- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান । পর্ব ১২
এই মানুষেরা, মাটি হারানো , স্বজনহারা, মুসলিম লিগের দ্বিজাতি তত্ব, ও হিন্দু নেতাদের বিভ্রান্তি ও গোপন প্রশ্রয়ের শিকার । তবু কই এদের তো জাতিদ্বেষ নেই ! যদি থাকতো, তবে মুসলমান সে, তাঁরই হাত ধরে সেই বৃদ্ধ এই খেদ করবে কেন ! একটা সত্যের রেখা যেন তার চোখে ভেসে উঠছে । মুসলমানেরা যে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে সেটা ওদের কাছে অবিশ্বাস্য... তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
।। ছ্যাতলাকান্ড ।।
উদ্বাস্তুগনের প্রতি বাস্তুহারা সংগঠনগুলির সংযুক্ত কমিটির আবেদন
কলিকাতা মনুমেন্ট ময়দানে মহাসমাবেশ
বৃহস্পতিবার ৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫১
বৈকাল ৩ ঘটিকা
উদ্বাস্তু ভ্রাতা ও ভগ্নীগন,
আপনারা সাতপুরুষের ভিটা মাটি হইতে উৎখাত হইয়া ভ্রান্ত রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার শিকার হইয়া এই বঙ্গে চলিয়া আসিয়াছিলেন। ভাবিয়াছিলেন এই দেশের সরকার আপনাদের প্রতি সদয় থাকিবেন, যথাযথ পুনর্বাসিত করিবেন। কিন্তু হায় ! কি করিয়াছেন তাঁহারা ? কতকগুলি স্মরণার্থী শিবির বসাইয়া কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছেন। অথচ পঞ্জাব প্রদেশ হইতে আগত স্মরণার্থীদের প্রতি সরকারের আচরন প্রত্যক্ষ করুন। এইরূপ বিমাতৃসুলভ ব্যবহার আমাদের ব্যথিত করিয়াছে। এই বঙ্গের শিবিরগুলিতে আশ্রয় পাওয়া উদ্বাস্তুগন বন্দি পশুর ন্যায় রহিয়াছেন।চিকিৎসা নাই। আহার নাই। ডোলে যা দেওয়া হয় তাহা জন্তু জানোয়ারেও খাইতে পারে না। যাহারা শিবিরে স্থান পান নাই বা তথায় আশ্রয় লন নাই, তাহাদের অবস্থা কতখানি দুঃসহ তাহারাই জানেন।
বন্ধুগন আমরা ভিক্ষা চাহিতেছি না। আমরা মানুষের মর্যাদা চাহিতেছি। আমাদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হউক। আমরাই আমাদের শ্রমে ও জ্ঞানে আমাদের নবজীবন গড়িয়া তুলিব। একটাই দাবী আমাদের, পুনর্বাসন চাই। বধির সরকারের কানে এই দাবী সগর্জনে পৌঁছাইতে হইবে। লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হউন আপনারা। কান্নায়,আবেদনে, নিবেদনে অনেক কাল ক্ষয় হইয়াছে। কোন ফল হয় নাই। ভবিষ্যতেও হইবার সম্ভাবনা নাই। লড়াই-ই একমাত্র রাস্তা।
তাই, বন্ধুগন, আগামী বৃহস্পতিবার তাং— ৮ই ফেব্রুয়ারী মিছিল করিয়া দলে দলে মনুমেন্টের তলে আসুন। এটিকে মহাসমাবেশে পরিণত করুন। হাজার হাজার কন্ঠে দাবী গর্জিয়া উঠুক।পায়ের ঘর্ষণে রাজধানী কলিকাতা কাঁপিয়া উঠুক। সকলে আসুন আওয়াজ তুলুন, — আমাদের দাবী পুনর্বাসন। এই দাবী এ দেশের সরকারকে পূরণ করিতেই হইবে।
জমায়েতের স্থান
শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরের চত্বর
সময় : বেলা ২ ঘটিকা।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ —
অম্বিকা চক্রবর্ত্তী
সভাপতি
বিমল মজুমদার
গোপাল বন্দোপাধ্যায়
যুগ্ম সম্পাদক
ইউ সি আর সি
………………………
।। পিদিমের তইল ।।
— আপনি কি ডাক্তারি পাশ করেছেন ? কিছু মনে করবেন না প্রশ্নটা করলাম বলে ।
আচমকা ভবতারিনী (হোমিও) ঔষধালয়ের দোকানদার বলেছিল। হতচকিত নীলাম্বর । এমন কথাটা যে উঠতে পারে, সে প্রস্তুত ছিল না। লোকটার মুখে একদৃষ্টে চেয়ে রইল খানিক । আস্তে না-ইঙ্গিতে মাথা নাড়লো এবারে, — হঠাৎ …।
— হঠাৎ নয় । অনেক দিন ধরে বলবো বলবো ভাবছিলাম । সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না । যে মেডিসিনগুলো আপনি কেনেন, কিংবা কিনবেন বলে অর্ডার দেন, সেগুলো এখানকার ডাক্তারেরা কখনো কেনেন না । হয় ওঁরা এই ওষুধগুলোর ফাংশান জানেন না, নাহলে প্রেসক্রাইব করতে ভয় পান । আপনি, মশাই, লুকোচ্ছেন।
— আমি সত্যি সত্যি ডাক্তারি পাশ করিনি । আসলে আমার বাবার একটা বই ছিল, মেটেরিয়া মেডিকার বই। সেটা পড়েই চেনাজনের অসুখে বিসুখে ওষুধ দিই। রোগ সারে কিনা ওরাই বলতে পারেন ।
কথার পিঠে কথা জোড়ে, চলতে থাকে নির্বাধ। নীলু অবাক হয় নিজের উপরেই। আশ্চর্য ব্যাপার ! বেশ সুন্দর গুছিয়ে, এখানকার শহুরে ভদ্রলোকদের কথার চাল ঢং আয়ত্ত হয়ে গেছে। এতদিন তো টের পায়নি! রিফিউজি গন্ধটা কি উবে যাচ্ছে শরীর থেকে?
তবু মনটা খিঁচখিঁচ করতে থাকে। এটা ঘটনা যে জামাই ডাক্তার নামে তার একটা পরিচিতি জন্মেছে পাড়াপড়শী গরীবগুরবো মহলে। অল্প পয়সায় নীলাম্বর নাকি ধন্বন্তরীর ওষুধ দেয়।
কথার মাঝে ভাবনা এলো। স্নেহলতার গর্ভের সাতমাস চলছে। তার মনটা অনেক শান্ত হয়েছে। এখন এসে পাশে বসে, গল্প করে, ছেলে হবে না মেয়ে, এ নিয়ে ছদ্ম ঝগড়াও করে, হাসে প্রাণ খুলে। ভালো লাগে নীলুর। এখন মাঝে মাঝেই বউয়ের জন্য ফল, শালপাতার ঠোঙায় মিষ্টি কিনে আনে। স্নেহ একটু রাগ দেখায়। ঘরে নাকি ফল ছিলোই। শুধু শুধু পয়সার অপব্যয় করলো। শ্বাশুড়ি-মা মেয়ের সাধ দেওয়ার আয়োজন করছেন মনে মনে, নীলু আঁচ পায়। স্নেহর সাধভক্ষণের দিন নিজে কিছু খরচ করবে স্থির করেছে। এখন ভেবে তার আনন্দ হল।
— শোনো, ছেলি হলি বাবার নামের সঙ্গি মেলায়ে নাম রাখবা। আর যুদি তোমার সাধির মেয়ি হয়, তয় মায়ের নামে। বলি রাখলাম।
— বাব্বা! মহারানী হোকোম দেচ্ছে! — নীলু কোপের ভাণ করেছিল।
— হুম। আমার ছেয়া ছেয়ির মাথায় ঠাকমা ঠাকুরদ্দের আশেব্বাদ ঝরি পড়ে য্যান। তাগেরে বংশের তেলকধারা তাগেরে দেখাতি পারলেম না। আমি এমুন হতভাগিনী! — স্নেহলতা চাইলেও কাঁদতে পারলো না। চিকিৎসকের নিষেধ মনে পড়লো। কেবল গলার স্বরটা রুদ্ধ হয়ে ভারি হয়ে গেছে।
বিশাল এই দেশ, নতুন দেশ, সেখানে কোন নিরুদ্দেশের ঠিকানায় সন্ধান করবে নীলাম্বর ! পিতৃসম জয়েনকাকার কাছে, উত্তরপুরুষ সে, চিরদিনের জন্য মিথ্যাবাদী হয়ে রইল সে।নীলাম্বর চোখে অন্ধকার দেখে, মাথাটা বেবাক ফাঁকা লাগে, আত্মপ্রশ্নে কূট জিজ্ঞাসা ভেসে ওঠে, ভাসা ভাসা বর্ষাফুটের মত, এই দেশভাগ, দেশান্তর, ভিখারি, আধাভিখারীর জীবনে পিছল সমতলে চলতে চলতে এক মিথ্যাশ্রয়ী উত্তরপুরুষ যুগের সূচনা হল
বাবার প্রসঙ্গ উঠলেই নীলাম্বর মিইয়ে যায়। অপরাধবোধ কুটকুট করে ইঁদুর দাঁতে কাটতে থাকে। জয়েনকাকার চিঠির উত্তর সে দিয়েছিল, লিখেছিল শিগগিরি সে তাঁদের খুঁজে বের করবে। খোঁজ করা হয়নি। খোঁজ করেনি। আসলে করতে পারেনি। নিজেকে নিয়ে, নিজেদের নিয়ে মানসিকভাবে পীড়িত ছিল, ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া বিশাল এই দেশ, নতুন দেশ, সেখানে কোন নিরুদ্দেশের ঠিকানায় সন্ধান করবে নীলাম্বর! পিতৃসম জয়েনকাকার কাছে, উত্তরপুরুষ সে, চিরদিনের জন্য মিথ্যাবাদী হয়ে রইল সে।নীলাম্বর চোখে অন্ধকার দেখে, মাথাটা বেবাক ফাঁকা লাগে, আত্মপ্রশ্নে কূট জিজ্ঞাসা ভেসে ওঠে, ভাসা ভাসা বর্ষাফুটের মত, এই দেশভাগ, দেশান্তর, ভিখারি, আধাভিখারীর জীবনে পিছল সমতলে চলতে চলতে এক মিথ্যাশ্রয়ী উত্তরপুরুষ যুগের সূচনা হল। সে নিজে সে-যুগের হয়তো প্রথম প্রাণকনা। বুকের ভিতরটা ধূ ধূ বালিয়াড়ির মতো পুড়ে যায়। হাপর ঠেলে অগুনতি শ্বাস ক্রমাগত উগরে দিলেও সে জ্বালামুখীর উষ্ণতা নমনীয় হয় না।
— দাদা, কী ভাবছেন? এত !
কষাঘাতে চমকে সম্বিতে ফিরলো নীলু। কথা ঘোরাতে বলে, — ডাক্তারবাবু আপনি…।
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো দোকানদার, — আমি ডাক্তার না, মশাই । আবোঝ লোকেরা ডাকে। আপনারই মতো। তবে কমা মাল।
— মানে!
লোকটা এখন গলগল করে বলতে শুরু করে, কাউন্টার ফাঁকা ছিল — বসুন না ওই চেয়ারটায়।— কেমন অন্তরঙ্গ হয়ে যায় দুজনে।
তার কাহিনীও বেশ বড়োসড়ো কম রোমাঞ্চকর নয়। এমনটাই লোকটা বলেছিল।
গরিব ঘরের ছেলে। মামা পয়সাওয়ালা। তিনি শখ করে ভাগ্নেকে কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজে ঢুকে দিলেন। তাঁর সাধ ছিল মালদা শহরে একটা ফার্মেসি দোকান দেবেন, বড়োমাপের। ভাগ্নে ডাক্তার হয়ে বসবে। সে গুড়ে বালি পড়লো। মেডিকেল শিক্ষা ভাগ্নের সইলো না। দুটো বছর হোঁচট খেয়ে খেয়ে ঘসটে ঘসটে তাও চলেছিল। থার্ড ইয়ারে মাতুলের অর্থের জোগান হঠাৎ বন্ধ হলো। কার্যকারণ সে জানে না। মৃদু আঘাত যে লেগেছিল সে সেটা অস্বীকার করে না। একটা অভ্যেসের মধ্যে তো ছিল, সেটা ভেঙে গেলে যেমন ফাঁকা লাগে তেমন। তবে দুঃখ পায়নি— ডাক্তার হবার কেরামতি কিসমত কোনটাই কপালে লেখেনি, বুঝলেন, দাদা । আমি বাঁচলাম ! অন্তত মামার হাত থেকে। — এবারে বাড়ি ফিরতে হল। বাবার দুঃখ, মায়ের রাগ, ওদিকে ছেলে বোখে যাচ্ছে ভয়। শেষে পিতার আলাপী এক ভদ্রলোক — ওনাকে কাকু বলতাম, তারই সুপারিশে চেষ্টায় এই দোকানের সেলসম্যানের কাজ জুটলো, মেডিকেল পাশ ( হাফ ) ওষুধের কারবারে কাজে লাগবে, এরকমই কিছু একটা হয়তো মালিক মনে মনে হিসাব করেছিলেন। মালিক দোকানে আসেন না। এ শহরে থাকেনও না। দুমাস তিনমাস বাদে বাদে দোকানটাকে দেখে যান। ওষুধ কেনাবেচা, ব্যবসাপত্তর সবই ওই সেলসম্যান লোকটি করে, আয় তারই, মালিকের হেলদোল নেই। ফার্মেসিটা আসলে ছিল মালিকের বাবার। দেখুন, সাইনবোর্ডে নাম লেখা আছে, ৺ডাঃ মণীন্দ্রনাথ সোম। ওনার পায়ের নিচে, যা হোক কিছু করে খাচ্ছি।
আলমারির মাথায় তাঁর বাঁধানো ছবি, মালা ঝুলছে, ধূপ পুড়ছে, সে ডাক্তারবাবুর লেখা হোমিওপ্যাথির দুই একটা চটি বই আছে আলমারিতে।
ওগুলো পড়েছে সে, এত খুঁটিনাটি মনে রাখা কঠিন। তবে বুদ্ধি খাটিয়ে নামের আগে ডা. লিখে নেমপ্লেট সেঁটে দিয়েছে পাল্লায়। হোমিওপ্যাথি জগতের সত্যি মিথ্যে খোঁজখবর বিশেষ হয় না। আরও দুটো গুহ্যকারণ অবশ্য আছে — ওষুধ যারা কেনে তারা তাকে ডাক্তারবাবু , ডাক্তারদা সম্বোধন করে। সে মিটিমিটি হাসে, আর রসিয়ে রসিয়ে এই সম্মান খায়। সে বলে — যাক গে, আমার কথা বাদ দিন। আপনাকে বলছি, ডাক্তারিটা পাশ করুন। আমার এখানেই চেম্বার করে দেবো।
নীলু বললো — আপনার লাভ কী এতে? আপনিই বা পাশ করছেন না কেন?
— তিনটে লাভ। এক নম্বর আপনার সঙ্গে মিলে আমিও পাশ করবো। দুই, চেম্বার জমে গেলে, জমবেই, দোকানের ওষুধ বিক্রি বাড়বে। আর তিসরা হলো, মালিকের সঙ্গে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিতে পারবো। শুনুন, আপনার ডাক্তারি সেন্সটা দারুন। বুঝতে আমার ভুল হয়নি। এ লাইনে অনেকদিনই তো হল।
লোকটাকে নীলুর ঈশ্বর বলে মনে হয়েছিল। তখন চোখের সামনে যেন বায়োস্কোপের পর্দা, ভেসে উঠছে সাইক্লোরামা — জাস্টিস বি এম চ্যাটার্জি রোড, জার্মান হোমিও ক্লিনিক, শার্ট প্যান্টে যেন জার্মান সাহেব ডাঃ সনাতন মজুমদার, এম বি (এইচ) গোল্ড মেডালিস্ট, স্কুটার চালিয়ে চেম্বারে আসছেন, ঘরে পাতা বেঞ্চিতে অপেক্ষারত রোগীর ভিড়। ছবিটা সরে গেল, এবার আর একটা — হ্যানিম্যান হোমিও মেডিকেল হল। ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি। ছবি হারিয়ে গেল, এখন সব সাদা।
এ বয়সে কী করে কলেজে পড়বে নীলাম্বর ! খরচই বা পোষাবে কেমন করে? সংসার, স্ত্রী গর্ভবতী, আগামীকাল আর একটা মানুষ! তার জন্য খরচের দুশ্চিন্তা। মা বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে সে। শ্বশুরের বাসায়, তাদের আশ্রয়ে খুন্নিবৃত্তি। তার মতো হতভাগ্য কে? স্বপ্ন যে দিবাস্বপ্ন! দেখতে নেই। মাথা নাড়লো নীলাম্বর।
— কী, মশাই? কী ভাবছেন? পড়ার ঝক্কি? কলেজ যাওয়া আসা ? ওসব কিস-সু না। আপনার সার্টিফিকেট লাগবে ব্যস।
— না পড়ে, না পাশ করে? কোন পাগল সার্টিফিকেট দেবে? — নীলাম্বর হাসি চাপতে পারলো না।
— দেবে। দেবার জন্য বসে আছে, দাদা। আপনার শুধু এটা লাগবে।— লোকটা তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে টুসকি আঁকে, — এথি।
— ঘুষ ! — নীলুর নয়নতারা স্থির।
— হ্যাঁ, দাদা, ঘুষই। এদেশটা ঘুষের দেশ। যা চাইবেন সব পাবেন। শুধু…।
— আবার সেই টুসকিটা বাজে। ওই যে ডাক্তারদের দেখেন, সব ঘুষের মাল, কারো সবটাই জালি, কারো বা পার্ট। এ শর্মাই এজেন্ট ছিল। সে ঠোঁট টিপে হাসছে।
নীলু বাকরুদ্ধ। মুখ ফসকে গেল— কত ?
— সিম্পল এম বি তিনশো, ফার্স্ট ক্লাস চারশো, গোল্ড মেডেল সাতশো, আমেরিকান ডিগ্রি নশো, লন্ডনের হাজার, আর জার্মানির দরটা বেশি তেরোশো, খোদ হ্যানিম্যানের চেলাদের দেওয়া চোথা, দাম তো হবেই। — লোকটা হাসতে থাকে, — যাকগে ওসব হিসেবনিকেশ ছাড়ুন, আপনি আমাকে পাঁচশোই দেবেন, আমার শেয়ারটা নেবো না। আমাদের দুজনের পার্টনারশিপ ডিল। অনেস্ট থাকতে হবে ব্যবসায় ! একেবারে হাইয়েস্ট গ্রেড আপনার জন্য বরাদ্দ করে রাখলাম।
চৌকিতে শুয়ে ছিল নীলাম্বর, কনুই ভেঙে দুচোখ ঢেকেছে।
স্নেহলতা ঘরে ঢুকছিল, হাতে সন্ধ্যের প্রদীপ আর ধুনুচি। স্বামীকে এরকম দেখে ভয়ে হিম হলো, নীলু পোশাক পর্যন্ত ছাড়েনি ! উৎকন্ঠ সে বললো, — কী গো, কী হইছে তুমার? জ্বর লাগায়ে ফিরিছো নাকি? — নীলুর কপালে কন্ঠায় হাত চিৎ করে উপুড় করে তাপ মাপে, নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস ফেললো, ঘরের কোনে যায়, হ্যারিকেনে আলো ধরায়। ওর এখন ছোটোখাটো কাজ সারতেও সময় লাগে। তারপর ফিরে আসে স্বামীর পাশে, বসে চৌকির ঘাটে,বলে, — কী হইছে, আমারে কও। কেও কিছু কয়েছে? অপমান করিছে?
উঠে বসলো নীলু, হাত দিয়ে বউকে কাছে টানলো একটুখানি, সময় নিল খানিক, তারপর বলে, —-স্নেহ আমার জন্যি একখান কাম করি দেবা? — স্বরে যেন প্রার্থনাই ঝরে পড়ছিলো।
— কী কাম ?
— ভুল বোঝবা না কিন্তুক।
— কও।
— তুমি বাবা মায়েরে পাঁচশোটে টেকা হাওলাত করি দিতি বলবা ? আমি ওষুধ বিক্কিরির দাম থেকি আস্তে আস্তে শোধ করি দেবানে।
অঙ্কটা শুনে কেঁপে উঠেছে স্নেহলতা। আবছা হয়ে আসে তার কন্ঠের আওয়াজ, কোনও রকমে বললো, — এত টেকা ! কী করবা ?
— স্নেহ , ওই টেকাটা পালি আমাগের জেবন বদলায়ি যাতি পারে।
স্নেহলতা স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। নরম ভীতু এক বাচ্চার মত কাতর সে মুখ। আবার স্বামীর কপালে হাত রাখে সে, পেতে রাখে, যেন হাতে নীলুর ধুকপুকি ধাক্কা মারছে। বললো, — বাবা মায়েরে কবা না তো ? — নীলু মাথা নেড়ে সায় দিতেই, — কাউয়িরি কিছু কবা না ? কথা দেও।
— না কবো না। কথা দেলাম।
— আমি তুমারে টেকা দেবো।
— তুমি ! — নীলাম্বর থ চেয়ে থাকে।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১১
❤ Support Us