Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ২৪, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৯

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৯

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। কাদাকান্ড ।। 

ষোলোগুটির ঘরবান্ধা

বিষ্যুদবার । হকার্স বাজারটা ঘুমিয়ে আছে সন্ধের অবেলায়, অগভীর মগ্নতায়, ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা ঝাঁপ আধখোল, ভিতর থেকে টিউবের আলো বাচ্চার মুখ ওথলানো দুধের মত কালোঘেঁষের উপর। ওই আলোতে বেঞ্চি টুল পেতে আড্ডা। হঠাৎ কারো মুখে লালচে মৃদু আগুন, বিড়ির ধোঁয়ায় কাঁপা কুয়াশা ।
 
দোকান বন্ধের দিন। আজ পূর্ণ, কাল অর্ধদিবস। আইন মোতাবেক নোটিশ আছে টাঙানো। ভাঙলে অপরাধ নেই, কেননা কোনও দোকানেই কর্মচারি নেই। কাউন্টারে দুজন থাকলে— বাপ-ছেলে, ভাই-ভাই, অথবা কাকা-ভাস্তে।
 
বন্ধ রাখাটা দোকানদারদেরই তাগিদই, একটু আয়েশ চাই। অনেকে দল বেঁধে রানাঘাট, না-হলে কাঁচরাপাড়ায় যায়, আট আনা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা হলে ঢোকে। ইন্টারক্লাস। ইভিনিং শো। উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সাবিত্রীর ছবি হলে ওরা পাগল। ছোকরাদের টান হিন্দি বইয়ে। কাঁচের চুড়িওয়ালা রঘু বাড়ৈয়ের ভাই চিত্ত বলে — হালার বাংলাবই দেখো, নায়ক নাইকা একজামা পইরা কাল কাটাইতাছে। আর হিন্দি খেল ! খালি কাপুড় বদলায়, খালি কাপুড়…। আর গীত গাইয়া কী নিত্তই না করে ! দিলখান য্যান দ্যাবদাস হইয়া যায়, মাইরি ।
 
নমিতা ক্লথের বাদল দেবনাথ হয়তো বলে ফেলেছে — যাই বলো, উদের দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, মীনাকুমারী, বুজুন্তিমালার পাশে ইয়ারা লাগে না ।
 
— আরে, হালা ! — হাততালি দিয়ে ওঠে সূর্য সাহা — চিটাগাইঙ্গা ! হুদ্দু ভাষায় বাতইতাছে। পুরা ইন্ডিয়ান হইলো এইবারে।
 
— আমি তো শুদ্ধ বললাম। তোরা বরিশালিয়ারা যা বলিস !
 
— আরে, আমাগো ভাষা বাঘের গর্জন। ওইগুলান গাইল না। ডাইল রানতে ফুড়ন লাগে। এমতে কইতেও লাগে। ওইয়া লোবজো। বোজঝো ? চোতমারানি !
 

রেডিওতে অজয় বসু কিংবা পুষ্পেণ সরকারের সুকন্ঠ বাজে — ঢুকে পড়েছেন তিনি পেনাল্টি বক্সের ভেতরে…গোল হতে পারে, গোল হতে পারে…বাড়িয়েছেন পাস…না, হল না…কী করলেন দশ নম্বর জার্সি…পা ছোঁয়াতে পারলেই গোল

 
আকাশ ফুঁড়ে হাসির ছড়রা ফালিচাঁদে উড়ে যায় ।
 
সিনেমা বাদে অন্য বিনোদন ফুটবল খেলার রিলে শোনা।কলকাতায় গড়ের মাঠে মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল ম্যাচ হলে ওদের একছাইটমেন্ট পারদ ছাড়িয়ে যায়।
 
কীভাবে যেন কথাটা এ-কান ও-কান বেয়ে ছড়িয়ে গেছে যে হকার্স কর্নারে দাম সস্তা। বিকেলে মাঝে মাঝে ফেলাইং কাস্টুমার জুটে যায়। হয়তো এই আধা শহরে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিল, ফিরবে ট্রেনে। পথে বাজারটা ঘুরে যায়। ‘আসেন, আসেন, কী লাগবে ?’  বা ‘দেখলিই নিতি লাগবে না’ শুনতে শুনতে নেশা ধরে, পছন্দসই হলে কিনে নেয় ছেলের জামা-পেন্টুল, মেয়ের ফ্রক, পকেটে কুলালে বউয়ের শাড়ি। সঙ্গে যদি অবিবাহিত মেয়ে, বোন কিংবা শ্যালিকা থাকে, তবে কাঁচের চুড়ি—কুমকুম—নখপালিশ
 
—সুনো—পাউডারে ভিড়। নানারঙের ফিতে তো আছেই।
 
সেদিন দুদলে যুদ্ধ লেগেছে। স্টেশনারি যাদব নাথ শখ করে হাতে ঝোলা ট্রানজিস্টর সেট কিনেছে, নিয়ে এসেছে দোকানে। এ যন্ত্র আর কারও নেই। কাজেই ওর দোকানের সামনে বড়োসড়ো জমায়েত, যেমন রাজনৈতিক দলের মিটিংয়ে হয়। তখন খদ্দের এলে ভিড় ঠেলে এগোনো তার পক্ষে দুস্কর।
 
রেডিওতে অজয় বসু কিংবা পুষ্পেণ সরকারের সুকন্ঠ বাজে — ঢুকে পড়েছেন তিনি পেনাল্টি বক্সের ভেতরে…গোল হতে পারে, গোল হতে পারে…বাড়িয়েছেন পাস…না, হল না…কী করলেন দশ নম্বর জার্সি…পা ছোঁয়াতে পারলেই গোল ছিল…এরকম সুযোগ শক্তিধর প্রতিপক্ষ আর কি দেবে !
 
যাদবের লাইনের সকলেই অতিথি । মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে নিজের দোকানে নজর রাখে । দূরের লাইনে যারা তারা আসতে পারে না, তাই দূত পাঠায় — এই, বিশু, যা তো । খবুর নিয়ে আয় আমি তোর দুকান দেখতাছি, সে টুল নিয়ে দু বিপণির মাঝখানে বসে ।
 
এসময়েই খদ্দের এসেছে । দম্পতি । বধূটির শাঁখা বেড়েছে, নতুন একজোড়া পরবে। দোকানদার তাদের বসিয়ে হালা টেনে আনলো, কোন ডিজাইন পছন্দ করবে ক্রেতা ! হাত হালার দড়িতে, মন যাদবের রেডিওতে, বিশুও আসছে না । সেই সময়েই চিৎকারটা ভেসে এসেছি। শাঁখারির বুক ঢিবঢিব করে।
 
— ওইটা দেখান না, দাদা, ওই যে সাগরলোরি কলকা।
বিশুও ফিরেছে তখনই, মুখ থমথমে।
 
—কীরে, কী হইলো ?
 
—কিছু হইলো না, বাঘাদা। বলুরামে মিস করলো। এক্কেরে ভাত মাইখ্যা অর মুখে দিছে। পাওখান ছুয়াইলো না। রেডিও কইতাছে গুল্ডেন চান্ছ !
 
— অগো থিকা টাকা খায় নাই তো ?
 
— ও, দাদা, দেখান, আমাদের গাড়ি ধরতে হবে ।
 
— আরে ধেত আপনে আর কথা কওনের সুমায় পাইলেন না ! আপনের লিগা বলুরামের গুলখান মিস গেল ।
নেয়াপাতি ভুঁড়ির যুবা পুরুষটি হেসে ফেলে — দাদা, আমিও ইস্টবেঙ্গলি ।
 
— তাইলে কুনু কথা নাই। বৌদি, গুসা কইরেন না। মটকা গরম হইয়া গেছিল। কন দেখি ওইরকম গুল মিস! বসেন, বসেন, গাড়ি একখান যাইব, আরেকখান আইব, আপনেরা তো রুজ আইবেন না । বোজলেন, দাদা, আইজ তিনগুল মারুম, বলুরামেই দিবো । একদম কব্রে ঠেইস্যা দিমু মুহনবাগানিরে । ঘটিগো থুতামুখ ভুতা কইরা দিমু ।
 
এ বাজারে একজনও মোহনবাগানের সমর্থক নেই, তবু এত ক্রোধ! ওরা যেন জাতশত্রু । বাঘা ওদের পায়ের তলায় পিষে মারতে চায় ।
 
তিনবছর আগে হকার্স কর্ণারের চিহ্ন ছিল না ।
 
রেল কোম্পানি লাইন পাতবে, পথের নিচে উঁচু মাটি চাই খোয়া ফেলতে। তাই খাসজমি পেলে, লাইনের পাশের জমি থেকে মাটি কেটে তুলেছে। তৈরি হয়েছে পুকুর, ডোবা, নয়ানজুলি। বাজার এলাকাটা সেই মহাকীর্তির অবশেষ। হয়েছিল নিচু বাদা, বছরে সাতমাস জলেকাদায় থিকথিকে, দুটো পচাডোবা কচুরিপানায় ঢাকা। মাঝেমাঝে আধখাড়া ঢিবি, আগাছায় ঝোপঝাড়, ঘনান্ধকার, ক্বচিৎ একটা কদমগাছ বর্ষায় বহুদূর মৃদুবাস ছড়ায়, অথবা খাড়াই তাল বা খেজুর। ডাকাবুকোরাও ওখানে যেত না। জঙ্গুলে মশা আদর করলে ম্যালেরিয়া হবেই, সেটাও না হয় ডি গুপ্তের কুইনাইনে কাবু করা যাবে। কিন্তু ওখানে যে, নাম বলতে নেই, লতা, নিজেদের রাজত্বে সদাই দেখা দিত। সব জাতিরাণী। বাপমায়েরা সন্তানের বুক সাপটে দিত, থুতু ছিটোতো —ভুলেও ওদিকে যাসনে যেন।
 
এখন হকার্স কর্ণারের মুখ থেকে বেরোলে জমজমাট রেলসাইড রোড। পাঁচ-সাত-মিনিট হাঁটতে হবে, ধারেই পালেদের পেল্লায় ভবন । বাড়ির ভিতরে বংশলতা টাঙানো—
 

গৌরীচরণ

কালিকাচরণ
↓          ↓
করালীচরণ          কৃত্তিকাচরণ

 
আদিকর্তা বর্ধমান বা হুগলী কোথা থেকে এসেছিলেন, তা নিয়ে লোকে তর্ক করে। এসেছিলেন রেল পাতার পর। তিনি নাকি গন্ধ শুঁকতে পারতেন। প্রতিষ্ঠা করলেন বংশাসন। তিনপুরুষে সেটা এখন রাজপাট। চাল-গম-আলুর গুদাম, এপ-টি শপের ব্যবসা, কেরাসিন তেলের স্থানীয় ভান্ডার, কয়লার ডিপো, পেট্রোল পাম্প, রুটের বাস— পাঞ্জাবি ড্রাইভার টানে। বাড়িতে ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়। সকলের মা লরিতে চেপে গেলেও এ বাড়ির দশভূজা তিরিশকাহারের কাঁধে দোলায় যান। দশমীতে দেখার মত সে ভাসানের জুলুস।
 
কালিকাচরণ বাপের চেয়েও ধুরন্ধর। তার মা স্বপ্ন পেয়েছিলেন— বুড়োপঞ্চানন তার পুজো ভিক্ষা করছেন, উপচার সামান্য— বেল, গুড়, দুধ আর জল। মাতৃভক্ত কালিকা দেরি করেননি। এই নাবাল জমির উত্তরে খুঁড়লেন বড়ো পুস্করিনী— দূর থেকে দেখলে জল কালো মনে হয়, কাছে গেলে স্বচ্ছ কাচ। আজও তেমনই আছে। পুকুরের পাড়ে স্থাপন করলেন মন্দির, কমলা মার্বেল, ছোট্ট, অপরুপ স্থাপত্য। বুড়ো দেবতার মাহাত্ম্য আছে। সোমবারের পুজো ছাড়াও শিবরাত্রি বা নীলব্রতে কুমারী, এয়োদের ভিড়ে চত্বরে মেলা বসে যায়।
 
আজকের বড়োকর্তা করালীচরণকে রাজ্যপাট নিয়ে ভাবতে হয় না। তবু ভাবনা যে ছাড়ে না । গোরাসাহেবরা ভালোই ছিল, শিবের মতোই, অল্পে তুষ্ট। দিশিদের মতিগতি ভজকট মার্কা। কাগজপত্তর সবই পাকাপোক্ত। এই সাম্রাজ্য দেখভাল করাও যে কম খাটুনির নয়। ছোটভাই কৃত্তিকা আছে, উকিল, কোর্টে পসার খারাপ না, মাথাটাও তার তুলনায় সাফ । একএকদিন রাতে নথিপত্তর নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বসতে হয়, ভরসা করার মতোই ভাই । করালীচরণ ভক্ত মানুষ, খাটো ধুতি, ফতুয়া, পায়ে চটি, সকলের সঙ্গে আচার আলাপী, বিনয়ী, সদাশিব। তবু কাঁটা যে মগজে খোঁচাচ্ছে। এই শহরেই জ্ঞাতিকুটুম্ব নন্দীরা ফুলেফেঁপে উঠছে। ভয় লাগছে করালীর। পালসাম্রাজ্যে না কোপ পড়ে ! জ্ঞাতির চেয়ে বড়ো শত্রু নেই। খিঁচটা বেড়ে যায় নাবাল জমিটার কথা ভাবলে। জমি যে তারই, এলাকার লোকেরা জানে, শুধু তিনি…।
 

স্টেশনের ধারে, রাস্তায়, কার্বাইডের গ্যাসলাইট জ্বালিয়ে পসরা সাজায়, কেউ চিনা সিঁদূরের বাক্স কাঁধে ঘুরে বেড়ায়— বাক্সে সেফটিপিন, টিপবোতাম, সূঁচ, টিপের পাতা, নকল যশোরের চিরুনি । ভোলানাথ কাঠের পুতুল বানায়, মেলায় মেলায় ঘোরে । গ্রাসাচ্ছাদনের জোয়াল টানার উৎসব । নতুন একটা স্বপ্নের উদ্রেক হচ্ছে—বিধান রায় নাকি চাঁদমারিতে অনেক কারখানা বসাবেন

 
কৃত্তিকা অভয় দিয়েছে। আইনের ফাঁক কোথায় কীভাবে ফাঁকি দিতে হয় সেটা শিক্ষাগত। এমনি এমনি বি এল ডিগ্রিটা অগ্রজের দয়ায় হাতায়নি। বলে সে — দাদা, আলুর গুদামটা এবার তুলে দাও।
 
— কী বলিস ! মাস গেলে কত টাকা আসে।
 
—দাদা, দিন পাল্টে যাচ্ছে, টের পাচ্ছো না। এখন কোল্ড স্টোরেজ। আলু আসবে লরি চেপে। গুদামে আলু পচবে ।
 
— তা হলে ঠান্ডা মেশিন বসিয়ে দিই ?
 
—উঁ হুঁ । ওতে লস। কাছেপিঠে আলুচাষ হয় না।
 
— তাহলে কী করবো ?
 
— সিনেমা হল খোলো, দাদা। সোনার খনি। মার্কেট ওপেন হচ্ছে। দেখছো না, আমাদের অনঙ্গপুরটা গঞ্জে বদলে যাচ্ছে। কত লোক বেড়েছে, জানো?
 
করালীচরণ হাসলেন, আকর্ণ বিস্তৃত — বেশ, সেটাই…।
 
সতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত চরগাঙপুরে প্রথম যেদিন এসেছিলেন, রাত ন-টা হবে । গরমকালে সন্ধেই । লোকেরা উঠোনে মাদুর পেতে গল্পগুজব করছিল, বিশ্রামের বিনোদন । কোথাও মাঝে হ্যারিকেন বসিয়ে ছেলেমেয়েরা গোল করে পড়তে বসেছে ।
 
সতীন যেদিনই আসেন, সঙ্গে তিনচারজন সহকর্মী, তারা এখানের লোকেদের আপনজন হতে চেষ্টা করছে । কলোনীতে ইউসিআরসি-র একটি শাখা হয়েছে । সতীনবাবুই সভাপতি ।
 
সাধনের মনে হয় নিতাই সরকারের সঙ্গে কোথায় যেন ফারাক আছে । নিতাই ছিলেন ঘরের লোক । ক্যাম্পের কেউ তাকে দুরের ভাবতে পারেননি । অনেকদিন নিতাইদার কাছে যাওয়া হয়নি । বউদিই বা কেমন আছেন ।
 
এখানে শাখার কাজে যেন ভাটা পড়েছে । পুনর্বাসনের দাবিটা জবরদখলের মধ্য দিয়ে একরকমভাবে অর্ধেক মিটে গেছে । সকলেই কিছু না কিছু জীবিকার খোঁজে ব্যস্ত । সাধন সায়া ব্লাউজ ফেরি করে । অনেকে স্টেশনের ধারে, বা অন্য শহরের রাস্তায়, কার্বাইডের গ্যাসলাইট জ্বালিয়ে পসরা সাজায়, কেউ চিনা সিঁদূরের বাক্স কাঁধে ঘুরে বেড়ায়— বাক্সে সেফটিপিন, টিপবোতাম, সূঁচ, টিপের পাতা, নকল যশোরের চিরুনি । ভোলানাথ ছুতোর কাঠের পুতুল বানায়, মেলায় মেলায় ঘোরে । গ্রাসাচ্ছাদনের জোয়াল টানার উৎসব । নতুন একটা স্বপ্নের উদ্রেক হচ্ছে—বিধান রায় নাকি চাঁদমারিতে অনেক কারখানা বসাবেন । একটা কাজ জোটাতে পারলেই জীবনে শান্তি ।
 
সতীনের সমস্যাটি অন্য জাতের । তিনি কলকাতার এক কলেজে পড়ান, মেঠোমানুষের ভাষা তার ধাতে নেই, তিনি ঘটি, বাঙালদের আদবকায়দা জানেন না । তবে তিনি গুণী লোক, গুছিয়ে কাজ করতে পারেন । প্রথম দিন এসেই সাধনকে বলেছিলেন — আপনি তো আমাদের পুরোনো লোক । দূরে থাকবেন কেন ? আপনার সম্পর্কে রানাঘাট থেকে সব জেনেছি ।
 
— ফিরি করি দোরে দোরে । সোমায় করতি পারবোনে না ।
 
—দূর । সবসময়ই কি আমাদের কাজ করতে হবে ? যখন সময় পাবেন, করবেন । আপনি এলে আমাদের জোর বাড়বে । — ইউসিআরসি-র সঙ্গে তার পার্টিরও ফর্ম ধরিয়ে দিয়েছিলেন সাধনকে । অন্যদেরও ।
 
সেদিনই সাধন বুঝতে পেরেছিল, সতীনবাবু জানেন দল কীভাবে বড়ো করতে হয় । যোগ্য নেতা । নিতাইদার এই গুন ছিল না । হয়তো মনে করতেন দল বড় করার জন্য ছটফট করবার কোনও কারণ নেই । নিজেরা ঠিক থাকলে, মানুষের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগ রাখলে, আদর্শ ধ্রুবতারার মতো স্থির জানলে দল আপনাআপনি বেড়ে যায় । এইটাই নিতাই সরকারের সঙ্গে সতীন্দ্রনাথের মূল তফাত ।
 
আজ সভা সাধনের উঠোনে। রাত আটটার আগেই এসে পড়লেন সতীন। বাড়ি বাড়ি থেকে মাদুর এনে পাতা হয়েছে। মাঝে মাঝে হ্যারিকেন তো আছেই। কয়েকদিন আগেই জানানো হয়েছিল, কিন্তু কী নিয়ে কথা কেউ জানে না, কেবল বলা হয়েছে জরুরি বিষয় ।
 
সভাসমিতিতে নিতাই খুব একটা সরব হতেন না। শ্রোতারাই সরগরম করে তুলতো। আনিসুর বা অন্য কাউকে কথা সাজিয়ে দিতে বলতেন। এখানে উলটো। সতীন বললেন — শুনেছেন কি, গভর্নমেন্ট আপনাদের ব্যবসা করার জন্য লোন দেবেন ?
 
— খবর তো পাইলাম, আমাগো ফাটা কপালে কি ছিকা ছিড়বো ?
 
— পাঁচহাজার টাকা। তিনবছরের মধ্যে শোধ দিলে সুদ মাপ। তারপর থেকে বছরে তিন পার্সেন্ট লাগবে।
 
হঠাৎ এত টাকার অকল্পনীয় খোঁজ পেয়ে উপস্থিত সকলের চোখে মশাল জ্বলে ।
 
—কিন্তু, স্থায়ী ব্যবসা, মানে দোকান লাগবে।
 
— দুকান পামু কইথথন ! — মুষড়ে পড়েছে সকলে —আমাগো কিছু হইবো না সতীন দাদা । এইরে, দাদা কইয়া ফেলাইছি । মাজ্জনা কইরেন ।
 
— বেশ তো — হাসলেন সতীন — আজ থেকে দাদাই বলবেন সকলে । আমার মাষ্টারি পা তাহলে নীচে নামলো ! আপনারা জানেন না, এ সমাজে অনেক উচ্ছিষ্টভোগী আছে । আপনাদের লোভ দেখিয়ে মিথ্যে দোকান সাজিয়ে টাকাটা ম্যানেজ করবে । আপনাদের দেবে একহাজার, বাকিটা নিজের পকেটে। হয়তো আপনাদের মধ্যেও এমন কেউ থাকতে পারে।
 

পালেরা ক্ষমতাবান। মারদাঙ্গা লেগে যায় যদি ! কলোনি গড়ার সময়ও ছোটখাটো হাঙ্গামা হয়েছিল। তখন ছিল পা রাখার জন্য জমির তীব্র খিদে। আজও বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রণা কম নয়, কিন্তু দহন যে অনেকটা শমে। দাঙ্গায় কেউ মারা গেলে সংসারভাগীরা ভেসে যাবে যে

 
—আছেই তো । রাখাল নন্দী মশয় । দ্যাশেও হারামজাইদ্যানি করসে । এহানেও ।
 
— শুনুন ।
 
আজব এক কথা । এক সপ্তাহ জুড়ে খুঁটি , টালি, দরমা জোগাড় করে রাখতে হবে গোপন জায়গায় । ডেরাটি সতীন বাবুরাই ঠিক করে দেবেন । তারপর নির্দিষ্টদিনে রাতারাতি দখল করে নিতে হবে জলাজমিটা ।
 
—ওইয়া তো পালমশয়ের জমি — বিস্ময়ে সমস্বরে কথা ওঠে ।
 
— তাই নাকি ? হতে পারে ।
 
সকলের ভয় জাগে। পালেরা ক্ষমতাবান। মারদাঙ্গা লেগে যায় যদি ! কলোনি গড়ার সময়ও ছোটখাটো হাঙ্গামা হয়েছিল। তখন ছিল পা রাখার জন্য জমির তীব্র খিদে। আজও বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রণা কম নয়, কিন্তু দহন যে অনেকটা শমে। দাঙ্গায় কেউ মারা গেলে সংসারভাগীরা ভেসে যাবে যে। ওদের চোখের মশাল নিভে যায়।
 
ভয় নেই আপনাদের। পালের ফণা তোলবার আগেই আমাদের ওঝাইমন্ত্র ওদের বিষদাঁত ভেঙে দেবে। আমরা সকলে আপনাদের সঙ্গে থাকবো। সারারাত। — আশ্বস্ত করেন সতীন্দ্রনাথ।
 
ভূমিষ্ঠ হল হকার্স কর্ণার। সকালে পালবাবুরা লোকলস্কর খাঁকি-উর্দিদের নিয়ে ছুটে এলেন। ছোটকর্তার তড়পানি আকাশ ফাটাচ্ছে। সতীনবাবু গিয়ে তাকে কী বলতেই, আশ্চর্য, সে মিইয়ে যায়। শেষে ভদ্রলোকের চুক্তি হল। দখলি দোকানের ঘরের মাপে মাসে মাসে একসিকি দুসিকি ভাড়া দিতে হবে।
এখনো সে ব্যবস্থা চলছে ।
 
বিষ্যুদবারের আড্ডায় ছিল রাখহরি। এনামেলের বাসনকোসন বেচে। মাথাটা একটু ঢিলে। মুখপাতলা বলে সবাই ভয় পায়। হঠাৎ সে বলে — একখান কথা কইতাম, সাধনদা।
 
— কবা যখন, থামলা কেন?
 
রাখহরি ঘেমে যায়, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে, গলা খ্যাঁকায় — কই যে, আমাগো মারকিটে রাধাকিষ্ণের ঝুলনের মেলা বসাইলে হয় না ? মেলা দেখতে লুকে আইবো, আমাগো বাজারে এডভেটিজও হইয়া যাইবো ।
 
প্রস্তাবটা মন্দ নয়, সাধন ভাবে। তবু ! বাজারে নাম কে ওয়াস্তে একটা কমিটি আছে। সতীনবাবু সভাপতি, কৃত্তিকাচরণ পাল সহ সভাপতি। বাজারের লোকেরা সাধনকে সম্পাদক বানিয়েছে। সাধন ভাবছে অনেক টাকার ব্যাপার, রাখহরির মাথায় সেটা ধরেনি। বলে সে — ঠিকাছে, কুমিটিতি কথক বলতি হবে ।
 
সকলে সিনেমা ইষ্টবেঙ্গল ছেড়ে মেলা নিয়ে শোরগোল তোলে, যেন সে উৎসব আগামীকালই শুরু ।
চক্কত্তি দাদায়, আপনে চুপ ক্যান? কি হইছে? পূজার কাম আপনারই ।
 
চক্রবর্তী নিরুত্তর। তার কষ্ট হচ্ছে। দরজির দোকানটা চলে না । বউ তাকে, বাচ্চাটাকেও, ফেলে কাছের শহরে বেশ্যাপাড়ায় ঘর নিয়েছে । অপরূপা ছিলোই সে, আরো অনন্যরূপা হয়ে বাজারে আসে মাঝে মাঝেই, দোকানদারদের সঙ্গে হেসে কথা বলে । স্বামীর দোকানে যায়, হাতে তুলে দেয় টাকা। বাচ্চার জন্য, স্বামীর জন্যও। ছবিটা ভেসে উঠেছে চক্রবর্তীর চোখের উপর। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
 
হকার্স বাজারে ঝুলন মেলার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। মেলার বয়স সাধনের ছেলের বয়সের সমান প্রায়। কলোনিতে একটা প্রাইমারি ইস্কুল হয়েছে। গোপালকে ইনফিনে ভর্তি করবে বলে রমা সন্ধেবেলা ছেলেকে নিয়ে বসে, হাতে যোগীন্দ্র সরকারের বই ‘হাসিখুশী’। গোপাল দুলে দুলে পড়ছে, — অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে…।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৮

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৮


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!