- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মে ৫, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৫
ল্যাম্পোর সামনেটায় হলদেটে আলোর গন্ডি, চাতালের সবটা দেখা যায় না। বসানো রয়েছে আবার আড়পাঁচিলটায়। মনে হয় ধোঁয়ায় যাতে কারো অসুবিধ না হয়, সেটাই উদ্দেশ্য। অন্ধকারে প্রায় কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না....তারপর

চিত্রকর্ম: দেব সরকার
।। কাদাকান্ড ।।
সোংসার সুখির হয়…
হরীশ ঘুরে ঘুরে বাবার নতুন বাড়ির ঘরগুলো দেখছিল। মনে ইতস্তত করছিল সে। চারুশীলা জোর করে পাঠিয়েছেন। হরীশের পাশে তার পাঁচ বছরের মেয়েটি—ছবিরানী। তেমন ভাবে দেখছিলোও না, আকাশ পাতাল ভাবছিল।
মাইনে যা পায় মাসের শেষে টান পড়ারই কথা। অফিসকর্মী বলে সে ভদ্রলোকশ্রেণীর মধ্যে পড়ে। অবস্থা বিপাক মুখ ফুটে অন্যকে বলা যায় না। তবে অভাবের তাড়নাটা অফিসের সকল কর্মচারীদের মতো কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারছে। জে এল আর ও অফিসের সর্বত্রই নানা ঘ্যাঁতঘোঁত। দেখে শুনে সতর্কভাবে হাত বাড়ালেই উপরি মেলে। ঘুষ কথাটা খুব নোংরা। হরীশও পায়, নেয়ও, না নিয়ে উপায় নেই, তেমন হলে গর্দানের ভয় আছে। উপরিটা মন্দ আসে না, কিন্তু উপর থেকে নিচ, তলায় তলায়, বাঁটোয়ারা সেরে নিজের নিট পরিমান আর কতটুকু ! যা হোক, হিসেব করে চললে মাসের শেষে কিছু হাতে রাখা যায়, যেতে পারে, অন্তত। বিষয়ভাবনা করেই পোস্টাপিসে বউ বাসন্তীর নামে একটা বই করেছিল। তেমন জমছে কই ! উলটে মাসের শেষে সঞ্চয় থেকে তুলতেই হয়। জিনিসপত্র মাগগি, রেশনের চাল অখাদ্য, খোলাবাজারে দর চার আনা, কিলো আর সেরে গন্ডগোল করে ফেলে হরীশ। সরষের তেল, ভালোটা, ঝাঁঝ বেশি, কলুবাড়ির গন্ধ মেলে, একটাকা। একটু কমা মাল বারো আনা, মানে পঁচাত্তর পয়সা। মালদা শহরে প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় খাদ্যের দাম কমানোর দাবিতে লাল পতাকার জুলুস বেরুচ্ছে, দাম কমছে না।
হরীশের ভাবনা বদল হল। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে— কয়েকজনকে ট্রান্সফার করা হবে। বলছে রুটিন বদলি। আসলে শাস্তিই। টাকার ছোঁয়াচে জীবাণুতে ঘুঘু বাসা বাঁধে। সেটা ভাঙতেই নাকি এ ফিকির। সাহেবের হাতে গোপন রিপোর্ট, তাতেই ফয়সালা। তার পেয়ারের পারদ নেমে গেলেই কাঁচি। তিনিও যে উপরির ভাগ নিলামে অদৃশ্যভাবে হাজির থাকেন, তার নামে রিপোর্ট লিখবে কে? হরীশের নামটা কি সাহেবের গোপন তালিকায় আছে! যদি থাকে? আবার নতুন জায়গা, নতুন বাসা খোঁজা, মেয়ের জন্য ইস্কুল ! বদলিটা কি শহরে, না গঞ্জে ! সেখানে জীবনযাপনের ব্যয় কেমন! বহরমপুরের এক স্টাফের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, সে শহরে বাজারে দাম মালদার দেড়া, কখনো দ্বিগুণ প্রায়। হুগলির চুঁচুড়ায় খরচ বহরমপুরের ডবল। দুর্ভাবনা গিলে খাচ্ছে হরীশকে, এই ঘরে। আসলে গৃহিনী যদি সুস্থির না হয়…। ও মেয়ে খারাপ না, কিন্তু হিংসুটে। নীচমনা। এতদিন পর স্ত্রীর স্বভাব নিয়ে এমন একটা উপসংহারে পৌঁছলো হরীশ।
— ও, বাবা, কী হল তোমার? দাঁড়িয়ে আছো !
— উঁ…হুঁ…আসো।
— জানলাগুলো কী বড়ো বড়ো ! আমাদের বাড়ির মতো নয়। তাই না,বাবা ?
— আমাদের বাড়ি নাই, মা, আমাদের বাসা, ভাড়ায় থাকি।
ছবি বাসা আর বাড়ির ফারাক বোঝে না, ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল।
বৈঠকখানাটা সাজানো গোছানোই। চারদেয়াল ঘেঁষে নিচু বেতের চেয়ার। কাঠের আলমারিটা পুরোনো, কাচের আড়ালে সৌখিন টুকিটাকি— সিরামিকের পুতুল, বাখারি চাঁছাড়ির হরিণের মুখ। সব স্নেহলতার শখ। কিনে সাজিয়ে দিয়েছে। ঘর সাজানোর এ কলাকৌশল এযুগের মেয়েদের। যাদবচন্দ্র চারুশীলার মগজে এসব ছিল না। ঘরণী হিসাবে চারুশীলা একটিই রেখেছেন— বেরুবার দরজার মাথায় বাঁধানো সূচিকর্ম। স্ফুটমান পদ্ম, নিচে পদ্মপাতার সবুজ গালিচা, উপরে অর্ধবৃত্তে অক্ষর খোদাই, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে
যাদবচন্দ্র ইজি চেয়ারটায় বসেই আছেন। উঠে হরীশের সঙ্গ দেওয়া উচিত কিনা মনোযুদ্ধে স্থানু। এতদিন পর বউমা এসে পদধূলি নিয়েছে। কোনও বিরাগ, অন্তত প্রকাশ্যে, যেন না আসে। সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করবার মতো মনের ক্ষমতা যদি না থাকে, তবে তিনি কি পিতা? শ্বশুরও যে পিতৃসমই। কিন্তু প্রাণখুলে কথাও যে বলতে পারছেন না। নাতনিটা যদি এখানে বসতো! অবরে সবরে আদরে খুনসুটিতে সহজ হওয়া যেত। তার যে কেমন কষ্ট লাগছে নিজে ছাড়া কেই বা বুঝবে !
মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে তিনজন। পুত্রবধুকে চারুশীলার মনে হয়, শীর্ণ দেখাচ্ছে, ফ্যাকাশেও, রক্তাল্পতা দেখা দিলো নাতো ? কি হয়েছে ওর ? কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি ! মেয়েমানুষের শরীর। হাজার যন্ত্রণা। ভিন্ন সংসার, ঘরে মা নেই, শ্বাশুড়ি নেই। স্বামী ছাড়া কেউ যত্ন করবে? হরীশের সঙ্গে সম্পর্কে জট লাগেনি তো? এদেশে এমন হওয়া আকছার। মনে খরা থাকলে শরীরে জল থাকে না। চারুশীলা এই সত্য প্রত্যক্ষ করেছেন। কষ্টের দিনগুলিতে স্নেহলতা কেমন শুকিয়ে গেছিল। তিনি, ওর বাবাও সব কষ্ট থেকে মেয়েকে আড়াল করতে চেষ্টা করেছেন, তবুও…। আজকে সেই মেয়ের বরণ ঝিলিক মারছে, চামড়া ভেদ করে উপরে ভেসে উঠছে ভিতরের সর ননী। চারুশীলা নানাভাবে বাসন্তীকে চোখে পরীক্ষা করেই চলেছেন। দেহে গোলাটে ঢপ ফোটেনি, তবে প্রথম অবস্থায় কখনো কখনো এমন হয়। বউমা কে জিগ্যেস করে জানবেন কি সব চক্রাবর্তন ঠিক আছে কিনা! তেমন যদি হয়, বউমাকে এখানে নিয়ে আসা দরকার। ঘরে ওকে কে দেখবে? শ্বশুর শাশুড়ি যখন আছে, নিজেদের বাড়ি আছে, ঠাকুরজামাই ডাক্তার, ওর যত্নে খামতি হবে না। এবারে একটা দাদুভাই আসুক। বলি বলি করেও বলা হয়ে উঠলো না চারুশীলার।
বৈঠকখানাটা সাজানো গোছানোই। চারদেয়াল ঘেঁষে নিচু বেতের চেয়ার। কাঠের আলমারিটা পুরোনো, কাচের আড়ালে সৌখিন টুকিটাকি— সিরামিকের পুতুল, বাখারি চাঁছাড়ির হরিণের মুখ। সব স্নেহলতার শখ। কিনে সাজিয়ে দিয়েছে। ঘর সাজানোর এ কলাকৌশল এযুগের মেয়েদের। যাদবচন্দ্র চারুশীলার মগজে এসব ছিল না। ঘরণী হিসাবে চারুশীলা একটিই রেখেছেন— বেরুবার দরজার মাথায় বাঁধানো সূচিকর্ম। স্ফুটমান পদ্ম, নিচে পদ্মপাতার সবুজ গালিচা, উপরে অর্ধবৃত্তে অক্ষর খোদাই, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে’। নজর পড়লেই ওটা মনে করিয়ে দেবে গৃহকর্ত্রীর জীবনদর্শন। তৈরি করতে সময় লেগেছিল। গাঁটছড়া বাঁধার শুভলগ্নের প্রাক্কালে কর্মযোগ্যতার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে ওটা দাখিল করা হয়েছিল। সেদিনের কথা মনে করলে চারুশীলার এখনও হাসি আসে। একটুকরো খুলনাই যেন আঁচল বেঁধে নিয়ে এসেছেন এই ঘরে। দেয়ালে আরও একটা অলংকার আছে, দেয়ালঘড়ি, ঘন্টা বাজে, দোলনচাকাটি প্রহর গুণে জানান দেয় তার সচলতা। ক-অ-চ ক-অ-চ আওয়াজ সে সূচি বুনছে আজকে এই সন্ধের জমিনে।
এই নীরবতা ঘরের চারজনের কাছেই বড় অসহনীয় লাগে।
— এইখান তোমার ঠাকুরদাদা আর ঠাকুরমায়ের ঘর, দেখিছো?
ছবি ছোট্ট মাথাটি ঝুঁটিসুদ্ধ নাড়ে।
হরীশ দেখলো খাটটি নতুন কেনা। হালের নকশা, চারপায়ায় বাঘের থাবা। খুলনায় ময়ূরপঙ্খী পালঙ্ক ছিল। খাটের পাটায় জাজিম, উপরে তোশক, পরিচ্ছন্ন চাদরে ঢাকা, বালিশ, ওয়াড়ের উপরে সুদৃশ্য আড়ালি। সব যেন বলতে চাইছে বাড়ির কর্তা অতীতের বেশন ভূষণ বদলে ফেলেছেন, নতুন হয়েছেন। ভাড়া বাসাতেও তিনটে ঘর ছিল, ছিল চৌকি, খাটপালঙ্কের সামর্থ্যই ছিল না তখন বাবার। যেটুকু ধনসম্পদ নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, সেটুকু যে কোনওভাবে রক্ষা করতে যাদবচন্দ্র হাড়কঞ্জুসি আচরণ করতেন। তার মধ্যে মেয়েজামাইয়ের আগমন। নতুন সংকট। সামলাতে গলদঘর্ম। হরীশ যেন আজ বাবার সেদিনের কষ্টাতিপাতের অবস্থাটি অনুভব করতে পারলো। প্রথমবার কর্তব্যের পরিধি বাইরে বাবার জন্য সমানুভূতির হদিশ পেল। আশ্চর্য ! সে নিজে কন্যার জনক হয়ে উঠতে পেরেছে বলেই কি হৃদয়ের এই নতুন ঝর্ণোৎসার ! সেদিন বিপন্ন পিতার পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো তার উচিত ছিল, পরিবর্তে সে বাবাকে পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেছে। নিজেকে মহাপাতক বিবেচনা করলো এখন। আত্মসুখের মারীচের ডাক শুনে বৃথাই সে এদেশে নগর-অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিরশির ব্যাথা যেন বুকের ভিতরে কাঁটা ফুটোচ্ছে, রক্ত ঝরাচ্ছে।
হরীশের বাসাটা যেন খুপরি। চৌকি পাতার পর জায়গা নেই। হ্যাঁ, বাবা মাকে ছেড়ে যাওয়াটা অপরাধই হয়েছিল।মানুবড়ো তৎক্ষণের প্রভাবে পড়ে যায়, দুর্বল তার মনের কাঠামো, আগু ভাবা পিছু দেখা কিচ্ছু নেই, বেকাজটি করে বসে, পরে পস্তাতে হয়, দীর্ঘশ্বাস ঢেলে ঢেলে ফাঁকপূরণের অপরিনামি চেষ্টা করে। হরীশের গলার ভিতরে কোনও কথা উচ্ছিন্ন হচ্ছিল, বেরোতে পারছিল না, পাক খাচ্ছিল, দম আটকানো অস্বস্তি, শেষে যেন না-উচ্চারণে প্রার্থনায় মুক্তি পেল, — বাবার জেবনে খুলনের সুখির দিনগোলানের সুখ নয় এটুকখানই ফিরায়ে দাও, ভগবান! অন্য কিছু চাইবের অধিকের আমার নাই। —জল আসছিল ঠেলে, হরীশ রুমালে ঢাকলো চোখ।
— বাবা, চোখ ডলো কেন?
— দেখতো, মা, পুকা পড়লো নাকি? চোলকাতিছে। এট্টু জোরে ফোঁ দে।
ওই ঘরেই চারুশীলার সাধের আলমারি আয়না টেবিল। র্যাকে নানা সৌখিন সরঞ্জাম। একধারে চামড়া-বাঁধানো মোটা একটি বই, তুলে নিল হরীশ কৌতুহলে, পাতা উলটালো— ‘গনিত রসায়ন মাত্র’। লেখক অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ। ভিতরপৃষ্ঠায় তাঁর স্বর্ণাক্ষরে লেখা — ছাত্র পুত্রসম, স্নেহের যাদবচন্দ্রকে শুভাশীর্বাদ। বইয়ের নীচে আর একটা মোটা লালমলাটি খেরোর খাতা। সুতলির বাঁধনটা খোলে হরীশ। অবাক বিষয়! গণিতের একই সমস্যা কতরকম ভাবে সমাধান করা যায়, তারই দলিল। বাবা কি এখনও অঙ্ক কষেন! হরীশ হতচকিত হয়ে ভাবতে থাকে।
নিজের ভিটে। ঘরণীর স্থায়ী ঠিকানা। মাটির চিহ্ন। আত্মপরিচয়ের নতুন কিন্তু দৃঢ় অবয়ব। খুলনা থেকে ভাসতে ভাসতে এতদিন ধরে অসম্ভব স্বপ্নসম্ভাবনাকে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে জিইয়ে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীকে আদর করে রাজি করাতে চেয়েছেন, কেঁদে সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এই একটি ব্যাপারে, সঠিক অর্থে, স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। কী হয়েছে জামাইয়ের অর্থ নিলে ! সে যে ছেলের মতোই। যেখানে ছেলে, ছেলের বউ তাদের দেখে না, দেখবেও না। পন্ডিত গোঁয়ার যাদবচন্দ্র সেদিন হার মেনেছিলেন। বিজয়িনীর হাসিটি ফুটে উঠেছিল চারুশীলার মুখে
অঙ্কে তিনখানা বড়ো শোয়ার ঘর। বাকি দুটোতেও চৌকিপাতা, বিছানা। তবে মামুলি।বোঝাই যায় ঘরদুটি ব্যবহার হয় না। বুড়োবুড়ির জন্য এতগুলো কামরার কী প্রয়োজন ! অবশ্য বোন-বোনাই এসে থাকতে পারবে। বাবা মায়ের কাছে কাটিয়ে যাবে দিনকতক। কিন্তু ওদের নিজেদের বাড়িও যে এই পাড়াতেই, ওদের ছেলেটা গলি ছুটে চলে আসতে পারে। ওরা কি এখানে থাকবে ! ঘরের সংখ্যাটা যেন অঙ্ক শাস্ত্রের অসীম সংখ্যামানের তত্ত্বে ক্রমবর্ধিষ্ণু হয়ে ফাঁপতে থাকে। বাবার কাছে কি বলতে পারে হরীশ — বাবা, আমি, আমরা, তোমার বাড়িতে এসে থাকি? যদি অনুমতি দাও। যে বাসায় আছি, ভাড়া মিটোয়ে হাতে বেশি কিছু থাকে না, বাবা। মেয়েটা বড়ো হতিছে। এ দেশিতে খরচা কেমন সিটা তুমিও জানো। — বাবা কি সামান্য ভাড়া দাবি করবেন! ভাবতে ভাবতে হরীশ অবসন্ন বোধ করে। ছবির মা যদি একটু বুঝদারি মেয়েমানুষ হতো !
— বাবা, ও বাবা, ওই দেখো! গাছটায় টিয়ে পাখি। কেরম করে দোল খাচ্ছে।
— হুঁ।— মনে পড়লো হরীশের, টিয়ারও একটা ভালোনাম, পোশাকি নাম ছবির নামের মতো সুন্দর আছে। হীরামন।
বাসন্তী উসখুস করছিল, এতক্ষণ চুপ বসে থাকা তার ধাতে নেই, বলল — তয়, মা, কুঠাখান তো বড়ো সোন্দর করিছেন। শোনলাম, ঠাকুরজামাই নাকি বানায়ে দেছেন। এমুন কপাল কয়জনার হয় কন।
চারুশীলা আঁতকে উঠেছেন। স্নেহলতা পাশেই, কিছু মনে করল না তো! বউমার কথায় ছিরি নেই। ও কি ঠেস মেরে কথা বলতে চাইছে? মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকালেন, বিশেষ ভাবান্তর পেলেন না। যাক! হাঁফ ছাড়লেন মনে মনে। মেয়ে এখন গিন্নিবান্নি হয়েছে, সংসারে অর্থাগম ভালো, স্বামীর নামযশ। কোমরে জোর বেড়েছে স্নেহলতার। নীচ বিদ্রুপ বা ঠাট্টাকে উপেক্ষা করার শক্তি বা কৌশল আয়ত্ত হয়েছে আপনা আপনি। ইজি চেয়ারে বসে থাকা যাদবচন্দ্রকেও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
ঘটনাটা যে সত্যই। ওরা না বানিয়ে দিলে নতুন করে বাড়ি এ জীবনে হতো না। যাদবচন্দ্রের তো আপত্তিই ছিল। সম্মানে খোঁচা দিচ্ছিল। লুব্ধ হয়েছিলেন চারুশীলা। নিজের ভিটে। ঘরণীর স্থায়ী ঠিকানা। মাটির চিহ্ন। আত্মপরিচয়ের নতুন কিন্তু দৃঢ় অবয়ব। খুলনা থেকে ভাসতে ভাসতে এতদিন ধরে অসম্ভব স্বপ্নসম্ভাবনাকে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে জিইয়ে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীকে আদর করে রাজি করাতে চেয়েছেন, কেঁদে সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এই একটি ব্যাপারে, সঠিক অর্থে, স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। কী হয়েছে জামাইয়ের অর্থ নিলে ! সে যে ছেলের মতোই। যেখানে ছেলে, ছেলের বউ তাদের দেখে না, দেখবেও না। পন্ডিত গোঁয়ার যাদবচন্দ্র সেদিন হার মেনেছিলেন। বিজয়িনীর হাসিটি ফুটে উঠেছিল চারুশীলার মুখে। স্নেহলতারও। এখন, বউমার কথায়, স্বামীর মুখটা কালো দেখাচ্ছে, বিমর্ষ চোখের তারা, যেন অনুচ্চার ভর্ৎসনাটি উগড়ে দিচ্ছেন স্ত্রীর দিকে। অপমান ধিমি আগুন জ্বেলেছে বুকে। চাইছিলেন প্রবলভাবে, কিন্তু পুত্রবধূকে কিছু বলতে পারলেন না।
স্নেহলতার পক্ষে আর বধির বসে থাকা সম্ভব হল না — বউদিদি, তুমি রটনাখান শুনিছো ঠিকই, তবে অদ-ধেক শুনিছো। তোমাগের সকলির আশেব্বাদে তোমার ঠাকুরজামাইয়ের কিছু টাকাপয়সা হইছে বত্তমানে। পেতামাতার জন্যি সোন্তানদের কত্তব্য থাকে, তাই নে? তাই বলি তেনায় বানায়ে দেন নাই। জামাই মানুষ, তার অধিকের কী? মেয়ি বিয়েশাদি হলি পর হয়ি যায়। বাবা মায়ের কাছে কুথায় তুমি-দাদা, আর কুথায় আমি-তিনি! আসলিতি কুঠা বানাতে যায়ি বাবার কিছু খামতি পড়িছেল। কামটা বন্ধ করি দিতি চ্যালেন। তেনার হাতে টাকা ছিল, দেছেন। উধার। বাবা পেনসোন থেকি অল্প অল্প করি শুধ দেচ্ছেন।
তোড়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে বাসন্তী নিচুগলায় প্রত্যুত্তর সাজায়, — ঠাকুজ্জি, এমুন করি কচ্ছ কেন! এতবড়ো কোঠাখান, তাই কয়ে ফেলেছেলাম। ঘাট হইছে। পুত্তের কত্তব্য থাকে, ঠাকুজ্জি, কিন্তু তোমার বড়ভায়ের যে সাধ্যি নাই, সে তার বাবার বাড়ি করি দেবে, নিজের ঘর তোলবে!
— তেমন হলি লজ্জা খায়ি আমারে কয়ো। আমি তেনারে কবানে। সমিস্যে থাকবে না। তেনার মনখান ছোট না। কোন বংশের সন্তান তিনি, জানোই তো। আমি কই, নতুন ঘরবাড়ি করবাই বা কেন। এ বাড়িতে তিনখান ঘর, বুড়োবুড়ির কয়খান লাগে? উয়েরা আজ আছে, কাল নাই। কখন যে ধম্মোরাজের চেডি আসি পড়বে! তাই কচ্ছি, চিন্তে নাই, বাসার পাঠ চুকোয়ে ঢুকি পড়ো। শউর শাউড়ির সিবা যত্ন করো। উয়েরা ভালো থাকবেন, তোমরাও ভালো থাকবা। আলি আমারি এট্টু সুরেহা হয়। রোজ আসতি লাগে না। আমারও তো সোংসারে কাজ কম না। তোমার ভানজেখান বড়ো হতিছে।
বাসন্তী এইবার ডুকরে উঠলো। এ কি সেই মুখচাপা, ভয়শীতলি মেয়েটা ! তার সেই ননদ ! এখানে আসবার আগে যে কামনাটি বাসন্তী অন্তরে আঁচলের তলায় লুকিয়ে এনেছিল, পরে আরও কয়েকবার এসে ধীরে ধীরে খোলসা করবে ভেবেছিল, সে পরিকল্পনা ননদের কাছে এইভাবে ধরা পড়ে গেল! নারীর কাছে নারীর হেরে যাওয়া! কাঁদছে বাসন্তী, শব্দ পাক খাচ্ছে ঘর জুড়ে।
যাদবচন্দ্র, সাড় নেই যেন, বসে রইলেন চেয়ারে। স্নেহলতার ছেলেটি বিমূঢ় দৃষ্টি মেলে দাদুর কোলে নেতিয়ে পড়েছে।
চারুশীলা চটপট বললেন — এই স্নেহ, চুপ কর, মা। বউমা কাইন্দো না। অনেকদিনের দুঃখ্যু জমা তো, বেরায়ে পড়িছে।
— ভুলি নাই, বউদিদি, তেনারে কী কী কইছো, মুখিতে, চক্ষুতে, শরীরীর দাগে এমনকি না কয়ি কইছো। চেষ্টা করলিই কি সেগোলান ভুলবের পারি? — ক্ষিপ্ত নাগিনী যেমন দংশনের আনন্দে দাঁত ফুটিয়ে বিষের সবটা ঢেলে ক্লান্তিতে একদিকে কাত হয়ে পড়ে স্নেহলতা বাসন্তীর থেকে চোখ সরিয়ে জানলায় রেখেছে। হালকা লাগছে, খু-উব হালকা।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২৪
❤ Support Us