- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৪৫

।। শুকনাকান্ড ।।
আরশিপাড়া
ঘঁ-অ-ক।
ট্যাক্সিটা সাধনের মুখে এসে ব্রেক কষে। ঘাট থেকে নতুন রাস্তা ধরে ফিরছিল সে। হঠাৎ ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তখন। এক ভদ্রলোককে দেখতে পায়, গাড়ি থেকে নামছে, পোশাকেআশাকে চেকনাই।
সাধন ভাবছিল বলবে— খিয়াল করতি পারি নাই, ছ্যার। — বলা হল না।
আগেই লোকটা বলে উঠেছে, — আমার সাধনদা !
রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো দূরে দূরে, এখানে জায়গাটা কুয়াশার মতো আবছা। সাধন মুখ তুলে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করে। চেনা চেনা, গলার স্বরটাও। সামান্য সাহস খুঁজে বলল — কোঞ্জবাবু !
— এই তো, একচান্সে চিনে ফেলেছো ! কেমন আছো, বল। কতদিন পরে দেখা। চোদ্দ পোনেরো বছর তো হলোই। বয়স বেড়েছে ঠিকই, তুমি কিন্তু একইরকম আছো। তা ব্যবসার খবর কী ?
— আগের মতুন না। হকার্স মারকিট বসি গেছে। এখন খাটতিও পারি নে অতখান ।
— তাতে কী ! তোমার ছেলের দোকান তো ভালোই চলছে। এখানে না থাকলে কী হবে, সব খবরই রাখি গো। বাড়ি যাচ্ছো তো ? চলো, গাড়িতে ওঠো। রমা বউদি কেমন আছে ? সেই মুড়ি আলুভাজার ভোজ আমি জীবনে ভুলবো না।
— না, না, আপনের সুমায় নষ্ট হবে। আমি একাই হাওয়ায় হাওয়ায় চলি যাবো।
— বেশ, তাহলে এখানে ধারে দাঁড়িয়েই কথা বলি, এসো।
কুঞ্জ এসেছিলেন কৃষ্ণনগর, রাণাঘাটে। দুই শহরে তার কয়েকজন খাতক আছে। প্রচুর টাকার লেনদেন, হুন্ডিতে দেনাপাওনার চলাচল। বছরে, বা দুবছর পরপর, হিসেবের কাটাকুটি মিলমিশ করতে হয়। খাতকেরাই আসামে মহাজনের ডেরায় যায়। এটাই প্রথা। এবারই মহাজন নিজে এসেছেন। কারণটা অবশ্য ভিন্ন। এরাজ্যের ফরেস্ট জোনে ডিফরেস্টিংয়ের বরাত নিয়েছেন তিনি। ছমাসের মধ্যে অনেক গাছ কাটা পড়বে, প্রচুর টিম্বার। সে খবরটা খাতকদের দেওয়া। এখানেই যদি বিক্রিবাট্টার ব্যবস্থাটা করা যায়, রাহাব্যয় অনেক কমে যাবে, লাভের অঙ্কটা বেশি।
কদিন খাতকদের ঘরে থেকে কাজ সেরেছেন, ফিরছিলেন কলকাতায়, সেখানেও সরকারি দফতরে কিছু কাজ আছে। অফিসারদের পাওনাপাতি চূড়ান্ত করে আসামে ফিরবেন। পথে সাধন।
কুঞ্জ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে চেন খুলে একটা কার্ড ধরেন — ধরো, সাধনদা। রেখে দাও। ছেলেকে দেবে, বলবে, আসামে যদি ব্যবসা বাড়াতে চায়, আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে। ভয় নেই, তার কুঞ্জজেঠু তার কাছ থেকে কমিশন নেবে না। শুধু গিয়ে যেন বলে, আমার সাধনদা রমাবউদির ছেলে সে। তোমাদের দুজনকে আমি সারাজীবন ধরে.মনে রাখবো। লোকভোলানো কথা নয়গো, সাধনদা, সত্যি।
সাধন লজ্জা পেল, হাসলো বিনয়ে।
কুঞ্জবাবুর যেন ব্যস্ততা নেই, — তাহলে, সাধনদা পার্টির সঙ্গে সামান্য সম্পর্কও রাখলে না !
— না, দলের লোকিদের সাথি দেখাসাক্ষেত হয়, কোশলকথা হয়।উরা দলে ফিরি যাতি বলেন। আমি ভিড়ি নে। আমার দলছাড়াতি কী আর ক্ষেতি হইছে ! কিন্তুক, আপনি যে নিতামানুষ ছিলেন, কুঞ্জদা। আপনিও যে দল ছাড়ি বসলেন একিবারেই। বিশ্বেসই হতি চায় না।
— হাঁপিয়ে পড়েছিলাম গো। কেন, জিগ্যেস করো না। তা আমি দল ছেড়ে দিলেও দল আমায় ছাড়লো কোথায় !
— মানি বোজলেম না।
কুঞ্জ সজোরে হেসে উঠলেন — ওই মানিই। টাকা দিতে হয় দলকে। সব দলকে। বাছবিচার করি না। নিতাইদার দল, সতীনদার দল, আনিসুরের দলের ষাটবাষট্টি টুকরোর প্রত্যেকটা দল, এমনকি অনিমেষের এখনকার দলকেও।
— অনিমেষের দলের অনেক টাকা।
— তাতে কী ! ব্যবসা করে খাই তো। আমাদের লাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম। ভালো করে খোঁজ নাও, সাধনদা, তোমার ছেলেকেও দিতে হয়। আমার কিস্তি বেশি, ওর হয়তো কম। শুনলে তুমি অবাক হবে, যারা মাঠে হাটে টাটা বিড়লার মুন্ডুপাত করছেন রোজ, তাদের কাছ থেকেও নিয়মিত পার্টিফান্ডে টাকা জমা পড়ে। সব মক ফাইট। মোরগলড়াই। যাকগে, আনিসুরের খবর জানো, সাধনদা ?
— না।
— কেন, খবরের কাগজ পড়োনি ! কতবড়ো হেডলাইন ! আনিসুর মারা গেছে। কীভাবে, জানো ?
অলৌকিক গল্প শোনে সাধন। কুঞ্জ এত গোপন কথা জানলেন কী করে ! অনিমেষরা নাকি নতুন একটা টুকরো হচ্ছিল। ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্যই অনিমেষের ঠিক করা এক বাড়িতে আনিসুর এসেছিল। এসে দেখে, সে বাড়ি তালাবন্ধ। পাশের বাড়ির লোকের কাছে চাবি রেখে গেছে, আনিসুর যথাকতে পারে। আনিসুরের পাকা মাথা, মুহুর্তে তার মনে হয়, বোধহয় ফাঁদে পড়ে গেছে। পলকে যে ম্যাজিকের মতো কোথায় মিলিয়ে যায়।
সারারাত সতীনদার দলের অ্যাকশন গ্রুপ, অনিমেষের গ্রুপ, রায়চৌধুরিদের গুন্ডারা, সাদাপোশাকের পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছে ওকে। একেবারে চতুরঙ্গ যুদ্ধ। পায়নি। রাত্রির সেই অন্ধকারে আনিসুর কোথায় যে আত্মগোপন করেছিল, আজও কেউ জানে না। সে রাতের সপ্তাহতিনেক পরে চন্দননগরের এক সেফ হোম থেকে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়।
— আমি তোমাকে বলছি, সাধনদা, ওকে ধরিয়ে দিয়েছিল অনিমেষদেরই আরেকটা টুকরো। নইলে পুলিশের বাপের সাধ্যি নেই আনিসুরের মতো কর্মীকে গ্রেফতার করে। তারপর জেলবাস। বিচারহীন ঘানিটানা। এদেশের পেনাল কোডে যত ধারা সব ওর বিরুদ্ধে ঠোকা। একদিন জেলবন্দিদের কয়েকজন জেল ভেঙে পালাতে গেল। যা হয়। পাগলাঘন্টি। গুলি। ফসিলেড।
আনিসুর ওই হঠকারীদের বুঝিয়ে সামলাতে গেছিল। জেলের কর্তারাই ওকে পাঠিয়েছিলেন।
— একটা গোছানো ষড়যন্ত্র ছিল, সাধনদা, আমি বলছি। ওই গোলাগুলিতে আনিসুর ছাড়া আর কেউ মরেনি।
কুঞ্জ আর কথা বলেনি। সাধনও নিশ্চুপ। নিউটাউন রোডের মাথায় ক্ষয়া চাঁদ, দখিনাবাতাস হালকা ছুঁয়ে যাচ্ছে, স্নিগ্ধ, নেশা ধরানো।
— যাই, সাধনদা, ইচ্ছে করলে চিঠি দিও। আমি মানুষটা বদলাইনি, কাজ বদলেছি। — কুঞ্জ গাড়িতে উঠে যান। সেটা ছাড়ার শব্দ হয়, উধাও হয়ে গেলেন দেখতে দেখতে।
সাধন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে, ন্যাড়া চারপাশে একা বটগাছের মতো।
সেই রাত্তিরটা ! গোপালকে একবার দেখতে চেয়েছিল আনিসুর, বাদ সেধেছিল রমা, আনিসুরের বিপদের ভয় পেয়েছিল।
সাধনের ঘরে মুসলমানি ঢংয়ের পাঞ্জাবিটা পড়ে আছে এখনও, সেটা পড়েই বুনোকালির মন্দিরে বিয়ে। রমা ওটা কোন বাক্সে রেখেছে ? ঘরে গিয়ে খুলে দেখবে। ওই পোশাকে আজও আনিসুরের হাতের ছোঁয়া জ্যান্ত হয়ে লেগে আছে। তাকে ছোঁবে সাধন। অজান্তে বিড়বিড় করে বললো — নেতাইদা, একমাত্তর আনিছুরদাদাই আপনের শিক্ষের মান রাখিছে। কিচ্ছু পায় নাই। কিচ্ছু নেয় নাই। আপনের খুয়াবে শহিদ হয়ি গিছে সে। ছিলাম, তোমারে আনিছুরদাদা, বহত ছিলাম। — কাঁধের উপর মুঠোহাত তুললো সাধন। অনেক দূরে চাঁদ আর তারারা।
দেশে যাবে কথাটি কেবলই ভাবছে সাধন। কেন যে ভেবে পাচ্ছে না। একেই কি নাড়ীর টান বলে !
এদেশ এখন শান্ত। ভোটের পর সতীনদার দলের একচ্ছত্র শাসনাধিকার কায়েম হয়েছে। একটা মিলিজুলি আছে, সেটা নামেই। অন্য দলেরা বাস্তবে সতীনদার দলে গ্রস্ত হয়ে গেছে।
দেশে আন্দোলন, বিক্ষোভ কিছু নেই, কাজেই দারিদ্র নেই, হাহাকারও নেই। দিল্লির ভিন্নদলের সরকার বন্ধু, তাকে বিব্রত করা উচিত ধর্ম নয়।
এতে সাধনের খারাপ লাগার কথা নয়। তবু খটকা লাগে, এই যে ক্ষমতার সুখাসন, তার মাঝখান দিয়ে, ঠিক চরগাঙপুর চেরা বিটুমিনের রাস্তার মতো, ভুলের কালো নদীর প্রবলস্রোত ঢুকে পড়বে না তো ! ক্ষমতার লোভ যে সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী।
উটকো এই ভাবনার ঘূর্ণি হাওয়াকে দূরে ঠেলে দিতে চেষ্টা করেও কেন যে জালে ঢুকে পড়ছে। বিকেল থেকেই এই গন্ডগোল। সচেতন হল সাধন। জোরে পা চালালো।
ঘনঘটা তবু দূরে যায় না। গ্রহের ফের। কলোনিতে ঢোকার মুখে তৈরি চা বিক্রির দোকানটা। ছেলেছোকরা মজুর মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। অনিমেষ বসেই ছিল। এখন সে রায়চৌধুরিদের দলের বড়োসড়ো নেতা, আসছে ইলেকশনেই হয়তো টিকিট পাকা। অনিমেষ একদা গরীব দলেই ছিল, বিপ্লবী গরীব হল, বড়ো বিপ্লবী হল, রায়চৌধুরি লগ্ন বিপ্লবী হল, অবশেষে বিপ্লবী ছেঁটে বিশুদ্ধ রায়চৌধুরি। অনিমেষের সঙ্গে এখন চারপাঁচজন অনুচর, আসলে দেহরক্ষী, সবসময় গায়ে লাগা, যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি। অনিমেষের চেহারাটি পুষ্ট হয়েছে, জেল্লা খোলতাই।
— এই, সাধনদা, — কথায় বড়ো আন্তরিক — কতদিন পর দেখা হল ! রোজই ভাবি, তোমার দোকানে ঘুরে আসবো। হয়ে ওঠে না। ভালো আছো তো? বউদি ? ছেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ভেবো না, তোমাদের ভুলে গেছি। এসো, চা খাও — হাঁক পাড়ে অনিমেষ — এই আরেকটা…।
— না, না, অনিমেষভাই, চা থাক। দেখা হয়ি ভালোই হয়িছে। আমার একখান উবগার করো দেখি।
— কী করতে হবে, বলো।
— আমি একখান পাসপুট করবো। পুলিশির ঝামিলা যেন কম হয়। তোমারে এটাই কলাম।
— তোমার সতীন দাদাদের ধরছো না কেন ? পুলিশ তো ওদের মুঠোয়।
— সতীনদাদাগের খ্যামতার তিরিপুলটা অনেক বড়ো। সেই খ্যামতা কাজে লাগানের খ্যামতাখান আমাহেন এলিবেলির জন্যি টান পাবেনে না। তুমাদের খ্যামতার ঘর ফাঁকা, তাই টানখান বেশি হতি পারে। কলাম, যদি পারো।
— ঠিকাছে, সাধনদা। যখন দরখাস্ত করবে, আমাকে বোলো। আমার লোক তোমাকে হাতেগরম দেবে। কোনও ছুটোছুটি করতে হবে না। পুলিশ যখন তোমায় ভেরিফিকেশনে ডাকবে, আমি তোমার সঙ্গে থানায় যাবো। কোনও ঝামেলা হবে না, আমি আছি। তা যাবে কোথায় ?
— বাংলেদেশিতে যাবার ইচ্ছে। মা ভাইবুনেরা রইছে, দেখি আসি।
— বেশ ঘুরে এসো। আমার কেউ নেই যে যাবো।
— কুঞ্জবাবুর সঙ্গি আজ সাক্ষেত হল। তোমার কথা কচ্ছিলেন। তোমার সাথি দেখা হয় নাই ?
— উনি এসেছিলেন নাকি !
— হুঁ। আচ্ছা অনিমেষভাই, একখান কথা জিগোবো ?
— বলো।
— আনিছুরদাদা নাকি মারা গেছেন !
— হ্যাঁ, দমদম সেন্ট্রাল জেলে। কয়েকজনকে নিয়ে জেল ভেঙে নাকি পালাচ্ছিলেন। গুলি চলে। বড়োমানুষ ছিলেন গো। শেষে বিভ্রান্তিতে হঠকারী হয়ে গেলেন। মনে পড়লেই খারাপ লাগে।
— মিত্যুর আগে তার সঙ্গি কি তোমার দেখা হয়িছিল?
— না, সাধনদা। সেই কবে …।
— চললাম, অনিমেষভাই। পাসপুটির ব্যাপারখান মনি থাকি য্যান।
— চিন্তা করো না।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪৪
❤ Support Us