Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫

ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৬

নলিনী বেরা
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৬

১৬ 

 
তবে কী এই ‘এক শত ছয়’ নম্বর কক্ষেই আমার গতি হল ? আপাতত অবস্থা দেখে তো তাই মনে হচ্ছেআর কেউ ঝিঁজরি ধরে টানাটানিও করছে নাপা- দুটোয় হাত বুলিয়ে দেখছি -আহা রে ! অদৃশ্য ঝিঁজরির রজ্জুবন্ধনের ছাপছোপ আর বুঝি লেশমাত্র নেই ! 
 
এখন আমি – মুক্ত , মুক্ত, মুক্ত –
 
   ঈষৎ ঝুঁকে ঘাড় গলিয়ে কক্ষের ভিতরের পরিসর মাপছি আর দেখি কি -ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল ঝপাং করে ! তারমানে মুক্ত নই আমি,  ফের  বন্দী হলাম কক্ষের অন্দরেই 
 
   রাগ, স্বাভাবিক কারণেই রাগ হল, ভয়ানক রাগখিদের জ্বালায় এমনিতেই রাগে জ্বলছিলামতার উপর আচমকা দড়াম করে ঝাঁপ বন্ধ হলরাগও বেড়ে দাঁড়াল দ্বিগুণ ত্রিগুণ চতুর্গুণ !
 
   দমাদ্দম ! দমাদ্দম !! 
 
   দরজায় লাথি কষালাম একের পর একদরজা এই ভাঙে কি সেই ভাঙে! তবুও কারো  কোনো ভ্রুক্ষেপই নেইকেউ আছে যে দৌড়ে এসে মানা করবে ? 
 
   আরে, কেউ যদি না-ই থাকে তবে দরজা বন্ধ করলই বা কে ?  
 
    তাহলে কি, যা কিছু ঘটে চলেছে সবটাই সেই ‘ইনভিজিবল্’ হাতের কাজ ? তারই হাতেরই কারসাজি ? যে আমাকে নিশুতি রাতে ঝিঁজরির টানে ঘর থেকে টেনে এনেছে মশানির দহে নিশির টানের মতো, রাতভর দহের জলে ডুবিয়ে রেখেছে, তারপর তো গো-শকটে এতদূর –
 
   তাছাড়া আশপাশ, চতুর্পাশ দেখে তো মনে হয় না কোথাও উল্টাপাল্টা অঘটন কিছু ঘটে চলেছেঅগত্যা রুদ্ধদ্বার কক্ষের পশ্চিম পার্শ্বস্থ ঝুরকায় খানিক চোখ রাখলাম 
 
      অপরাহ্ণের আলো এসে গৃহের অভ্যন্তরে ইকিড় মিকিড় খেলা খেলছে আর সে-আলোয় দেখা যাচ্ছে – পোঁটলায় বাঁধা কতক কাপড়চোপড় ঘরের এককোণে স্তূপ করে রাখা আছে 
 
    এসব বস্ত্রাদি, কাপড়চোপড়, তোষক-বিছানা কার ? মনে মনে ভাবলাম – কার আবার ? কক্ষের যে হকদার, তারহয়তো সে কোথাও কাজে গিয়েছেসন্ধ্যা হব হব সময়ে কি সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে বাসায় ফিরবে 
 
    এসেই কর্মক্লান্ত শরীরে বিছানা পেতে একটু গড়িয়ে নেবে হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়েউঠেই হাত-মুখ ধুয়ে আসবে পুষ্করিণীর জলে, চাই কি পুষ্করিণীর জলে ঝপাং করে একডুব-দুইডুব-তিনডুবও দিয়ে আসবে 
 
     তারপর ? তারপর ? তারপর তো খাওয়া ? কী খাবে ? ধারেকাছে কোথাও কি কোনও পান্থশালা, আহারাগার, হোটেলমোটেল আছে ?
 
    যৌথপাক কি রন্ধনশালা ?  
 
    যৌথ রন্ধনশালার কথায় মনে পড়ল আমাদের ইস্কুল হোস্টেলের রাঁধুনি টুনিঠাকুরের কথাটুনিঠাকুর আদতে শ্রীনবকুমার চক্রবর্তী মোকাম শ্রীশ্র৺- রামেশ্বরজীউর মন্দির সংলগ্ন দেউলবাড় গ্রাম 
 
    হোস্টেলে প্রায় তিন শতাধিক বোর্ডারতাদের দিবারাত্র কোলাহল কলরোলে মাটির দেয়াল টিনের ছাউনি তিনতলা বাড়ি অষ্টপ্রহর গমগম করেতারা যখন উচ্চৈঃস্বরে ভূগোল-ইতিহাস-ইংরাজি-বাংলা, ইত্যাদি পাঠ মুখস্ত করে, তখন যেন “ কল্লোলিনী কলস্বরে করে কুলকুল ” বা, সহস্রাধিক পায়রা-পারাবতের বকমবকম ডাককেও হার মানায় । 
 
   ওই তারাই আবার আহারের ঘন্টা পড়লে স্ব স্ব কাঁসকুটের থালা, এনামেলের বাসনহাতে টুনিঠাকুরের তথা ইস্কুল হোস্টেলের সুবৃহৎ রন্ধনশালার সমুখে দণ্ডায়মান হলে, দাপুটে রঁসুইকরের উচ্চবাচ্যে তাদের গলায় আর স্বর ফোটে না !
 
   কী তরকারি ? ওই বড়জোর কাঁকুড়ের ছ্যাঁচড়া, ভেঁড়ী কি বৈতালের ঘন্ট তবে হ্যাঁ, কাঁচা লাউয়ের শাঁস বেমালুম বাদ দিয়ে কেবলমাত্র তার চোপা নিয়েই যে ‘লাউয়ের চুপি’-র রেসিপি – তার তুলনা বুঝি ভূ-ভারতে নেই 
 
   কাজেকাজেই রন্ধনশালা যেমনটা বড়ো, আড়ে-বহরে এক শো  বাই দু শো  কিংবা সওয়া দু শো ফুট, তেমনি পাঁচ-ফুটিয়া শ্রীনবকুমার চক্রবর্তীর হাইটও বড় কম নয় !
 
   ছেঁড়া কাঁথা, তোষক-বিছানার মালিক যেই হোক, আপাতত তাই পেতে খানিক গড়িয়ে নিলামঝুরকা দিয়ে অপরাহ্ণিক সূর্যের রোমাঞ্চকর আলো গায়ে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল 
 
   একপেট খিদে সত্ত্বেও ঘুম এসে যাচ্ছিলঘুমই তো ! সেই “ আয় ঘুম যায় ঘুম বাগদীপাড়া দিয়েবাগদীদের ছেলে ঘুমোলো কাঁথা মুড়ি দিয়ে।”
 
   আমাদের গ্রামের পাশেই বড়ডাঙা গ্রামে কয়েকঘর বাগদী বসতি আছেতাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উদারডাঙায় কত লাল-নীল-হলুদ কাচের গুলি খেলেছি ! বাঈধর নামের ছেলেটার হাতের টিপ্ ছিল এককথায় অসাধারণ ! প্রায় সবগুলিই সে একাই জিতে নিত 
 

বলিদানের আগে নিরীহ গোবেচারি ছাগ খুঁটোয় দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও জিভ লম্বিত করে মুখের কাছে জড়ো করা বট-অশ্বত্থের পাতা, চিরোল চিরোল শালপাতা, মনের সুখে চিবোয়, চিবোতে থাকে ।  সে তো আর জানে না এই জীবনে এই তার শেষ খাওয়া ! এমনকি বলিদার যখন গলার রজ্জু ধরে নিয়ে যায় হাড়িকাঠের দিকে, সে তখনও ঘাড় বেঁকিয়ে জিভ আরোই লম্বা করে শেষ পাতাটুকুও খাবলে খেতে চায়।

 
    সে নিকতাবলে তাদের পাড়াতেই ঘুমের এত আতা-যাতা কেন ? কই, কেউ তো কখনও বলে না বামুনপাড়া, কায়স্থপাড়ার কথা !  নিদেনপক্ষে  সদগোপ কি মহাজনপাড়ার কথা !  তবে কি একটা কিছু ষড়যন্ত্র আছে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বাগদীদের ? 
 
    হবেও বাযাহোক ঘুমিয়ে পড়েছিলামহঠাৎ যেন কোথাও একটা বাজনা বেজে উঠলসেই একটানা পূজার ঘন্টাধ্বনি জলের তলায় কতবার যে  শুনেছি !
 
    কিন্তু এ যে বলিদানের ঢাকের বাদ্যি ! “ ড্যাং ড্যাং ড্যা ড্যাং ড্যাং !!” আমাদের গ্রামের ‘গরাম থান’-এ গরাম পূজায় অথবা ‘শীতলা থান’-এ শীতলা পূজায় পাঁঠা বলিদানের প্রাক্কালে এমনটা হামেশাই বাজতে শুনেছি 
 
    বলিদানের আগে নিরীহ গোবেচারি ছাগ খুঁটোয় দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও জিভ লম্বিত করে মুখের কাছে জড়ো করা বট-অশ্বত্থের পাতা, চিরোল চিরোল শালপাতা, মনের সুখে চিবোয়, চিবোতে থাকে 
 
    সে তো আর জানে না এই জীবনে এই তার শেষ খাওয়া ! শেষ আহারএমনকি বলিদার যখন গলার রজ্জু ধরে সজোরে টানতে টানতে নিয়ে যায় হাড়িকাঠের দিকে, সে তখনও বিপরীত পার্শ্বে ঘাড় বেঁকিয়ে লকলকে জিভ আরোই লম্বা করে শেষ পাতাটুকুও খাবলে খেতে চায় 
 
    তার পিছনের পা দুটো টেনে ধরে, ঘাড় যতটা পারা যায় লম্বা করে অর্গলে পুরে যখন হাড়িকাঠের আংটা খড়াং করে আটকেও দেয়, তখনও ছাগ ঘুণাক্ষরেও টের পায় না লোকগুলো তাকে নিয়ে কী করতে চায় 
 
    এমনকি খাঁড়াটা গলার উপর ঝপাং করে এসে পড়ার আগ-মুহূর্তেও সে তার কানদুটো ঝটপট করে, চোখদুটো গুলির মতো বড় করে তোলে, গলাটা কোনক্রমে টেনেটুনে ছাড়িয়ে নিয়ে পাতা খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে, জিভটাও কিঞ্চিৎ বেরিয়ে আসে  
 
    — সেই  “ ড্যাং ড্যাং ড্যা-ড্যাং ড্যাং”  বলিদানের বাজনাটা অনর্গল বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে বলি কী হয়ে গেল ? না,  হতে চলল ?  ছাগবলি না নরবলি ? 
 
     যদিও ধারণা করা হচ্ছিল মন্ত্রযানী-বজ্রযানী-কালচক্রযানী, কী হীনযানী বৌদ্ধদেরই আবাসস্থল এই পোড়ো গৃহটি, তাঁরাই উৎসবাদিতে মেতে উঠে ঘন্টাধ্বনি সহকারে ঢাকঢোল বাজাচ্ছে, অদ্যাবধি চর্মচক্ষে একটাও তো লোক দেখি নাঅথচ মনে হচ্ছে– আছে, আছেসবকিছুই আছে 
 
     বিছানায় যে শুয়েছিল, এইমাত্র উঠে সে চলে গিয়েছে,  তার শরীরের ওম যেন এখনও লেগে রয়েছে !
 
     ষোড়শ প্রচারে পূজা বোধকরি এতক্ষণে শেষ হল বাজনার “ কাঁই না না, কাঁই না না ”  শব্দধ্বনিও আর শোনা যাচ্ছে না এক্ষণে পূজা শেষে হয়তো প্রসাদ বিতরণের পালাও শুরু হয়েছে  
 
     প্রসাদের কথায় হুদ্ হুদ্ করে মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামের হরিমন্দিরে প্রতি পূর্ণিমায়,  তৎসহ অন্যান্য উৎসবাদিতে  ‘চিড়া-ভোগ’ প্রস্তুতিকরণের কথা— 
 
     পূর্বদিগন্ত আলোয় আলোময় করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে,  মৃদঙ্গে চাঁটি পড়েছে— “ধা ধিন ধিন ধাধা  ধিন ধিন ধা ।। না তিন তিন তাতেটে ধিন ধিন ধা ।।”
 
   অমনি ঘর-ঘর ঝকঝকে কাঁসার থালায় ধবধবে চিড়া, গুড়, বাতাসা, দুধ, নারকেল, পাকারম্ভাসহ নানাবিধ পূজা-উপাচার এসে গেলসঙ্গে গুলাজ ফুলের মালা, জ্বলন্ত প্রদীপ !
 
    জলদে কীর্তন চলত খোল-করতাল-কাঁসরঘন্টা বাজিয়ে – “ ভজ শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দহরে কৃষ্ণ হরে রাম রাধে গোবিন্দ ।।”
 
    পুরোহিত নারায়ণ দাশঠাকুর উৎসর্গীকৃত নৈবেদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নিজের গাঁটরিতে বেঁধে বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পিতলের বড় হাঁড়ায় তাহুত করে মেখে ভোগ তৈরি করতেনচিড়া-ভোগের গন্ধে তখন চারধার  ম ম করে উঠত 
 
    কীর্তনেও ‘ভরা’ উঠত – “ হরি হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমঃ ।।  “ মৃদঙ্গে বোল ফুটত – “ ঝে নে  ঝা গে  না তে নে  তা খি টি   ঝা ঝিনি  ঝা ঝা   ঝা খিটি  তা খি  তা –”
 
   অতঃপর শুরু হত প্রসাদ বিতরণমুঠো মুঠো চিড়া-ভোগ -আহ্ ! পাকা-রম্ভা-গুড়-দুধে মাখামাখি সে-চিড়া, চিড়া তো নয়,  ‘অম্রুতো’ ! তার উপরে গোঁজা থাকত আস্ত পাঁচ-দশটা বাতাসা !
 
   শুধু কী চিড়া-ভোগ, পৌষসংক্রান্তি অর্থাৎ মকরসংক্রান্তির সকালে হরিমন্দির বা হরিবাসরে পূজাশেষে বিতরণ করা হত ‘মকরভোগ’আতপচাল, গুড়, দুধ, নারকেল, রাঙাআলু আর ছাল-ছাড়ানো-আখের টুকরোছোটরা খেত বলে বাদ দেওয়া হত ভাঙ বা সিদ্ধি 
 
   সেই ‘চিড়া-ভোগ’  ‘মকরভোগ’-এর গন্ধ যেন এই খিদের মুখে ‘মহকে’ উঠছে নাকে ! “ছ্যা-অ্যাং ছ্যাং-চ্যাং” করে  এরা কী  শুধু পূজাচারের নামে খোল-কত্তালই বাজাবে ? চিড়াভোগ, মকরভোগ, কোনো ভোগই কি দেবে না ?
 
    বৈদিক পূজার্চনার চল ছিল,  এখনও আছেতাবলে বৌদ্ধদেরও কি  ‘দেবপৃজা’-র প্রচলন আছে ?  না  বোধহয়বুদ্ধই তাঁদের দেবতাবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব“বুদ্ধং শরণং  গচ্ছামি– ধর্মং শরণং গচ্ছামি  -সংঘং  শরণং গচ্ছামি —”
 
    তবে যে ঢাক-ঢোল-বাদ্য ? হ্যাঁ,  হ্যাঁ তাও একসময় বেজেছিল  বটে– ওই যখন  তাঁদের মধ্যে তন্ত্র-মন্ত্র এসে পড়ল খড়্গহস্তা,  খট্টাঙ্গা  পরশুহস্তা বজ্রহস্তা, ডাকিনী-যোগিনী, ইত্যাদির পূজার্চনা শুরু হলপাঁঠাবলি,  এমনকি নরবলিও হতে লাগল 
 
    একটু আগে– জানি, জানি–যে বাদ্যধ্বনি আমার কর্ণকুহরে শ্রুতিগোচর হচ্ছিল- তা তাঁদেরই  তাঁদেরই ‘চিড়াভোগ’  ‘মকরভোগ’  ‘ক্ষীরিভোগ’ -তারা আর পাবে কোথায় !
 
  রাগে, দুঃখে ও অভিমানে বিছানায় ফের গড়িয়ে পড়লাম বেলা আড় হয়ে গেছে সেই কখন ! এখনও আহারের সংস্থান হল না !
 
    ভিক্ষুরা নাকি একাহারীসারাদিন ভিক্ষা করে খায় !  সারাদিন ভিক্ষা করে যা সংগ্রহ হয়,  ‘পর্যোহ্নে’ তাই নাকি একত্রে রান্না করে খায় ! ‘মাগন’  থেকে এখনও কী  কেউ ফিরল না ?
 
    এঁরা কোন ভিক্ষু ? গৃহী ভিক্ষু  না জাত ভিক্ষু ? শুনেছি একশ্রেণীর ভিক্ষুরা নাকি  গুহ্যসিদ্ধির জন্য  মাছ-মাংস-মদ সবই খান “ হস্তীমাংসং হয়মাংসং শ্বানমাংসং  তথোত্তমম্   
 
   আমার বদ্ধমূল ধারণা হল— এই পোড়োগৃহ,  পরিত্যক্ত আবাসন—তাঁদের, তাঁদেরইসেই সমস্ত ভূতপ্রেতের উপাসকদেরই  যাঁদের পাল্লায় পড়ে আজ আমি পর্যুদস্ত ও নাস্তানাবুদ হচ্ছিএখন আর রাগ নয়,  কেমন যেন একটা অসহায়তা — তবু, তবু বলব রোমাঞ্চকর বোধ হচ্ছে–দেখিই না,  দেখি -কী হয়—
 
    পার্শ্বস্থিত পুষ্করিণীর জলেও এতক্ষণে অপরাহ্ণের রং ধরেছেরাঙা  রৌদ্রের মলিন ছায়া নেমেছে জলেজল ক্রমে বাতাসে তরঙ্গায়িত হতে হতে আলোড়ন পরিশেষে  কিনারায় মৃদুমন্দ শব্দে উপর্যুপরি আছড়ে পড়ছে  
 
    ছোট ছোট পাখি- জলপিপি-কাদাখোঁচা-পানকৌটি-ডাহুক-ফুটকি মাছরাঙারা -পুষ্করিণীর ধারে ধারে অগভীর ঝাঁজি-জলে যাহোক তাহোক করে ডানা ফেটিয়ে গা ধুচ্ছেঅবগাহন শেষে পরিপাটি হয়ে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আগেই ঝোপে ঝাড়ে তাদের বাসায় ঢুকবে 
 
   বাসায় ঢোকার আগ-মুহূর্তে বাসার মুখে উড়েঘুরে তারা ডাকতে থাকবে মুহুর্মুহু, যেন বা ‘ধর্মের ডাক’ দেবে –“কেউ যদি বহিরাগত বা শত্রুপক্ষের লোক আমার বাসায় ঢুকে থাকো, আমি ‘চেতাবনী’ দিচ্ছি -তুমি বেরিয়ে এসো !”
 
  পাখপাখালির বাসায় সাপখোপ তো হামেশাই ঢুকে থাকে ! পাখিদের চিল-চিৎকারে হয়তো বেরিয়েও আসেপাখির ডাকের সেই ‘চেতাবনী’ এই কক্ষের একশো ছয়তম ঘরে শুয়ে থেকেও শুনতে পাচ্ছি 
 
  তবে কী সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে এল ? “পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল ।।” কিংবা,  “পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি পাখির ডাকে জেগে ।”  সন্ধ্যায়-প্রভাতে– ওই দুবারই !  পাখির ডাকে ফুলও ফোটে 
 
আমাদের খলা-খামারের ধারে খেতিবাড়িতে তো বেলা থাকতে থাকতেই ঝিঙামাচানে রদোবদো করে স-ব  ঝিঙাফুল ফুটে যায় !
 
    এই পোড়োগৃহের খেতিবাড়িতে লাউমাচান কী ঝিঙামাচান নেই ?  সেখানে ভোরে কী সাঁঝবেলায় রদোবদো করে লাউফুল কী ঝিঙাফুল ফোটে না?  পাখি তো আছেইওই তো ওই –
 
    পারাবতগুলো গলা ফুলিয়ে “কঁহরাচ্ছে” !  তাদের ডাক শুনতে পাচ্ছি ডাক তো নয়, যেন টুলো পণ্ডিতের পাঠশালায়  ‘ব্যাকরণ কৌমুদি’-র  ধাতুরূপ শব্দরূপ মুখস্ত করছে !
 
    মনে হয়  একটা পারাবত অধ্যাপকসুলভ গমগমে গলায় শিক্ষা দিচ্ছে“ ন  হি  সুপ্তস্য সিংহস্য  প্রবিশন্তি মুখে মৃগাঃজননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সীসর্ব-মত্যন্তগর্হিতম্চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুঃখানি চ ছাত্রাণামধ্যয়নং তপঃ।”
 
   কে যেন দরজায় করাঘাত করলচমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম —
 
  —“ কে ? কে-এ-এ-এ ?”
 
   কোনও উত্তর এল নাআর কোনও করাঘাতও শোনা গেল নাতবে অনুমান হল -এই পোড়োগৃহ যদি সংঘই হয়,  তাহলে মাধুকরি থেকে ভিক্ষুদের প্রত্যাবর্তনের সময়কাল বুঝি সমুপস্থিত !
 
   যে কক্ষে আমার আপাতত অবস্থান, যার বিছানায় সাময়িক শুয়ে আছি, অনাহারক্লিষ্ট শরীরেও সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অপরাহ্ণ শেষের আমেজটুকূ উপভোগ করছি– সেই কী দরজায় করাঘাত করেছিল ?
 
   হবেও বাতার লণ্ডভণ্ড বিছানার দিকে চোখ রাখলাম খাটিয়া-তক্তপোষ  -কিছুই নেই মেঝেতেই খেজুরপাতার পাটিয়া বা চাটাই পাতাকোথায় যেন  পড়েছিলাম—

 
“ অয়ঃ পাত্রে পয়ঃ পানম্।
শালপত্রে  চ  ভোজনম্ ।।
শয়নম্ খর্জ্জুরী পত্রে ।
ঝারিখণ্ডৌ  বিধিয়তে ।। ”

 
   অর্থাৎ, মাটির ভাঁড়ে জল পান করা, শালের পাতায় খাওয়া, খেজুরপাতার পাটিয়াতে শোওয়া – এই ছিল ঝারিখণ্ডবাসীদের বিধিলিপি তবে কি এই অঞ্চল ঝারিখণ্ডের ? না, কজঙ্গল-দণ্ডভুক্তির ?
 
   বৈষ্ণব শাস্ত্রকার কৃষ্ণদাসকবিরাজ তাঁর  ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন –
 
                “ মথুরা যাবার ছলে আসি ঝারিখণ্ড। 
 
                            ভিল্লপ্রায় লোক তাঁহা  পরম  পাষণ্ড ।।”
 
    ঝারিখণ্ড— “ অরণ্য পর্বতাবৃতং দেশং  ঝারিখণ্ভ  খ্যাতং।”  প্রাচীন কালের রাঢ়া বা লাঢ়া,  রাঢ়ভূমিরাঢ়ীখণ্ড জাঙ্গলভূমি আলেকজান্ডারের সময়কালের গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাঢ়আর অশোকের অটবীরাজ্যপর্বত ও অরণ্যসঙ্কুলধর্ম প্রচারের জন্য এখানে এসেছিলেন পার্শ্বনাথ ও বর্ধমানপরবর্তীতে বুদ্ধদেব ও শ্রী-চৈতন্য 
 
     একটা লোকায়ত গানেই আছে— “খেজুর-মেজুর খাঞে বুড়ীর পেট ফাঁপিল।”  সত্যি সত্যিই এ তল্লাটে বুনো খেজুরগাছের আধিক্যপ্রায় ঘরে ঘরেই খেজুর- পাতার পাটিয়া এখানেও একটা ছেঁড়াখোঁড়া পাটিয়া দেখলামতবে,  গদি-তোষক-বালিশ-পাশবালিশের চিহ্নমাত্র নেই কয়েকটা ছেঁড়া কাঁথা অবশ্য আছে 
 
   ভিক্ষুদের ব্যবহৃত কষানো বা ছাপানো রক্তরঙা ধুতি-চাদর তো নেই ? 
 
   – নেই, নেই–
 
   কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, ঘোরতর সন্দেহ ! পোড়োবাড়িটা -যার মধ্যে ঈষৎ স্থূলকায়া পারাবতগুলো সংস্কৃত টোল খুলে বসেছিল, ‘কঁহরাচ্ছিল” – আছে তো ঠিক ? আছে তো ? 
 
 কিছুক্ষণ আগে পুষ্করিণী তটে যে সমস্ত স্নানরতা পাখিদের হর্ষোৎফুল্ল কলরব শোনা যাচ্ছিল – তারা বাসায় ঠিকঠাক ফিরল কি ?
 
   যে গো-শকট একটা আস্ত গ্রাম পরিক্রমা শেষে – যে গ্রামটির অবস্থিতি মনে হচ্ছিল নিম্নশায়ী জলাভূমিতে, যার একধারে অনেকগুলি নৌযোগ, নৌঘাট, যে ঘাটে ছোট-বড় নৌকো বাঁধা,  যে গ্রামের নাম হলেও হতে পারে ‘বলিকন্দর’ ‘বাল্লহিটঠা’ ‘ব্যাঘ্রতটী’ ‘খেদিবল্লী’ ‘কন্তেড়দক’ ‘নাদভদক’ ‘কুক্কুট’ কী ‘বিলকীন্দক’ – সেই গ্রাম, সেই গো-শকট, সেই মহেঞ্জাদড়োর ষাঁড় – সত্যি সত্যিই ছিল তো ?
 
    সবকিছুই কেমন যেন মরা মরা, পাংশুটে 
 
   অকস্মাৎ দেখি – দরজাটা ঈষৎ নড়ে উঠল যৎকিঞ্চিৎ ফাঁক হল সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে একে একে ঢুকে এল -শালপাতার থালায় ‘চিড়াভোগ’ – ‘মকরভোগ’ -মাটির গাড়ুতে জল –

 

১৭ 

 
   শুধুই কী শালপাতায় চিড়াভোগ, মকরভোগ আর মাটির পাত্রে জলপান? না, এ তো গেল ঠাকুরপূজার প্রসাদ“ প্রসাদং সত্যদেবস্য ত্যক্ত্বা দুঃখমবাপ  সঃ –”
 
    সিদ্ধিপ্রসাদ, ক্ষীর, মালা, প্রসাদান্ন, গুরুর ভুক্তাবশেষ, ইত্যাদি“ যাবৎ না খাইবে তুমি  প্রসাদ আসিয়া –”তারপরই তো মহাভক্ষণ !!
 
    আহা ! কী-ই না খেলাম !! ভাত তো ভাত, ‘কুড়কুড়িয়া’ ছাতুর তরকারি, ‘বাঁশকরোল’-এর মাংস, মায় মিহিদানার মতো কাঁচা কাঁকড়ার ডিম আর পোস্ত-পোড়ার মতো ‘কুরকুট-পোড়া’ –
 
    সেই যে ডিমওয়ালা লাল লাল ডেঁয়ো-পিঁপড়ে ! সাদা ভাতের মতো ডিমনোড়া দিয়ে শিলে বেঁটে সামান্য নুন মাখিয়ে পোস্তপোড়ার মতো কাঁচা  শাল-পাতায় মুড়ে আগুনে ‘ধুড়সে’ নেওয়া ! 
 
    বাংলাভাষার খবরের কাগজগুলো তো হামেশাই খবর পরিবেশন করে :
 
                  “ মেদিনীপুরের অনাহারক্লিষ্ট লোধারা 
 
                   পিঁপড়ের ডিম ভক্ষণ করিয়া উদরপূর্তি করে ।”
 
     বাবু রে ! বনে-ঝাড়ে ‘কুরকুট-পটম’ অর্থাৎ ডিমওয়ালা লাল লাল ডেঁয়ো পিঁপড়ের পোঁটলা দেখলে আমাদেরও জিভে জল আসে যে !
 
     তাবলে এই পোড়োগৃহের, ‘লা সিট্টা ইনভিজিবিলি’, অলক্ষ্য জনপদের মানুষজনও এইসমস্ত আহার্য খায় নাকি ?  খায় খায়, নচেৎ সংগ্রহ করল কী করে ? নাকি আমাকেই তুষ্ট করতে ?
 
     যাঁদের কথা ভাবছি, তাঁরা যদি এঁরাই হন, তবে তো তাঁদের ‘সংঘ-ভোজন’-ও আছেআমাকে তাহলে একা একা নিরালায় বসিয়ে এতসব আহার্য খেতে দিলেনই বা কেন ?    
 
     ভিন্ন জাতগোত্রের, তদুপরি আগন্তুক বলে ? নাকি ‘দ্বিজত্ব’–এর মতো এখনও গোত্রান্তর হয়নি, তাই ? 
 
     শুনেছি, সাত ইঞ্চি উঁচু পিঁড়ির উপর উবু হয়ে বসে তাঁরা খানদুটো পিঁড়ি, অর্থাৎ দুজনের মাঝখানে অন্তত একফুট জায়গা ফাঁকা থাকেতাবলে ব্রাহ্মণদের মতো ছোঁয়াছুঁয়ি নেইপঙক্তি ভোজন হলেও যার পাতে যখন যেমন পড়ে, তাই তাঁরা হাপুস হুপুস শুরু করে দেন খেতে 
 
     একবার তো নাকি প্রায় তের হাজার ‘পাত’ পড়েছিল একসঙ্গে ! তখন আর সাত ইঞ্চি উঁচু পিঁড়ি কোথায় ! চাদর বিছিয়ে খাওয়া ! একসুতোও ফাঁক নেই, চাদরের উপর চাদর – এ যেন সেই এক ‘আরব্য উপন্যাস’-এর  ‘গালিচা’ !
 
—“ গালিচাটা এমন ত কিছু বেশী সুন্দর
নয় যে, ত্রিশহাজার টাকা দাম হাঁকছ ?”
ফেরিওয়ালা হোসেনকে বণিক মনে করিয়া
বলিল, “মশাই এই দামটাই অসম্ভব বোধ
হচ্ছে ? তাহলে একথা শুনলে না-জানি কি
বলবেন যে নগদ ত্রিশহাজার টাকা হাতে না
পেয়ে গালিচা ছাড়া বারণ ! ”
হোসেন বলিলেন, “ তবে নিশ্চয় এর কোনো
গুপ্ত গুণ আছে ।”
ফেরিওয়ালা বলিল, “ আপনি ঠিক ধরেছেন
ত ! এ গালিচায় বসে যে যেখানে যেতে চায়
তখনি সেখানে যেতে পারে।”

 
    সেই চাদরটাও যেন তাইভাত তরকারি পরোটা লুচি -মূলো সিদ্ধ, ডাল – চাদরে একের পর এক পড়ছে তো পড়ছেইআর তাঁরা খাচ্ছেন তো খাচ্ছেনইছোঁয়াছুঁয়ি নেই, আগে পড়া পিছে পড়ার বাছ-বিচারও নেই 
 
    শুধু কী খাদ্য, চাদরে উড়ে এসে জুড়ে বসছিল – ট্যাঁকের কড়ি, এলাচ, লবঙ্গ, চাল, সুপারিখাদ্য তো জুটলই, সঙ্গে আবার জুটল চাদর-গোটানো কিছু নগদানগদি, যজমানদের দেওয়া দানসামগ্রী !
 
    যাহোক, অবশেষে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলবাইরের আলো নিভে এলশুধুমাত্র দিকচক্রবালে অস্তগামী সূর্যের লাল আভাটুকু মন্দের ভালো এখনও জেগে থাকলজেগে আছে, কিন্তু সেটুকুই বা আর কতক্ষণ ? এই নিভল বলে !
 
    তবে এবারই ঠিক বুঝা যাবে – এই পোড়োগৃহে অদৃশ্য মানুষজনেরা আদৌ বসবাস করে কীনাপ্রতিটা কক্ষে ভাঙাচোরা দীপাধার বা কুলুঙ্গি দেখেছি বটে, এই, এই তো এঘরেও একটি বর্তমান 
 
      এক্ষণে দেখার –“ যেন দীপে দীপ জ্বলে ”কিংবা, “ আমার এ ঘরে আপনার করে গৃহদীপখানি জ্বালো।” 
 
      যদিও এখন ঝুঁজকো অন্ধকার,  আলো ক্রমে কমে আসছেএই সময়টায় আমাদের গ্রামে হলে– গোঠ থেকে গরুগুলো গোহালে ফিরেছে , জরিলাল তাদের ‘তাড়’-এ ভাতের ফেন আর খড়ের কুচি গুলে ‘জাবনা’ দিচ্ছে,  মা-কাকিমারা মশা আর ডাঁশ তাড়াতে ধুনো  জ্বেলে ধোঁয়া দেওয়ার উদযোগ নিচ্ছে !
 
    ছোটকাকিমা খলা-খামারে তুলসীচৌরায় প্রদীপ জ্বেলে গলায় শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে শাঁখ বাজিয়ে ‘সঞ্ঝা’ দিলচল্লা-পাকুড়-আশ-শ্যাওড়ার ডালপালার ফাঁক- ফোকর দিয়ে হিজল-বিঝল তারাদের ভিতর থেকে সাঁঝতারাটিকে গড় করল 
 
    নকুলজেঠু দাওয়ায় বসে ‘ঢেরা’ ঘুরিয়ে শনের দড়ি পাকাচ্ছিলতার সাদা চুল সাদা দাড়ি সাদা ভ্রু শনের ভুরভুরে আঁশে আরোই সাদা হচ্ছিলঝুঁজকো অন্ধকারে আর কিছুই ঠাহর হচ্ছে নাঢেরা তাই বন্ধ রাখল 
 
    সরকারি পাতকোতলায় ঘড়রি ঘুরিয়ে জল তোলার হিড়িক পড়ে গেছে বউড়িদের মধ্যেবেলা যে পড়ে যাচ্ছে ! কুয়োর ভিতর দড়ি-বালতির “ধাস্” “ধাস” আওয়াজগুঞ্জন চরমে উঠেছে  
 
    এসবই ‘ঝুঁজকোব্যালা’-র আখ্যান-উপাখ্যানসন্ধ্যা হয়ে আসা আর ঊষার প্রাক্কালএইমুহূর্তের অন্ধকারই তো ঝুঁজকো অন্ধকার 
 
   কিন্তু এহেন পোড়োগৃহে যেন কোনও নিয়মকানুনের বালাই নেই ! এই তো এখনই কে যেন একপোঁচ কালি ঢেলে দিল চারধারে “কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধ- কারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল…”
 
     এতক্ষণে ভয়ই ধরল আমারমষীকৃষ্ণ অন্ধকারে কারা যেন ভিতরে ও বাইরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছেফিসফিস করে কথা বলছেকে সে ? কারা তারা ? 
 
     ঝিলের জলও তরঙ্গ তুলে কেঁপে কেঁপে উঠছেজলোচ্ছ্বাসের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছেমনে হচ্ছে পারাবতগুলোও হঠাৎ হঠাৎ ভদকে উঠে ডানা ফেটিয়ে উড়ে  গেল বাইরেএই ঘনঘোর অন্ধকারেও তারা আকাশে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে !
 
   আশ্চর্য ! তারমধ্যেও কেউ কী এসময় খঞ্জনী বাজিয়ে এই “বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনী ”-তে গান ধরল ? নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গই বা আর থাকল কী করে ? এ যে “কোলাহলতাড়িত বাতক্ষুব্ধ” !!
 
   খঞ্জনী না করতাল? করতালধ্বনি ? “ চ খ  চ খ তালধ্বনি করতালে ।”  কে যেন গাইছে – 
 
“ মাধব, বহুত মিনতি করি তোয় ।
দেই তুলসী তিল     এ দেহ সমর্পিল
দয়া জনু ছোড়বি মোয়ো ।।
গণইতে  দোষ গুণ     লেশ না পাওবি
যব তুহুঁ করবি বিচার ।
তুহুঁ  জগন্নাথ        জগতে কহাওসি
মু  জগ বাহির নই ছার ।। ”

 
   স্পষ্ট শুনছিআরে, এ তো বিদ্যাপতির পদাবলী কীর্ত্তন !  এ পদ ক-ত শুনেছি ! আমাদের গ্রামের উপান্তে ‘নুয়াসাহি’ বলে আরেকটা গ্রাম আছেসে-গ্রাম আদিবাসী অধ্যুষিত হলেও চারুবোষ্টুমী ও তার পরিবার সেখানে বাস করেনজাতিতে তাঁরা বৈষ্ণব 
 
রোজদিন সন্ধ্যায় তাঁদের ‘আখড়া’ বসে “অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়াচক্ষুরুম্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে     নমঃ ।। হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো  দীনবন্ধু জগৎপতে গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে ।। ” -এই বলে বন্দনা করে তাঁরা ‘হরিনাম সংকীর্তন’ শুরু করেন 
 
     চারুর মেয়ে গিরিবালা যেন শ্রীরাধিকাকীর্তনের আখর, পাঠ কিছুই জানি না, বুঝি নাতবু তার কন্ঠে গাওয়া কীর্তন আর সেই শ্রীখোলের বোল,  “গুড় গুড় গুড় গুড় ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ  তেত্তা  – খিটিতা  খিতা তেত্তা তেত্তা” যেন কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে যেত !
 
    কান খাড়া করে সজাগ হলাম কেউ কী খঞ্জনী বাজিয়ে গিরিবালার গাওয়া সেই গানটাই গাইছে এখন ?  ওই যে—
 
“ ও শারী তুই দে গো সাড়া  –
সুখের নিশি হল সারা  -ও শারী তুই দে গো সাড়া  –
নইলে শারী হবে সারা,  যদি শাশুড়ি ননদী  দেখে তারা
ও শারী  সব হবে সারা । ।…”  

 
    না না,  কোথায় কি !  এ তো শুভঙ্করের  ‘আর্য্যা’  কেউ ‘শিশুবোধক’ থেকে  বিড় বিড় করে মুখস্ত বলছে ‘সের কসা’ । 
 
“ তৈল লবণ ঘৃত চিনি যাহা কিনিতে যাবে ।
তঙ্কা প্রতি মণ হইলে সের কত  লবে ।।
আনা প্রতি কত হবে গণ্ডায় কত লবে ।
কড়া প্রতি কি ধরিবে  স্থির করিতে হবে ।।
ইহার  নিয়ম  কিছু  শুন  শিশুগণে ।
টাকায়  অষ্ট  গণ্ডা  সেরে লইবে যতনে  ।। …”

 
        পরক্ষণেই মনে হল,  উঁহু,  ‘সের কসা’  তো নয়,  কে বা কারা যেন বুদ্ধদেবের কথামৃত পাঠ করছে —

 

১৮ 

 
        দীপাধারভাঙাচোরা দীপাধার দেখেছি বটে 
 
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ লেখে যে, “ দীপ পুং, যাহা দীপ্তি পায় বা গৃহাদি দীপিত করে; জলদবর্ত্তি, প্রদীপ।”
 
     কিন্তু সে দীপ বা প্রদীপ জ্বলে কীসে,  তার তো কোথাও উল্লেখ দেখিনা‘পঞ্চতন্ত্র’-এ আছে –
 
                 “ ণৃপদীপো ধনস্নেহং প্রজাভ্যঃ সংহরন্নপি । 
 
                  অন্তরস্থৈগুর্ণৈঃ শুভ্রৈলর্ক্ষ্যতে নৈব কেনচিৎ ।।”
 
        ণৃপ-দীপের কথা আলাদাদরকার হলে প্রজার চর্বি দিয়েও রাজার আলো জ্বলতে পারেপাহাড়পুর ও ময়নামতীতে পাওয়া মাটির ফলকে দীপাধার, পুস্তকাধারের প্রতিকৃতি আছেতাবলে তৈল, ঘৃত, ইত্যাদি তৈজস ? 
 
     ঘিয়ের কথা তো আছেই ! আছে না –“ওগগরা  ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা ? ” ঘিয়ের প্রদীপ তো এখনও বর্তমান ! তাছাড়া নাড়িয়েল, কুসুম, কচড়া, নিম, রেড়ী, তিল, তিসি, সরিষা থেকেও তেল হত । 
 
       এখনও হয় । 
 
        গন্ধতেল মাখানো চকচকে কেশদাম, তাই নিয়ে মাথার উপর ‘শিখণ্ড’ বা চূড়াবাঁধা, তাতে আবার ফুলের মালা গোঁজা, কানে নবশশিকলার  মতো ঝক- ঝকে তালপাতার ‘কর্ণাভরণ’ বা কানপাশা 
 
     ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-য়েই তো আছে— 
 
               “ বাসঃ সূক্ষ্মং বপুষি ভুজয়ো কাঞ্চনী চাঙ্গদশ্রীর্ । 
 
                          মালাগর্ভঃ সুরভি মসৃনৈগন্ধর্তৈলৈঃ শিখণ্ডঃ ।। 
 
                          কর্ণোত্তংসে  নবশশিকলানির্মলং  তালপত্রং । 
 
                          বেশং  কেষাং ন হরতি  মনো  বঙ্গবারাঙ্গনাম ।। ”
 
        রেড়ির তেলের কথা তো এই সেদিনও পড়েছি শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’-এ 
 
                    “ সেদিনটা আমার খুব মনে পড়ে সারাদিন অবিশ্রান্ত 
 
              বৃষ্টিপাত হইয়াও শেষ হয় নাই শ্রাবণের সমস্ত আকাশটা  
 
              ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া আছে,  এবং সন্ধ্যা উত্তীর্ণ 
 
              হইতে না হইতেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে 
 
              সকাল সকাল খাইয়া লইয়া আমরা কয় ভাই নিত্যপ্রথামত 
 
              বাইরে বৈঠকখানার ঢালা-বিছানার উপর রেড়ির তেলের 
 
              সেজ জ্বালাইয়া বই খুলিয়া বসিয়া গিয়াছি…”
 
        রেড়ি, তারমানে তো ভেরেণ্ডা গাছের ফল থেকে তৈরি তেল ! মশাল বা মোশাল বোধকরি ততোধিক প্রাচীন কাঠিতে জড়ানো তেলমাখা ন্যাকড়ার বাতি বিশেষ 
 
    “মোশাল ধরিল বীরগণ ” কিংবা,  “থাবায় থাবায়, মশাল নিবায় ” 
 
   — সে না হয় হল, কিন্তু মশালের তেলই বা কীসের তেল ? এই পোড়োগৃহের কি সংঘারামের ভাঙাচোরা দীপাধারেই বা রেড়ির না ঘিয়ের মশাল জ্বলে উঠবে -সেইটা এখন দেখার !
 
    পল, দণ্ড, মুহূর্তের পর মূহূর্ত কেটে যাচ্ছে, ইত্যবসরে অন্ধকারাত্মক রাত্রি আরোই যেন ঘনসন্নিবিষ্ট হয়েছেচোখের সামনে হাতের আঙুল তুলে তুলে দেখছি – দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না । 
 
    ঝুম্ ঝুম্ করে কোথাও অন্ধকারে নূপুর বাজছেকে যেন নাচছে, কে যেন গাইছে ! ত্রিতাল, ছোট-খেয়ালগান-টানের আমি কিছুই বুঝি না তবু শুনতে পাচ্ছি –
 
                    “ আব না করো মূসে রার কাহ্নাইয়া 
 
                             ছোড় না মোহে কর কর বাতিয়াঁ । 
 
                                  চালি  যাত  সব  যমূনা  তটপর 
 
                                              রোকো  না মোকো শ্যাম  কাহ্নাইয়া  ।। ”
 
এ কিরে বাবা ? কখনও বিদ্যাপতি কখনও রাধারতি ! তার উপর তমিস্রাঘন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারবাতিহীন, বাতিহীনসবকিছুই কেমন যেন ঘুলিয়ে দিচ্ছেপোড়োবাড়ি,  না  তার হানাবাড়ি ? সংঘারাম,  না তার ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনও রাজ- প্রাসাদ ? 
 
     ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ  পড়েছি বটে সেই যে সেই—
 
               …“ সেইদিন  অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া  বসিয়া 
 
               শুনিতে পাইলাম  কে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া,  বুক ফাটিয়া 
 
               ফাটিয়া কাঁদিতেছে  -যেন আমার খাটের নীচে,  এই বৃহৎ 
 
               প্রাসাদের পাষাণভিত্তির তলবর্তী একটা আর্দ্র অন্ধকার গোরের 
 
               ভিতর হইতে কাঁদিয়া  কাঁদিয়া বলিতেছে,  ‘তুমি আমাকে
 
               উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও— কঠিন মায়া,  গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল 
 
               স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া,  তুমি আমাকে ঘোড়ায় 
 
               তুলিয়া,  তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের ভিতর 
 
               দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের 
 
               সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও আমাকে উদ্ধার 
 
               করো ।”
 
    সেই রাত্রে সারঙ্গীর সংগীত, নূপুরের নিক্কন কী আর বাজেনি ? সুবর্ণ মদিরার মধ্যে মধ্যে ছুরির ঝলক –
 
  আমাদের এদেশেও সেরকম রাজপ্রাসাদ তথা রাজা-রাজড়া বড়ো কম ছিল নামহাভারতের যুগ থেকেই তো তাম্রলিপ্ত রাজবংশ – ময়ূরবংশীয় ময়ূরধ্বজ, তাম্রধ্বজ, হংসধ্বজ, গরুড়ধ্বজ  
 
  তস্য তস্য পরবর্তী কৈবর্ত রাজারা – কালুভুঁইয়া, জঙ্গলভুঁইয়াশুধু কী তাম্র- লিপ্ত বা তমলুক, কাশীজোড়া, চন্দ্রকোণা, নাড়াজোল, মহিষাদল, চিল্কিগড়, কর্ণগড়, নারায়ণগড়, চন্দ্রকেতুগড় – আরও কত ক-ত যে গড়, রাজ্য, রাজ- বাড়ি ! তারপরেও শক-হূনদল-পাঠান-মোগল ! 
 
   মালজেঠিয়া নামের একটি গড় ছিল এই তো কাছেই “ মালঝাটা গড় বন্দ মহলা রুক্মিণী ১৬ শো রাখাল খেয়ে সেজেছে ডাকিনী ।।” গড়ের  অদূরবর্তী একটি গো-চারণের প্রান্তর ছিলপ্রান্তরের মধ্যস্থিত একটি পুরাতন প্রস্তর ছিল। 
 

পূজা শেষ হল। এবার বলিদান – নরবলি ! কনিষ্ঠতম গো-রাখালটি অনিচ্ছুক পুংছাগের মতো ‘অর্গলা’-য় অর্থাৎ যূপকাষ্ঠে মাথা রাখল। বলিদার বা হন্তারক বাগালছেলেটি একটি শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আলতো ভাবে খড়্গাঘাত করল তার ঘাড়ে ! কী হৃদয়বিদারক মর্মন্তুদ কাণ্ড !! আলতোভাবে শুষ্ক কাষ্ঠাঘাতেই গো-রাখালটির মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে গেল, রক্ত ছিনছাতুর হয়ে চারধারে ছড়িয়ে পড়ল।  

 
   প্রাচীন প্রস্তর,  বোধকরি মাকড়াপাথরই হবে, আর এ জাতীয় পাথর পড়ে থাকলে যা হয় – ক্লান্তশ্রান্ত রাখাল বালকেরা বসে দুদণ্ড বিশ্রাম করেচাই কি, গরুগুলিকে নিশ্চিন্তে চরতে দিয়ে পাথরের উপর গামছা পেতে খানিক ঘুমিয়েও নেয় 
 
   দৈবাৎ একদিন রুণ্ডু-উরুণ্ডু গরু-বাগালদের মধ্যে ভক্তিভাবের উদয় হলতারা পাথরটিকে জলে ধুয়ে-পুঁছে  দেবীজ্ঞানে পুজোও শুরু করে দিলতবে সব- কিছুই খেলাচ্ছলে হা-ডু-ডু, ছো কিত্ কিত্ তো নয় – পুজো করতে হলে ব্রাহ্মণ চাই, ক্ষৌরকার চাই, ঢাকী-বাজনদার চাই, বলিদার চাই –
 
   সাকুল্যে ষোলজনতাদের মধ্যেই কেউ ব্রাহ্মণ সাজল, কেউ ক্ষৌরকারকেউ আবার নকল ঢাকী সেজে “ডু-ডু-ম্”  “ডু-ডু-ম্” করে বাজাতে লাগলবলিদারও সাজল, কিন্তু বলি কোথায় ? 
 
   আসল কী আর, নকল নকলগরু-বাগালদের খেলা – খেলাই তো ! অবশেষে দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ জনই ‘বলি’ সাজল শুরু হল পুজো –“ অং বং চং” “ অং বং চং” করে মন্ত্রও উচ্চারিত হলভক্তিসহকারে বাজনাও বাজতে থাকল – “ ডু-ডু-ম্ ডু- ম্ ” ! “ ডু-ডু- ম্ ডু-ম্ !!”
 
  পূজা শেষ হলএবার বলিদান – নরবলি ! কনিষ্ঠতম গো-রাখালটি অনিচ্ছুক পুংছাগের মতো ‘অর্গলা’-য় অর্থাৎ যূপকাষ্ঠে মাথা রাখলবলিদার বা হন্তারক বাগালছেলেটি একটি শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আলতো ভাবে খড়্গাঘাত করল তার ঘাড়ে !
 
  আর কী আশ্চর্য ! কী হৃদয়বিদারক মর্মন্তুদ কাণ্ড !! আলতোভাবে শুষ্ক কাষ্ঠাঘাতেই গো-রাখালটির মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে গেল, রক্ত ছিনছাতুর হয়ে চারধারে ছড়িয়ে পড়ল 
 
  এহেন অদ্ভুতুড়ে দৃশ্য দেখামাত্রই বাকি বাগালরা ভয়ে-ত্রাসে যে যেখানে পারল লুকিয়ে পড়লগরুগুলো  “হাম্বা” “ হাম্বা” রবে কীসব বলতে বলতে ঘরে ফিরল। 
 
  সন্ধ্যা সমাগত হলতবু গো-রাখালরা ফিরল না দেখে ‘গিরিহা’ বা গৃহ- স্বামীরা ‘ভাতুয়া’-দের খোঁজে গো-চারণে গেল   – খোঁজ – খোঁজ –
 
  গোচারণের মাঠে পৌঁছে তারা দেখল – নেই , নেই কোনও গো-বাগালই সেখানে নেইকেবলমাত্র একজনেরই ধড়-মুণ্ড আলাদা হয়ে পড়ে আছে আর  রক্তে লাল হয়ে আছে জায়গাটা 
 
  এখবর শোনামাত্রই চারধারের গাঁ-গঞ্জ থেকে ধাঁ ধাঁ করে লোকজন দস্তুরমতো আসতে লাগলসেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তারাও হাহাকার করে উঠল গো-চারণের মাঠ, লাটাপাটা, মায় বন-প্রান্তরও যেন হাহাকারে ভরে গেলতারাও দমকে দমকে কাঁদছে – কাঁদছে অঝোরঝরে –
 
             “ কাঁসা-ভাঙা পেতল-ভাঙা সবই জোড়া যায় । 
 
               মানুষ ম-র-লে আর নাইকো জোড়া যায় ।।”
 
     কিন্তু গৃহে ফিরে গৃহস্থরা দেখল– যেমনকার তেমন ! সবই তো ঠিক আছে সমস্ত বাগালরাই তো ঘরে ফিরেছে ! পোড়ামাটির ‘তাড়’-এ তারা জাবনা গুলে ওই তো গরুগুলোকে খেতে দিচ্ছে 
 
    এমনকি গোচারণের মাঠে তারা যে গো-রাখালটির ধড়-মুণ্ড আলাদা আলাদা দেখে এসেছিল— সেও তো এখন তার ‘গিরিহানী-র নির্দেশমতো  গোহালে ঘুঁটে পুড়িয়ে ধোঁয়া দিচ্ছে !
 
    এমন অলৌকিক কিত্তিকাণ্ড তথা  ‘কাটা মুণ্ড জোড়া  লাগা’-র ঘটনাটা অবশেষে কানে গেল মালজেঠিয়া গড়ের রাজা রুক্মের তিনি দেবীজ্ঞানে পাথরটির প্রতিষ্ঠা  করে নাম রাখলেন  ‘দেবী রুক্মিণী’আর গোচারণের মাঠ হল  ‘রাখালদ্বীপা’। 
 
  আজও সে রাখালদ্বীপা আছে, আছে সেই পাষাণ প্রতিমাতবে সে রাজাও নেই, সেসব দিনও আর নেই ! দেবীর কাছে নরবলি দিতে না পারায় রাজাকেই নাকি দিতে হয়েছিল আত্মবলিদান !!
 
  এমনি কত শত কাহিনী যে গুমরে গুমরে কাঁদে  গুমাইগড়,  রুক্মিণী কুণ্ড, শোণিত কুঠিতে ! গাংড়ার বনবাশুলী, ৺দধিমাধব জীউর মন্দির, সিঁদুরটিকার মঠে ! সেই বলে না –
 
“ There happen more things
In heaven and earth, Horacio,
Than are reported in your newspapers.”

 
    অকস্মাৎ আলো জ্বলে উঠলদীপাধারে দীপ না, মশাল জ্বলল ? বন্ধ দ্বারের অভ্যন্তরে থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না তবু দ্বারের নিম্নতলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে যে আলো, আলো না বলাই ভালো, যেটুকু আলোর আভাস এল তাতে করে এটুকু বলাই চলে – আলো জ্বলেছে। 
 
   তদুপরি কোলাহল উঠেছেতারমানে, লোকজন আছেআছে, আছেলোক- জন না থাকলে কোলাহল কোত্থেকে আসে? মনুষ্য না থাকলে আলোই বা জ্বলে কী করে? তাছাড়া, অতসব খাবারদাবার –
 
   আমি অতঃপর ভারি তদগত হয়ে মনুষ্য কোলাহল শুনতে সচেষ্ট হলামশোনা যাচ্ছে কী, সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে কী –“ বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি ? ”
 
   বারে বারেই বা এমনটা কেন হবে ? আশপাশে দাঁতনে, মোগলমারিতে সদ্য সদ্য মাটি খুঁড়ে বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে বলেই কী সেই ‘তাঁহাদের’ কথাই স্মরণে  আসছে বেশি করে ?
 
   হবেও বানচেৎ তাঁরা তো অহিংসার পূজারী, এসব হিংস্র কাজে জড়াবেন কেন ? তাছাড়া, একটু আগেই তো অন্যরকম – যেমন ‘পদাবলী’  গিরিবালার  ‘বালক-সংগীত’, মায় শুভঙ্করের আর্য্যা ‘সের কসা’,  এমনকি “আর না করো মুসে রার কাহ্নাইয়া” রাধারতিও শুনছিলাম 
 
   হঠাৎ দরজা খুলে গেল হাট করে ! কে যেন দীপাধারে একটা জ্বলন্ত দীপও রেখে গেল !  তার শিখায় এখন ১০৬ নম্বর  দাগামারা ঘরটি যথেষ্ট আলোয় আলোকিত 
 
     আমি ঈষৎ উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম—
 
  -“ কে ? কে ? কে তুমি ? ”
 
   যেতে যেতে পিছন ফিরে সে যেন মুচকি হাসলকোনও উত্তর দিল নাকিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল, কেমন যেন – ঠিকঠাক দেখেছি তো ?
 
   উঠে গিয়ে আবারও যে খুঁটিয়ে দেখব – তারও সর-অবসরটুকু পাওয়া ভারি দুষ্কর হলকেননা তন্মুহূর্তেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল ধড়াস্ করে !
 
   আলো ছিল নাঘরভরতি অন্ধকারহঠাৎ আলো এসে সবকিছুকেই ধাঁধিয়ে দিল, ঝলসে দিলআমার চোখদুটিও তেমনটা হয়ে থাকবে বোধকরিতাই কি দেখতে কি দেখে ফেলেছি, মাথামুণ্ডহীন !!
 
   সময় সময় এমনটা হয়আমাদের জাহাজকানার জঙ্গলেই তো হয়হয় না ? হঠাৎ হঠাৎই ঝলসে ওঠে জাহাজের কানা !
 
   বানিজ্যযাত্রায় বেরিয়ে শ্রীমন্ত সওদাগর তো সমুদ্রবক্ষেই আচমকা দর্শন করেছিলেন ‘কমলে কামিপী’ – কমলে আসীনা কামিনীরূপিনী চণ্ডী !! “ বঙ্গ- হৃদ-হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী ।”  কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কবিতা – 
 
                   “ কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে 
 
                    কালীদহেবসি বামা শতদল-দলে 
 
                   ( নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে 
 
                    মনোহারি) বাম করে সাপটি হেলনে 
 
                    গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে 
 
   ‘মনসা মঙ্গল’-য়েই তো আছেচাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা তৈরি হল, নাম তার ‘মধুকর’ মধুকর কালীদহের জলে ভাসান শুরু করবে – তার আগে “ কলীদহের বালিচরে কত তাল জল ” – পরিমাপ করতে হবে ডাক পড়ল ‘ডুবারু’-দের । 
 
    কে কতক্ষণ জলের তলায় একডুবে থাকতে পারে ? তার পরীক্ষা  
 
   চাঁদ সওদাগরের সামনে তাই নিয়ে অভিজ্ঞতার বাখানএ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ ! রীতিমতো কমপিটিশন, কমপিটিশন ! গঙ্গা, বোনা, জয়, রামেশ্বর, তোতারাম, সিতা, জিতা – সব বাঘা বাঘা মাঝির দল !
 
                “ গঙ্গা বোলে ‘ মহাশয়, করি নিবেদন 
 
                 এক ডুবে থাকিতে পারি দিবস কত্তন ।।
 
                 বোনা মাঝি বোলে আমি জগাই-সন্তান 
 
                 এক ডুবে ছয়মাস থাকে কোন বস্তুজ্ঞান ।।
 
                 আসি জয় মহাশয় বোলে, ‘নাহি হীন । 
 
                 এক ডুবে বৎসর কাটাই বরং চারিদিন ।।
 
                 রামেশ্বর মাঝি বলে সুদামের জ্যাঠা 
 
                 ‘ডুব দিয়া তলায় না পড়ি যেন লৌহভাটা ।।
 
                 তোতারাম কিঙ্কর দুলাল জয়হরি 
 
                 আমরা, একডুবে থাকিতে পারি ছয়মাস বৎসরি ।। 
 
                 সিতা জিতা বোলে, শুন, পাহাড়ী 
 
                 এক ডুবে জনম কাটে লেখাজোখা কি ।। ”
 
   আরে ! জলের তলায় একডুবে আমিও তো ছিলাম একরাত্রি অর্ধেক দিবসযেখানে গঙ্গামাঝির মতো মাঝির একডুব-স্থিতিকাল বড়জোর একটা দিবস। 
 
   যাহোক, যা দেখেছি তা নিজেরই ভ্রম বলে মনে করলামদীপাধারের দীপের আলোয় অতঃপর ধাতস্থ হয়ে আবারও ঘরের চারধারটা দেখতে লাগলামসেই পোঁটলায় বাঁধা কতক কাপড়চোপড়, ছেঁড়া কানি, তোষক- বিছানা –
 
   দেখতে দেখতে কেন জানি আবারও মনে হল – এই পোড়োবাড়ি তাঁদেরই, সেই সমস্ত শিক্ষার্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণেরই  সেই স্টাকো, সেই ভাঙাচোরা মূর্তি –
 
   সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছেমাধুকরীর ভিক্ষান্ন থেকে প্রস্তুত আহার্যও গৃহীত হয়েছেদীপাধারে দীপও জ্বলেছেএবার তো –
“ ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ
। ”
 
   হয়তো এক্ষুনি বৌদ্ধ শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা দীপাধারের আলোয় অধ্যয়ন শুরু করবেকেউ পড়বে ‘সূত্তপিটক’  কেউ বা ‘বিনয়পিটক’ আর কেউ ‘অভিধর্ম- পিটক’ আবাসন গৃহ, অলিন্দ, কক্ষ, দ্বার, গবাক্ষ মায় উঠোন পাঠোচ্চারণে  নিনাদিত হবে – “ উচ্চ উঠাঅন বিমলঘরা, তরুণী ঘরিণী বিনঅপরা ” –
 
   সহসা বন্ধ দরজা আবারও খুলে গেল ! কে যেন কক্ষে ফের হুটমুট প্রবেশ করলমনে হল, ১০৬ তম কক্ষটি তাঁরই, তাঁরই মাথায় পরা ‘হেলমেট’-এর মতোই কী একটা মাথা থেকে খুলে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল, অবিকল গৃহ- কর্তার মেজাজেই 
 
  এবার লোকটাকে সামনাসামনি পরিষ্কার দেখলাম – স্পষ্টতই ‘মাথামুণ্ডুহীন’ –  ওদিকে এইসময়ই যুগপৎ শুনতে পাচ্ছি – না না, ‘সূত্তপিটক’ কি ‘বিনয়- পিটক’ নয়, কেউ কোথাও যেন ‘টাকার খত্ লিখিবার ধারা’ সুর করে মুখস্ত করছে –
 
                   “ মহামহিম শ্রীযুক্ত রামজয় চট্টোপাধ্যায় 
 
                                   মহাশয় বরাবরেষু ।। 

 

                                লিখিতং শ্রীকমলকৃষ্ণ ঘোষ কস্য কর্জ্জপত্রমিদং 
 
                    কার্য্যঞ্চাগে আমি মহাশয়ের স্থানে  মবলগে কোং 
 
                                সিক্কা  ৩২৲ বত্রিশ টাকা কর্জ্জ করিলাম ইহার সুদ 
 
                                ফিঃ  টাকায়  মাসিক দস্তুর দরমাহ দিব টাকার 
 
                                ওয়াদা মাহ  চৈত্র সুদসমেত…”
 

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৫

ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৫


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!