- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ১৪, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান । নবম পর্ব
সাধন খুঁজে পেল চন্দ্রমোহনকে। তিনি ভিড়ে মিশে নয়, দাঁড়িয়ে মৃত্যুপর্বতের শোভা দেখছিলেন, চোখ যাকে বলে উদ্ভাসিত তরল। সাধন তাঁর বাহুমূলে নাড়া দেয় —খুড়েমশাই, চলেন ইবারে... তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
।। সোরোত কান্ড ।।
।। ভানুমতির ফাগ ।।
সরলা গজ গজ করছিল, গলা যথেষ্ট নামানোই, বাইরের গেটটা খুলে বেরোচ্ছিল সে তখন। আসলে বোসগিন্নি ওর ওজর শুনতে রাজি হননি। সরলা বলেছিল— ছোটো ছেলেটার শরীরটা খারাপ, মাসিমা, ওবেলা কাজে আসবো না।
গিন্নি জানেন— বাড়ির ঝি চাকরদের এরকম নানা বাহানা,নানান ছুতো। নানান চাল। কাজেই বিরক্ত, তিনি সাফ বলে দিলেন— দেখ,সরলা,ভয় দেখাসনে। না পোষায়, ইচ্ছে না হয় যদি, কাজ ছেড়ে দে । আমি অন্য লোক খুঁজে নেবো। ভাত ছিটালে কি কাকের হাভাত লাগে নাকি রে !
সরলার রাগের কারণটা অমূলক ছিল না। অজুহাত নয়, সত্যিটাই বলেছিল। গিন্নিমা কাজ ছাড়াবার ভয় দেখাচ্ছে। মালিক। সুযোগ পেলেই চোখ রাঙানোর হক। বেচাল সরলা ভাবছিল,কাজটা চলে গেলে মুশকিল। নতুন কাজ আদৌ জুটবে কি না কেউ জানে না। সারা শহর জুড়ে গিসগিস করছে রিফুজি বউ মেয়ে। একেবারে আধখাই মজুরিতেই লেগে যাচ্ছে ওরা। একটু দূরে এগোয় সরলা, দাঁড়ায়,পরখ করে কেউ দেখছে কিনা,আঁচল টেনে চোখ মুছলো জল জল।
বোসবাড়ির হাঁড়ির খবর যাদবচন্দ্রের ঘরে সবটাই পাওয়া যাবে, কেননা তাদেরই বাইরের দিকে তিনখানা ঘর যাদবচন্দ্রেরা ভাড়াটে। হরীশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একটা ঘর ফাঁকা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা যায়, অন্তত কিছুটা, দেশঘরের মতো।
তবু তার কাছে তিন ঘরের ভাড়াটিয়ানা বিলাসিতারই নামান্তর। দৈনন্দিন খরচটা দৈনন্দিনই লাফিয়ে বাড়ছে। ঘরে গর্ভবতী কন্যা। রেশনে পাওয়া চাল পি.এল ৪৮০ গমের আটা খাওয়া যায় না। এতদিন ছেলের মাইনেতে সুরাহা ছিল। এখন তার কাছে দাবী তো অনেক দূরের, ভিক্ষে চাওয়াও যায় না। এ কোন সন্তানের জন্ম দিলাম আমরা ! ভাবেন তিনি। ক্লিষ্ট লাগে। কোন পাপে এ দুর্গতি ! এ জন্মের ? না পূর্বজন্মগুলির ? আঁধার দেখেন তখন যাদবচন্দ্র।
ফাঁকা ঘরখানায়, জানলাটার পাশে হাতে সেই বই, বাইরের দুপুর রোদের বাড়াবাড়িটা দেখছিল নীলাম্বর। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কারণে তো করেই। অকারণেও।
দিনকয়েক জুড়ে স্নেহলতার পয়সায়, আসলে শ্বশুরেরই, তিনি জামাইয়ের মানে লাগবে ভাবেন, তাই হাতে ধরে দেন না, তার স্ত্রীকে দিয়ে পাঠান, ফল কিনে আনে নীলু। ফলারির সঙ্গে নানা কায়দাকিসিমে দরকষাকষিতে সামান্য পয়সা জমাতে পারে। দুটো তিনটে তাজা ফলের সঙ্গে একটা হেজো মিশিয়ে নেয়। দু আনা জমেছিল। সেই সম্বল গাঁটে বেঁধে গেছে মোড়মাথায়, কাটিং সেলুনে দাড়িটা ছাঁটাবে। জঙ্গল হয়ে গেছিল মুখখানা, অস্বস্তি হয়, লজ্জা লাগে কেমন। দোকান বারান্দায় পেতে শোয়ানো তিন তা খোলা সেদিনের খবরের কাগজ–যুগান্তর যেন অবহেলাতে। অপেক্ষা ব্যয় করতে নীলু সামনের তা টানে। ফ্রন্টে চোখ রেখেই চমকে উঠতে হল।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর অগ্নিগর্ভ।— নিচে সাবফ্রন্ট— ইষ্টক বর্ষণ, বোতল বোমা, পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস,গুলি। —তিনজন মৃত, আহত পঁচিশ,দুশোর বেশি গেপ্তার ।
গোলদিঘির কাছে পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করে ।আরম্ভ হয় খন্ড যুদ্ধ । উত্তাপ বেড়ে ওঠে, ট্রাম-বাস-পুলিশ ভ্যানে আগুন ধরানো হয়। তারপর লাঠি গুলি ওইসব। পুলিশ মতে তিন বেসরকারি সূত্রে দশ রাউন্ড। জঙ্গিপনা তাতেও নিভতে সময় নিয়েছে। নীলু চোখ বোঁজে, ভাবতে থাকে— যারা মুসলমানের ভয়ে, কল্পিত ভয়ে বেসামাল হয়ে ঘরবাড়ি, ক্ষেত,ফসল ফেলে পালিয়ে এসেছে— তারা আজ গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় ! কোন যাদু ?
নীলাম্বরের চোখ কাগজের অক্ষর ও পৃষ্ঠার ইতিউতি ফটোতে থাকে। এদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে ! মুসলমানেরা দেশ ছেড়ে ওপারে তাদের জন্য গড়ে দেওয়া দেশ পাকিস্তানে চলে গেছে। যারা যায়নি, কী যেতে পারেনি, তারা সংখ্যায় এতই নগণ্য যে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের জো হুজুরে না চললে বাঁচা দূরস্থান, টেঁকাই না-উপায়। তাহলে আগুনের কারনটা কী ! নীলাম্বর দাড়ি কামাবার জলদি আরজিটা ভুলে যায়, সে খুঁটি পৃষ্ঠাটা পড়তে শুরু করে।
এতদিন বে-আইনি পর্দার আড়াল সদ্য ছাড় পাওয়া কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্রদল বি পি এস এফের মিছিল ছিল সেটা । তাদের দাবি একাধিক গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের অবিলম্বে মুক্তি, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ, আগত উদ্বাস্তুদের সঠিক পুনর্বাসন, বাস্তুহারাদের অন্য রাজ্যে পাঠানো চলবে না, ইত্যাদি। এসব লেখা ছিল চলমান হাতির প্লাকার্ডে প্লাকার্ডে । জমায়েত ছিল লম্বা । বিপিটিইউ ভিড়ে গেছিল কলকাতা ও লাগোয়া অঞ্চলের কল মিলের মজুরদের নিয়ে । অবাক কান্ড — ফেস্টুন নিয়ে যোগ দিয়েছিল উদ্বাস্তুদের যৌথ মঞ্চ ইউসিআরসি।
ওয়েলিংটন স্কোয়ারে পথসভা হয়, বক্তৃতা করেন ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি, শ্রমিক নেতা মহম্মদ ইলিয়াস, উদ্বাস্তুনেতা বিমল মজুমদার। সভাশেষে মিছিলটি লালবাজারের দিকে এগুচ্ছিল। গোলদিঘির কাছে পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করে ।আরম্ভ হয় খন্ড যুদ্ধ । উত্তাপ বেড়ে ওঠে, ট্রাম-বাস-পুলিশ ভ্যানে আগুন ধরানো হয়। তারপর লাঠি গুলি ওইসব। পুলিশ মতে তিন বেসরকারি সূত্রে দশ রাউন্ড। জঙ্গিপনা তাতেও নিভতে সময় নিয়েছে।
নীলু চোখ বোঁজে, ভাবতে থাকে— যারা মুসলমানের ভয়ে, কল্পিত ভয়ে বেসামাল হয়ে ঘরবাড়ি, ক্ষেত,ফসল ফেলে পালিয়ে এসেছে— তারা আজ গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় ! কোন যাদু? এ যে একেবারে এডভান্সড মেটেরিয়া মেডিকার কথা ।
রোগীর শিবনেত্র উঠিয়াছে দেখিতে পাইলাম। কাল অপব্যয় না করিয়া ঔষধ পেটিকা হইতে পলছিলা নাইকোম ৩০০ শক্তি একমাত্রা গিলাইয়া দিলাম । একঘন্টা অপেক্ষা করিলাম ঔষধের ক্রিয়া নিরীক্ষণ করিতে। দেখিলাম রোগী বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া, ফতুয়া পড়িয়া, টাকার খুঁতি কোমরে গুজিয়া,নাতির হাত ধরিয়া, চারি মাইল দূরের চশমাগাজীর হাটে সওদা করিতে বাহির হইল ।
স্নেহলতা ঘরে ঢুকেছিল ।
একটা আধুলি দেয় সে নীলাম্বরকে— চারখান কমলা আনে দিও।এট্টু বাছি আনবা। পরশু আনিছিলে, বায়রালো একখান।— চেষ্টা করেও কথা তার ভিজে নয়
আচম্বীতে কেঁপে উঠল স্নেহলতা। কী বলছে স্বামী তার ! কী বলতে চাইছে ! এমনভাবে কখনো বলেনি তো ! কান্নায় ভাঙতে চাইছে স্নেহের ইষৎ কালিঢালা কোটরী চোখ। নীলুর কোনও এক না-ফোট উচ্চারণ কালো একটা মূর্তি নিয়ে তার চোখের তারায় ধেয়ে আসছে
আহত লাগে নিজেকে।কিন্তু নীলু কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করে না।বরং নিজেকেই সে দোষে,ভাবে- স্বামীর শক্তিই স্ত্রীর বল। সে শক্তিটা খুঁজছে বটে, খুঁড়ে মরছে একা, একাই কিন্তু পাচ্ছে কোথায়? বউ ফিরে যাচ্ছিল, হাত ধরে টানলো তাকে, আস্তে, বলতে পারলো— এট্টু খাড়াবা, আমার কাছে ?
বিনতিটা এমন যে স্নেহলতাকে জানলার পাল্লায় হেলান দিয়ে, কাঠের মতো,নির্জীব মুদ্রায়,দাঁড়াতেই হয়— বলো,কী বলবা।
অনেকক্ষণ ধরে স্থির হাত মুঠোয় নাড়ে নীলু। চট করে কিছু মুখে আসে না।
—জলদি কও। মা পাকের ঘরে একা।
—স্নেহ,—আওয়াজ যেন শ্লেষ্মায় চাপা, —তোমার কাছে স্বামী কয়ে কোনওদিন কিছু চাই নাই। তুমি এমনি অনেক দেছো। কিন্তুক, চাবার মধ্যি সেগুলান পড়ে ?
সত্যিই তো, দুজনের পাওয়ার ব্যাপার যে কিছুই ছিল না। মুক্তোকান্দির জীবনপথে সেসব ছিল গাছ, পাতা, বিষ্টি, রোদের মতোই। স্বাভাবিক।আরো সত্যি, কিছু চাইতে হবে —সেটা নীলু জানতো না। না জানতো স্নেহলতা।
— আমি বুধায় স্বামী হিসেবে বাতিল।—আবার স্বর ভারী হয়ে উঠছে — আমার সাথি বিয়েশাদি না হলি এ কষ্ট তোমারে পাতি হতো না। যারি পাতে, সেই মানুষটে তোমারে সুখী রাখতো। আমি তোমারে কিছুই দিতি পারলেম না।
আচম্বীতে কেঁপে উঠল স্নেহলতা। কী বলছে স্বামী তার ! কী বলতে চাইছে ! এমনভাবে কখনো বলেনি তো ! কান্নায় ভাঙতে চাইছে স্নেহের ইষৎ কালিঢালা কোটরী চোখ। নীলুর কোনও এক না-ফোট উচ্চারণ কালো একটা মূর্তি নিয়ে তার চোখের তারায় ধেয়ে আসছে। এবারে বোধহয় জলটাকে আর রোখা যাবে না। অন্য হাতটি বাড়িয়ে স্নেহ নীলুর বাঁধন দেয়া হাতটি চেপে ধরে— যাবা না,তুমি কুথাও যাবা না আমারে ছাড়ি। —নীলুর বুকে মাথা রেখে হিস্টিরিয়াধরাদের মতো কাঁদতে থাকে।
যেন অযুত বৎসর পর নীলু স্ত্রীর চেনা পিঠে হাত রাখলো। – না,স্নেহ, কুথায় যাবো? সুইসাইড করতি গেলে সাওস নাগে। তুমি তো বুঝি গেছো, একখান কাপুরুষ। — আমাগের অভিশাপ লাগিছে।
— কে শাপ দেবে?
— বাবার অভিশাপ। মায়ের শাপ।তাগেরে ছাড়ি আসিছি। পাপ করিছি।ভগবানের অভিশাপ।
এত কষ্টেও একটুকরো হাসি উঁকি দিল নীলুর ঠোঁটে। বউটা তার শুধু ছোট না বোকাও। নীলু বুঝেছে কোনও অভিসম্পাত নয়, এক অভাব্য আবর্তের মাঝে পড়ে যেতে হয়েছিল। দেহের সমস্ত জোর দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর দরকার ছিল। কিন্তু মনের তেজটাও যে প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে সেটি হারিয়ে গেছিল। এই ঘূর্ণিটা এলো এমন যে মাথা নৌকার দাঁড়টা টাল সামলাতে পারলো না।
— স্নেহ, তোমার কাছে এট্টা জিনিস চাবো,দেবা?
— কী ? এখনও স্নেহলতা মেদুর।
— আধুলি দিয়ি চারটি কমলা পাওয়া যায়। আরো ভালোগুলান তিনখান। আমি তোমারে আজ একটারে আনি দেবো। মায়েরে বলবা না।মিছি কথা।
স্নেহলতা বুঝতে পারছে না। তবু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ফেলে। আজ যে কী হল তার !
— সরলাদিদির ছানাটার কী হইছে ?
— জানি নে। শোনলাম বারবার দাস্ত হতিছে।
— দিদিরে কবা ছেয়াটারে নে আসে যেন। বলবা, জামাইদাদা ওষুধ দেবে।
—তুমি ডাক্তেরি করবা ? — স্নেহের চোখে ঘোর বিস্ময়।
— আমি না, এই বইখান। এডভান্সড মেটিরিয়া মেডিকা তুলে ধরে নীলু। তোমার কমলা বাঁচি ছ আনা দে একটা ওষুধের শিশি কেনবো।— চোখ বোঁজে নীলু, সামনে কালো পর্দা,তাতেই ভেসে উঠছে অক্ষর—
একমাত্রা সেবনেই মৃতপ্রায় সেই রোগী দৌড়িয়া বর্ধমান হইতে ট্রেন ধরিয়া ধানবাদের কয়লাখনিতে ডিউটি করিতে গেল।
খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া রোগীর রোগজীবনের সমস্ত খবরাদি জানিয়া লইলাম। অপচিকিৎসকগণ (এলোপেথিক) কেবল দুই চারিটি উপসর্গ শুনিয়াই খসখস করিয়া ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লিখিয়া দেন। অসুস্থ সাময়িক উপশম পাইল বটে, কিন্তু রোগ তাহার মজ্জায় গিয়া বাসা বাঁধিল।একমাত্র মহাত্মা হ্যানিম্যান ও মহদাশয় ডা: কেন্টের নির্দেশিত সুচিকিৎসার পথেই রোগী সম্পূর্ণ নীরোগ হয়। তাই বোপি দত্ত বিবরণের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখিয়াই ঔষধ নির্বাচন করি বলিয়াই ওই দুই প্রাত:স্মরণীয় মহাজনের পদরজ আমার মস্তকে পরিয়াছে নতুবা এই বিপুলায়তন গ্রন্থ লিখিতে … আমি কে?
সরলাকে একশিশি জলে তিন চারফোঁটা কনোট আক্সটিয়াম ৬০০ শক্তির তরল ঢেলে দিল নিলাম্বরলাম্বর বললো— দেখো, দিদি, ভালো করে দেখে নাও। বাঁ হাতের তালুতে এমনি করে ডানহাত দিয়ে এই শিশি দশগুনে ঝাঁকাবে। কেমন ? সরুলা মাথা নাড়ে –তারপর এককাপভর্তি জলে শিশির ওষুধ এক চামচ ঢালবে। বুঝেছো ? এবার কাপ থেকে এক চামচ তুলে বাচ্চাকে খাওয়াবে। কাপের বাকি জলটা ফেলে দেবে। দিনে চারবার ওষুধ খাওয়াবে। যা বললাম মনে থাকবে তো ? নাকি আর একবার বলবো ?
— ওকে কি খাওয়াবো,জামাইদাদা ? কিছুই যে খেতে চাইছে না।
— ওর যা ভালো লাগে সব খাবে। কাল বিকেলে একবার খবর দিও।
— সরলা কিন্তু কিন্তু করছিল — কিছু বলবে দিদি ?
— ওষুধের দাম ? – সরলা তোতলায়।
— আজকের ওষুধের কিছু লাগবে না। বাহ্যি কমে গেলে আরো দুবার ওষুধ নিয়ে যেও। নইলে যা থেকে রোগ সারবে না তখন দুয়া না করে দাম দিও।
।। বেহেশতের চেডি ।।
যেন চতুর্কল্প পেরিয়ে গেছে । খামে ভরা চিঠি এলো নীলাম্বরের নামে । ডানদিকে ডাকটিকিট সাঁটা — সবুজের মাঝে কাটা চাঁদ । নিচে উর্দুও হরফে চিত্রকলা, তার তলায় ইংরেজি অক্ষরে— পাকিস্তান
মুক্তকান্দি, যশোহর
৩রা ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১
এলাহি ভরসা
বাবা নীলাম্বর,
আল্লা রহমানের কাছে তোমার ও বধূমাতার জন্য বহোত বহোত দোয়া মঙিলাম। আশা করি, রসুলের মেহেরবানিতে তোমরা সকলে খুশ আছো।
তুমি তো জানো— তোমার পিতা ও আমি কেবল গ্রামসুবাদে প্রতিবেশী ছিলাম না। আমরা শুদ্ধ মাত্র মিতে ছিলাম না। আমরা উভয়ে সহোদর ছিলাম। মানবী মাতার গর্ভজাত দুই সন্তানই সহোদর হয়? দেশজননীর দুই পুত্র কি অন্যথা হইবে? আচাজ্জি আর আমি মুক্তোকান্দি মাতার দুই গর্ভজ। যেমন তুমি আর একরাম। ভাতৃশোক কি গভীরতর, তুমি এখন বুঝিতে পারিবে না। যখন বয়স বাড়িবে, কালে কাল্র চোখের সামনের ধূলায় ভরা আবছা চাদরখান সরিয়া যাইবে, তখন নজর করিবে দোজখ নদীর একপাড়ে একরাম দাঁড়াইয়া আছে, অন্যপাড়ে তুমি। হাত বাড়াইয়া ডাকিতেছ। উভয়ে জড়াইয়া ধরিতে পারিতেছ না।কাঁদিতেছ। কাঁদিতে হইবে। হাপুস নয়নে চিৎকার করিবে।করিবেই।আমি হয়ত তখন থাকিব না। দেখিব না।
জানি না। আল্লা এ কোন ফরমায়েশ দিলেন আমাদের সন্তানদের। যাহা হউক,আমি ইহার পূর্বে তোমার এই ঠিকানায় তিন তিনখানি খৎ পাঠাইয়া ছিলাম। জবাব ফিরৎ আইসে নাই।তুমি কি তোমার জয়েনকাকার উপর অভিমান পুষিয়া বসিয়া আছ? নাকি আমার খৎগুলা তোমার হাতে পঁহুছায় নাই? একমাত্র নবীই জানেন কি ঘটিয়াছে।
তোমাকে অবগত করি, ভাবীদান ও আচাজ্জি দেশ ত্যাগ করিয়া ইন্ডিয়ায় চলিয়া গিয়াছেন। তিন মাহিনার অধিক হইল। একরাম তাঁহাদের বসিরহাটের কাছে নিরাপদে পঁহুছিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। ওইখানকার পুলিশ তাঁহাদের কোথায় লইয়া গিয়াছে, তোমার ভ্রাতা জানিতে পারে নাই। জানা উচিৎ ছিল,পারে নাই। যে জয়ের পরিবেশ সে এখানে দেখিতেছিল,ওখানেও তাহাই সে প্রত্যক্ষ করিয়া ফিরিয়াছে। তাহার পর হইতে আচাজ্জি ভাবীজানের আর কোন সংবাদ আমার কাছে নাই। আমি মরমে মরিয়া আছি;বাবা নীলু। ভাই হইয়া ভাইকে রক্ষা করিতে পারলাম না। আমার কি ইনসানিয়াতির কথা কওন সাজে? ভাতৃশোকে আমি জর্জর। যেমন করিয়া পার, তোমার পিতামাতার সমাচার অবগত করিয়া আকুলি মুক্ত কর। পিতৃপ্রতিম হইয়া তোমার কাছে মিনতি করিতেছি, পায়ে ঠেলিও না।
দেশত্যাগের পূর্বে ভাবীজান তোমার বাস্তু দত্তাবেজ, কিছু স্বর্ণালংকার, নগদ পরিমান আমার কাছে গচ্ছিত রাখিয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণের গাথায় সীতা দেবী দেবর লক্ষণকে,ওইরূপ, ফলাবিশেষ রাখিতে বলিয়াছিলেন। চৌদ্দ বৎসর বনবাস কালে লক্ষণ তাহা সযত্নে ধরিয়া রাখিয়াছিলেন। ভুলিয়াও কামড় দেন নাই। আমি কি তাঁহার মত হইতে পারিব? আমার এন্তেকালের বোধহয় বেশিদিন বাকি নাই। হৃদয় চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তুমি বুঝিবে। ভাবীজান আমার জীবৎকালে আসিয়া তাঁর সহায় সম্পদের অধীশ্বরী হউন,এই আমার একমাত্র কামনা।
যে আচাজ্জি ছিল আমার আদর্শ, কস্মিনে যাঁহাকে অস্থিরপনায় দেখি নাই, সেই তিনি প্রলয়কালে সহসা স্থৈর্য্য হারাইলেন। আমি যে আমি, যার একটি কথায় আচাজ্জি সব পরিত্যাগ করিতে পারিত, সেই আমি তাঁহাকে আপনশক্তিতে ফিরাইতে পারিলাম না। তিনি দুর্বল হইয়া দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। কাহার উপর অভিমান হইল ? নিজের উপর, না আমার উপর?
দেশের সংবাদ তোমাদের কাছে নিশ্চয়ই নাই। এ দেশের বদ কিসসা টোলে ঢাকে বাদ্যিতে তোমরা হয়ত পাও, যেমন আমরাও ওই দেশের কথা পাইয়া থাকি। সুখবর দিবে বলিয়া তো খবরের কাগজ জন্মে নাই। চলিয়া যাইবার আগে রায়টের পাগলামি থামাইতে গিয়া চেয়ারম্যান জয়নাল সরকার গুন্ডাদের হাতে খুন হইয়াছেন। তাঁহার অন্তরঙ্গ পার্ষদ খলিলুর রহমান চেয়ারে বসিয়াছে। লোকে বলে, খলিলই ষড়যন্ত্র করিয়া অপকর্মটি ঘটাইয়াছে। উহাকে কেহ দেখিতে পারে না। তার তাকতাদি ওই কাঠের চৌঠাঙে।সাটিতে আর নাই। সারাদেশের হালও এইরূপ। মুসলিম লীগ ক্ষমতা দখলিয়ৎ রাখিয়াছে বটে, তবে গোড়ায় উলু ধরিয়াছে। যে কোনদিন হুড়মুড় করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িবে। দেশের মানুষের পাকিস্তানের মোহ কাটিল বলিয়া। পূর্বাংশের বাঙালীরা বুঝিয়াছে পশ্চিমারা তাহাদের পোষ্য করিয়া রাখিতে চায়।ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা জিহাদ তুলিয়াছে— এই বাংলায় জোর করিয়া ভাষার রাষ্ট্রভাষার নামে উর্দুকে চাপাইয়া দিলে তাঁহারা প্রতিবাদী হইবেন। দেশে নতুন একটি পলিটিক্যাল পার্টি ক্রমশই ক্ষমতাবান হইতেছে— ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি। এই দলের নেতার নাম তুমি পূর্বেই শুনিয়া থাকিবে— মোলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
মৌলানা সাহেব শহরে-নগরে গঞ্জে– গ্রামে সভা সমাবেশে উচ্চরব করিয়া বলিতেছেন,- আমাদের হিন্দুরা, যাহারা দেশ ছাড়িয়া ইন্ডিয়ায় রিফুজি হইয়া অসম্মানের জীবন যাপন করিতেছেন, তাহারা দেশে ফিরিয়া আসুন। আপনাদের জমি জিরাত পুনরায় গ্রহণ করুন। আমার হাতে ছয়টা আঙ্গুল। একটি কাটিয়া দিলে হাতের কি সেই তাকত থাকে? আপনারা গিয়াছেন আমাদের আনন্দ গিয়াছে। আবার আমাদের আনন্দ ফিরাইয়া দেন। দোলের ফাগ, ঈদের মুবারক, দুর্গার ভাসান, মোহারামের তাজিয়া জুলসে ভরিয়া যাক।আপনারা আসিয়া হাত ধরুন, এই দেশ গড়িয়া তুলিব। তোমাদের পারের লেখক তারাশঙ্কর ব্যানার্জীকেও এই কথাগুলি বলিয়াছেন মৌলানা।কলিকাতার সংবাদপত্রে হয়ত মুদ্রিত হইয়া থাকিবে।যদি না হয়, বড়ই দুঃখের। মৌলানার ভাষণে এ দেশের মানুষের বুকের ভাষা বাজিয়া উঠিতেছে। ন্যাপের কর্মীরা বারংবার আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে – হেডমাস্টার মশাইয়ের ঠিকানা কি আপনি জানেন? তাঁহাকে বলুন…।
কি বলিব? উহারা আমাকে বিশ্বাস করিতেছে না।
বড় দীর্ঘ খত লিখিলাম বাবা। অনেক কথা যে বলিবার।ফুরাইতে চাহে না। এদিকে স্থান যে সীমিত !
বাপ, নীলাম্বর,আমার বেরাদর, ভাবীজান, আমার বধূমাতা সকলকে লইয়া দেশে ফিরিয়া আইস। তোমার কাছে আমার মিনতি রাখিলাম।আল্লা মেহেরবান।
আশীর্বাদক
জয়েন উদ্দিন নস্কর।
— কার চেডি ?
হঠাৎ শব্দে শিউরে উঠলো, পিছে চেয়ে দেখে নীলু স্নেহলতা,কখন এসে এমন নিশ্চুপে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি । উত্তর দিতে পারলো না,বিভ্রান্ত হয়ে আছে, চিঠিটাই তার দিকে বাড়িয়ে দিল ।
খোলা কাগজটা ধরলো স্নেহলতা, পড়লো না । তার চোখে ছবিটা —চিঠি হাতে নিথর নীলু বসে আছে।এতক্ষণে বললো—কী লিখিছে?
নীলু সেটা শুনতে পেলো না । তার চোখে স্নেহলতা, তার আদরের স্নেহ, এক নতুন রূপে । কেমন সে রূপ ? দেহে মনে আকাশের মতো শূন্যতা, তবু যেন অপরূপ প্রতিমা ! অযত্নের চুলের বিন্যাস, ক্লান্তির ময়লা ঢাকা মুখ, আ-তেলা খসখসানির ছিটে,হনুদুটি ঠেলে উপরে উঠেছে, মুখ গলা ভেঙে বুক শীর্ণ।রুক্ষ, শাড়ি আড়ালে কোমর থেকে পায়ের পাতা তেমনই হবে মনে হয়,দৃশ্যমান পায়ের পাতায় ব্যতিক্রমী দাগ— একটু ফোলা, কেবল শরীরকান্ডের মাঝখানটি ভারে নেমে এসেছে, পুষ্ট সে দেশ,নেমে আসা আকাশের ভূমি,প্রাণের পিন্ড রেখেছে গোপনে, জানান দিতে চাইছে এই পৃথিবীতে কোনও এক আবির্ভাব, শঙ্খ বাদনের পূর্ব ইঙ্গিত।সব মিলিয়ে চৈত্রমাসের পাতাঝরা এক বৃক্ষের শোভা, মহাযোগী শিবের প্রেয়সী তপসিনী অপর্নার পটে আঁকা চিত্রলেখা।
— কলা না, কী লিখা আছে পত্তরখানে ?
নীলু যেন ঘোর আশ্লেষের ঘনঘটা থেকে হঠাৎ ফিরে আসছে।নামলো চৌকি থেকে, হাঁটু গেড়ে বসলো স্নেহের পায়ের কাছে, জড়িয়ে ধরলো তার কোমর, মাঠাটি নামিয়ে দিল স্ত্রীর জানু যুগে,ঘষতে লাগলো, যেন আতান্তরের মেলায় হারিয়ে যাওয়া শিশু কাঁদছে অঝোরে, শব্দ শাড়ি আটপৌরে পাহাড়েই যেন প্রতিধ্বনি তোলে, বললো, এত বড়ো দেশে বাবারে মায়েরে কোথায় খুঁজি পাবো, স্নেহ?
স্নেহলতা যেন অকস্মাৎ কঠিন হয়ে উঠেছে, গম্ভীর নাদে তার আদেশ শুনতে পেলো নীলু— খোঁজো । যিখান থেকি পারো, খুঁজি বায়ের করো । আর অকল্যেণ বাড়ায়ো না ।
• সোরোত কান্ড সমাপ্ত •
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৮
❤ Support Us