, কাকা ও আরো দু-জনকে কলেজের স্নাতকোত্তর বিভাগে ভরতি করতে করলেন অস্বীকার৷ প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করল৷ ধর্মঘট খুব সফল হয়৷ মাসের পর মাস কলেজ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এস এফ-এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে৷’
সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায় এই সময়ের ছবিটি বিশদে তুলে ধরেছেন সাল-তারিখ সহ৷ তিনি বলছেন, ‘ষাটের দশকে যে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী চেতনার আত্মপ্রকাশ ঘটে তার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দৃশ্যতই প্রবল নাড়া দিয়েছিল৷ একটি কলেজের আন্দোলনকে এত দ্রুত সামগ্রিকভাবে ছাত্রসমাজের আন্দোলন হয়ে উঠতে তার সমসাময়িক কালে বা তার পরের দু-দশকে দেখা যায়নি৷ কোনো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও শিক্ষক, অভিভাবক, সংবাদপত্র, শিক্ষা কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এমনকি কিছু শ্রমিক সংগঠনের এত সোচ্চার প্রতিক্রিয়াও (অনুকূল ও প্রতিকূল দু-রকমই) একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা৷’
তাঁর লেখায় এই আন্দোলনের যে কালপর্ব পাই, তা কিছু বেশি পাঁচ মাসের৷ ৩০ আগস্ট ১৯৬৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭৷ ৩০ আগস্ট হিন্দু হস্টেলের প্রায় আড়াইশো আবাসিক হস্টেলের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. হরপ্রসাদ মিত্রের (প্রেসিডেন্সির বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান) পদত্যাগ ও অন্যান্য দাবিতে অনশন ও অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে৷ ড. মিত্রকে হস্টেলের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি৷ ১-২ সেপ্টেম্বর আবাসিক ছাত্রদের দাবির সমর্থনে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র ধর্মঘট হয়৷ একই কারণে মৌলানা আজাদ কলেজে ও গোয়েঙ্কায় ধর্মঘট৷ হরপ্রসাদ মিত্রের বিরুদ্ধে স্লোগান চলতে থাকে৷ পোস্টারে ছেয়ে যায় দেওয়াল৷ তাঁর কুশপুতুল পোড়ানো হয়৷ হরপ্রসাদ মিত্র পদত্যাগ করেন৷ ৩০ সেপ্টেম্বর, প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক শ্রেণির সাতজন ছাত্রকে (রণবীর সমাদ্দার, অমল সান্যাল, প্রণব মুখার্জি, সব্যসাচী চক্রবর্তী ও আরও দু-জন এবং মৌলানা আজাদ কলেজের একজনকে) অসদাচরণের অভিযোগে একই সঙ্গে হস্টেল ও কলেজ থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়৷ হস্টেলের আবাসিক নন এমন দু-জন অসীম চ্যাটার্জি ও সুদর্শন রায়চৌধুরীকে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভরতি না-করার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ ৪ অক্টোবর ঘেরাও হন কলেজেরে অধ্যক্ষ ড. সনৎ বসু৷ পরদিন, নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করে পুজোর ছুটি ঘোষণা করা হয়৷ বহিষ্কার প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতর অবস্থানের ফলে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ পর্যন্ত কলেজ সম্পূর্ণ অচল থাকে৷ এই সময়কালে যা ঘটেছিল তার অবশ্য উল্লেখ্য কয়েকটি: বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে সমর্থন জানাতে আসে প্রেসিডেন্সিতে৷ আসে অন্যান্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠন৷ এসেছিলেন ট্রাম শ্রমিকদের প্রতিনিধিরাও৷ গোটা শীতকাল খোলা আকাশের নীচে দিনরাত গেটে ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান৷ পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ৷ অধ্যক্ষ সনৎ বসু ঘেরাও হন গেটে৷ লাঠি ও টিয়ার গ্যাস চার্জ করে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে৷ ১০ ডিসেম্বর কলেজের রসায়ন বিভাগের গবেষণাগারে কে বা কারা তালা ভেঙে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়৷ অবশেষে, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে এক চুক্তির পথ ধরে প্রেসিডেন্সি খোলে ও ক্লাস শুরু হয়৷
মনে পড়ে, বঙ্গবাসী কলেজের কয়েকজন ছাত্র বামপন্থী ছাত্রনেতা অচিন্ত্য গুপ্তের সঙ্গে প্রেসিডেন্সির এই আন্দোলনে যোগ দিতে এসেছিল৷ কয়েক দফায়৷ সেই ছাত্রদলে আমিও ছিলাম বার দুয়েক৷ তখন ফার্স্ট ইয়ার৷ আমার বিভাগের কেউ ছিল না সেই দলে৷ একটা কারণ, দূরের স্টেশনে যাদের বাড়ি তারা ফিরতে সমস্যা হবে৷ দুই, ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত নয় বলে কিংবা বাড়িতে বকুনি খেতে হবে বলে কেউ কেউ এড়িয়ে গেছে৷
সদ্য কলেজে-আসা ছাত্রদের এই লড়াই ছিল আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিশান তোলা চরম প্রতিক্রিয়ার প্রবল দুর্গরক্ষকদের বিরুদ্ধে লড়াই, যেখানে রাষ্ট্রশক্তি স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছে৷ সেই লড়াইয়ের অন্তর্গত প্রাণশক্তি ও তাৎপর্য আজ এই পচে-যাওয়া পোকা-খাওয়া সময়ে যথার্থে বুঝতে পারা হয়তো সম্ভব নয়৷ অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্সের নামে, শৃঙ্খলার নামে কলেজ কর্তৃপক্ষের নরম-দৌরাত্ম্য চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে ছাত্ররা এক কঠিনযুদ্ধে সামিল হয়েছিল৷ শাসানি ছিল, ষড়যন্ত্র ছিল, পিসিএসও-র মাধ্যমে গুন্ডা আমদানির ব্লু-প্রিন্ট ছিল, পড়ুয়াদের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার বিপন্ন হবার আশঙ্কা ছিল৷ অভিজাত ও উন্নাসিক পড়ুয়াদের একটি অংশ এসব ‘বিশৃঙ্খলা’র বিরোধিতা করেছে৷ একটি বাম রাজনৈতিক দলের দ্বিচারিতার মোকাবিলাও করতে হয়েছে ছাত্রনেতাদের৷ তবু আন্দোলন পিছু হটেনি৷ প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা সংকীর্ণ স্নবারি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবাসী, সুরেন্দ্রনাথ, সিটি কলেজের তথাকথিত সাধারণ ছাত্র এবং ভবানী দত্ত লেন আর বেলঘরিয়ার সর্বস্তরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পেরেছে এই আন্দোলনের প্রভাবে৷ নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের (২৪ মে ১৯৬৭) পর প্রেসিডেন্সির লন যে আর প্রেসিডেন্সির একার থাকেনি, তার ভূমিকাপর্ব ছিল এই আন্দোলন৷
আমি পালিয়েছিলাম ওই স্নবারির চেহারা দেখেই৷
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৮
❤ Support Us