- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৫

১৩
কক্ষের পর কক্ষ । কত যে কক্ষ পার হয়ে এলাম ! গণনা শুরু করেছিলাম বটে, অকস্মাৎ দাপাদাপি-ঝাঁপাঝাঁপিতে কখন যে গুলিয়ে গেল ! মনে পড়ে ঊনচত্বারিংশ তম কক্ষ পর্যন্ত গণনা করেছিলাম–
ঊনচত্বারিংশ ? অ্যাঁ, তারমানে তো ঊনচল্লিশ ! কথায় কথায় সংস্কৃতের এত টানটোন আসছে কেন ?
শ্রীশ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ এক্ষণে তর্জমা করে যে, এগূণ-চত্তালীস, একোনচত্বারিংশৎ সংখ্যক। আর ‘ঊন’ তো কতই শুনেছি ! “ কার্তিকের ঊন জলে । খনা বলে দুন ফলে ।। “ কিংবা, “ ঊন ভাতে দুন বল। ভরা ভাতে রসাতল।।”
অর্থাৎ, কার্তিক মাসের অল্প জলেও দ্বিগুণ ফসল ফলে। কিঞ্চিৎ অল্প আহারেও শরীরে দ্বিগুণ বলবৃদ্ধি হয়।
ধু-উ-র ! কীসব ভাবছি ! যাকে মশানির দহের ‘অর্গলা ভূত’-এর ঝিঁজরি বাধাছাঁদা করে নিয়ে এসেছে, যে কিনা বলিপ্রদত্ত -তার এসময়ে এসব ব্যাসকূট- শ্লোককূট, ইত্যাদি কূটকচালি নিয়ে ভাবনাচিন্তা কি আর মানায় ?
মানায় না, মানায় না ।
মনে তো হয়, এসব কক্ষে শিক্ষার্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণই একদা বসবাস করতেন। ঝিঁজরির অদম্য টানে কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে যাবার পথে নাবালকের মতো দেয়ালগাত্রে হাত থাবড়াচ্ছি, কী যেন ঝুর্ ঝুর্ করে ঝরে পড়ছে হাতের থাবড়ায়।
‘স্ট্যাকো’-র গুঁড়ো কি ? পড়েছি বটে সংঘারাম, কী বৌদ্ধবিহার, মহাবিহার-এর বহির্দেয়াল ‘স্ট্যাকো’-র প্রলেপ দেওয়া। যেমনটা নালন্দা মহাবিহারে এখনও দেখা যায়।
একটু ছাড়া ছাড়াই দেয়ালে কুলুঙ্গি। একটা তো নয়, অজস্র। আমাদের ঘরের মাটির দেয়ালে একটাই কুলুঙ্গি আছে বটে। মা প্রত্যহ সন্ধ্যায় সেখানে প্রদীপ জ্বেলে গলায় শাড়ির আঁচলা জড়িয়ে কাকে যেন নমঃ করে।
‘স্ট্যাকো’ তারমানে চুনের পলেস্তরা । চুন বা অন্য কোনো যৌগ। যা দিয়ে মূর্তি গড়া হত । মূর্তির গায়ে দেয়ালে দেয়ালে নানারকম কারুকার্য করা হত । কুলুঙ্গিতে কুলুঙ্গিতে বসানো হত মূর্তি।
ছায়াচ্ছন্ন ঈষৎ অন্ধকারময় ফেলে আসা কক্ষের কুলুঙ্গিগুলোতে কোনও মূর্তি ছিল কীনা – এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি । এবার সতর্ক হলাম – দেখিই না, কোনও বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর কিংবা গৌতমবুদ্ধের মূর্তি দেখতে পাই কিনা । কোথাও খোদিত আছে কী না – “ ওঁ মণি পদ্মে হুঁ ” –
তিব্বতিরা নাকি এখনও এই মন্ত্র জপ করবার জন্য পথেঘাটে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে একপ্রকার ‘কল’ বা প্রার্থনা-চক্র বসিয়েছেন। কল ঘুরোলেই ওই জপমন্ত্র “ ওঁ মণি পদ্মে হুঁ ” ঘুরতে থাকবে। ঘুরতে থাকবে। আর, যতবার ঘুরবে, যত বেশিবার ঘুরবে, তত বেশি পুণ্য।
একবার হয়েছিল কি, এই নিয়ে তো মহাধুন্ধুমার কাণ্ড ! জনৈক লামা প্রার্থনা-যন্ত্র ঘুরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গৃহে ফিরছিল। যন্ত্রের ঘুর্ণন তখনও অব্যাহত। হঠাৎ আরেকজন লামা তৎক্ষণাৎ এসে চাকা ঘুরিয়ে দিল তার দিকে।
পূর্বতন লামা ফের অকুস্থলে হাজির হয়ে বর্তমান লামার চাকাকে বন্ধ করে নিজের স্বপক্ষে চক্রযান ঘুরিয়ে নিল। গালাগালি থেকে মারামারির উপক্রম হল।
এ বলে, ‘ আমি প্রথম ঘুরিয়েছি। তুমি আমার চাকায় ঘূর্ণন শেষ হওয়ার আগেই কেন হাত দিয়েছ ?’ ও বলে, ‘ আমার ঘুরন্ত চাকা তুমি এসে কোন্ সাহসে বন্ধ করেছ ?’
অবশেষে এক বৃদ্ধ লামা এসে পুণ্যার্থীদের কলহের অবসান ঘটাল। পুণ্যার্থীদের হয়ে স্বহস্তে চাকা ঘুরিয়ে যার যত সংখ্যক পুণ্য তাকে তা পাইয়ে দেয়। পুণ্য অর্জন করে পুণ্যেচ্ছুক ব্যক্তিদ্বয় নিশ্চিন্তে যে যার গৃহে গমন করে।
সেই ‘ ওঁ মণি পদ্মে হুঁ ’ প্রার্থনা মন্ত্রটি কোনও দেয়ালগাত্রে কী কুলুঙ্গিতে খোদিত আছে কী না – খুঁজে চলেছি, খুঁজেই চলেছি ।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা মূর্তি, কুলুঙ্গিতে যেন ধরছে না ! তলায় একটা টেরা-কোটার প্রদীপ। মায়ের মাটির প্রদীপের থেকেও বৃহৎ, সুবৃহৎ।
হাতে ‘স্ট্যাকো’-র রঙ লেগেছিল দেয়ালগাত্রে হাত বুলিয়ে। রঙ আর কী, চুন বা কুইক লাইমের সঙ্গে জিপসাম অর্থাৎ বালি মিশিয়ে তার প্রলেপ। গেঁড়ি-গুগলি-শামুক আর ঝিনুক পুড়িয়ে ‘কলিচুন’ তো চুনাভাটিতে চুনাবুড়িরা এখনও করে।
মূর্তির গায়ে হাত বোলালাম। একবার, দুবার, তিন-তিনবার। তেমন কোনও রঙ বা যৌগ হাতের তালুতে উঠে এল না। তবে কী মূর্তিটি প্রস্তর নির্মিত? পাথর দিয়ে গড়া ?
ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয়রা তো লোকভোলানো তন্ত্রমন্ত্রে, ‘ব্ল্যাক-ম্যাজিক’-এ সবিশেষ পটু ! শীঘ্রই তাঁরা ধ্যানীবুদ্ধকে যোগাসনারূঢ় মহাদেব বানিয়ে ফেললেন। শুধু কি মহাদেব, একে একে আসতে লাগল শক্তি, উমা, জয়া, চণ্ডী মহাকালী খড়্গহস্তা কপালিনী, কপালমালা অজিতা, অপরিজিতা মার্তৃকা, খট্টাঙ্গা বজ্রহস্তা মহারূপা
হবেও বা। বইয়েই পড়েছি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার বা সংঘারামগুলোয় স্থানীয় পোড়ামাটির ভাস্কর্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল আমদানি করা মুগনি আর শিস্ট্ পাথরের মূর্তি। কুবের, জাঙ্গুলী, মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বর আর বোধিসত্ত্বের মূর্তি। নানাবিধ নক্সা করা ইট !
কিয়ৎক্ষণ পরে আলো-আঁধারি যৎসামান্য দূরীভূত হলে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম– মূর্তিটি মস্তকবিহীন ! তার মাথা নেই !
মাথা নেই, মাথা নেই ।
অতঃপর সারিবদ্ধ একাধিক কুলুঙ্গিতে মস্তকবিহীন মূর্তিই দেখা গেল। শুধু কি মস্তক, কারোর হাত ভেঙেছে কারোর বা পা । কাটা গেছে কান, ভাঙা পড়েছে নাক ।
একের পর এক যত সব ভাঙাচোরা মূর্তি। বিশেষ করে মাথা-ভাঙা, মাথা-মুণ্ডুহীন। কতক পদ্মাসনা, পদ্মোপবিষ্ট। কতক দণ্ডায়মান, দণ্ডায়মানা ।
এমন একটা দেখেছি বটে ইতিহাসের পাতায়। কী যেন নাম, কী যেন –
হ্যাঁ, কনিষ্ক। গলাকাটা সম্রাট ।পরনে গলা থেকে পা পর্যন্ত আলখাল্লা । পায়ে ভারি গামবুট। কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে কৃপাণ –
যাহোক, আর কোনও সন্দেহ নেই পোড়োগৃহটি বৌদ্ধবিহার বা সংঘারামই হবে। মূর্তিগুলি গৌতমবুদ্ধ, অবলোকিতেশ্বর, বোধিসত্ত্বেরই বটে । মুণ্ডুহীন কিছু মূর্তি তো মনে হয় লক্ষ্মী, গণেশেরও।
কোনও কোনও কুলুঙ্গিতে মূর্তি নেই, কেবল প্রস্তরফলক। ত্রিরত্ন, ধর্মচক্র, হস্তী, ব্যাঘ্র, নাগমূর্তি, মকরমূর্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। চুন, চুনাপাথর, মার্বেল পাথর, হাড়ের গুঁড়ো আর অসাধারণ এক ‘চিট’-এর মিশেলে সব তৈরি !
প্রায় সবই তো কবন্ধ, মস্তকবিহীন। ভাঙা । হন্তারক কালাপাহাড়ের মতো কেউ যেন তরবারির প্রকোপে ছেদ করেছে অগণিত মুণ্ড। কথা বলতে চায়, হায় ! মুখ নেই তার কথা বলবে কী ?
‘বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী
স্তম্ভিত হয়ে রও –
ভাষা দাও তারে, হে মৌন অতীত,
কথা কও, কথা কও ।’
একদা বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, বিদ্যাধর, কিন্নর-কিন্নরী, কুবের, বরুণ, মঞ্জুশ্রী, গন্ধর্বের মস্তকবিহীন ভাঙাচোরা মূর্তি দেখে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র খেদ প্রকাশ করে বলেছেন – ‘পুতুলগুলোও আধুনিক হিন্দুর মতো অঙ্গহীন হইয়া আছে ।’
বটেই তো !
‘বসিত রাজেন্দ্র যথা স্বর্ণসিংহাসনে,
ফুকারে শৃগাল তথা বিকট নিঃস্বনে ।
লুপ্ত গৌড়, সমতট, কর্মান্তের চিহ্ন,
কোথা হরিকেল কোথা কর্ণসুবর্ণ !
পথে পথে রাজধানী – ফুলের বাগান,
এ তো নহে বঙ্গ – এ যে বঙ্গের শ্মশান ।’
একথা তো সত্যি, সত্যিই। হাজার মুখে বলতেই হয়, ভারতবর্ষের ইতিহাস যা, তা বৌদ্ধযুগেরই ইতিহাস । সংস্কৃতি যেটুকু, তা বৌদ্ধযুগেরই সংস্কৃতি। মাটি খুঁড়লেই হিন্দুস্তরের দুহাত নীচেই বৌদ্ধস্তর–
গাঁইতি-শাবলের ঠোকাঠুকিতে কী বেরিয়ে আসবে, বেরিয়ে আসছে -হয় বৌদ্ধ সংঘারাম নয় বৌদ্ধ মহাবিহারের ভগ্নস্তূপ । ‘স্ট্যাকো’-র কাজ করা গৃহপ্রাঙ্গন, কারুকার্যময় ইটে তৈরি কুলুঙ্গির পর কুলুঙ্গি –
আর পুতুলগুলো । লোকেশ্বর, অবলোকিতেশ্বর, বোধিসত্ত্ব, বুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ, মানুষীবুদ্ধ … কুবের, বরুণ, শিব, সূর্য, গন্ধর্ব … জাঙ্গুলী, মঞ্জুশ্রী, সিদ্ধাচার্য তিলোপা, সিদ্ধাচার্য নাড়োপা–
পুতুল, পুতুল ।
প্রথম প্রথম, বিশেষ করে অশোকের আমলে এবং তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তারিত হয়েছিল স্তূপপূজা । ফলতঃ সারনাথ, সাঁচিস্তূপ । কিন্তু স্বয়ং বুদ্ধও চাইতেন না তাঁর মূর্তিপূজা হোক । তবুও এত পুতুল এল কী করে ?
বুদ্ধের তিরোধানের প্রায় চারশো বছর পরে সম্রাট কনিষ্কের আমলেই মূর্তি পূজার প্রচলন হয়। তাঁর রাজত্বেই বৌদ্ধসম্প্রদায়ও ‘মহাযান’ ও ‘হীনযান’-এ বিভক্ত হন। মহাযানীরাই গান্ধার শিল্পের অনুকরণে বুদ্ধের মূর্তি গড়া শুরু করেন । অবশ্য হীনযানীরা প্রথম প্রথম মূর্তি গড়া পরিহার করতেন ।
মূর্তি গড়তে গড়তে ‘আদিবুদ্ধ’ প্রথমে তিনভাগ, ‘ধ্যানীবুদ্ধ’ ‘বোধিসত্ত্ব’ আর ‘মানুষী বুদ্ধ’, তারপর তাঁরা নিজেরাই আবারও পাঁচভাগ–
বুদ্ধ ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছেন। বেড়ে চলেছেন, বেড়েই চলেছেন। ওদিকে তখনও স্বমহিমায় বিরাজিত ‘ব্রাহ্মণ্য ধর্ম’ ভারতবর্ষে তাহলে কী করছিল? অপরাপর যুক্ত শৈবরা, শাক্ত আর তান্ত্রিকেরা ?
বৌদ্ধ ধর্মের বাড়বৃদ্ধি যখন এতটাই, তখন তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল কী করে ? কী ভাবে ? ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে ? আরবদের আক্রমণে ?
মূর্তিগুলোর শিরশ্ছেদ হল। তাদের হাড়গোড় ভেঙে পড়ল। সব খণ্ডিত মস্তকের স্তূপ, সংঘারাম, বিহার, মহাবিহারের ভগ্নস্তূপ রসাতলে চলে গেল।
উঁহু, কতকটা উপরোক্ত কারণেও বটে, কতকটা স্বখাত সলিলে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে ক্রমশ মিশতে গিয়ে, মতের আদান প্রদান করতে করতে, একসময় লীন হয়ে গিয়েছে উভয়ত ।
আর, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয়রা তো লোকভোলানো তন্ত্রমন্ত্রে, ‘ব্ল্যাক-ম্যাজিক’-এ সবিশেষ পটু ! শীঘ্রই তাঁরা ধ্যানীবুদ্ধকে যোগাসনারূঢ় মহাদেব বানিয়ে ফেললেন। শুধু কি মহাদেব, একে একে আসতে লাগল শক্তি, উমা, জয়া, চণ্ডী মহাকালী খড়্গহস্তা কপালিনী, কপালমালা অজিতা, অপরিজিতা মার্তৃকা, খট্টাঙ্গা বজ্রহস্তা মহারূপা –
তদুপরি ডাকিনী, যোগিনী, পিশাচী, যক্ষিনী, ভৈরবী। তাদের সাধনার জন্য লেখা হল ‘সাধনমালা’, তাতে সাধনমন্ত্র, ‘বজ্রযোগিনী’ ‘কুরুকুল্লা’ ‘বজ্র- বারাহী’ ‘মহামায়ূরী’ ‘মহাপ্রতিসরা’ ইত্যাদি ইত্যাদি ডাকিনী-যোগিনীর ধ্যান-মন্ত্র ।
রীতিমতো মূর্তি গড়ে ‘গুহ্যপূজা’-ও শুরু হল। ততদিনে কী হীনযান, কী মহাযান- উভয়ে মিলে সহজযান, সহজিয়া। ভিতরে ভিতরে লণ্ডভণ্ড হতে লাগল।
এ যেন ‘পরশুরাম’ বিরচিত ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’-র আড়াধাড়া। “ পেনেটির আড়পাড় কোন্নগর। সেখান হইতে উত্তরমুখ হইয়া ক্রমে রিশড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটীর হাট, চাঁপদানির চটকল ছাড়াইয়া আরও দু-তিন ক্রোশ দূরে –”
সেখানে পানতুয়ার শাঁসের মতো ডাকিনীকে দেখে শিবু ওরফে পেনেটির শিবু ভট্টাচার্য যেই একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া গান ধরিল –
‘আহা, শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী
কারে রেখে কারে ফেলি ।’
সহসা প্রান্তর প্রকম্পিত করিয়া নিকটবর্তী তালগাছের মাথা হইতে তীব্র কন্ঠে শব্দ উঠিল ।
‘চা রা রা রা রা রা
আর ভজুয়াকে বহিনিয়া ভগলুকে বিটিয়া
কেকরাসে সাদিয়া হো কেকরাসে হো-ও-ও-ও-’
এই পোড়ো সংঘারাম অথবা বৌদ্ধবিহার অদ্য মধ্যাহ্নেই যেন সে ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’-র আকার-প্রকার ধারণ করেছে !!
১৪
‘ভুশণ্ডীর মাঠে’-র সঙ্গে কোনও গতিকে তুলনা টানলেও এখানকার রকমসকম একটু আলাদা প্রকৃতির ।
আসশ্যাওড়া, ঘেঁটু, বুনোওল বাবলার গাছপালা থাকলেও এখানকার মানুষজন, কী শরীরী কী অশরীরী, কেউই এ পর্যন্ত দৃশ্যমান নয় । সবাই ‘ইনভিজিবল্’ ।
মাঠটি বহুদূর বিস্তৃত, জনমানবশূন্য হলেও তবু তো পিটুলিবিলের ধারে শ্যাওড়াগাছের পেত্নী পোলো-হাতে মাছ ধরতে যায় । শাঁকচুন্নী একটা গামছা পরে আরেকটা গামছা মাথায় দিয়ে এলো চুলে বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাতের হাঁড়ি থেকে গোবর-গোলা-জল ছড়ায় ।
ক্ষীরি-বামনীর পরিত্যক্ত ভিটায় ডাকিনী খেজুরের ডাল দিয়ে রোয়াক ঝাঁট দেয় । কারিয়া পিরেতকে ডাকলেই তালগাছের মাথা থেকে সড়াক করে নেমে এসে বলে, ‘গোড় লাগি বরমদেওজি ।’
তদুপরি হিজলিতে নেমকের গোমস্তা কালিদাসের ভায়রাভাই ৺নদের চাঁদ মল্লিক ওরফে নাদু মল্লিকের কন্ঠে পেট বাজিয়ে চৌতাল শোনা যায় – ছ মাত্রা, চার তাল, দুই ফাঁক –
এখানে, এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে তো লোকজন একটাও দেখি না ! অথচ আস্ত না হোক ভাঙাচোরা একটা বাড়ি । “চি-চি-ঙ্ ফাঁ-ক”-এর মতো একটা দরজা, অবারিতও বটে ।
কক্ষের পর কক্ষ । গবাক্ষ ও কুলুঙ্গি । পারাবত কুহরে, চর্মচটকা-বাদুড়ার মাঝেমধ্যে ঝটপটানিও আছে । রৌদ্র উঠেছে, গাছের পাতায় হি লি হি লি গি লি গি লি করে সে-রৌদ্র ছলবলাচ্ছে । হেসে খেলে বেড়াচ্ছে ।
পুষ্করিণীর জলে মধ্যাহ্নে সূর্যসহ রৌদ্রেরও ছায়া পড়েছে । আকাশে চক্রাকারে উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে চিল । “ভু-ই-চু-ঙ” আওয়াজ করে একটা পাখি তো এইমাত্র কোত্থেকে উড়ে এসে পুষ্করিণীর জল ছুঁয়ে আবার উড়ে গেল কোথায় ! ডাক শুনে বোধ হল – ‘ঢ্যাপচু’ ।
তারমানে ফিঙে পাখি । ফিঙেই ।
পোড়োবাড়িটার অন্দরে, অকুস্থলে, দেয়ালগাত্রে, কুলুঙ্গিতে এইসব মুণ্ডুহীন মূর্তি, তথাকথিত ‘পুতুলগুলো’ – “কথা কও কথা কও” বলে হাজার চেঁচালেও তারা বুঝি আর কখনও কথা বলবে না ! কোনও কালে বলেওনি ।
এসব কতযুগ আগের ! গত জন্মের । হয়তো বৌদ্ধদের, বৌদ্ধ শিল্পীদের দ্বারাই নির্মিত । এখন হাড়-গোড়-ভাঙা ‘দ’ হয়ে পড়ে আছে । মরা, মৃতই ।
এতকিছু দেখে ইতিহাস-পুরুষেরা এইমর্মে সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা সব বৌদ্ধ ছিলেন । কমবেশি তামাম বাঙলাই ছিল বৌদ্ধদের চারণক্ষেত্র ।
সে যাহোক, পোড়োবাড়িটা তথা বৌদ্ধসংঘারাম বা বৌদ্ধবিহারের ভিতরটা যখন মরা মরা, তখন বাহিরে গনগনে আঁচের মতোই জীবন ! ওই, ওই তো পুষ্করিণী-জলে বিলি কাটছে মৃদুমন্দ হাওয়া –
গুচ্ছ গুচ্ছ ছেয়ে আছে শুশনির দঙ্গল, ছেয়ে তো নয় যেন জলাশয়ের ধারে ধারে ভেসে বেড়াচ্ছে । তেমন আর বিলম্ব কই? হয়তো আমাদেরই গ্রাম থেকে এক্ষুনি চলে আসবে সোমবারি-কাঁদরিরা । ‘টুপা’ ভরে তুলে নিয়ে যাবে শুশনিশাক ।
যেতে যেতে শাক তোলা নিয়ে হয়তো দুকলি গানও শুনিয়ে যাবে তারা –
– “শাক তুললম লতা লতা মাছ রাঁধলম গেঁতা লো । বিটি ছাইলার দূরে বেহা কাঁদিছে অন্তর লো । । “
গাঁতি-জাল ফাবড়ি-জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমে পড়বে বিপিন আর সুরেশ বিশুইয়ের দল । জল ঘোলা করে ছাড়বে বেলা আড় অব্দি । মাছও উঠবে তেমন -রুই, মিরগেল, কালবোউশ, বাটা, খয়রা –
ফের জলে কে যেন ঝপাং করে ঝাঁপ দিল -দেখিই তো দেখি ! ঝোরকার দিকে তড়িদ্বেগে দৌড়ে ঝুঁকে পড়েছিলাম, ‘অর্গলা ভূত’-এর ঝিঁজরি হ্যাঁচকা টান মারল । তবু এরমধ্যেই জলে যেন এবার বুজকুড়ি কাটতেও দেখে ফেললাম ।
কিন্তু সে কই ? সে, সে-ই -জলে যে ঝপাং করে ‘ডাইভ্’ মারল ! সে কি এই পোড়োবাড়িটার উঁচু ছাদ থেকেই লাফ দিল? জলাশয়ের জল তো মনে হয় পোড়া- বাড়িটার তল ছুঁয়েই আছে ।
এতক্ষণ পরে আমার রাগ হল । রাগ বলতে রাগ, ভয়ানক রাগ -সেই কখন রাতে খেয়েছি ! আমাদের নিজের ঘর হলে খিদের জ্বালায় এতক্ষণে মাকে কত যে জ্বালাতন করতাম ! “খেতে দাও মা, খেতে দাও !”
চিৎকার-চেঁচামেচিতে ফের কতক বাদুড়া-চর্মচটকার ওড়াউড়ি শুরু হল । পারাবতগুলোর ভদভদানি, কতক ডানা ফেটিয়ে বাইরে বেরিয়েও গেল । কিন্তু আমার কথায় শরীরী অশরীরী কেউই যেন কর্ণপাত করল না ! যথা পূর্বং তথা পরং, ঝিঁজরি ঝিঁজরির মতোই চলতে লাগল
মা বলত, “ দাঁড়া বাছা , এই তো সবে তরকারিটা বসিয়েছি ! “ বলেই বাঁশের ফুঁক-নলিতে উনুনে ফুঁ দিত মা । ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চোখ তার লাল হয়ে উঠত ।
জিজ্ঞাসা করতাম, “ কী তরকারি মা ? কী তরকারি ?” উত্তরে মা হয়তো বলল, কুড়কুড়িয়া ছাতু কিংবা বাঁশকরোল । আহা, ডুমো ডুমো ডুমুরের মতো এক ধরনের ছত্রাক । ব্যাঙের ছাতা । বালিতে কুড়্ কুড়্ করে ফোটে বলেই ‘কুড়কুড়িয়া’ । কাঁচায় ভেঙে নখে টিপে তার কালো না নাহোক সাদা শাঁসটুকুই কত খেয়েছি !
আর ‘বাঁশকরোল’ -মাংসের মসল্লা দিয়ে যদি রাঁধো, খেতে একেবারে খাসির মাংস ! বাঁশকরোল, তারমানে নতুন বাঁশের কলি । বাঁশের পোঙ বা চারা । তাই খেতে দলমার হাতি পর্যন্ত আসে লাইন দিয়ে ! গুরাসাঁওতালের ‘ঘুসুর’ বা শূওর তো গজামুখে ঘোঁত্ ঘোঁত্ আওয়াজ করে ভেঙে তসরপাত্ করে দেয় !
যাহোক লোভে পড়ে বলতাম, “ বেশ মা, বেশ । তাহলে তো একবার নয়, দুবার খাব । ভাত চাট্টি বেশিই খাব মা । কিন্তু যাহোক-তাহোক দিয়ে এখন কিছু তো দাও মা !”
কপট রাগ দেখিয়ে মা হয়তো বলল, “হা-ঘরে ছেলে কোথাকার ! যা, ‘বাড়ি’ থেকে কটা ঝিঙা তুলে আন জলদি !” তন্মুহূর্তেই দৌড়ে গিয়ে ‘বাড়ি’ অর্থাৎ ঘরের পিছনের বাগান থেকে ছিঁড়ে আনলাম একটি-কি-দুটি ঝিঙা ।
তারপর তো ঝিঙাঝোল আর ভাত । তরিবত করে ঝিঙাদুটি চুলহার আগুনে ধুড়সে নিয়ে সামান্য নুন-লঙ্কা-তেল দিয়ে মা আমার চটকাত । চটকালেই পোড়া ঝিঙা রসস্থ হয় । তাই ঝিঙাঝোল ।
মায়ের হাতের ঝিঙাঝোল আর ভাত ! যেমন তেমন খাদ্য তো নয়, একেবারে ‘অম্রুতো’ ! এই পোড়োবাড়িটার অন্দরে ঝিঁজরির টানাটানি সত্ত্বেও খিদের জ্বালায় আর ঝিঙাঝোল-ভাতের কথা মনে পড়ায় জিভে জল এসে যাবে না আমার?
তৎক্ষণাৎ অলক্ষ্য জনপদের অলক্ষ্য জনমানুষদের উদ্দেশ্যেই তড়পে উঠে চিৎকার করে বলি, এই যে খেতে দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাইরা ! তোমরা শুনছ কি ? আমার খিদে পেয়েছে, ভয়ানক খিদে ! ঝিঁজরি টানছ, যত পারো টানো । তা বলে খেতে দেবে তো !
আমার চিৎকার-চেঁচামেচিতে ফের কতক বাদুড়া-চর্মচটকার ওড়াউড়ি শুরু হল । পারাবতগুলোর ভদভদানি, কতক ডানা ফেটিয়ে বাইরে বেরিয়েও গেল । কিন্তু আমার কথায় শরীরী অশরীরী কেউই যেন কর্ণপাত করল না ! যথা পূর্বং তথা পরং, ঝিঁজরি ঝিঁজরির মতোই চলতে লাগল ।
“ মামনুসর ” বলে কাপালিক নবকুমারকে পশ্চাতে অনুসরণ করতে বললে, ক্ষুধাতৃষ্ণাকাতর নবকুমার নিমরাজি হয়েও পশ্চাদভাগে গমন করতে করতে বলেছিল, “প্রভুর যেমত আজ্ঞা । আমি ক্ষুধাতৃষ্ণায় বড় কাতর । কোথায় গেলে আহার্য সামগ্রী পাইব অনুমতি করুন ।”
নবকুমার তবু তো বলেছিল বটে । হায়, আমি তো “ -সবিস্ময়ে দেখিলা অদূরে, ভীষণ-দর্শন মূর্তি “ – তেমন কোনও কাপালিকেরও সন্ধান এপর্যন্ত পেলাম না ! ক্ষুধা-তৃষ্ণার আবেদন অতঃপর কার কাছেই বা রাখব?
অগত্যা ঝিঁজরির মন্থর টানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে খাদ্য না জুটুক, নানাবিধ খাদ্যের কথাই মনের ভিতর উপর্যুপরি আসতে লাগল ।
প্রথমেই আমাদের গ্রামের নিত্যানন্দ বেহেরার কথা মনে এল । তাঁর বয়স আশির উপরে হবে বৈ কম হবে না । গ্রামে কারোর বিবাহের প্রীতিভোজের অনুষ্ঠানে কী শ্রাদ্ধশান্তির ‘আঁশপালনা’-য় মৌখিক বা চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ থাক বা না থাক, নিত্যানন্দ কাঁশকুটের কানাভারি একটা গহীরা বাটি কী তাটিয়া সঙ্গে নিয়ে আগেভাগে উপস্থিত থাকবেই থাকবে ।
পরিবেশনকারীরা হাতা ভরে এক অবর্ণনীয় দ্রুততার সঙ্গে মাংসের ঝোল- ব্যঞ্জন যাহোক তাহোক করে ভাতের উপরিভাগেই ঢেলে দিতে চাইলে দুহাত আড়াআড়ি পেতে মানা করবেই করবে নিত্যানন্দ । মাংসের জ্যুস-ব্যঞ্জন দিতে হয় দিক তারা তার নিজের ঘর থেকে আনা তাটিয়া বা বাটিতে। তা না হলে কব্জি ডুবিয়ে তরিবত্ করে ভোজ খাওয়া আর কাকে বলে !
মনে আসছে ভজহরির ছেলেটার ভোর ভোর পেট ভরে খাসি মাংস আর ভাত খাওয়ার কথা । একদিন হয়েছিল কী, চারদিকে পাতলা ফিনফিনে কুয়াশা । ঝুনঝুনি গাছগুলোর ডগায় ডগায় সপ্ সপে শিশিরজল । তার ভিতর দিয়ে, তার ভিতর দিয়ে আমাদের ভজহরির ছেলেটা দখিণসোলের সোঁতার দিকে এগুচ্ছে তো এগুচ্ছে ।
ভালো করে সকাল হয়নি তখনও। ভজহরি ও তার পরিবার ঘুমোচ্ছে। দড়ি-টানা হাফ-পেন্টুল, গায়ে চারহাতি ময়লা চাদর। বয়স বড়জোর বছর আট, ভজহরির ছেলেটা।
দখিণসোলের সোঁতায় ন্যাড়াবিলে যত্রতত্র ডোবায় ঝিরঝিরে জল তখন । সেসময় হি-হি করা শীতে সোঁতার দিকে ছেলেটার হেঁটে যাবার হেতু অনুমান করা সহজ বৈকি ।
কিন্তু না, হাফ-পেন্টুল ময়লা চাদর আচমকা বাঁক নিল দক্ষিণে । সে দেখতে পেয়েছে একটা কিছু । আনকোরা নতুন মেটে হাঁড়ির মুখে বসা কতক কাক ভদভদিয়ে উড়ে উঠল চারদিকে ।
উড়ে উঠল বটে, তবে একেবারে ছেড়ে গেল না জায়গাটা । ঘুরে ঘুরে মাথার উপর উড়তে লাগল, ততক্ষণে ভজহরির ছেলেটা হাঁড়ির মুখ দেখছে উবু হয়ে । হাঁড়ির ভিতর ঝরঝরে শুকনো ভাত, হলুদ মশলা মাখা খাসি মাংসের তরকারি !
আহ্লাদে স্তম্ভিত হয়ে গেল হাফ-পেন্টুল, খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করেই থাকল ছেলেটা । তারপর উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল সে, “ হিঁ-ই-ই-ই বাবা ! এত ভোরে এ-ত্ত মাংসভাত মাঠের মধ্যি কে রেখে গেল? কে??
ব্যস্ ! বাবু হয়ে বসে ভজহরির ছেলেটা হাঁড়ির ভিতর ডানহাতটা সটান ঢুকিয়ে দিল । এতক্ষণে ঘুরতে ঘুরতে আরও কাছে নেমে এল ক্ষুধাতুর কাক-
গুলোও । খাড়া খাড়া চুলে ভরতি হাফ-পেন্টুলের মাথাটায় খুবলে দেয় আর কী?
ওসব গ্রাহ্য করল না ও । পরম নিশ্চিন্তে ভোজন পর্ব সমাধা করল । সোঁতার দিকে যাওয়া আর হল না, ভারি পেট নিয়ে ভজহরির ছেলেটা ফিরে আসছে ।
ঘুম থেকে উঠে অ্যানামেলের ঘটিতে জল ঢেলে মুখ ধুচ্ছিল ভজহরি, ধুয়ে পোস্তঢুলির জোগাড় দেখবে ভাবছিল ।
ফলের বীজ থেকে পোস্ত, ফলের গায়ের আঠা থেকে আফিম আর শুকনো ফলের খোল জলে ফুটিয়ে পোস্তঢুলির রস ! র-চায়ের মতো দেখতে, চিনিসহ সেবনে একপ্রকার ঢুলু ঢুলু নেশা হয় ।
ভজহরি সেই নেশার তরে উনুনের ধার ঘেঁষে কুঁকড়ে বসে পড়ল । তখন জল আর পোস্তফলের খোল ফুটছিল বুগ বুগ করে উনুনে । ময়লা চাদর, হাফ-পেন্টুল – হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকল ভজহরির ছেলেটা ।
ডানহাতের তর্জনি মুখে পুরে চুষতে চুষতে বলল, “বাপ, মাঠের মধ্যি এত ভোরে এ-ত্ত মাংসভাত কে রেখে গেল বলদেখি?”
খানিক থম মেরে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকল ভজহরি । তারপর বলল, কেন? তুই কি খেয়েছিস?
-“হুঁ-উম !” ছেলেটার চোখদুটো অহ্লাদে বুজে এল ।
ততক্ষণে লাফিয়ে উঠেছে ভজহরি, পোস্তঢুলির নেশা টুটে গেছে তার ।
-“হায় ! হায় !! কী সব্বোনাশ করেছিস, হা-ঘরে হতচ্ছাড়া বাঁদর !”
কাকে খাচ্ছিল, না হয় সে খেয়েছে – এর মধ্যে অপরাধটা কোথায়? বুঝতে না পেরে ছেলেটা কেঁদে ফেলল হুড়ুস করে ।
তার কান্না দেখে বাপের চোখেও জল, কপাল চাপড়ে সে বলতে থাকল, “শেষে তুই কী না মরা মানুষের ভাত খেলি ! হারু বেহেরার ‘আঁশপালনা’-র মাংসভাত কাল মাঠের মধ্যি দে গেছিল হারুর জন্য -আর তুই অভাগা খেয়ে ফেললি?”
“বাঁচবি না, আর তোকে বাঁচানো গেল না রে ! এখন যে কী-ই ওষুধ দিই তোকে !” আতঙ্কিত ভজহরি অস্থিরতায় ছটফট করল । মৃত হারু বেহেরার ‘আশ-পালনা’-র দিন হারুকে উৎসর্গ করা ভাতমাংস এখন ছেলেটার পেটের ভিতর ! মরা মানুষের ভাত জ্যান্ত মানুষের পেটে পড়লে মানুষ কি আর বাঁচে !
অতএব মরে যাবার ভাবনায় ভজহরির ছেলেটা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলে, “একটা কিছু অষুধ এনে তুই আমাকে দে বাপ !”
তার উত্তরে ভজহরি বলেছিল, “ সার্থক ওঝার আখড়ায় চ শিগগির, দেরি করলে আর তোকে বাঁচানো যাবে নারে !”
বলেই দুচোখে জল ভজহরি ছেলেকে কাঁধে তুলে পড়ি-কি-মরি দৌড়েছিল সার্থক ওঝার আখড়ার দিকে ।
ভজহরির ছেলেটার মৃতমানুষের উদ্দেশে উৎসর্গ করা ‘আশপালনা’-র মাংস- ভাত গোগ্রাসে গলাধঃকরণের দৃশ্যটা এসময় ভারি মনে পড়ছে । রাখো তোমার ‘আঁশপালনা’-র ছুঁৎমার্গতা ! এখন হাতের কাছে তাই যদি পেতাম, আহা ! আমিই কি আর ছেড়ে দিতাম?
খাই খাই । কবি সুকুমার রায়-এর ‘খাই খাই ‘ কবিতার কথাও মনে আতা-যাতা করছিল । ‘খাই খাই’ । এই বলে জোড়হস্তে দণ্ডবৎ করে কবিতাটা কতই না আবৃত্তি করেছি—
‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে –
খাওয়ার আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে ।
যতকিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড়ো করে আনি সব, -থাক সেই আশাতে ।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যতকিছু সৃষ্টি ,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে –
ব্যাঙ খায় ফরাসিরা ( খেতে নয় মন্দ ),
বার্মার ‘ঙাপ্পি’তে বাপ্ রে কি গন্ধ !
মান্দ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কন্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘন্ট !
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কিযে খায় লোকে নাহি তার কিনারা ।’
এত খাওয়া-খাওয়ির মধ্যেও একটা হাসির কথা এই ‘আবৃত্তি’-র প্রসঙ্গে মনে এল ! তখন আমাদের ফ্রি প্রাইমারির থ্রি-ফোরের ছাত্রছাত্রীরা ‘খাই খাই’-এর মতো লম্বা লম্বা কবিতাই আবৃত্তি করত ।
শনিবার শনিবার ‘বড়দা’ অর্থাৎ হেডস্যার ইস্কুলে আবৃত্তি ধরত । ওয়ান-টুয়ের ছাত্রছাত্রীরা আবৃত্তি না করলেও মন দিয়ে সেসব শুনত । আবৃত্তি শুনতে শুনতে তাদের চোখগুলি হয়ে উঠত বড় আর ড্যাবা ড্যাবা । অত্যধিক মনোযোগ হেতু অসাবধানতাবশত তাদের মুখ থেকে লালা ঝরত ।
‘খাই খাই’-ই হচ্ছিল । শেষ হতে না হতেই ক্লাস টু-এর একটি ছেলে আচমকা দাঁড়িয়ে উঠে হাত জোড় করল । আমরা থ্রি- ফোররা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম । আরে এ যে অ-ভ-য় চ- র-ণ ! মোঃ চঁদর পুর । অর্থাৎ রামচন্দ্রপুর ।
—“কী ব্যাপার অভয় ? উঠে দাঁড়ালে যে ?”
বড়দার জিজ্ঞাসা ।
অভয় হাত জোড় করে বলল, “একটা আবৃত্তি করব !”
বড়দা ভারি উল্লসিত হয়ে টেবিল চাপড়ে অভয়কে অভয় দিয়ে বললেন, “এই তো চাই-ই ! ছোটদের মধ্য থেকেও উৎসাহিত হয়ে কেউ যদি আবৃত্তি করতে চায় – বাঃ বেশ বেশ ! অভয় শুরু করো !
প্রথমটায় অভয় থতমত খেল । তারপর শরীর মৃদুমন্দ দোলাতে দোলাতে রুদ্ধশ্বাসে বলে চলল—
“ অ থ অথ ক র কর চ র চর ধ ন অন
ই হ ইহ খ ল খল ছ ল ছল ন খ নখ
ঈ শ ঈশ গ ণ গণ জ ল জল ন ত নত
ঋ ণ ঋণ গ ত গত ত ট তট – ”
বড়দাও হতচকিত হয়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলেন । অতঃপর চেঁচিয়ে উঠলেন, “ অভয় ! থামো থামো ! ওহে এ যে পদ্য নহে, গদ্য -”
কিন্তু থামতে বললে অভয় থামবে কেন? সে যে শেষ পর্যন্ত বলে তবেই ছাড়বে– “ ন র নর এ ক এক ঘ ন ঘন দ শ দশ প ট পট ।”
থামল বটে অভয় । ততক্ষণে সারা ইস্কুলঘরে হাসির কলরোল আছড়ে পড়েছে । বড়দাও না হেসে থাকতে পারলেন না । এই পোড়োবাড়িটায়, সংঘারাম, কী বৌদ্ধবিহারের ভগ্নস্তূপে একপেট খিদে নিয়ে আমিও মনে মনে হেসে একশেষ ।
শ্রীশ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ তর্জমা করে যে, “একশেষ, একের শেষ অর্থাৎ যাহাতে এক বিভক্তিস্বরূপ শব্দ সমূহের একমাত্র শব্দ শেষ থাকে, অন্য শব্দ নিবৃত্ত হয় ।”
১৫
ভাত, ভাত, ভাত । কবে কোন যুগ থেকে ভাত খেয়ে আসছি আমরা ! আমাদের গ্রামের সাঁওতালরা অবশ্য ভাতকে ভাত বলে না, বলে ‘দাকা’ ।
একসময় কত সাঁওতালি ‘ঠার’ মুখস্ত করেছি ! ভাত খা – ‘দাকা জম্ মে’ । আমি ভাত খেয়েছি – ‘দাকা এং জম্ আকাদা । আমরা ভাত খেয়েছি -‘আলেদ দাকা লে জম্ আকাদা’ ।
প্রবাদ আছে –‘টাকা খান বৌহু, দাকা খান কৌহু’ । মানে ? মানে হল – ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না । কত রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন সাঁওতালী করেছি ! আজি ঝর ঝর মুখর – “তেহেন ঝিপির ঝিপির জাপুট” । তুমি কোন কাননের ফুল -“নাম দো নোকা বাগারেন বাহা” –
আজ ‘অর্গলা ভূত’-এর হাড়িকাঠের দিকে ঝিঁজরির টানে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি, এখনও এসব কথা মনে আসছে !
শিবই তো কৃষিকাজের দেবতা । আবার নিজেও একজন দরিদ্রতম চাষী । “ কোন গুণ নেই তার কপালে আগুন । “ একটাই গুণ আছে বটে -বড়ই অলস । স্ত্রী দুর্গা তাঁকে ঠেলে ঠেলে জমিতে নামান । পুকুরধারের জমিতে পঞ্চশস্য অর্থাৎ ধান, সরষে, তুলো, যব আর তিলের চাষ করান । কখনও কখনও সব্জি
কী ব্রাহ্মণ্য যুগ, জৈন যুগ, বৌদ্ধ যুগ –সব যুগেই কৃষিকাজই ছিল প্রধান কাজ, ভাতই তো ছিল প্রধান খাদ্য । হাল-লাঙল-বলদ কৃষিকাজের প্রধান উপ- করণ । সঙ্গে খনার বচন । এই যেমন -“যদি বর্ষে মকরে । ধান ফলে টিকরে ।।” “কার্তিকের ঊন জলে । দুনো ধান খনা বলে । ।” “যদি বর্ষে মাঘের শেষ । ধন্য রাজার পুণ্য দেশ ।।”
তাছাড়া শিবই তো কৃষিকাজের দেবতা । আবার নিজেও একজন দরিদ্রতম চাষী । “ কোন গুণ নেই তার কপালে আগুন । “ একটাই গুণ আছে বটে -বড়ই অলস । স্ত্রী দুর্গা তাঁকে ঠেলে ঠেলে জমিতে নামান । পুকুরধারের জমিতে পঞ্চশস্য অর্থাৎ ধান, সরষে, তুলো, যব আর তিলের চাষ করান । কখনও কখনও সব্জি ।
চর্যাপদেও তো আছে ‘ভাত’-এর কথা –
“ টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী ।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ।। ”
গুহ্য অর্থ যা-ই হোক, সরল কথা তো এই – টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই । হাঁড়িতে ভাত থাকে না, প্রায়ই উপোষ করতে হয় । এখানে ভাত না পাওয়া গেলেও অন্যত্র তরকারি বা ষোড়শ ব্যঞ্জনের ছড়াছড়ি-
“ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা ।
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খাই পুনবন্তা ।। ”
রম্ভা বা কলাপাতায় ভাত, গাওয়া ঘি, দুধ, মৌরলা মাছ আর নালিতা শাকের তরকারি । স্ত্রী বেড়ে দিচ্ছে আর ভাগ্যবান স্বামী খাচ্ছে । এরকম দৃশ্যও তো দেখা গিয়েছে ।
তাছাড়া শুধু মৌরলা মাছ, আরও যে কত কী !
“ রোহিত মাগুর পাবদা তপসী চিতল ।
ভেউস বাউস কই জিওল কাতল ।।
ইলিশা খলিশা বাইস গোলসা কোড়াল ।
চাঁদা বাচা চিংড়ি চেলা বাতাসি বোয়াল ।। ”
হরিণের মাংস, ছাগের মাংস, গণ্ডারের মাংস, গো-মহিষাদির মাংস তো ছিলই । তদুপরি ময়ূর, কুক্কুট, নানাবিধ পাখির মাংস ।
ভাত তো ভাত, একটু ফ্যানের জন্য এই তো সেদিন মানুষের কী হাহা-কার ! ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর । কলকাতার রাস্তায় “ একটু ফ্যান দেবে গো ” “একটু ফ্যান দেবে গো ” বলে উপোসি মানুষের সে কী আর্তচিৎকার !!
কলকাতা যেমন তেমন, দুর্ভিক্ষের কবল থেকে আমাদের মেদিনীপুরকে বাঁচাতে কাগজে কাগজে কি কম লেখালেখি হয়েছিল? একটা কাগজের রিপোর্ট তো এইরকম :
“ মেদিনীপুরকে বাঁচাইতে এক হও ”
গতবছর মেদিনীপুর জেলায় ৫০ হাজার লোক অনাহার ও
মহামারীতে মরিয়াছে । তমলুক, সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম, পাঁশকুড়া
মহিষাদল প্রভৃতি অঞ্চলে হাজার হাজার লোকের একমাত্র
সম্বল ছিল লঙ্গরখানা । শতকরা ৯০ জন ম্যালেরিয়া,
শতকরা ৩০ জন কলেরা ও বসন্তে এবং শতকরা ৬০ জন
রোগে ভুগিয়াছে । গত বছরের এই অবস্থা সামলাইয়া না
উঠিতেই আবার মেদিনীপুরে অনাহার দেখা দিয়াছে । বীজধান
ও বলদের অভাবে এবার ৩০ ভাগ আউসের জমিতে ফসল
হয় নাই । আমনধান যা হইয়াছিল, তারও অধিকাংশ মহাজনের
ঘরে । বর্তমানে শতকরা ১০ জন কৃষকের ঘরে ধান একেবারে
নাই । পাঁশকুড়া থানার ১৫ নং ইউনিয়নে একটি গ্রামে
১০০ ঘরের মধ্যে ৩৫ ঘরে কোনো খাবার নাই । কলাগাছিয়া
গ্রামে শতকরা ৫০ জন না খাইয়া আছে । শতকরা ৫০ জনের
বস্ত্র নাই । ইহার উপর বসন্ত, ম্যালেরিয়া আবার ছড়াইতেছে ।
দুধের অভাবে শিশুমৃত্যু বাড়িতেছে । ”
ভাত তো ভাত, এখন ভাতের ফ্যানটুকু হলেও মন্দ হত না ! বিড় বিড় করে যেন বললামও, “একটু ফ্যান দেবে গো !” “একটু ফ্যান দেবে গো !!”
কেউ শুনল না । কেউই না । এই ভগ্নপ্রায় গৃহে আছেটাই বা কে, যে আমার কথায় কর্ণপাত করবে? আছে তো কতক ঘর-ঘর কুলুঙ্গি, তায় মাথাভাঙা হাড়গোড়হীন কতক অবয়ব । মূর্তি বললে মূর্তি ।
আর আছে – চর্মচটকা বাদুড়া – বাদুড় চামচিকা । কতক কবুতর পায়রা । আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে তারাই ‘কঁহরাচ্ছে’ । মাঝে মাঝে ডানা ফেটিয়ে সাঁক করে উড়ে যাচ্ছে । ইতস্তত উড়ে-ঘুরে আবারও ফিরে আসছে ।
তবু তো তারা আছে । আছে, আছে । নচেৎ পোড়োবাড়িটাকে আরোই হতকুচ্ছিৎ “মরা” “মরা” লাগত । মনে মনে ভাবতে না ভাবতেই পারাবতসকল আরো একবার ভদভদিয়ে উড়ে উঠল ।
অতিরিক্ত ভদকানিতে গায়ে গায়ে ডানা ঝটপটানিতে একটা পায়রার পালক খসে ঘুরে ঘুরে নিচে পড়ল । নিচু হয়ে পালকটা কুড়িয়ে নিলাম। পালকই তো ?
হ্যাঁ, পায়রার পালকই বটে । তবে আকারে ঈষৎ ‘পুরুষ্টু’ ও বড় । এরকমটা কতই দেখেছি ! কেননা, আমাদের মাটির বাড়ির ‘দাঁতিয়া’-য় পায়রার বাসা বাঁধবার নিমিত্ত কত যে পোড়ামাটির হাঁড়ি টাঙানো থাকতো, এখনও আছে ।
তাছাড়া, আমাদের মা-কাকিমারা এই পায়রার পালক দিয়েই তো তিলের তেল, দুধের ঘি নিষ্কাশন করে – সে এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় !
গ্রামের মাথায় জঙ্গলের ধারে ‘ডাহি’ জমিনে, এমনকি টাঁড়ে-টিকরে লাট-কে-লাট ‘খসা’-র চাষ হয় । খসা, যাকে বলে তিল । চৈত্র-বৈশাখে তিল বোনা হয় আর শ্রাবণ-ভাদ্রে সে তিলগাছে ফুল এসে যায় ।
“তিলফুল জিনি নাসা ” -পুরাণ-মহাভারতে রমণীয় নাসিকাকে তিলফুলের সঙ্গে তুলনা করা হয় । শ্রাবণ-ভাদ্রে ডাহি-ডুংরিতে লাট-কে-লাট তিলজমিনে যখন তিলফুল ফুটে ‘আলা’ হয়ে যায়, তার চারধারে কত যে রঙিন প্রজাপতি উড়েঘুরে বেড়ায় ! প্রজাপতি তো নয়, আমরা বলি ‘পতনি’ ।
অবশেষে খসা বা তিল পেকে খসার বন হাওয়ায় ঝুন্ ঝুন্ করে । খসা কেটে খসা ঝাড়া হয় । আছড়ে পাছড়ে খসাকে ধূলাবালি মুক্ত করা হয় । তারপর তো শুরু হয় মা-কাকিমাদের হাতের কারসাজি –
বালির খোলায় ভাজো রে ! জলে ধুয়ে খোসা ছাড়াও রে ! কালো তিল খোসা ছাড়ালেই ধবধবে সাদা । অতঃপর তো গরম জলে ফেলে উসুম উসুম সেদ্ধ করা ।
কথায় বলে না -“তেলে-জলে মিশ্ খায় না? “ সত্যিই তো, জল পড়ে থাকে নিচে, তেল জলের উপরিতলে ভাসে । তা তো কথার কথা শুধু নয়, পিছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে ।
জলে মিশে না কোনও তেল বা তরলের আপেক্ষিক গুরুত্বের উপরই তেল বা তরলের ভেসে থাকা নির্ভর করে ।
এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে একটা অঙ্কের কথা তো এখনই মনে পড়ছে –
“ একটি U- নলে কিছু জল আছে । এক
বাহুতে জলের সঙ্গে মিশে না এমন একটি
তরল ঢালা হইল যাহাতে অন্য বাহুর জলতল
তরল স্তম্ভ d উচ্চতায় থাকে; কিন্তু প্রথম
বাহুর জলতল ইতিমধ্যে L দূরত্বে নামিয়া
গিয়াছে । জল এবং তরলের ঘনত্ব Q1 এবং
Q2 হইলে প্রমাণ কর :
Q2 ( 2L +d ) = 2Q1L
ডায়াগ্রামটাও এইরকম :
সে যাহোক, মা-কাকিমারা তো এসব কিছু বোঝেও না । তারা তাদের মতো সাময়িকভাবে উসুম উসুম জ্বাল দেওয়ার উনুনের পাশে পায়রার পালক হাতে নিয়ে বসে যায় ।
তারপর তো ক্রমাগত উসুম উসুম ধোঁয়া-ওঠা পোড়ামাটির খোলায় পায়রার পালক চোবানো আর তেলে ভেজা সপসপে পালক হাত মসকে গাড়ু বা তৈলাধারে নিঙড়ানো !
ভারি একঘেঁয়ে তৈল কী ঘি নিষ্কাশন পদ্ধতি ! একঘেঁয়ে বলতে একঘেঁয়ে, কতদিন দেখেছি মা-কাকিমারা উনুনের ধারে বসে পালক নিঙড়াতে নিঙড়াতে তন্দ্রাবশতঃ ঢুলছে ।
ঘিয়ের পালক হলে তো কথাই নেই, আমাদের পোষা বিড়াল জানকী কী সারদা ঘুমন্ত মা-কাকিমাদের হাত ফসকে পড়ে যাওয়া ঘিয়ে ভেজা পালকটা চেটেপুটে দেখত – ঘিয়ে ঠিকঠাক পাক ধরেছে কীনা !
শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তীর আফিঙ্গখোর মার্জার হলে আরও এককাঠি উপরে উঠে গাড়ুর সবটুকু ঘৃত নিঃশেষ করে গোঁফ মুচড়ে উদগার তুলে হয়তো মন্তব্য করত, “কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।” আর নয়তো, “ উর্দ্ধ আঙ্গুলে কভু বাহির না হয় ঘি। ”
পালকটা হাতে পেয়ে যেমন যেমন মা-কাকিমাদের তৈল ও ঘি নিষ্কাশনের কথা এল, তেমন তেমন এই হা-অন্ন হা-অন্ন সময়ে ‘পালক’ নিয়ে একটা ‘পদ্য’-র কথাও মনে এল।
চেঁচিয়ে তাই মুখস্ত বলতে লাগলাম –
“ কী একটা পালক খুঁজতে খুঁজতে লোকটা এদিক দিয়ে চলে গেল
তার চরণচিহ্ন ছায়ায় পড়ে না, চরণচিহ্ন মাটিতে পড়ে না
সে নিশ্চিহ্ন হেঁটে গেল
সূর্যের সব আলো তাকে ঝলসে দগ্ধাতে পারল না
পৃথিবীর সব ঘাস পুড়ে ছাই হয়ে গেলে সমুদ্র ধোয়াবে পা
অরন্যে একটাও দেবদারু না জন্মালে আকাশ দেবে ছায়া
ছায়া বরফের মতো মৃত্যুর মতো দূর থেকে আর্দ্র হয়ে আসে –
এ তথ্য সে জেনে গেছে, জেনে চলে গেছে
পালক সন্ধানে
কী একটা পালক সে রোজ খোঁজে, রোজ, সারাক্ষণ ”
চেঁচালাম, জোরসে চেঁচালাম ! কিন্তু কেউ তা শুনল না । অগত্যা পায়রার পালকটাকে নিশান করে যাহোক তাহোক ভাবে মেঝেয় পুঁতে রেখে এখানেই গ্যাঁট হয়ে ‘অনশন’-এ বসে পড়লাম ।
যতই টানো, মারো ধরো, অদৃশ্য ঝিঁজরির কসরত-কেরামতি দেখাও –
খেতে না দিলে আর একপা-ও নড়ছি না ! একচুলও না !
ততক্ষণে মধ্যাহ্ন সূর্যও পশ্চিমে হেলে পড়েছে । পুষ্করিণীর জলে তার ছায়া- বিম্ব, সূর্যের আলো জলে বিলি কাটছে ।
বাঁদিকে আরেকটা কুঠরিঘর, কে জানে কত নম্বর ! কী যেন অস্পষ্ট লেখাও রয়েছে ! একশত ছয় কী? একশত ছয়কে সংস্কৃততে বলে, ‘ষড়ধিকং শতম্’ আর পালিতে?
পালিতে তো শতকিয়াকে এইরকমই বলে – ‘পঠমো’ ‘দুতিযো’ ‘ততিযো’ –
‘পঠমো বগগো’ ‘দুতিযো বগগো’ ‘তিতিযো বগগো’ –
আচমকা কানে এল, কে যেন বিড়বিড় করে বলছে –
“ ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং ।
ত্বগাস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু ।।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্প দুর্লভাং ।
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে ।।”
‘কে ? কে বলল একথা ?’ অনশনে বসে আমার মুখ দিয়েই কি উচ্চারিত হল একথা ? “এখানে এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে যাক, আমার চামড়া, হাড় ও মাংস ক্ষয় হোক, আমি ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ না করে উঠছি না !”
কিন্তু না । আমার কথা কেন হবে, একথা তো নৈরঞ্জনা নদীতীরে বোধি- বৃক্ষের নিচেয় যোগাসনে বসে বোধিলাভের আশায় সিদ্ধার্থই বলেছিলেন ।
এখন এই তো আবারও শুনলাম –“ দ্বিতীয় প্রহরবেলা অতীত হইলে আহার করিবে, নাট্যক্রীড়া ও সঙ্গীতাদি হইতে বিরত থাকিবে, অলঙ্কারাদি এবং সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার করিবে না, দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শয়ন অনুচিৎ, রৌপ্য ও সুবর্ণ গ্রহণ নিষিদ্ধ ।”
“কে? কে?” প্রায় চিৎকার করে উঠলাম । চারধার তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম । কেউ থাকলে তো উত্তর দেবে? কেউই নেই । কেউই নেই । কিছুক্ষণ পরেই নধর-গতর একটা গিরগিটি , যাকে আমরা বলি ‘ক্যাঁকলাস’ , কুঠরিঘর থেকে ধীরে-সুস্থে নির্গত হল ।
দ্বারকক্ষে পেট-তাবুড় দিয়ে কয়েক পলক আমারই দিকে নেত্রপাত করে তার তাবড় মাথাটা বারকতক নাড়ল । তারপর আমারই পাশ দিয়ে আমাকে গ্রাহ্য না করে দ্রুতগতিতে কোথায় হারিয়ে গেল ।
ডানা ফেটিয়ে পায়রাগুলো এসময় আবারও ফিরে আসছে – ওই তো, ওই !
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৪
❤ Support Us