Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ১২, ২০২৫

ধারাবাহিক উপন্যাস। শেষ পর্ব। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। শেষ পর্ব। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

 
কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের শেষ পর্ব

 

ভেজা বারুদের স্ফূলিঙ্গ পেরিয়ে

 
শুনচি তোমার নাকি বিয়ে ?
 
আপনি জানলেন কী করে ?
 
আমার নেটওয়ার্ক তুমি জানো না । লোটনের মুখে বাঁকা হাসি ।
 
ঠিক আচে । তাই যদি হয় তাহলি আপত্তি আচে আপনার ? রোজি কড়া গলায় বলল ।
 
আমি যে অন্যরকম ভেবে রেকেচি ।
 
সে আপনি যা খুশি ভেবে রাকুন, তাতে আমার আসে যায় না
 
তোমার ভুল হচ্চে ।
 
আপনার কিচু বলার নেইতো ? বিরক্ত হয় সে । বসিরহাট টাউনে বিউটি পার্লারে যাচ্ছে কথা বলতে । ব্রাইডাল মেকআপ নেবে বিয়ের দিন । সে বোধহয় পাশ কাটাতে যাচ্ছে তখন লোটন বলে,আমাকে কী বয়স্ক দেখাচ্চে ?
 
অবাক হয় । আবার হাসি পায় । তবু নিজেকে সামাল দিয়ে বলে, হঠাৎ একথা ?
 
বাইরি যাই হোক আমি যুবক, আমি ব্যাচেলার
 
তাতে কী হয়েচে ?
 
সেটাই তো ভাবাচ্চে আমাকে ।
 
আপনার ভাবনা নিয়ে আপনি থাকুন ।
 
তোমার অভিনয় ?
 
আবার সে কথা !
 
ক্যাসেটগুলো আমার কাচে আচে ।
 
আপনি কী চান ? গলা একটু কেঁপে যায় তার ।
 
তুমি বুজতি পারচ না ?
 
আপনি ব্ল্যাকমেল করতে চান ?
 
অসম বয়সের বিয়ে কি হয় না ?
 
আপনি তো পাকা চিটিংবাজ !

 
মুহূ্র্তে তার চোখমুখ লাল হয়ে যায় । তবু নিজেকে সামলে নিয়ে লোটন বলে, এত অহংকার ভালো নয় । যার সঙ্গে বিয়ে হচ্চে সে কী ?

 
সে গরিব স্কুলমাস্টার হলেও আপনার মতো নয় ।
 
ঠিক আচে । ভবিষ্যতে দেকা যাবে । ইতিমধ্যে মোবাইল বেজে ওঠে । লোটন ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে । সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন মনে করে না রোজি ।

 
বাড়ি ফিরে একটু ধন্দে পড়ে যায় সে । কবিরকে ফোন করে জানাবে, লোকটা সম্পর্কে সাবধান থাকবে । তাতে যদি ফল উল্টো হয় ? কবিরই হয়তো তাকে সন্দেহ করে বসল । আগ বাড়িয়ে কিছু করার দরকার নেই । যখন যেমন পরিস্থিতি হবে তখন তেমন মোকাবিলা করতে হবে । অভিনয় করতে গিয়ে ফেঁসে যাবে, তা কে জানতো ? টাকা গেছে আবার মানসম্মান যাওয়ার ফিকির । বড়ো বড়ো কত কথা বলে এসেছে, এখন তারা জানতে পারলে কী হবে ? ভয়ানক মুচড়ে পড় । আবার ভাবে, সে তো অন্যায় করেনি । অভিনয় শেখা বা করা অপরাধ ? তাহলে সমাজে এত কদর কেন ? তাদের জন্যে লোক মাথা কোটে কেন ?
 
যাহোক । বিয়েটা নির্বিঘ্নে হয়ে গেল । মকবুলমিয়া আর টগরবেগম একটু আপত্তি করেছিল । বড়লোকের মেয়ে শেষ পর্যন্ত পদে পদে তাদের অপমান করবে না তো ?ফরিদের জেদাজেদিতে সায় দিতে হল । বিয়ের সময় অবশ্য পাত্রের বাপ মা হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পেয়েছে । তারা খুশি হয়ে ভাবে, তাদের আশঙ্কা বোধহয় মিছে ।
 
আরো একটা ঘটনা বিয়ের সপ্তাখানেক আগে ঘটে । রাজারহাট মোড়ে একটা বাইক আক্সিডেন্ট হয় । একজন পুরুষ আর একজন নারী । তারা গভীর রাতে নিউটাউনের প্রাইড হোটেল থেকে ফিরছিল । পুলিশ তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছে । ইউিউবে খবরটা বার কয়েক দেখেছে সে । একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ।
 
কবির স্কুলে যায় আসে । নতুন ঘটে যাওয়া বিয়ে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে শেফালি । তাদের পাঠানো ঘটক সফল হয়নি । আসলে তার কোন ভূমিকা ছিল না । শেফালিওতার সীমা অতিক্রম করতে চায়নি । তবে একটা ভাবনা তাকে ক্লান্ত করে । কবিরদা সুন্দরি বৌ পেয়েছে, বড়লোক শ্বশুর পেয়েছে । এর বাইরে তার আর কিছু চাওয়ার নেই ?
 
তারা যাতায়াত করে । বিনা মেঘে মাঝনদীতে ঝড়ের আশঙ্কা করে না । কোনো কোনো দিন ট্রেন অবরোধ হয় । খুশি মনে বাড়ি ফিরে । চমকে দেয় রোজিকে । বেলা পড়ে এলে চাঁপাপুকুর দিঘির ধারে বসে । রোজি শরীর এলিয়ে দেয় । আদুরে গলায় বলে,পৃথিবীর স্বর্গ বুজি এখানে ।
 
চাঁপাফুলের সুবাসে চরাচর মোহিত । মাথার ওপর দিয়ে পাখির ঝাঁক উড়ে যায় । বিকেলের রোদ নেমে আসে গাছের ফাঁকে । রোজির মাথা কোলে নিয়ে অকারণে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে কবির । আলোআঁধারিতে তা টের পায়না রোজি ।
 
ডালিয়ার এখনো বিয়ে হয়নি । বাবানের একটা প্রমোশান বাকি । সেটা হয়ে গেলে তারা বিয়ে সেরে হংকংএ হনিমুন করতে যাবে । এখন ছুটির দিনগুলোতে তারা ঘুরে বেড়ায় । লাখদুই টাকার দামি মোটরবাইক চড়ে দুজনে ইকোপার্ক সিটিমল ঘুরে বেড়ায় । এখনো চাঁপাপুকুর ছাড়েনি ডালিয়া । তবে গাঁয়ের মানুষের কাছে সে ক্রমশঃ অপরিচিত হয়ে পড়ছে । সে নতুন আই ফোন কিনেছে । সেখানে কবিরের নাম্বার ঝরে গেছে । বিনা মেঘে ঝড় এল,নদীতে নয় মোবাইলে । একদিন এরকম অবিশ্বাস্য খবর এসেছিল তার কাছে ।
 
এই খবরেও সে বিশ্বাস করেনি । এখন দুমদাম ভুয়ো খবরের দুনিয়া । যাচাই করতে করতে সংশয়হীন হত হয় । বেশি দেরি হল না । সোমবাবুর ফোন হাজির । তাঁর কাছে বোর্ডের অফিস থেকে অর্ডার এসেছে । সব শুনে নীরব থেকেছে । এক একটা ঘটনা মানুষকে গভীরে তলিয়ে দেয় । সেখান থেকে ভেসে উঠে কিছু অবশিষ্ট থাকে না । কবির হতভম্বও হয়নি । মাথায় হাত দিয়ে বসেনি । কোথার খবর কোথায় চলে যায়, তা কে জানে !
 
একদিন সাঁজবেলায় ফোন করে চুলবুলমিয়া, ফরিদ বাড়ি আচ নাকি ?

 
কেনো বলুন তো ?
 
এখনই তোমার কাচে যাচ্চি ।
 
আসুন ! সে তো আমার সৌভাগ্য ।
 
আমার যে দুর্ভাগ্য !
 
কী বলচেন ?
 
লাইন কেটে যায় ।

 
ঘণ্টাদুয়েক বাদে চারচাকা নিয়ে হাজির বুলবুল । ফরিদ তার গাড়ির দরজা খুলে আপ্যায়ণ করে,আসুন ! খালুজান !
 
চুলবুলমিয়া নামতে নামতে বলে,আমি কুটুম্বিতা করতি আসিনি ।
 
ফরিদ জবাব দেয় না । মাথা নীচু করে তাকে সঙ্গে করে অফিসঘরে ঢোকে । তাকে ঘামতে দেখে ফ্যান চলা সত্ত্বেও এসি চালু করে । একটু সময় নিয়ে মকবুলমিয়া বলে,নিজের আত্মীয় বলে তোমাকে বিশ্বাস করেচি ।

 
তা আমি কী ভঙ্গ করেচি ?
 
চুপ কর ! কথা বলার মুখ আচে ?
 
সে অবাক হয়ে বয়স্ক মানুষের দিকে তাকায় । তারপর মিনমিনে গলায় বলে,আমার অপরাধ ঠিক বুজতি পারচি নে ।
 
তা বুজবে কেন ? নিজের দোষ কি কেউ দেকতি পায় ?
 
আমি তো সেরাম কিচু মনে করি নে।
 
আমার রোজির কী হবে ?
 
কী হয়েচে তার ?
 
আমার ফুলের মতো মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলে ?
 
কী বলচেন আপনি ?
 
ছেলে যে পুরুয়ত্বহীন !
 
এতদিন বাদে একথা বলচেন ? যদিও একথা আমি মানি নে।
 
ঠিক আচে । ওকথা বাদ দাও । কিন্তু লোকের কাচে মুখ দেকাব কী করে ?
 
কেন ?
 
তুম আবার জিজ্ঞেস করচ কেন ? সবাই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে । আমি কি কিচু বুজি নে নাকি ?
 
কোর্টের অর্ডার হলি কী করবে ? সে তো আর ফাঁসির আসামি না ।
 
লোক কি তাতে ছাড়বে ? আমার মানসন্মান সব ধুলোয় মিশে গেল । তারা বলবে, চুলবুলমিয়ার মুখে বড়ো বড়ো কথা । জামাই চিটিংবাজ ঘুষ দিয়ে মাস্টারি খরিদ করেচিল । এখন ধম্মের কল বাতাসে নড়ে ।

 
ফরিদকে আরো কিছু কড়া কড়া শুনিয়ে সে চলে যায়।যাওয়ার আরো একটা কথা বলে যায়,এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তার এই শেষ।
 
রোজি কদিন গম্ভীর হয়ে গেছে।বিয়ে হয়ে গেছে যদিও কয়েকমাস তবু সবটুকু হয়নি।যা হলে একজন মানুষকে বাইরে থেকে ভেতরটা চেনা যায়।বাইরের লোকের কথায় কিছু যায় আসে না।কিন্তু রোজি যখন জিজ্ঞেস করে তখন কবির ক্ষুব্ধ হয়েই বলেছে,তোমার সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক যে বাইরের লোকের সাথে গুলিয়ে ফেলচ ?
 
রোজির লোটনের কথা মনে পড়ে।সে ঠকে গেছে।কবিরও কি ঠকে গেছে ?
 
সেদিন সকালবেলা শেফালি ফোন করে।কবির তখন মাঠে।ফসলের খেতে নতুন জীবন খুঁজছে।মাটিমাখা হাতদুটো ঝেড়ে ফোন ধরে, কী ব্যাপার ?

 
বসিরহাটে আসতে হবে ?
 
কেনো ?
 
ফোনে অত কথা বলা যাবে না।

 
কী আর হবে ? খুব একটা উৎসাহ নিয়ে হাজির হয়নি । দুপুর নাগাদ বসিরহাট টাউনহলে পৌঁছে দেখে, চারিদিকে উত্তেজনা টগবগ করছে । কয়েকশ ছেলেমেয়ে সেখানে জড়ো হয়েছে । অনেক নরম গরম বক্তব্যের পর দুটো সিদ্ধান্ত পাশ হয় । এক, হাইকোর্টে পাল্টা কেস করতে হবে । দুই, কলকাতার রাজপথে ধর্ণা দিতে হবে । এভাবে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ?
 
কদিন বাদে চুলবুলমিয়া এসে হাজির । কবির বাড়ি নেই । তাদের সংগঠনের মিটিং আছে বারাসাত । মকবুলমিয়া বেয়াইয়ের আপ্যায়ণের ত্রুটি করে না । হঠাৎ তার আগমনে যাতে কোনো সন্দেহ না জাগে, তার জন্যে অহেতুক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে । শেষে টগরের দিকে তাকিয়ে বলে,বুবু ! আপনার কি আপত্তি আছে ?

 
কীসের ?
 
ওর মায়ের মন খুব খারাপ ।
 
কেন ?
 
মেয়েটা অনেকদিন বাপের বাড়ি পা রাখেনি ।
 
এইতো সেদিন গেল না ?
 
সেও তো হবে মাসখানেক বোধহয় ।
 
তা হবে হয়তো ! আনমনে বলে টগর । তবে আপনি নিজে এসচেন যখন তখন ফেরাই কী করে ?
 
তবে একটা কিন্তু রয়ে গেচে ?
 
কী তা ? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে চুলবুলমিয়া ।
 
ছেলেডা যে বাড়ি নেই ।
 
সে আমি ফোন করে নেবো ।
 
সে আপনি যা ভালো বোজেন । কোনোরকম সন্দেহ জাগে না তার ।

 
বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে যায় । এমন অসময়ে চলে যাওয়ার কথা নয় । এমন না ঘটলে তাদের তো পাহাড়ে ঝর্ণার ধারে ঘুরতে যাওয়ার কথা । তবে একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে । এখন তার অনেক কাজ বাকি । কলকাতার ধর্ণামঞ্চে থাকতে হতে পারে ।
 
সেদিনও বাড়ি ছিল না কবির । চার পাঁচজন লোক এসে হাজির । তাদের মধ্যমণি লোকটা বলে,চাচা ! এতবড়ো ঘটনা ঘটে গেল আমাকে জানালে না ?
 
ছেলেকে তো বলেচিলুম ।

 
তাকে আমি জানি । সে বড়ো ভালোমানুষ । সেজন্যি আমারে ছুটে আসতি হল । মুখচোরা সে ।
 
ছেলে বললে, এতো আমার একার সমস্যা না ।
 
জানি । সে তো কোর্টে কেস চলচে ।
 
তবে বাবা ! সিরাজের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় ।
 
আপনার বৌমাকে তো দেকচি না ।
 
সে তো বাপের বাড়ি গেচে ।
 
তার আর কোনও খবর পেয়েচেন ?
 
কেন ? বিপদ-টিপদ ঘটেচে ?

 
সিরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মকবুলমিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে । গাঁয়ের লোক সে, দিনরাত মানুষ চরাচ্চে । তাদের যত বোকাহাবা ভাবা হয় তা না । লোকটার পেটে অন্যকোনও খবর নেই তো ? সে এবার চাঁচাছোলা গলায় বলে, আপনারদের নামে পঞ্চায়েতে নালিশ পড়েচে ।

 
কীসের নালিশ ?
 
পাঁচলাখ টাকা জরিমানা দিতি হবে ।
 
আঁ- কেন ? মকবুলমিয়া আকাশ থেকে পড়ে ।
 
নারী নির্যাতন কেস । পুলিশকে আমরা ঠেকিয়ে রেকেচি ।
 
তাহলি উপায় ? এত টাকা কোথায় পাব ?
 
ছেলেকে একবার দেখা করতি বলবেন।
 
ঘটনা শুনে ভেজা বারুদ কবিরও জ্বলে ওঠে । তখনই ফোন করে । তোমাকে আমরা কোন কষ্ট দিয়েচি ?
 
আব্বার মুখের ওপর কিচু বলতি পারচি নে ।
 
এভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে ?
 
কথা বলে না রোজি । শুধু ফোঁপানোর শব্দ । একসময় নীরব হয়ে যায় ওপ্রান্ত ।

 
ডালিয়া ফোন করে । তাকে সহানুভূতি জানায় । ঠিক কী জন্যে তা বুঝতে পারে না কবির ।
 
কলকাতার রাজপথের ধারে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছে তারা । দিন যায় । রাত কাটে । শেফালির পাশে থাকে সে । অনেক কথা হয় । তারা যেন এক নতুন জগতে উপনীত । তাদের ভবিষ্যত কী ? বর্তমান কী ? অতীত কী ? সব যেন ভুলে গেছে । কোন ক্লান্তি নেই । গ্লানি নেই । জীবনের স্বাদ তাদের আচ্ছন্ন করে আছে ।
 
রাতেরবেলা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে শেফালি । মাথার ওপর ঘোলাটে চাঁদ । জেগে থাকে তার পাশে কবির । সামনে দিয়ে দু’একটা গাড়ি হুশহাস শব্দে বেরিয়ে যায় । তারপর সব নিস্তব্ধ । হাসি পায় কবিরের । জীবনের জটিলতা যত সে এড়িয়ে চলতে চায় তত যেন তাকে ঘিরে ধরে । এভাবে ধর্ণা দিয়ে কী হবে ? তার চাকরি গেছে । মানসম্মান গেছে । এর সঙ্গে যাদের লাখ লাখ টাকা গেছে ? না । আর সে চিন্তা ভাবনা করবে না ।

 
ভোরে শেফালি উঠে দেখে, তখনও বসে আছে সে । কবিরদা ! তুমি ঘুমোওনি ?

 
কার জন্যে ঘুমুব ? বলে শেফালির মুখের দিকে তাকায় । শহর হলেও একটা স্নিগ্ধ বাতাস বইছে । তার মুখে যেন শরতের রক্তিম আভা । দিনেরবেলা হৈচৈএর মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যায় । একজন চালাক গোছের তরুণ সাংবাদিক তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায় । তাকে একটা ডার্ক চকলেট অফার করে বলে, আপনার নাম কী ?

 
কেন,বলুন তো ? কবির জিজ্ঞেস করে ।
 
আপনার প্রকৃত নাম জানাব না ।
 
কিছু জিজ্ঞেস করবেন ?
 
সে খোঁজেই তো এসেছি ।
 
আপনি মানে কত টাকা ?
 
যা খুশি একটা বসিয়ে নিতি পারেন ।
 
ঠিক আছে । আপনার ডিগ্রি ।
 
ধরুন, যার কোনও ভিত্তি নেই, বাস্তবতাও নেই ।

 
সাংবাদিক খুশি হয়ে চলে যায় ।
 
চুলবুলমিয়ার মাথা ঠান্ডা হয় । ঠিক আছে কেস ফেস তিনি করবেন না । তবে ওঘরে লোক হাসিয়ে আর মেয়ে পাঠাবেন না । তার পয়সা আছে । ভালোছেলের অভাব হবে না ।
 
এক একদিন সন্ধ্যেবেলা ঝড়বৃষ্টি শুরু হয় । তারা এখন মাঝ নদীতে নেই । তবু এখানে আশ্রয় কোথায় ? কবির তার মাথার ওপর ছাতা ধরে । কিছুটা রক্ষে পায় শেফালি । বাইরের জগতের দিকে মন নেই তার । অন্তর জগতে ডুবে আছে । তার ভেতরে বুঝি বৃ্ষ্টি নেমেছে । সে বলে,আমি কি অযাচিতভাবে তোমার সঙ্গে ভিড়ে গেচি ?

 
একথা বলচ কেন ?
 
মাঝে মাঝে মনে হয়, কোন গভীরে তলিয়ে যাচ্চি । তুমি টেনে তুলচ । তোমার এমন দায় কেন ?

 
চুপ করে থাকে কবির । সহসা উত্তর দিতে পারে না । সে সতর্ক হয় । সোমবাবুর কথা মনে পড়ে । বাইরের কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না । সে বলে, তোমার কোনো সন্দেহ আচে ?

 
কীসের ?
 
আমরা তো আর ছেলেমানুষ নই । পরস্পরের ভেতরে কোন ফাঁক নেই তো ?

 
কথা বলে না শেফালি । বৃষ্টি থেমে গেছে । ছাতা বন্ধ করে কবির ।
 
রাত গভীর হতে থাকে। মেঘ কেটে গেছে। আকাশে একখণ্ড চাঁদ উড়ছে। নিস্তব্ধ রাত শুধু জেগে আছে তার চোখের পাতায়। সে প্রার্থনা করবে আকাশের কাছে ভোরের আলোর কাছে। একটা চেনা ফুলের সুবাস পাচ্ছে। এখানে কাছে কোথাও ফুলের গাছ আছে ?
 
ভোরের আলো সবে দেখা দিয়েছে। সারি সারি ছেলেমেয়ে জীবন গড়ার আকাঙ্খায় এখনও জেগে ওঠেনি। সে ওদের সঙ্গে আছে। কিন্তু জেগে আছে সম্পূ্র্ণ একা। সে এক বিভ্রম তাঁকে ঘেরাও করেছে।
 
উঠে দাঁড়ায় সে। আশেপাশে বেশ কিছু গাছ আছে। পরিচিত সেই গাছ খুঁজতে থাকে যার ফুলের সুবাস সে কিছুক্ষণ আগে পেয়েছে। সেই ফুলগাছের নীচে দু’হাত পেতে দাঁড়াবে। ভোরের নির্মল বাতাসে দাঁড়াবে। মনের এই প্রার্থনা নিয়ে দাঁড়াবে। শিউলিফুল সে ঝরে যেতে দেবে না। সে ঘুরতে থাকে। খুঁজতেই থাকে।সকালের রোদ তার নিশ্চিত মুখে এসে পড়ে।
 

– স · মা · প্ত –

 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৯

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৯। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!