Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • আগস্ট ২৫, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৪০

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৪০

।। শুকনাকান্ড ।। 

সোনা রূপার কাঠিকাঠা

 

অনঙ্গপুর। 
 
সেদিন আর আজ ! একদিন এই জনপদে বাস করেছিলেন, এখন অন্যত্র, এমন লোকের কাছেই পার্থক্যটি ধরা পড়বে। যারা আছেন স্থায়ী, তাদের চোখে পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে ঘটেছে বলে চমক লাগে না। 
 
সেসময়ে গ্রাম। পুব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ জুড়ে। রেলস্টেশনের গায়ে একটু গঞ্জগন্ধ, বাজার, দোকান একটা দুটো। পুবে স্টেশনের গা থেকে একটা রাস্তা ছিল, কাঁচা, কোথাও কোথাও মোরামের ভগ্নাবশেষ। এখন কালোপিচ, বেড়ে বেড়েছে আড়ে বেড়েছে, দুটো মালঠাস লরি কিংবা যাত্রীঠাসা বাস পরস্পরকে টেক্কা দিতে ইচ্ছা করলেও পিচপথ উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। সেদিন স্টেশন থেকে নামলে পুব সীমানা জুড়ে ধানক্ষেত, সবুজে সোনালীতে স্নিগ্ধ নয়নসুখ। অনেকদুরে দেখা যেত বিরাটাকার বৃক্ষের সারি। সন্ধে নামলে ছোটো প্ল্যাটফর্মের আপডাউন দুটিতেই দেখা যেত টিমটিমে ফিলামেন্ট বাল্ব। আবছা আলোয় রহস্যের মায়াঘোমটায় মাথাঢাকা কনে বউটির মতো যেন বসে থাকতো সমস্ত অনঙ্গপুরটাই। 
 
উন্নতি ঘটেছে সবকিছুরই। রাস্তার নামেরও হবে। পুবের ওই রাস্তাটির এখনকার নাম কল্যাণী রানাঘাট নিউ রোড। লোকেরা সংক্ষেপ করে, কে আর এন। পুবপারে এখন নতুন শহরতলি। তিনতলা চারতলা বাড়ি একের পর এক। সেদিনের বৃক্ষশোভাকে বিদ্রুপ করে। আলোয় আলোয় ঝলমল সন্ধেলগ্ন। বাইরে থেকে স্বচ্ছল লোকেরা এসে ভিড় করেছে এখানে। তৈরি হয়েছে অনঙ্গপুর নোটিফায়েড এরিয়া অথরিটি, শোনা যাচ্ছে শিগগিরি মিউনিসিপ্যালিটি হবে। নির্বাচন হবে। উনিশটা ওয়ার্ড। ভোটের ঢাক না বাজলেও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সাধন হিসাব করে, বারোবছরে এই বদল। আরো বারোটি বছর যদি বেঁচে থাকে, তবে দেখে যাবে অনঙ্গপুর দ্বিতীয় কলকিতা হয়ি গেছে। 
 
সময় গোনার মত সময় আছে সাধনের এখন। অঢেল না থাকলেও অনেকটা বিশ্রাম তার। গোপাল সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মুখে না বললেও ছেলের কাছে যে ঋণী মনে মনে বলেই। অহংকারও একটু হয় বইকি। 
 
কে আর এন রোডের গায়ে অনঙ্গপুর নিউ মার্কেট। ব্যবসার রমরমা ঢাল খেয়ে ওদিকটায় চলে গেছে। হকার্স কর্ণার এখন মরা বাজার। বেশিরভাগ দোকানে বেচাকেনা প্রায় নেই, দোকানদারেরা অভ্যেসে আসে, গনেশের জলবাতাসা দেয়, ধূপধুনোর তিনপাকও। তারপর হাঁ করে চেয়ে থাকে পথের দিকে, নয়তো নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে, দুপুরে খেতে যায়, আবার সন্ধেয় ঝাঁপ খোলে। অভ্যেস। যেন প্রাত্যহিক নিত্যকর্ম, পুণ্য বা পাপ কিছুই সঞ্চয়ে জমা পড়ে না। রাত্রি নটা বাজলে, পুজো পরবের মরসুমেও হকার্স কর্ণার অন্ধকার হয়ে যায়। দোকানের আয়ে সংসার চলে না অনেকের, সেটা স্পষ্টই। ঝুলন্ত মেলাটা এখনও প্রতিবছর হয়, কিন্তু বাজার আর জমে না। একসময়ের বিজ্ঞাপন এখন শুধু নামে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের দোকান।.কয়েকটা বিক্রির চেষ্টা চলছে, ঠিক খদ্দের মিলছে না। 
 
এদিকে বিজয়চাঁদ সিং চেনানা পুরো হকার্স বাজারটা চাইছে। পরিকল্পনা, ওখানে হাউজিং কমপ্লেক্স তৈরি করবে, এল আই জি, এম আই জি, এইচ আই জি। হঠাৎ জেগে ওঠা বাঙালি অবাঙালি মধ্যবিত্তদের ভোগের জন্য স্বপ্নের নতুন ফেরিওয়ালা সে, বলেছে — সভি দুকানদারকো একটা করে ফিলাট দিবো, এলাইজি, একদম মুফত। — দোটানায় পড়েছে সকলে, বেচলে নগদ কিছু হাতে আসে, অন্য ধান্দায় ঝাঁপ দেওয়া যায়, কলোনির টেরানজরি রিফুজিপট্টি ত্যাগ করে ভদ্দর লোকেদের গা-মাখা হওয়া যাবে। সামাজিক মর্যাদা কয়েক সিঁড়ি টপকে উপরে উঠবে। 
 
সবাই সাধনের পরামর্শ চায় — সিংজি রুজি আসতে লাগছে। কইতাছে পয়লে সইসাবুদ কর দেনা, ভাইয়া। অখনই তো দুকান ভাংতাছে না। 
 
সাধন এড়িয়ে যায় — যা ভালো মনে লাগে করবি। তবে বাজার আর বেশিদিন রাখা যাবে না বুধায়। সিংজি, মনি হচ্ছে, পার্টে পার্টে ভাঙ্গে পাসাদ তোলবে। তারপর যে কটান বাকি থাকবে, চাপের চোটে টপাটপ গিরাস করি নেবে। সব পার্টির নিতারা আসি কথার বাজার গরমায়ে দেবে, ভিৎরে ভিৎরে পাকা চোক্তি হয়ি গিছে তাগেরে।
 
আসলে সাধন গোপালকে একটু ভয় পায়। ছাব্বিশের জোয়ান হল। বুদ্ধিটা বাপের মতো মোটা নয়, মায়ের মতো মিহি।
 
গোপাল এসে বললো — বাবা, রাজি হবে না, তুমি, আমি না-বললে। দর উঠুক। ও দোকান রাখা যাবে না ঠিকই, কিন্তু পাঞ্জাবী চালাকি করে আগেই লেনদেন মিটিয়ে রাখতে চাইছে। 
 

টাকা নিয়েই খুঁতখুঁতানি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমেও যে সঞ্চয় সিন্দুকভরা নয়। দুজনের জীবনের ‘ছিকরিটি’। এছাড়াও ছেলের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি।  আর কত দেরি করবে! সেখানে খরচাপাতি আছেই। নতুন বউ আসার আগে একটা ঘর তোলা দরকার। এমন সাধারণ ছোটো ঘরে সে থাকতে পারবে কি! এমন পাত্রী মেলাও দুস্কর। সংসারযাপনের রীতটাও যে বদলে গেছে

 
এসব কথা উঠলেই সাধন কেমন উদাস হয়ে যায়। স্বপ্ন ! তার আর রমার। শ্রম ! দুজনের। চন্দ্র রেডিমেড স্টোর্স। সেই গড়ার দিনগুলি ! সাধন নিজেই মজুর, নিজেই ঘরামি। বিন্দু বিন্দু ঘামের বিপণি। দেশ ছেড়ে এসেছিল খুড়িমা খুড়েমশাইকে হাতে ধরে। এবার কি গোপাল তাকে রমাকে নিয়ে যাবে চরগাঙপুরের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও! হয়তো ক্যাম্পে আশ্রয় পেতে হবে না, কিন্তু ক্যাম্পের মতই আবার শিকড়হারা অবস্থান। গোপাল তাদের দুজনকে নেবে তো ! নীলাম্বরের মতো হয়ে যায় যদি। হয়তো সাধনদেরও সন্তান হারানোর বেদনা অন্তরে  বাহিরে বয়ে বয়ে শেষে চন্দ্রমোহনের মতো অর্ধোন্মাদ করে দেবে নাতো ! রমা কি খুড়িমার মতো…। আর ভাবতে পারে না সাধন, তার কান্না আসে। এখন তার চোখের চরিত্রবদল ঘটেছে। সাধন কি সত্যিই বুড়ো হলো ! 
 
গোপালের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছে দুজনেরই। 
 
ব্যবসাটা অনেকদিন হলো গোপাল হাতে নিয়েছে। সাধনকে বড়োবাজার ছুটতে হয় না, তৈরি মাল পাইকারি ডেলিভারি ছেলেই করে। সকালে সন্ধ্যায় সাধন দোকানে এসে কেবল ক্যাসবাক্স সামলায়। 
 
ছেলে দায়িত্বশীল, বাবা মা তৃপ্তিতে ছিল। হঠাৎ…।
 
কারণটা, বা কারণগুলো, অতি সাধারণ। 
 
গোপাল কে আর এন রোডে নিউ মার্কেট এক্সটেনশনে দুটো বড়ো দোকানঘর নিতে চায়, টাকা চাইছে। সেলামি, আগাম, তিনমাসের অগ্রিম ভাড়া, মার্কেট কমিটির চাঁদা, ঘরদখলের আগে পলিটিক্যাল দাদাদের পেন্নামি, তারপর ডেকরেশন, ফার্নিচার, চন্দ্র রেডিমেডের মত র‌্যাকমার্কা হলে চলবে না, ডিসপ্লে চাই, চোখ ঝলসানো শোকেস। কাজেই টাকার অঙ্কটা ভরাট।  
 
টাকা নিয়েই খুঁতখুঁতানি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমেও যে সঞ্চয় সিন্দুকভরা নয়। দুজনের জীবনের ‘ছিকরিটি’। এছাড়াও ছেলের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি।  আর কত দেরি করবে! সেখানে খরচাপাতি আছেই। নতুন বউ আসার আগে একটা ঘর তোলা দরকার। এমন সাধারণ ছোটো ঘরে সে থাকতে পারবে কি! এমন পাত্রী মেলাও দুস্কর। সংসারযাপনের রীতটাও যে বদলে গেছে। 
 
বিয়ের প্রস্তাব নিয়েও বিরোধ। 
 
মায়ের সঙ্গেই সংঘাত চলে — বিয়ে বিয়ে যে গাওনা লাগাচ্ছ, মা, সেটা হলে বউকে নিয়ে ঘর করতে পারবে?
 
— ক্যান? পারুমনা ক্যান? তর ঠাকুমায় আমারে নিয়া সোংসার করে নাই? 
 
— ঠাকুমার কথা ছাড়ো। আমার মা যে ঘরে ঢুকেই বাবাকে বলেনি যে তার মা কে আলাদা করে দাও, নইলে সে থাকবে না। আমার বউ এসে প্রথমেই এই কথা বলবে। আর আমি যে তার কথা না শুনে থাকতে পারবো না, মা। তার চেয়ে বিয়েটা এখন থাক। 
 
—বা-বা! বিয়া না হইতেই পুলার আমার বউয়ে টান! 
 
— হবে না কেন? আমি তো বড়ো হয়েছি, দেখতেই পাই, বাবার টান আমার চেয়ে তোমার দিকেই বেশি। 
 
রমার, বোধহয়, লজ্জা এসেছিল, — এই গুপাল! দুষ্টামি হইতাছে, না? বাবায় রে কমু। দেউক পুলার পিঠে চাপুড় কয়খান। 
 
গোপাল জড়িয়ে ধরেছে — মা, ওমা, তুমি বাবাকে বলো। দোকানঘরটা নিই। তোমাদের যে বয়স হলো। আর কত কাজ করবে ! ওদিকে হকার্স উঠে যাবে। সময় চলে যাচ্ছে, মা। অন্যেরা খাপগোপনে বসে আছে। সুযোগ পেলেই খপ করে নিয়ে নেবে। ঘরের মালিকও ফায়দা খুঁজছে, সেলামির টাকাটা বাড়ানো যায়। আমি পার্টির দাদাদের ধরে একমাস সময় চেয়ে নিয়েছি। ব্যাঙ্কেও গেছি, বলেছে দোকানটা পেলেই লোন মিলবে। নতুন বিজনেসটা দাঁড় করিয়ে নিই, তারপর তোমার বউ এনে দেবো। সে শ্বশুরশাশুড়িকে দেখুক, না দেখুক।
 
সাধনের সঙ্গেও ছেলের মতিগতি নিয়ে ছেলের কথা হয়। 
 
— কারুর সাথি ভাব-ভালুবাসায় পড়ে নাই তো, তোমার ছাবাল? 
 
— পড়তেই পারে। বাপে পড়ছে। কুলের ধারা। যাইব কই? 
 
— আমি পড়ি নাই। পড়িছিল তার মা। 
 
— হুঃ। পইড়া হাপানি চুবানি খাইতাছিলা।  চোখে চাওনের খ্যামতা আছিল না। কাপুরুষ এইক্কেরে! 
 
এরপর কথা বলা যায় না, বলতে নেই। এক শিরশির বেদনার আনন্দে ডুবে ওরা মূক হয়। 
 
— সেইদিন আর ফিরা আইবো না। আমাগো জীবনে। না আসুক। আসা সম্ভুবও না। কিন্তুক, আমাগো পুলাপানের জীবনে কি আইবো? কে জানে!
 
নিউ মার্কেটে গোপাল মন্ডলের দোকান। একটি ঘরে অফিস। স্টিলের আলমারিতে অ্যাকাউন্ট বুক। একজন টাইপ রাইটিং জানা কর্মচারী, মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলার জন্য চেয়ার গোলটেবিল, টেবিলে টেলিফোন। পাশে বড়ো রিটেল ফ্লোর, ডিসপ্লে চোখ ধাঁধানো, ঝুলছে ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ, সুদৃশ্য বাক্সের আড়ালে অন্তর্বাস। প্রথা ভেঙে একটি সেলসগার্ল রেখেছে গোপাল, যুবতীটি সুন্দরী, সুভদ্র এবং চটপটে। দোকানের মাথায় বিশাল নিওন সাইন— হুম লেডিজ গার্মেন্টস। হোলসেলার্স। ফ্যাক্টরি…। এ ফার্মে সাবরেটে অনেকে কাজ করে। মাঝে মাঝে গোপালকে ক্লাইন্টমিটে বাইরের মার্কেটে– বর্ধমান আসানসোল শিলং যেতে হয়।
 
প্রায় সন্ধেতেই সাধন এসে বসে দোকানে। সময় পেলে রমাও একপশলা ঘুরে যায়। 
 
রমা ভাবে, গোপালের সঙ্গে সেলসের মেয়েটিকে জুড়ে দিলে কেমন হয়! দুজনে মিলে ব্যবসাটা দেখতে পারবে। ভাবলো, সাধনের সঙ্গে কথা বলবে ও।আজই।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৩৯

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৩৯


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!