Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ৩, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৬

হেমশশীর চোখে জল ভাসছে। আবছায়া সামনের পটে ভেসে উঠছে নীলু আর স্নেহলতার মুখ... তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৬

।। ছ্যাতলাকান্ড ।।

চড়াইয়ে ধর্মরাজ

শৈশব যেন ফিরেছে চন্দ্রমোহনের।

   হেমশশী ঘরে নেই, কাছেপিঠে গেছেন। চন্দ্রমোহন ভাবলেন তার ফিরতে দেরি আছে, এই সুযোগে একটুখানি কানামাছি খেলা যায়। টুপ করে মাথা গলিয়ে ফতুয়াটা পরলেন, ডোলে পাওয়া, আকার বেঢপ, রেল অফিসারদের বউয়েরা নাকি বানিয়ে দিয়েছে। আরামই লাগল। ঢিলেঢালা। হাওয়া খেলে ভিতর গায়ে। আরেকবার এদিকসেদিক নিরিখ করলেন, স্ত্রীর চিহ্ন পেলেন না। এবার পরের কাজটা। জানেন, হেমশশীর একটা ছোটো বার্লির কৌটো আছে, খাসসিন্দুক, কোথায় রাখেন সেটাও জানা, ওতেই এখন তাঁর প্রাণভোমরা। ওখানে আছে জমানো পয়সা, ডোলের খয়রাতি কষ্টে বাঁচানো, সাধন এনে যা দেয়— সেগুলোও। কৌটোটা খুলে নানাজাতের মুদ্রা গুনে গুনে ছ-আনা তুললেন নিচপকেটে। তারপর চড়ুইএর মত বেরিয়ে পড়লেন।

   বন্দিবাস। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কেউ তাঁকে চিনছে না। তিনিও কাউকে চেনেন না। সাধনের কাছে যে মেয়েটা এসেছিল, হয়তো সে দেখলে চিনতে পারতো। ভালোই হয়েছে, বলা যায় না— তাঁকে ধরে আবার টিনকুঠুরিতে ঠেলে দিত। মেয়েটা কেমন যেন। ডাকাত ডাকাত। মনে পড়লেই ফিক করে হেসে ফেললেন। সে-রাতে মেয়েটা তাঁকে প্রণাম করেছিল, আর তিনি ওকে দেখছিলেন। বড় মিষ্টি লেগেছিল, যেন বুকে মায়াভিজে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সুনয়নী বেঁচে থাকলে ওরই মত ডাগরডোগর হতো। স্মৃতির গুহ্যদেশ থেকে কন্যা ফিরে এসে তাঁকে মেদুর করে তোলে। নাক ডললেন কোঁচার খুঁটে। থামলেন একটু, বিরাম নিতে হবে।

কটা একটা ডানা বেরুচ্ছে, তার পালক ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে, একের পর এক ছেঁড়া সংসারের ছবি। দেখতে দেখতে আবার একই জায়গায় ফিরে আসতে হচ্ছে তাঁকে। অতিকায় কুমিরের পেটে প্রাণহীন অগুন্তি হাড়মাস, অথবা মৃত পশু, অথবা বস্তুদেহকে যেন গিলে খেয়েছে এই শরণার্থী শিবির

   মনটা অনেকদিন পর লঘু লাগছে। এমন করে এই পরবাস চেখে দেখেননি আগে। কত মানুষ! গাদাগাদি! নগরই! কচিকাঁচারা হুটোপাটি করছে, ঘরে ঘরে রান্না চড়েছে, রসুন পেঁয়াজ পোড়ার ম ম বাতাস নাসা জ্বালালো চন্দ্রমোহনের। হাঁচলেন দুবার, কোঁচার খুঁট তুলতে হল।

   আবার ভাসালেন নিজেকে, ধরলেন ক্যাম্পের দক্ষিণকানা।

   এ এক ভুলভুলাইয়া, আজব চক্কর। একটা একটা ডানা বেরুচ্ছে, তার পালক ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে, একের পর এক ছেঁড়া সংসারের ছবি। দেখতে দেখতে আবার একই জায়গায় ফিরে আসতে হচ্ছে তাঁকে। অতিকায় কুমিরের পেটে প্রাণহীন অগুন্তি হাড়মাস, অথবা মৃত পশু, অথবা বস্তুদেহকে যেন গিলে খেয়েছে এই শরণার্থী শিবির। দেখলেন, কলহ বেঁধেছে মুখোমুখি দুই ঘরের মধ্যে, কারণটা এতটাই অকিঞ্চিতকর — তাঁর হাসিই পেল। দু-ঘরের মাঝে দড়ি টানিয়েছে একঘর। এমুখে নমশূদ্র,ওমুখে বদ্যি। ভেজাকাপড় রোদে শুকোতে দড়িতে মেলে দুপক্ষই। তবু আজ অন্ত্যজের বসনে ছোঁয়া লেগেছে উচ্চের চর্মদেহে। অনর্গল চলছে অশ্রাব্য গালিবৃষ্টি। চন্দ্রমোহন সরে গেলেন।

   মাথাটা তখন থেকেই ঘুরছিল, জিজ্ঞাসা জাগছিল অন্তরদেশে — আচ্ছা, মানুষে মানুষে ঝগড়াঝাঁটি তো নতুন নয়, কিন্তু যে বিবাদটি ঘটমান, তার হেত্বাভাস কী! অভাব চিরদিনই আছে। ব্যাপকই ছিল, এখনও তাই। তবু ভেদ এত সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠেনি। হৃদয় জানোয়ারের হিংসায় বদলে যায়নি। তবে কি আসল নিয়তিটি ভূমি? যখন মানুষ তাতে লগ্ন ছিল, তখন মৃত্তিকার গভীর গভীরতর তলদেশ থেকে তরল প্রাণরস শোষিত হতো মানুষেরই দু-পা দিয়ে, যেন দুমুখি শিকড়, পৌঁছে যেত সারা দেহে। জীবনের অমৃতশ্রোত। হৃদয়ের কুঠুরিতে সঞ্চিত হত। তাইতো প্রেমের আশ্লেষ বিভাজন মুছে জড়িয়ে ধরতো একে অপরকে। নইলে নিযুতভেদ নিয়েও এ জাতি জীবন্ত ছিল কেমন করে ! ভূমি শব্দের অর্থ কি শুধুই জমিজিরেত ! অঙ্কের মাপে আল, পাঁচিলে দাগা মাটি? আকাশ-বাতাস, নদী-পুকুর-খাল-বিল, বৃক্ষ-গুল্ম-তৃণ, পোষ জীব-আপোষ জানোয়ার, আহার-বিহার, আচার-বিচার, ধর্ম-কর্ম-ব্রত-পুরান, সবমিলিয়ে এক অখন্ড মন্ডলাকার। এখন সেই লগ্নতা চূর্ণ, কোথাও প্রাণের আশ্রয় নেই। তাই মনুষ্যত্বও বিলীন। চেতনার স্থায়ীসিন্দুক থেকে অন্তরকে অপসারন করে সেখানে পাশববৃত্তি ঢেলে দিয়েছে পিশাচ। হে করুণাময়, হে ঈশ্বর, এ কোন অভিশাপ হানলে তুমি! আমাদের সন্ততি প্রসন্ততিরা আর কোনওদিন কি ভূমি খুঁজে পাবে? আবার মানুষ হতে পারবে? মাথা ধরে ঝাঁকাতে থাকলেন চন্দ্রমোহন। অদৃশ্য রক্তক্ষরণের যন্ত্রণায়।

   খেয়াল করেননি, অবরেসবরে চিন্তার কাটাকুটির হঠাৎ ভরা কোটালের ধাক্কায় ভাসতে ভাসতে কখন ক্যাম্পের দক্ষিণখিড়কির কাঁটাতারের বেড়ার কাছে চলে এসেছেন। সামনে লোহাগরাদের ছোটো গেট, বাইরে থেকে শেকল বাঁধা, সেটায় তালা। বাইরে বেঞ্চি পেতে দুই যুবক তিনপাত্তির জুয়া খেলছিল। বদরি সিংয়ের চেলা ওরা, গেটপাহারার কাজ করে। চন্দ্রমোহনের ইচ্ছে হল ছোকরা দুটোর সঙ্গে খেললে মন্দ হয় না। গেটে আওয়াজ করতেই একজন বলে, — কী,কাকু ? কী চাই?

    —এট্টু বাইরে যাতাম।

   ছেলেটা ভুরু কুঁচকে তাকায়, এ গেট দিয়ে যাওয়া আসা বারণ, বুড়োর ধান্দাটা কী, — কেন ?

   —তামুক কেনতেম।

   — বাঃ, কাকাবাবু বাঃ। ভাত জোটে? তামাকের লোভ! — ওরা ছিরকুটে হাসে, ইশারায় পরস্পর কথা হয়, বলে পয়সা আছে? এক আনা  এক আনা দু আনা লাগবে।

   এবার চাবিটা চন্দ্রমোহনের হাতে। পকেট থেকে পাওনাটা দিতেই ওদের হাসি মোলায়েম ও চওড়া, — ভালোকাকু। যখন নেশার জিনিস লাগবে এ গেটে চলে আসবেন। সকালের দিকে, কেমন। ওবেলা আমরা থাকি না। — গেট খুলে যায়, —এই মাঠ দিয়ে চলে যান। সামনেই পাকা রাস্তা। স্টেশনরোড। এবার ডানদিকে যাবেন। সোজা। স্টেশনের সামনে বাজার। যান। এখানে দাঁড়াবেন না। শুনুন একঘন্টার মধ্যেই ফিরবেন। বুঝলেন?

   প্রায় দৌড়ে মাঠ পেরোলেন চন্দ্রমোহন। রাস্তায় উঠে শ্বাস ভরে নিলেন বুকে। মুক্তি! মুক্তি! মাত্র দু আনায় কেনা। এ কেমন দেশ?

   বাঁ হাতে লম্বা পাঁচিলঘেরা বাগানবাড়ি, নন্দপ্রসাদ সিংয়ের, বদরি সিংয়ের বাপ। বাগান না বলে জঙ্গল বললেই ঠিক হয়। দূরে ধবল ইমারত, মফস্বলী তাজমহল। ভিতরে কি কেউ বাস করে? নাকি বাবুরা ফুর্তি করার সময়…।

   হাঁটছেন চন্দ্রমোহন। রাস্তা ডানদিকে হেললো। বাঁকের মুখে বুনো কালীমাতার মন্দির। সিঁদুরগোলা রঙ। ঢুকে পড়লেন চত্বরে, চারধাপ সিঁড়ি, তারপর গর্ভগৃহ। সিঁড়ির মুখে হাঁড়িকাঠ মেঝেয় গাঁথা, পরবে বলি হয়, যূপের বেদিতে তেলসিঁদুর। কোনও মূর্তি নেই, আছে গাছের গুঁড়ি — উপরাংশ কাটা, সারা গা সিঁদুরতেলে পুরু, জ্যাবজেবে। ধাতব ত্রিনেত্র, নাসা, আর লেলিহান জিহ্বাটি বসানো। মেয়েরা এয়োরা পুজো দিচ্ছে, ডালা থেকে সিঁদুর তুলে গুঁড়ির গায়ে লেপে দিচ্ছেন এক পুরোহিত। আর এক পুরোহিত, বৃদ্ধ, বসে আছেন বারান্দায়, সামনে কাঁধাউঁচু পাথরের জামথালা। পুজো শেষে পূজারিণীরা গর্ভমন্দির ত্রিপ্রদক্ষিণ শেষ করলে বারান্দার সিলিংঝোলা বিরাটাকার পিতলের ঘন্টাটা ঢং ঢং ঢং বাজায়, তারপরে বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছে আসে। তিনি থালা থেকে এককুশি জল তাদের গন্ডুষে ঢেলে দেবেন।  পূজারিণীরা খায়, হাত চুলে মোছে।

   চন্দ্রমোহনকে দেখলেন প্রবীণ পূজারী, — বাবুজি, পূজা দিবেন? — চন্দ্রমোহন মাথা নাড়লে বললেন, — তো, ও ঘন্টেটো বাজিয়ে দেন একবার। জয় মা।

   চন্দ্রমোহন বাধ্য ছেলের মত নির্দেশ মেনে যান। হাসি পেল একচিলতে, যাক মানুষের এখনও বিশ্বাস তাহলে মরেনি।

   — আইয়ে, বাবুজি, মাকী শ্রীচরণামৃত লিজিয়ে।

   বেরিয়ে গেলেন চন্দ্রমোহন পথে। আবার বাঁক। জায়গাটা বড় সুন্দর। একধারে সেন্ট অলিয়েন্স অরফ্যানেজ, ছোট একতলা বাড়ি, ওপাশে সেন্ট অলিয়েন্স মডেল হাই স্কুল। থমকে দাঁড়াতে হল। নলিনবিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে এত বড়ো বিলডিং ছিল না। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসছে, হেঁটে, রিক্সায়। চোখ জুড়ানো ইউনিফর্ম। নলিনবিহারীতে টিউনিক ছিল না। ছেলেমেয়েগুলির মুখ দেখে তৃপ্তির ঝরণাস্রোত শরীর ভিজিয়ে দিল। স্মৃতি ভান্ডার ভেঙে হু হু করে কত মুখ! মনে হল এখানে আলো, এখানে হাওয়া, শিশিরকণা সব একাকার। ইচ্ছে হচ্ছে, একবার ভিতরে যাবেন, মাষ্টারমশাই দিদিমনিদের সঙ্গে আলাপ করে আসবেন। আর অপেক্ষা করলেন না।

   একটু পরেই আঁতকে উঠলেন অচেনা কন্ঠস্বরে, — মিস রয়, দেয়ার, হু ইজ হি?

   — পারহ্যাপস এ বেগার, স্যার।

   — হোয়াট! শাংকার, শাংকার, — হাঁক পাড়ছে লোকটা। একটি যুবককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, — কোথায় থাকো? আউটকাস্ট ঢুকে পড়ে ক্যামপাসে!

   — যাচ্ছি, স্যার, এখনই।

   — দাঁড়াও। ধরো, এই দুই পয়সাটা। নাও। ওকে দাও, আর বিদায় করো। রাব-বিশ।

   চন্দ্রমোহন ক্রসিং লেভেলের খোলা গেট দিয়ে উঠে পড়লেন প্ল্যাটফর্মে। কী স্টেশন রে বাবা ! নীচু ক্লাসের ছাত্রদের কতবার পড়িয়েছেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলপ্ল্যাটফর্ম। প্রথম খড়্গপুর। এই রাণাঘাট জংশন থেকে চারটি রেলের রাস্তা বেরিয়ে গেছে। একখানা গেছে ফুলিয়া-শান্তিপুর কৃত্তিবাসের দেশ।

   — রামায়ণগান শুনিছো তো ?

   — হ্যাঁ স্যার।— ক্লাস জুড়ে শব্দ।

   কবি কৃত্তিবাস সেই গান লিখিছেন।

   — স্যার, আপনি যে সেদিন কলেন, রামায়ণ রচিছেন বাল্মিকী!

   — ঠিকই।  তবে তিনি লিখিছেন সংস্কৃতভাষাতে। কৃত্তিবাস লেখলেন বাংলায়, আমাগের ভাষায়। বুঝিছ?

   — হ্যাঁ…।

   — রেলির কথা শোনো। আর এক রাস্তা গেছে কৃষ্ণনগর-মোরশিদাবাদ-লালগুলা। সিরাজদ্দৌল্লার দেশ। সাহেবরা তারে পলাশিতে হারায়ে দেশির ক্ষমতা নিল। আমরা পরাধীন হলেম। তিননম্বরটি গেছে পদ্মা পার হয়ি ঈশ্বরদি জংশন। সেখান থেকি দুটে রাস্তা। একখান যাবে শিলিগোড়ি-দার্জিলিং, অন্যখান বর্মাদেশের রেঙ্গুন। আর শেষের খান বনগিরাম হয়ি আমাগের যশুর খুলনে। কেরম মজা কও। রেলপথের মজা। হাঃ হাঃ হেসে চলেছেন তিনি। ক্লাসের বাচ্চারাও সঙ্গ দিচ্ছে।

হেমশশী, দুপুর থেকে সন্ধে, টুকরো দাওয়ায় ঠায় বসে, চোখ কিছুই আর দেখতে পায় না, তবু মেলে আছেন সামনে। মানুষটা তাকে ছেড়ে কোথাও কোনদিন যাননি। এখন কঠিনজমাট উদ্বেগটি গলে নোনাজল নামছে দুগাল বেয়ে, অকাল বর্ষাঋতু

   সেই স্বপ্নের রেলস্টেশনে। বেঞ্চিতে তাঁর দুপাশে যাত্রীরা অপেক্ষমান। দূরে প্ল্যাটফর্মের শেষে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজলো। একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায়, দেখলেন সেটা লালগোলামুখী। কিছুক্ষণ পর আবার ঘন্টা বাজে। ট্রেন আসে। ঘন্টা। ট্রেন। পাশে বসা লোকগুলি বদলে বদলে যাচ্ছে। তিনিই কেবল স্থানু। হঠাৎ একজনকে প্রশ্ন করলেন, — আচ্ছা, ঈশ্বরদির গাড়ি কখন আসবে? — শুনে লোকগুলো তাকে পাগল ভাবে, — কবেন না ?

   একজন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, — ঈশ্বরদি এখন পাকিস্তান। ট্রেন যায় না। বানপুর পর্যন্ত যাতায়াত করে।

প্রচন্ড ধাক্কা লাগলো যেন মাথায়। পাক-ই-স্তান! হিন্-দু-স্তান! গান্ধীবুড়ো। কায়েদ-এ-আজম। জয়নাল। জয়েনউদ্দিন। নলিনবিহারী স্কুল। মাটি ফুটো করে উঠে আসা সেই গোঙানি— উঁ…উঁ…উঁ…।

   — আপনি কোথায় যাবেন ? — যেন উড়ে এল কানে।

   আবার ধাক্কা। চেতনা ফিরলো, নড়ে উঠলেন তিনি, — আমি বনগিরাম যাব।

   — বনগাঁর ট্রেন ওই যে পাঁচনম্বর, ওখানে আসবে।

   তখন সে প্ল্যাটফর্মটি খাঁ খাঁ করছে।

   সাধনের আজ ফিরতে দেরি হয়েছে।

   খুঁটি পাতা টানা বাঁধা শেষ হয়েছে গতকাল। আজ ছিল মাটিফেলা। বিল থেকে মাটি কেটে তিন তিনটে কোঠার মেঝেতে ডাই করে ফেলা কম কাজ নয়। নিজের ঘর, খুড়িমার ঘর, রমাদের ঘর — সেটা আবার একটু দূরে। আটতিরিশ নম্বর প্লটে। বলরাম দাস, রমার বাবা, ছিলেন অবশ্য, কিন্তু তিনি তো আর জোয়ানমদ্দ নন, ছেলেটাও ছোটো। সাধনকেই দেখতে হচ্ছে। চরগাঙপুরের সরকারি খাস জমি ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে নতুন চেহারায়। চল্লিশখানা ঘরের ম্যারাপ তৈরি। পরের লটে যাদের নাম, তারা এখন রাতপাহারা দেবে, হাতে শিঙে, পাঞ্চজন্য, একবার বাজলে যুদ্ধ পরিস্থিতি। নিতাইদা বলেছেন, — ঝামেলা যতটা পারো এড়িয়ে যাবে। — কিন্তু সবটা কি পারা যায়? কালপরশু আরও চাপ। জল ঢালতে হবে মাটিতে, কত পরিমান বলা যায় না। দুরমুশ পেটানো। উপরে টালি বসবে, তাঁর খাঁচা নির্মান। সবমিলিয়ে সাতদিন লেগে যাবে। পেটভরে খাওয়া হচ্ছে না দুপুরে, বিশ্রাম নেই, তবু ক্লান্তি এলে দুহাতে ঠেলে দিতে হবে, মার্জনা নেই। স্বপ্ন মার্জনা করে না।

   রাত নেমে গেছে বলে ব্যস্ত ছিল সাধন। ক্যাম্পে ঢুকেই দেখলো লোকেরা কেমন যেন ত্রস্ত, —সাধনদা, জলদি জলদি খুড়িমার কাছে যাও।

   — কেন কিছু ঘটিছে নাকি?

   ঘটনা সামান্য। চন্দ্রমোহন ঘরে ফেরেননি। শিবিরের নিরুত্তাপ জীবন হঠাৎ দোল খেয়েছে। উত্তেজনায় যাবতীয় বিভেদ ভুলে খুঁজেছে চন্দ্রমোহনকে। কোথাও পাওয়া যায়নি। কিছুক্ষণ হল ক্যাম্প অফিস থেকে থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল। এখন পুলিশ এসেছে।

   হেমশশী, দুপুর থেকে সন্ধে, টুকরো দাওয়ায় ঠায় বসে, চোখ কিছুই আর দেখতে পায় না, তবু মেলে আছেন সামনে। মানুষটা তাকে ছেড়ে কোথাও কোনদিন যাননি। এখন কঠিনজমাট উদ্বেগটি গলে নোনাজল নামছে দুগাল বেয়ে, অকাল বর্ষাঋতু। সাধন ঢুকতেই হাউমাউ করে উঠলেন, — বাপ রে, তোর খুড়েমশাই…।

   সাধন ঝুপ করে কাঁধ থেকে বস্তা, কোদাল মাটিতে ফেলে বললো, — রও, খুড়িমা, আমি আসতিছি।

   এতক্ষণ ঘরে ভিড়ের মধ্যে রমাও ছিল, বলে, — আমিও আপনের লগে যামু।

   সাধন কেমন ভয়ঙ্কর রুক্ষ, এবং শান্ত, — না, রমা, যতক্ষণ না ফিরতিছি, তুমি খুড়িমার কাছি থাকবা। নড়বানা।

   সাধন ফিরলো উৎকন্ঠার তিনঘন্টা পর।

   হেমশশী কুলভাঙা দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ালেন, কোমর পা বশে নেই, —- সাধন, কুনু খবর…।

   সাধন তার খুড়িমাকে জড়িয়ে ধরলো। হেমশশী যেন তরুকান্ড। তার খসখসে বল্কলে ঘসে ঘসে নামতে রক্তক্ষতই তৈরি হচ্ছে সাধনের করতলে। ধীরে ধীরে গুঁড়ির পদমূলে লুটিয়ে পড়লো সে।

♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৫

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৫


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!