Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ১০, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৭

হেমশশী যেন তরুকান্ড। তার খসখসে বল্কলে ঘসে ঘসে নামতে রক্তক্ষতই তৈরি হচ্ছে সাধনের করতলে। ধীরে ধীরে গুঁড়ির পদমূলে লুটিয়ে পড়লো সে...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৭

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। ছ্যাতলাকান্ড ।। 

কুঞ্জভঙ্গ ও কুঞ্জরাসের কীর্তন 

 

বুনো কালীতলায় ভূজ্যি সাজিয়ে দিয়েছিলেন হেমশশী। পুরোহিত প্রবীণ পূজারী। সাধন আছে, ক্যাম্প থেকেও কয়েকজন। সকলেই বসেছিল চাতালের কোণটায়, যেখানে আয়োজন।

 

 রমা হেমশশীর গায়ে, বারবার সাধনকে দেখছিল, ওর জন্য কষ্টের তাত পাচ্ছে, ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে সাধনকে সঙ্গ দিয়ে আসে। মানুষটা বড়োই কড়াধাতের, গোঁয়ারেপনায় টুবুটুবু। বাইরে থেকে চেনার উপায় নেই তার ভিতরটা। একসাথে কাজ করতে করতে, মিশতে মিশতে, রমা এখন অনেকটা বুঝতে পেরেছে। অন্তরগুহার মধ্যে সাধন যে বড় সহায়হীন। অথচ কাছে যাওয়ার পথ নেই। খুড়িমার কাছে থাকা দরকার। ক্ষণকালের জন্য ছেড়ে গেলেও হয়ত সাধন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

 

 প্রকৃতই সাধন ছাইপাঁশ ভাবছিল। তার নাকি চাঁড়ালের চোখ, জল আসে না। বড়জোর আর দশটা দিন। ছাদের আড়া বাঁধাটাই বাকি ছিল। দু-ঘরেই। বাতাবেড়া আর টালি বসালেই ঢোকা যায়। সব যখন ছন্দ মেনেই রচিত হচ্ছে, তখনই সব গন্ডগোল হয়ে গেল। খুড়িমাকে একলা ওই ঘরে রাখা যাবে? বিপদ আপদ আসতে কতক্ষণ ! সে ছাড়া খুড়িমার আর কেউ নেই। ঘরটা অন্য কাউকে ছেড়ে দিলে হয়। কিন্তু চন্ডালের ঘরে ব্রাহ্মণ ঘরণী কি থাকবেন? না, ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে হেমশশীর মধ্যে কোনও বিকার দেখেনি সাধন। তবু! তার নিজের ভিতরেই যে কতকালের, কতপুরুষের, তিল তিল করে জমানো সংস্কারগুলো ভূগর্ভে পিঁপড়ের চলন পরিখায় পথ-উপপথ-শাখাপথ গড়ে রেখেছে। তাকে ভাঙা কি এতই সহজ ! কয়েকটা কথায় ! তর্কে! বিচারে! — খুড়েমশাই, আমারে আর কয়েকটা দিন সময় দিতি পারলা না? আমার লাঠি, আমার তাকতে তোমার আর ভরসা ছেল না? তুমি যে কইতে সাধন থাকতি তোমার যমেরেও ভয় নাই। মিছিকথা ছেল সেগুলান? — সাধন হাহাকার করে উঠতে চায়।

 

দাওয়ার বাইরে বেরিয়ে দেখলেন সূর্য উঠছে, আকাশকোল পূবদিকে নবীন রক্তের মত লাল। প্রণাম করলেন হেমশশী। আলোর দেবতা যেন তাকে ঠিকমত পথ দেখান। অশ্রুস্ফিতিতে ভিজছে তার রেখাকিণাঙ্কিত কপোল

 

 প্রবীণ পুরোহিত হেমশশীর কাছ থেকে দশসিকি দক্ষিণা হাতপেতে নিয়ে প্রণাম করলেন, বললেন, — মাজি, ই মান্দিরমে শ্রাধ ই প্রাথমবার হালো। ও আৎমা মাহৎ থে। পুণ্যাৎমা হ্যায় ও।ই মান্দির কো, ই পুজারিওঁ কো নয়া জীবন দিয়ে যাইলেন ও মাহৎ আৎমা। মাজি, ও আৎমা উনহোকে শারির মে ছিল। যো আপনাকে স্পারশ কারেছিল সোই আৎমা আখন ই আসমান, ই ধুলা, ই হাবা, জল, নদী, গাছ, লতা সবকুছুর মধ্যে বেয়াপ্ত হোয়ে গেলো — হেমশশীর রুদ্ধাশ্রু ঝরণা হল সশব্দে, — রোও মৎ, মা, রোও মৎ। সমঝো ই ধরিত্রী আনন্দ কি জগৎ হো। ও আৎমা আখন প্রেত। যো প্রীতি উদগাতা ওহি প্রেত। মহামায়া কি লীলা। বুনাকালি কি নৃত। মন খারাব লাগলে মাকে শরণ লিবেন, কী কই দেব-তা যো আপকি প্রীতি হ্যায়, শরণ লিবেন। জগন্মাতা আপকি কলুষ দিবে না। — হেমশশীর জোড়হাত নিজ গন্ডুষে ধরে প্রণাম করছিলেন।

 

— বাবা, আপনার কাছে একখান, না না দুটে জিনিস চাবো, দিবেন?

 

—কী, মাজি?

 

— অনেকগুলান মাটির সরা দেখতিছি। একখান সরা আর কয়েকখান তেলকমাটির টুকরে দিবেন?

 

— কী কারবেন মা ?

 

— আপনি রাস্তা দশ-শন দেলেন, বাবা। আনন্দির পথি যাব।

 

— শি…ব শি…ব । পূজারীজি, — হাঁক দিলেন পুরোহিত, — মাজিকো এক বড়া সা ভান্ড, এক মুঠ্ঠা তিলকালক দে দিজিয়ে না।

 

 আরও চারমাস কেটে গেছে হেমশশীর। পথ তাকে ডাকছে মন তাকে বেঁধে রাখছে। প্রতিদিনই ভাবছেন, আজ শুভক্ষণ। তবু কোন পিছুটান তাকে আঁচল ধরে টানে। বাঁধন ছিঁড়তে চাইছেন, পারছেন না।

 সাধন কেমন যেন হয়ে গেছে, খুড়িমাকে একা রেখে বেরোতে চাইছে না তেমন। ব্লাউজের গাঁটরি নিয়ে পসরায় যাওয়া চরগাঙপুরের ফ্যাসাদে অনেকদিন ধরেই বন্ধ। কাজও প্রায় শেষের মুখে। অথচ সাধনের উৎসাহ যেন মরে গেছে। সাদা থান, কাটা চুলের ঝাঁকড়ায় চোখ গেলেই কেমন যেন মিইয়ে যায়। ক্ষেপে ওঠে ভিতরে ভিতরে, নিঃশব্দে গজরায়, — খুড়েমশাই, তুমি বিশ্বেসঘাতক। — নীলাম্বরের ঠিকানা হাতড়ায়, — নেয়ি যাক তার মায়েরে। তার ভার বইতি পারবানে না। ক্যান বইবো ? আমারে তো খুড়িমা গভভে ধরে নাই। — আগে রমা এলে লজ্জা লাগতো, সেটা ঢাকা দিতে আজেবাজে কথা, সমিতির কথাই বেশি হতো। এখন সেকথাও উপর উপর। রমাও নিস্প্রাণ হয়ে শুনে যায়। তারপর একসময়ে বেরিয়ে যায়।

 

জনাকুড়ি, স্ত্রী পুরুষ বাচ্চা মিলিয়ে, ক্যাম্প থেকে এসেছে। বেশিরভাগই নিতাই সরকারের খাস লোক। তিনি নিজে আসেননি, ধর্মীয় আচারে তার নাকি আসতে যেতে নেই। তবে সবিতা এসেছেন। তারই দেওয়া ঢাকাই শাড়িতে, ব্লাউজে, সাটিনের সায়ায় রমা বরাঙ্গনা

 

 হেমশশী রমাকে দেখে হৃদয়পিন্ডে কন্টকপীড়া পান। সাধনও কি শেষে তার খুড়়োমশাইয়ের মতো আধপাগল হয়ে যাবে? আজ শুভদিন। দুটো কাজ করতে হবে তাঁকে। ভাত জাউ কিছু একটা আখায় চড়ানোর আগে ক্যাম্পের পিছনডানায় রমাদের ঘরে যাবেন, ওর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। বিকেলে রমার হাত ধরে নিতাই সরকারের বাড়ি যেতে হবে। দাওয়ার বাইরে বেরিয়ে দেখলেন সূর্য উঠছে, আকাশকোল পূবদিকে নবীন রক্তের মত লাল। প্রণাম করলেন হেমশশী। আলোর দেবতা যেন তাকে ঠিকমত পথ দেখান। অশ্রুস্ফিতিতে ভিজছে তার রেখাকিণাঙ্কিত কপোল।

 

  শুভতিথি দেখা দিল আরও পাঁচ সপ্তাহ পর।

 

 সন্ধে। বুনোকালীর বারান্দার কোণ। পিঁড়িতে কনে সাজে রমা, পাশে বর বেশে সাধন। মঙ্গলাচরণ করছে এক তরুণ পূজারী। প্রবীণ পুরোহিত তার পাশেই বসে আছেন। জনাকুড়ি, স্ত্রী পুরুষ বাচ্চা মিলিয়ে, ক্যাম্প থেকে এসেছে। বেশিরভাগই নিতাই সরকারের খাস লোক। তিনি নিজে আসেননি, ধর্মীয় আচারে তার নাকি আসতে যেতে নেই। তবে সবিতা এসেছেন। তারই দেওয়া ঢাকাই শাড়িতে, ব্লাউজে, সাটিনের সায়ায় রমা বরাঙ্গনা। বউদির আরেক সাথীর কিনে দেওয়া সোনার জলচুবোনো দানে রমা সালংকারা। বলরাম ও তার স্ত্রী শাঁখা পলা ছাড়া আর কিছু দিতে পারেননি। জামাইএর অভিজ্ঞানটুকুও নয়। তাদের মন বিষণ্ণ। হেমশশী আজ কিছু দেননি, দেবেননা। বউদির হুকুমে আসতে বাধ্য হয়েছে আনিসুর। সাধনের জোড় ওর কেনা। এসব সওদা বোঝে না সে, পাঞ্জাবীটা মুসলমানী ঢংয়ের হয়ে গেছে বলে মনটা তার চিটপিট করে। আনিসুর মন্দিরে ঢোকেনি, দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে, দুহাতে মিষ্টিভরা দুটো হাঁড়ি।

 

 বৃদ্ধ পুরোহিতের নজর যায় সেদিকে, — বাবুজি, আপনি বাহার কেনো? আন্দর পে আসেন, —- আনিসুর ইতস্তত করে, — কী হালো ?

 

—আজ্ঞে, আমি মুসলমান তো।

 

—তো কেয়া হালো ? বাবুসাব, ইয়ে বুনামায়িকি চবুতরা আছে। বুনা-মা সবকোয়িকো মা আছে। কিসিকো ভেদভাও নাই। জয় মা!

 

ওদিকে পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে, — যদিদং…।

 

হেমশশীর হাত ধরে কাঁদছেন রমার মা।

 

 হেমশশী বললেন, — বেয়ান, মেয়ি জামাই আজ আপনের ঘরে থাকবে। জাউ ভাত যা হয় উয়েগেরে পাতি দিবেন। কাল সোজ্যি ডুবলি আমার ঘরের লক্ষ্মীরি বরণ করি তোলবো।

 

 বউদি পাশ থেকে সরব হন, — না,না, নতুনজোড় জাউ ভাত খাবে কেন! আমরা ভোজ করবো। — সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন সবিতা। বলরামের ঘরে ওরা ফিরলে আইন মোতাবেক রেজিস্ট্রি হবে। উকিল বাবুকে বলা আছে। চলে আসবেন সময় মতো। তারপর ভোজ। আজকের আয়োজন বউদির। ক্যাম্পের অফিস থেকে রীতিমতো কসরত করে পঞ্চাশ টাকা অনুদান আদায় করেছেন।  সেটা হেমশশীর ঘরে বউভাতের খরচ।

 

♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৬

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৬


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!