Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ৫, ২০২৫

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৯। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৯। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

 
কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের নবম পর্ব

 

প্রথম আর শেষ আশ্রয়

 
মেয়েটা মেধাবি, বয়েসের তুলনায় পাকামিটা বেশি । ডালিয়া বলে, আগামি রোববার আমি পড়াতে আসব না ।
 
জুঁই বলে, কেন, ম্যাডাম ?
 
তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে। তবুও একটা ফারাক আছে।

 
ব্যক্তিগত সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না।
 
বুজেচি।মেয়েটা চটুল হাসে।
 
কী বুজেচ ? আনমনা হয়ে সে জিজ্ঞেস করে।

 
জুঁইয়ের মুখের বোধহয় আগল নেই। প্রেম করতে যাবেন বুজি ?
 
ডালিয়া তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে। মনে হয়, ঠাস ঠাস করে গালে চড় কষিয়ে দেয়। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজেকে সংযত করে। তার দায়িত্ব বেশি। যতই উস্কানি থাক, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা শোভা পায় না। কঠিন গলায় বলে, আমি পড়াতে এসেচি। তার বাইরে কোনো কথা বলবে না।
 
রোববার মনোয়ার স্যারের বাড়ি থেকে ফিরে ভয়ানক ধন্দে পড়ে যায়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে সে।কার সঙ্গে কথা বলবে ? মা তার প্রথম এবং বোধহয় শেষ আশ্রয়স্থল।সব শুনে সফুরা বলেছে, এ কী করে সম্ভব ?

 
কিন্তু মা–? সে মিনতি করে।
 
কী ?
 
আমার সম্ভবনা ?
 
কবিরকে কী বলবি ?

 
সেও মনে মনে অনেক ভেবেছে।কবিরের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ? ভালোবাসার ? তবে বাবানকে দেখার পর তার সব কিছু ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে কেন ?কোনটাকে ভালোবাসা বলে ? কারো জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ইচ্ছে না আটপৌরে চলাচল ? কবিরের সঙ্গে সে ছোটবেলা থেকে মিশছে।তাকে ভালো লাগে, বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্ত। তার আকাঙ্খা আছে, চাহিদা নেই। এভাবে কি তার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে পারবে ? সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে না ?

 
কী ভাবচিস ?

 
মায়ের কথায় চটকা ভাঙে। সে বলে, তুমি তাহলি আমারে কী করতি বল ?

 
তুই ভেবে দেক ? আমাদের স্বপ্ন দেকা ভালো, চাঁদকে স্বপ্নের মধ্যি টেনে আনা মানায় না।

 
মায়ের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। মা যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলেছে। সত্যিই তো !  বাবান কী স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম !  চাঁদই বটে !  তাকে ছুঁতে পারবে ?
 
কলেজ জীবন থেকে পূর্ণিমা ম্যাডামের সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক।এই পরিশ্রমী মহিলা, স্নেহ করেন। ডালিয়াও যেকোন ক্ষেত্রে তাঁর কাছে পরামর্শ প্রার্থী।
 
তিনি বলেন, কবিরও আমার স্নেহভাজন। তবে এখানে অনেক কথা আছে। সবকিছু শ্রুতিমধুর হবে না।

 
তবুও বলুন।

 
কবিরের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কত গাঢ় তা জানিনে। তোমাদের মধ্যে পেশাগত একটা তারতম্য থাকবে।

 
ঠিক বুজতি পারলুম না।
 
লোকে বলবে কবির প্রাইমারি স্কুলের টিচার।
 
তাতে আর কী আচে ?
 
একটা সময় তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

 
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে।সুড়ঙ্গের শেষে সে কি আলো দেখতে পাচ্ছে ?

 
তোমাকে একটা কথা বলি।
 
বলুন।
 
যাকে নিয়ে তোমার সমস্যা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বল।
 
ঠিক আচে। ধন্যবাদ, ম্যাডাম।
 

নিত্যদিনের পরিচিতির মধ্যে অপরিচয়ের মনোবেদনা থাকে। কখনো কখনো তা টের পেলেও তা গভীর হয়নি। একটা রাতচরা পাখি ডেকে ওঠে। তার চিন্তার অভিমুখ পাল্টে যায়।

 
খোকা ! ওঠ ! স্কুলে যাবিনে।

 
একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে সে। যা অবধারিত তাই বুঝি ঘটেছে। তবে সময় পাল্টেছে। কাঁচা বয়েস পার হয়ে এসেছে। আবেগ একটা মাত্রা পর্যন্ত এসে থমকে যায়। চা দিতে গিয়ে টগর বলে, খোকা ! আজ যখন ছুটি তখন হাসনুদের বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আয়।
 
ঘাড় নাড়ে সে। কিছু কথা বলতে পারলে, হয়তো হালকা হওয়া যেত। ডালিয়া যে এভাবে বলবে, সে হয়তো বুঝতে পারেনি। সে অবাক হয়ে বলেছে, তুই শেষ পর্যন্ত মনিরের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পেলি ?

 
আমি কি তাই বলেচি ?

 
সেদিনও সরকারি ছুটির দিন। একটু বেলা হলেও সেই চাঁপাপুকুরের ধারে বসেছে। আজ ডালিয়াকে অসম্ভব গম্ভীর দেখাচ্ছে। কবির ভয় পায়। বেলার রোদ দিঘির জলে যেন হাজারো সোনা রং। সেদিকে কারো নজর নেই। নিজেদের ভেতরে ডুবে আছে তারা।
 
কৈখালিতে ভি আই পি রোড়ের ধারে দোতলাবাড়ি। তিনি হয়তো তার প্রতীক্ষায় ছিলেন। গেটে বেল বাজাতে দরজা খুলে দিলেন।
এসো ! তিনি তাকে নীচের ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন । এখনও ঠিক বুঝতে পারে না ডালিয়া ভদ্রলোক কি নিছক সৌজন্যমূলক আপ্যায়ণ করতে চান ? হয়তো সে অন্যমনস্ক ।
 
মেয়েটা তো বেশ ! মহিলা কণ্ঠে তার চটকা ভাঙে।
 
তাকিয়ে দেখে অজস্র গয়না পরা একজন বয়স্ক মহিলা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
 
আমার মিসেস ! মনোয়ার স্যার পরিচয় করিয়ে দেন।
 
নিজের প্রশংসায় সে কোনদিন মোহিত হয় না। লজ্জা পায়। এবার আরেক বিস্ময় তার সামনে এসে হাজির হয়।

 
তুই যখন ঠিকই মনে করে নিয়েচিস, তখন আমাকে ডাকলি কেন ?
 
তোকে না জানিয়ে কোন কাজ করেচি ? তাছাড়া পূ্র্ণিমা ম্যাম বললেন।

 
দিঘির মাঝখানে একটা বড়োমাছ ঘাই মারে। পদ্মপাতা সব তছনছ। সেদিকে তাকিয়ে থাকে কবির। এ মুহূর্তে তার কিছু করার নেই। বলার নেই।তাকে নীরব দেখে ডালিয়া প্রশ্ন করে, তুই কী ভাবচিস ?

 
আমার ভাবনা শুনে তোর কী হবে ?
 
তবু শুনি ।
 
যার জন্যি লড়াই করচিস তার কী হবে ?
 
মায়ের কথা বলচিস ?

 
চুপ করে যায় ডালিয়া । হয়তো মায়ের কথা ভেবে দেখেনি। দেখেনি কি ? কথায় কথায় বাবানকে বলেছে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জবাব দিয়েছে, কোন সমস্যা নেই ।
 
আঁশফলের মতো ঘোলা বেদনা নিয়ে উঠে পড়ে কবির।জীবন যা চায় সবসময় তা পাওয়া যায় না। সবচেয়ে কাম্য যে সে দূরে সরে যায়। এভাবে সান্ত্বনা খোঁজে মানুষের মন। সান্ত্বনা পায় কিনা সে জানে।
 
জলের মতো টাকা খরচা করেও বাবলুকে ছাড়াতে পারে না হুনুমিয়া । দিল্লির জেলে নিয়ে গেছে তাকে। তাই হতাশ হয়ে একদিন বলে, আমার জন্যি তোমার ক্ষতি হোক চাইনে।

 
কী বলতে চাইচ ? জিজ্ঞেস করে জুব্বার।
 
তোমার মেয়ের তো বয়েস বেড়ে যাচ্চে।

 
চুপ করে যায় জব্বার। একথা যে একেবারে ভাবেনি তা নয়। তবে বোধহয় হুনুমমিয়ার মুখে রায় শোনার অপেক্ষায় ছিল।
 
দিন কেটে যায়। শেফালির বাপ মা দুজনে পরামর্শে বসে। সেই যে ছেলেটা ? জব্বারমিয়া বলে।

 
বাড়িতে লোক পাঠাবে ? মালতি বলে।
 
যুক্তি মন্দ না।
 
মেয়েকে একবার জিজ্ঞেস করবে ?
 
এখনই বলার কি আচে ? ওদিকে কী রায় আসে ?
 
তা ঠিক। মাথা নাড়ে মালতি ।

 
সফুরা থমকে যায়। মেয়ের জেদ আছে। উন্নতির চেষ্টা করছে ।কবির ভালো ছেলে, ওই ছেলেটাও মন্দ নয়। যা শুনছে পরিবার বেশ ভালো। সে বলে, মা ! তুই পিচুটান ভুলে যা।

 
তা কী করে হয় !
 
যেমন সবাই ভুলে যায় তেমনি ।
 
তুমি যে আমার মা !
 
আমি আর কদ্দিন ?
 
যে কদিন আচ, আমার সঙ্গে থাকবে ।
 
চাকরি ছাড়তে হবে ?
 
তোমার কোন আপত্তি আচে ?
 
তোর সুখের কাঁটা হতি পারব না ।
 
কী বলচ, তুমি ?
 
তুই ব্যাপারটা বুজে দেক। লোকে কী বলবে ?
 
কী বলবে তারা ?  অবাক হয় সে।
 
মেয়ের সুখে ভাগ বসাচ্চে।
 
তাহলি কী করবে ?
 
আমি জামাইয়ের বাড়ি থাকতি পারব না ।
 
সে তো তোমার ছেলের মতোন ।
 
কবির হলে কথা ছিল।

 
মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই বিয়ে তার পছন্দ নয় ? কবির মায়ের বুকে কতখানি জায়গা জুড়ে আছে ?
 

অভিনয় তাদের জীবনে কি আলাদা কোন অর্থ বয়ে আনে ? এই যে তার রোজকার কাজ চলাচল সেখানে তাকে অভিনয় করতে হয় না। সে বলে, আলাদা করে কী শিখবে ?

 
পলি মণ্ডল বলে, আগে তো লোকটাকে এড়িয়ে চলতে। এখন কী হয়েছে ?
 
লোটনকে ভয় পায় সে। তাই আজকে আসেনি বলে খোলামেলা কথা বলতে পারে পলি। শেফালি কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারে না। একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে, তেমন কিছু না। আমরা একটা অন্য বিষয়ে আলোচনা করি।

 
তুমি কি ট্রান্সফার নেবে ?
 
এত তাড়াতাড়ি হয় নাকি ?
 
এখন অসম্ভব বলে কিছু নেই।পয়সা ফেললে সবকিছু হয়।
 
আমরা অভিনয় নিয়ে কথা বলি।

 
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পলি। ঠিক বুঝতে পারে না। অভিনয় তাদের জীবনে কি আলাদা কোন অর্থ বয়ে আনে ? এই যে তার রোজকার কাজ চলাচল সেখানে তাকে অভিনয় করতে হয় না। সে বলে, আলাদা করে কী শিখবে ?

 
সেটাই তো বুজতি চাইচি।
 
ওই ছেলেটা কি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে ?
 
কোন ছেলেটা ?
 
প্রথমদিন তোমার সঙ্গে যে এসেছিল ?

 
ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধে হয় না। মৃদু হেসে বলে, আপনি যা ভাবচেন তা নয়।

 
তবে তোমার এ অধঃপতন !

 
এ কী বলচেন ? মুখ ভার করে শেফালি।

 
তোমার ভালোর জন্যে বলছি।
 
অভিনয় জগত কি খুব খারাপ ?
 
সে আমি জানিনে তবে লোকটাকে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

 
শেফালি ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। জীবনকে নিয়ে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। ট্রাজেডিকে সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবে। সেখানে এক অস্বাভাবিক মুক্তি তাকে দিশেহারা করে তুলেছে । সে ঠিক বুঝতে পারে, বাপ মা তার জন্যে গোপনে দেখাশুনোর কাজ শুরু করেছে। তাদের অবাধ্য সে হতে পারবে না। অভিনয় ব্যাপারটা তারা কীভাবে নেবে ?

 
চলো দাদাভাই !
 
কোথায় ?
 
আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি।
 
চুলবুলমিয়ার বাড়ি মুরারিশা । এখান থেকে দশকিমি।
 
ঠিক আচে। তুমি যখন বলচ।

 
ফরিদের মোটরবাইকের পেছনে বসেছে সে।
 
আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল। আজ ছুটির দিন বলে মায়ের কথামতো এখানে এসেছে। তাদের সঙ্গে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা জানে না কবির।
 
মেন রোড থেকে একটু ভেতরে পেল্লাই তিনতলা বাড়ি। চুলবুলমিয়া নিজেই বেরিয়ে এল। খুব খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেল। সে সংসারে পোড় খাওয়া লোক। ছেলে স্কুল মাস্টার। পয়সা কম হলেও সরকারি ছাপ আছে। সে নিজে অগাধ পয়সার মালিক। কিন্তু ব্যবসা হচ্ছে পদ্মপাতায় জল। এই আছে এই নেই। জীবনে অনেক দেখেছে।
 
সকাল দশটায় ওখানে তারপর এখানে। দুপুরে ভূরিভোজনের ব্যবস্থা। সব কাজে ফরিদের উৎসাহ বেশি। বাপের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠেছে ।
 
খাওয়াদাওয়ার পর ফরিদ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, কেমন দেকলে ?
 
কবির কোন নেশা করে না। মৌরি চিবোতে চিবোতে ভাবতে থাকে।

 
কথার জবাব দিচ্চ না।
 
মেয়েটাকে কোথায় যেন দেকেচি।
 
সব মেয়েকে ওরাম চেনা চেনা মনে হয়। লঘু গলায় বলে ফরিদ ।
 
তা নয়। এখন ঠিক মনে করতে পারছে না।

 
চুলবুলমিয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় সব— ইঁটভাঁটা চালকল ধানের আড়ত। তবে এসব কিছুতে মন নেই। রোজিকে যেন কার মোটরবাইকের পেছনে দেখেছে।
 
সোমবাবু বললেন, ভায়া ! তোমাকে একটা কথা বলব ?

 
বলুন !
 
তোমাকে বড়ো উদাসীন দেখাচ্চে।কী ব্যাপার বলত ?

 
মৃদু হেসে চুপ করে যায় কবির। কী কথা বলবে ? বলার মতো কিছু আছে নাকি। একটা স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তার। তা কি ফলাও করে বলবার মতো বিষয় ? তবু বলতে হয়। সোমবাবুকে সবকিছু বলা যায়। তিনি সবকিছু শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, জীবনে টানাপোড়েন থাকে।একটা বাঁকে সব শেষ হয় না। ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারব না। একটা কথা বলি, তোমাদের ভালোবাসায় কোথাও ফাঁকি ছিল।
 
তাঁর কথা শুনে চমকে ওঠে কবির। তাঁর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে। এমন কথা সে তো কখনও ভাবেনি। নিজের ভেতরে সে আত্মগত হয়ে ওঠে।
 
জুঁইয়ের কথা বোধহয় সঠিক হয়। রোববার হাজিরা দিয়ে বসে থাকে। খানিকবাদে সিরাজ ডেকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার তোমার ?

 
ডালিয়া আমাকে ফোন করেছে।
 
কেন ?
 
আপানার মেয়েকে পড়াতে হবে।
 
তুমি পড়াবে ? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে শিরাজ ।
 
আপনি যদি অনুমতি দেন।

 
কিছুক্ষণ ভাবে সিরাজ ।তারপর বলে, ঠিক আচে। সে যখন তোমাকে পাঠিয়েচে।
 

·•·•·•·•·•·•·•·•·•·

 
এক একদিন রাত বাড়তে থাকে। ঘুম আসে। নিজের ফাঁকিটা ধরার চেষ্টা করে। সে ডালিয়াকে পাওয়ার জন্যেই শুধু স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নকে বাস্তবের সঙ্গে মেলাতে পারেনি। কবির উদ্যমী পুরুষ নয়। যা সহজ তাকে সহজ মনে করেছে। সহজের আবরণের ভেতরে অদৃশ্য কঠিন স্তরকে টের পায়নি।নিত্যদিনের পরিচিতির মধ্যে অপরিচয়ের মনোবেদনা থাকে। কখনো কখনো তা টের পেলেও তা গভীর হয়নি। একটা রাতচরা পাখি ডেকে ওঠে। তার চিন্তার অভিমুখ পাল্টে যায়। বিরহের দুঃখ তার ক্ষণস্থায়ী হয়। যথেষ্ট উদ্যম তার নেই কোনকিছুতে। রোজি বলে মেয়েটার মুখ ভেসে ওঠে। কোথায় দেখেছে ? কোথায় দেখেছে ? এবার মনে পড়ে।
 
শেফালির সঙ্গে যায় আসে। ভালো মন্দ কথা হয়। এর মধ্যে কালো মেঘ ঘনিয়েছে। টেট পরীক্ষার প্যানেলের ওপর কারা হাইকোর্টে কেস করে দিয়েছে। শেফালি ভয় পায়, কী হবে, কবিরদা ?
 
ইছামতিতে ভেসে যাব। তখন তারা নৌকায়। আর আশ্চর্য বিনা মেঘে যেন ঝড় এল। সামাল সামাল রব। নৌকা টালমাটাল। শেফালি ভেজা কণ্ঠে বলে, তুমি এমন ঠাট্টা করলে ?
 
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমি যখন ঝাঁপ মারব।
 
নৌকা দুলতে থাকে। শেফালি তার হাত জাপ্টে ধরে থাকে। ঝড় যেমন এসেছে তেমনি চলে গেল। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। শেফালি বলে, নদীর বুকে দাঁড়িয়ে এমন কথা কখনো বলতে নেই ।
 
তীরে নেমে হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, ঝড় যখন ওঠবার ঠিক ওঠবে। আমার কথায় কি আসে যায় ?
 

·•·•·•·•·•·•·•·•·•·

 
সেদিন বুধবার। আনুয়াদহের হাটে শীতের সবজি বিক্রি করে ফিরেছে । একটা অপরিচিত লোক তার কাছে জানতে চায়, এটা কি মাস্টারের বাড়ি ?

 
কেন ? কী দরকার ?
 
আপনি বুজি গার্জেন ?
 
আমি তার আব্বা।

 
সালাম কালামের পর লোকটা বলে, আপনার সঙ্গে কথা বলতি পারি ?

 
বারান্দায় ওঠেন।
 
আমি মধ্যমপুর থেকে এইচি। ঘটক বলতি পারেন।
 
তার কথা শুনে মকবুলমিয়া বলে, একটু দেরি হয়ে গেচে।
 
বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেচে ?
 
কথাবার্তা চলচে।
 
তাহলি আমার কথাডা ভেবে দেকবেন।কন্যে চাকুরিজীবি।

 
টগরবেগম কখন এসে সেখানে দাঁড়িয়েছে। সে বলে, আমরা চাষাভুষো মানুষ ওমুন মেয়ে লে কী করব ?

 
কী যে বলেন ?
 
কেন ?
 
এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে !
 
আপনার কথা ঠিক বুজলুম না।
 
আমি বুজিয়ে দিচ্চি। কিচু কিচু গাইগোরু আচে না যারা মাঠে লাঙল টানে, আবার দুধও দেয়।
 
ঠিক আচে। ছেলে এখন স্কুলে। ফিরুক। তার সঙ্গে কথা বলে দেকি।
 
এই আমার ফোন নাম্বার। তাড়াতাড়ি করবেন। আপনার ভরসায় তো থাকা যাবে না।

 
লোকটা গুটি গুটি পায়ে নেমে যায়।
 
ব্যাপারটা আড়াল থাকে না । দুজনেই জেনে যায় । কিন্তু কেউ কাউকে জানতে দিতে চায় না সে জেনেছে । দুজন আগের চেয়ে আরো খোলামেলা হয় ।আরো স্বাভাবিক হয়।
 

·•·•·•·•·•·•·•·•·•·

 
জুঁইয়ের কথাই সত্যি । ডালিয়া আর সময় পায় না ।তাকেই পড়াতে হয়। মাসের শেষে তলব করায় সিরাজ। তার হাতে একটা খাম তুলে দেয় সে ।কবির খাম খুলে টাকা দেখে অবাক হয় । এ আপনি কী করেচেন ?

 
আমার সন্দেহ ঘুচে গেচে।

 
কবির বিস্মিত হয়ে বলে, আমি আবার কী করলুম ?

 
তুমি কিচু করনি। আমারই কিন্তু কিন্তু ছিল। প্রাইমারি টিচার হয়ে আমাকে পড়াতে পারবে ?

 
মনোক্ষুণ্ণ হয় সে। অন্যসব ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও পড়াশুনোয় তার কোন ফাঁকিবাজি ছিল না। উঠতে উঠতে সে ভাবে, এ কোন দয়ার দান না।তার নায্য পারিশ্রমিক। কে তার মূল্যায়ন করছে ? একজন অশিক্ষিত মানুষ তার যোগ্যতা বিচার করছে। এ কী সেই দিনকাল পড়ে গেল ? একটা বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করে।
 

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৮

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৮। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!