Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৫

আমরা হিন্দু না, মোচলমানও না, কেবল বাতাসে উড়াউড়ি করতেছি, আমাগের পাকিস্তান হিন্দুস্তান কিছুই নাই, আমরা আস্থানী। — ভাসমান বুদবুদের মতো চিন্তাজটের সরটা ছিঁড়ে গেল হঠাৎ শোরগোলে...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৫

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। ছ্যাতলাকান্ড ।।

রঙ্গিলা শিমূলের ফাগুন

চন্দ্রমোহন আর সাধনকে ভাত বেড়ে দিয়েছেন হেমশশী। মেঝেতে পাশাপাশি আসন ।

সাধন কাজে বেরোয়নি। কদিন ধরেই সময়জজ্ঞান আগের মাপসই হচ্ছে না। সাধনই রাখছে না।

ছেলেটার মতিগতি বদল হচ্ছে নাকি ? হেমশশী ভয় পাচ্ছিলেন। এ দেশটা ডাইন পেতনীর দেশ। পেটে ধরেননি, কিন্তু সাধন যে সন্তানের অধিক। মনে পড়েছে, পাঁচদিন আগে হবে, সাধন কথায় কথায় বলছিল — খুড়িমা, মাটি ঘাটি কুদাল কোড়ল চালানির কামখান ছাড়লেম ভাবতিছি। — আর কিছু বলেনি। হেমশশীও তেমন গুরুত্ব দেননি। ছেলে লায়েক হয়েছে, কিছু গোপন থাকতেই পারে — সবকিছু বাপে–মায়েরে খুলি কবে ! — ভেবেছিলেন। আজ এই অবকাশটুকুতে নীরব থাকতে পারলেন না — কাম ছাড়ার কথা কইছিলি। ক্যান? দু চ্যার টেকা তো রুজগার করতিছিলি। সিটা বন্ধ হয়ি যাবে যে, বাপ। —উদ্বেগ স্পষ্ট প্রকাশ পেল।

নিতাইয়ের ঘরে সাপ্তাহিক মিটিং ছিল। আলোচ্য একটাই, কীভাবে ভিটেহারা, বিশেষ করে ক্যাম্পে আশ্রয় পাওয়া মানুষগুলোর অবস্থার একটু সুরাহা হয়। সভায় কথা হয় কম, ঝগড়াই বেশি। নিতাই মতান্তরের মর্যাদা দেন, সূত্র খোঁজেন একসুরের

সাধন কান ছুঁইয়ে হাসলো — না, খুড়িমা, বস্যে নাই। নোতন একখান কারবার ধরিছি।

হেমশশীর অবাক হওয়ার পালা এখনও শেষ হয়নি — কিসির কারবার করতিছিস, তুই?

সাধন হেসেই চলেছে — মায়েগের বুনেগের বেলাউজ বিক্কিরির ব্যাবসা। — হেঁকে ওঠে — বেলাউজ নিবে গো, মা বুনিরা, ট্যাকসই, ডিজাইনের বেলাউজ…।

চন্দ্রমোহন ওর দিকে চোখ মেলে দিয়েছেন, যেন পূর্ণিমা আকাশে দুই তারা।

তা পুজি পালি কনে ? — হেমশশীর উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে — বেয়াপারে টেকা আটকোয়ে গেলি ফিরি যে ভরতি হবে। কে দেবে?

কারু দিবার নাই।

কী সব বলছে সাধন ! হেমশশীর মুখ সাদা, বুক ঢিপঢিপ করছে।

— ওই যে, কাল রাত্তিরিতি ফিরি, থলেটারি যত্ন করি রাখতে কলাম না ! উয়ের মধ্যি বেলাউজ আছে।

— ওগুলা কিনতি লাগে না ? কুথা থে কিনিস ?

— সে এক মহাবেত্তান্ত খুড়িমা। আরেকদিন কবানে। আট্টু ভাত দেও, পেটি টান রইছে।
বৃত্তান্তের অনেকগুলি পাঠ আছে।

প্রথম পাঠ। রমা। সেই মেয়েটা—শ্যামলা বরন, দোহারা গড়ন তেজাই চোখ, শানে ঘষা জিভ আর গলা, কলকাতা মিছিলে ওর দৃপ্ত চলনটা ছিল দেখার মত। ধোপা ঘরের মেয়ে। ক্যাম্পজীবনে কাপড় ধোলাই ইস্ত্রি করতে কেউ দেয়না। আনিসুরদের তালে ঘরে ঠোঙা বানানোর কাজটা শুরু করেছিল পরিবারের সকলে। সহায় সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না, নেইও, তাই দেশ ছেড়ে আসার সময়ে খোলা হাতে আসা। অবশ্য এনেছিল দুটো ইস্ত্রি। এখন জঙে লাল, খসখসে, কোনায় পড়ে থাকে। বুদ্ধিটা হঠাৎ খেলেছিল রমার মাথায়। দেরি করেনি। পরদিনই সকাল সকাল ক্যাম্পের বেড়া পাহারা ডিঙিয়ে এ শহরের রাজপথ গলি ঘুঁজিতে ঘুরতে শুরু করেছিল। ধোপার কাজ করে দেবে, মজুরি লন্ড্রির চেয়ে কম। লোকেরা প্রথমে ওকে বিশ্বাস করতো না চোখ কুঁচকে সন্দেহ ঠিকরোতো, পরে আস্তে আস্তে কাজ বেড়েছে ওর। গাঁটরি বাঁধা কাপড়চোপড় কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আসে। ক্যাম্পের পিছন দিকটায় বড়ো মজে আসা পুকুর। বাপ মা ভাই নিজে মিলে ধোলাইএর কারখানা চালায়। ঠোঙার মজুরি কষ্টে জমিয়ে কিনেছে ‘বুলুবড়ি, বাংলাগুলা সাবান, সুডা’। কড়কড়ানি মাড়ের অভাব নেই, ক্যাম্পের ঘরে ঘরে তার জোগান অঢেল। রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে দুদিন বাদ দিয়ে খদ্দেরদের ঘরে ঘরে ‘ডিলিবারি’।

দ্বিতীয় পাঠ। নিতাই সরকার। জাল বিছিয়ে ছিলেন ক্যাম্পে। সাকরেদরাও ছিল। জালে ধরা পড়েছে সাধনের মত বেশ কয়েকজন। মেয়েদের মধ্যে রমার দিকে বেশি নজর। ওর নানা গুন আবিষ্কার করেছেন তিনি। স্বভাবনেত্রীর রসদ আছে, হিম্মতটাও সহজাত। সেদিন নিতাইয়ের ঘরে সাপ্তাহিক মিটিং ছিল। আলোচ্য একটাই, কীভাবে ভিটেহারা, বিশেষ করে ক্যাম্পে আশ্রয় পাওয়া মানুষগুলোর অবস্থার একটু সুরাহা হয়। সভায় কথা হয় কম, ঝগড়াই বেশি। নিতাই মতান্তরের মর্যাদা দেন, সূত্র খোঁজেন একসুরের। তার ইচ্ছা, শিগগিরি এখানে পাকাপাকিভাবে ইউসিআরসি-র শাখাটি গড়ে তুলবেন, যেখানে ওরাই কাজ করবে, নেতৃত্ব দেবে। সেদিন এরকম আলোচনা গরমাগরম শেষ হলে নিতাই হঠাৎই বললেন, — রমা, একটু থেকে যাস তো। দরকার আছে।

তৃতীয় পাঠ। সবিতা। নিতাইয়ের ঘরণী। স্বামী বেয়াড়া, কাছেই এক ভাঙা ঘরের প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়, বেতন লবডঙ্কা, এই পেল তো পরের দুমাস কবে আসবে, বেতনই জানে। পড়ুয়াদের দেয় মাসিক ফি মাস্টারমশাইরা ভাগাভাগি করে নেন। এদিকে ঘরসংসারে মন নেই, অবসরের সবটুকু সময় বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আহারের বরাদ্দ ঘরকে সামলাতে হয়। শ্বশুরমশাই কঠিন এবং নীতিপ্রজ্ঞ, সিধে করার জন্য হাঁড়ি ভাগ করে দিলেন। ভদ্রাসন থেকে বঞ্চিত করলেন না। সেটা নাকি বউমার মুখ চেয়ে, অবশ্য মুখে স্বীকার করেন না — ও হতভাগা মামলা ঠুকে দেবে। ওর সঙ্গে যত বাজে লোকের ওঠাবসা। বুড়ো বয়সে কোর্টে হুজ্জুতি করতে পারবো না, বাপু। আছে যখন, থাক।

— গ্যানজেস রোড থেকে বেরিয়েছে পন্ডিত প্রমথ ভট্টাচার্য লেন, তারই ডানদিকে চারনম্বর দোতলা বাড়ির একতলার দুকামরা ছেলে-ছেলেবউয়ের ভাগে। তার একটায় প্রভাবতী সেলাই স্কুল। মেয়েদের জন্য। নামটা ঠাকুমা শ্বাশুড়ির, সবিতা তাঁকে দেখেননি, নিতাইও না। সুতরাং বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। তবে নিতাইয়ের বাবা সে নাম শুনে বলেছিলেন ছেলেকে — হুঃ। ঢং দেখে বাঁচিনে। — এদিকে সবিতার হাত ধরে কেঁদেছিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন, — মা, তুমি আমার প্রভাবতী। আমার কোনও ভয় নেই গো। বংশের আগাছাটাকে তুমি শায়েস্তা করতে পারবে। — আসলে সবিতার শ্বশুর শ্বাশুড়ি জীবিত, তাঁদের নাম যে দেওয়া যায় না। স্মৃতি হলে তবেই না স্মরণ ! স্কুলে সাকুল্যে পাঁচটা হাতমেশিন, তার মধ্যে একটা মাত্র নতুন, বাকিগুলো হয় দোহাতি তিনহাতি ঘুর কেনা, নয় চেয়েচুয়ে সংগ্রহ।

একটা নদী ছিল দূর অতীতে। কবেই সেটা মরে গেছে, এখন হাজাহুজো, অলীক নদী, বাওরের মত টুকরো রেখে গেছে, মানুষ চলে গেলে যেমন স্মৃতি রেখে যায়, শীত গ্রীষ্মে সুখা, হাঁটুজল, ভরা বর্ষায় পৃথুলা, থই থই পানি। তারই বুক পয়োস্থি জমি, সবটাই সরকারের খাস

নিতাই স্কুলঘরে ঢুকলেন। পিছনে রমা — এই প্রথমবার ভয় পাচ্ছে সে। বললেন — শুনছো, এই যে রমা, ওকে তোমার হাতে দিলাম। গড়ে পিঠে নাও তো। দেখি। হয়তো তোমারই অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে।

সবিতা হেসে রমাকে কাছে ডেকেছিলেন। অনেক কথা হল।

— কামটা আমি পারুম বউদি?

— পারবে না কেনো ? কাপড় কাচো, ইস্তিরি করো, ঠোঙা বানাও। এরকমই সহজ করে নেবে। মন দাও। ধৈর্য ধরো। দেখবে, শেখা হয়ে যাবে।

— অতদিন ধইরা প্যারেক ঠুকাঠুকির ধইরজ নাই। তিনমাসে অইবো না?

— হবে। খাটতে হবে খুব। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস। তবে, তুমি তো সাহসী মেয়ে — সবিতা হাসছেন — তোমার দাদার জোয়ান অব আর্ক। দেখো।

— কিসের জুয়ান?

তখনও হাসছেন সবিতা — সেটা পরে বুঝো। ক্লাসে আসবে নিয়মিত। কামাই করলে তোমার দাদা আমায় আস্ত রাখবে না।

চতুর্থ পাঠ। পথ। নিতাই সরকারের ঘরে হই হট্টগোলের মিটিং ভাঙলো। ক্যাম্পে ফিরছিল রিফুজিরা। শীত যাই যাই। তবু সাবধান থাকতে হয়। তাই ডোলে পাওয়া শিয়ালে রঙের এন্ডির চাদর সকলের গায়ে। রাত সাড়ে আটটার পর ক্যাম্পে ঢুকতে গেলে পাহারাদার আর ভলান্টিয়ারেরা নানা আকথা কুকথায় হেনস্থা করতে চায়। রেললাইনটা পার হলে ধড়ে একটু প্রান আসবে। ওরা ছুটছিল। উর্ধ্বশ্বাসেই। মেয়েদের পায়ের জোর ততটা নয়, পিছিয়ে পড়ছিল। পুরুষেরা তাড়া দিচ্ছে বারবার, পা চালাতে হবে।

— ও সাধনদা —রমা একটু চেঁচিয়ে ডেকেছিল। সাধনকে থামতে হয় — পায়ে কি ডাকাই কুট্টির গুড়ার জিন বাইন্দা আইছেননি ? একটু রণ তো। আপনের লগে কথা আছে। একখান।

— কী ?

— আরে কইতে আছি। খাড়ন একটু। দম লই। সেই সুমায়টারে তো দিবেন। নাকি ?

রমা যা বললো, সাধনের পক্ষে সাংঘাতিক। সেলাই স্কুলে এখন প্রচুর ব্লাউজ তৈরি হচ্ছে। বিক্রির ভাবনা বউদিমণির। ঘরে ঘরে ঘুরে বিক্রি। মেয়েরা এখনও এ কাজ করার অবস্থায় নেই। তিনি চেষ্টা করেছিলেন। মেয়েরা পিছিয়ে গেছে। সংস্কারবাধা কাটাতে পারেনি। তাই পুরুষ চাই। রমার ইচ্ছা সাধন এই কাজটা করুক। বউদিরও সায় আছে। সাধন তোতলাচ্ছিল — বেলাউজগুলান তো কেনতি লাগবে?

— হ। লাগবো।

সাধন আত্মশক্তি ফিরে পেতে হাসে এবারে — তুমি আমারে ভালোই গুড়ির হাঁড়ি দেখালা। পকিটে নাই কানাকড়ি শা বনবার খুয়াব ছাড়তিছো।

রমার যে কি হল, খপ করে সাধনের হাত মুঠোয় ধরেছে — সাধনদা, টাকাটা, ধরেন, আমি আপনেরে দিলাম। আপনের কি মানে লাগবো ? আহা, পুরুষের মান ! টনটনাইয়া। পশ-শো করলেই সম্বরে ছ্যানছ্যানাইয়া উঠলো ! — তীর্যক কথার রেখায় লোহাকাটা করাতের ধার।

সাধনের প্রচন্ড রাগ হয়। এই বয়সেও মেয়েটার বিয়ে হয়নি। আসলে ওর বাপ দিতে পারেনি। কে ওকে বিয়ে করবে ? মনে মনে বললো সাধন — এ মুখির পালি পড়লি বাঘ পলায়ে যাবে, তো পাত্তর বাবাজীবন! কাছাকুছে না খুলি যায় ! রাগ গোপন করা গেল না, তুমি দিবা ! তুমার বুঝি টেকার গাছ হইছে?

রমার হাতে এখনও সাধনের মুঠো। দলটা এগিয়ে গেছে খানিকটা দূরে, সেদিকে একবার তাকিয়ে রমা বললো — না সাধনদাদায়। টাকা দিমু কইথথিকা? বউদিদিরে গেরান্টি দিমু। বুলাউজ বেইচ্যা লাভের টাকা রাইখ্যা বউদিদিরে দিবেন। আপনের টাকায় আপনের বানিজ্য। তখন আমার কথা আর সোরণে থাকবো না।

হাতটা তেলজ্বলা প্রদীপের মত তেতে উঠেছিল। ঝটিতি ছাড়িয়ে নিল সাধন। হনহন করে রওনা দিল দুজনেই। মাথার উপরে চটুল চাঁদ ছিল ত্যারচা, রেললাইনের খোয়ার উপরে উঠকো ঘাসের মেঝে, ডগাগুলোর টিকিতে খয়াশীতের নীহার বসানো নোলক। সাধন রমা কিছুই দেখলো না।

খাওয়া সারা হয়েছে।

মেঝেতে কাঁথা চাদর বিছিয়ে চন্দ্রমোহন বসেছেন। পায়ের কাছে ডোলের কম্বল দিয়ে রেখেছেন হেমশশী।

সাধনের ডরমিটারে ফেরার মন নেই। উচ্ছনেকগুলা পাল্লায় দড়ি বেঁধে দিলে দেবে। রাতটা বরং এখানেই কাটিয়ে দেবে আজ। সে গল্পের ফেরে পড়েছে — খুড়িমা, কাল একখান কামে বেরাতি হবে। পেভাত কালে। রাত্তিরিতি ফিরতি পারবানে কিনা কতি পারতিছি না। ধরিই নাও ফেরবানে না।

হেমশশীর ভয় ক্রমশই বাড়ছে। ছেলেটার কাজকম্ম বুঝে উঠতে পারছেন না, বেশ কিছু গোপন করছে সাধন। লায়েক হলে কি এরকম হয় ! নীলুকে তো এত ছুপিছাপি করতে হত না ! স্লেটে পেনসিল দিয়ে হাত বোলানো স্বরবর্ণের মত ছিল সে।

কিন্তু সাধন ! বললেন, — কি এমুন কাম রে?

কাজটা সত্যিই এমনতরো।সাধন বলতে চাইছিলো না সেই জন্যই। খুড়িমার চিন্তা বাড়বে। উদ্বেগ, উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা সবের রসদ যে সে কাজটায়। রানাঘাট স্টেশনে গাড়ি ধরে পাঁচটা স্টেশন। সেখানে নেমে পশ্চিমে হাঁটা পথ, গঙ্গার দিকে। মাঝখানটায় একটা নদী ছিল দূর অতীতে। কবেই সেটা মরে গেছে, এখন হাজাহুজো, অলীক নদী, বাওরের মত টুকরো রেখে গেছে, মানুষ চলে গেলে যেমন স্মৃতি রেখে যায়, শীত গ্রীষ্মে সুখা, হাঁটুজল, ভরা বর্ষায় পৃথুলা, থই থই পানি। তারই বুক পয়োস্থি জমি, সবটাই সরকারের খাস। বিনা কাগজপত্রে জমির দখলদার এক কুন্ডুবাবু।

— ওই জমি দখল নেব আমরা। কাল তাই যাতি হবে। নেতাইদাদাও সাথে যাবে। জরিপ করা হয়ি গিছে। কুথায় বসত, কুথায় রাস্তা পিলান হইছে।

— দখল নিবি? মারদাঙ্গা লাগি যাবে বাপ !

— যাতি পারেই, খুড়িমা। লাঠি সড়কি নেয়ি যাবো। পুলিশ, কুণ্ডুর গুন্ডে দলবাঁধি আসবে। এই দেখো — সাধন ফুঁ দিয়ে বাজায় — শিঙ্গে। বাজিয়ে দিলিই সব বেবাক তোয়ের — সাধন দুবার বাজায়— পোঁপোপো পোঁ, পোঁপোপো পোঁ। — মেয়িরাও যাবে, ঝাঁটা বটি দাও নেয়ি যাবে। তবে রাত্তির বিলায় ওরা থাকবে না নেতাইদা কয়েছেন।

— ধারাবিবরনী দিচ্ছে সাধন, নিরুত্তেজ — পেত্তেকের চারকাঠা করি জমি, তোমাগের চার, আমার চার। লাগুয়া দাগদড়ি দেব, খুড়িমা। মুক্তেকান্দির মতুন না হয়, তবু যে নিজিগের ভিটে।

চন্দ্রমোহনের চোখে তরল আলো জ্বলে উঠলো, হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন — মাইকেল! মাইকেল ! বীরবাহু মরি গিছে, সিনাপতি হল্য ইন্দ্রজিৎ। উঠ গো, শোক পরিহরি, সতি উঠ। সাধন, মেঘনাদেরে কোথায় পালাম !

— ঠান্ডা হন, ঠান্ডা হন — হেমশশী দ্রুত উঠে চন্দ্রমোহনের পিঠে হাত বোলাতে থাকে।

—সাধনদায় ! — ডাক দরজায়।

সাধন এগিয়ে গেলে হেমশশী ওই মুখে চেয়ে রইলেন। চাপা আওয়াজে ওরা কথা বলছিল। ফিরবে বলে আগন্তুক পিছনে পা বাড়াতেই হেমশশী ডাকলেন — সাধন, মেয়িটারি এট্টু ভিতরি আসতি ক।

স্বভাববিরুদ্ধ তবু ইতস্তত করে ঢুকল রমা, প্রণাম করলো হেমশশীকে, চন্দ্রমোহনকেও।

— বসো, মা। বলছেন হেমশশী।

সাধন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না, বলে বসল — আমি তবে যাই, খুড়িমা, দুয়োরে কাতা লাগায়ে দেবে। সকাল বিলায় আমারে যে কৌটোতে খাবার দেও সিটায় মুড়ি আর গুটিক ছাতু বাঁধে দিও।

— আচ্ছা, যা।

রমার ডিমের মত মুখ, পুকুর পাড়ের মাটির মত রঙ, দুহাতের তালুতে উঁচু করে ধরলেন হেমশশী, মনে হল দীপ্ত তেজপিন্ড, বললেন — মা আমি যে মা, সব বোঝবার পারি। সাধন আমার চাড়ালের পো, বামুনের পুত, তোমার বাপেমায়ে কিছু কবে না তো ? তুমি আশরয় দিতি পারবা আমার সাধনেরে ? ও বড়ো ভালুবাসার কাঙাল, মা। পারবা তো ? আমার এখন খ্যামতা নাই। পুড়া কপাল। মুক্তেকান্দিতে থাকলি ধুম করতেম। — হেমশশীর চোখে জল ভাসছে। আবছায়া সামনের পটে ভেসে উঠছে নীলু আর স্নেহলতার মুখ।

রমা, চোখ তার মাটির তলায় চলে যেতে চাইছে। ভিজে, ড্যাবডেবে কন্ঠস্বর — যাই, খুড়িমা। বাবায় চিন্তা শুরু করলেই মোশকিল। এমুন চিল্লামিল্লি জুইরা দিবো…।

♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৪


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!