- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ১৭, ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ২। নজরবন্দী সময়ের উপকথা
অলঙ্করণ: দেব সরকার
কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব
ষাট হাজারের গল্প
সকাল সকাল পৌঁছে দেখে সে এক হৈ হট্টগোল ব্যাপার।কোথায় যাবে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ডিআই অফিসের সামনে ফাঁকা চত্বর।একপাশে একদল ছেলেমেয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। আর বিল্ডিংএ ঢোকার মুখে একটা জটলা।কী ব্যাপার ? সবার মুখে কুলুপ।সে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে গোলগাল চশমা পরা একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করে,আপনার কোন মেসেজ এসেচে ?
সেজন্যে তো খোঁজ করতে আসা।
ঠিক আচে।মেয়েটা একটু সরে তার জন্যে জায়গা করে দেয়।
এবার সে টের পায় তারা একটা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে । আর একটা টাক মাথা লোক সেখানে কাগজপত্তর নিয়ে বসে আছে।
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বাদে অনেক ধস্তাধস্তির পর সে টেবিলের কাছে হাজির হয়।লোকটা অসম্ভব গম্ভীর গলায় বলে,কী নাম ?
আজ্ঞে ! কবির মানে কবিরুল হোসেন।
কবিরুল হোসেন—কবিরুল হোসেন—লোকটা হাতে ধরা লিস্টটাতে চোখ বোলাতে থাকে।
বুকে তার ধড়ফড়। লিস্টে কি তার নাম খুঁজে পাবে লোকটা ? তার দিকে না তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,মোবাইলে মেসেজ—? আরে এইতো—কবিরকে কোন জবাব দিতে হয় না।
লোকটা খসখস করে একটা চিরকুট লিখে তার হাতে দিয়ে ইশারা করে। তার বুঝতে কোন অসুবিধে হয় না। সিঁড়িতেও একদল ছেলেমেয়ে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিচ্ছে। কয়েকজন পুলিশ তাদের ঘিরে রেখেছে। সেসব দোতলায় পৌঁছে দেখে,তার আগে যারা এসেছে তাদের লম্বা লাইন।
এখানেও ঘণ্টাদেড়েক বাদে যখন ঘরের দরজার কাছে পৌঁছেছে তখন অফিসার ভদ্রমহিলা কমপিউটার ছেড়ে উঠে পড়লেন। টেবিলের সামনে বোর্ড ঝোলানো হয়েছে।
প্রায় পয়ঁতাল্লিশ মিনিট বাদে এসে টিফিন টাইম লেখা বোর্ড উল্টে দিলেন। দুতিনজন পরেই তার পালা।
কই চিরকুট দেখি।
সে কাগজের টুকরো এগিয়ে দেয়। তিনি স্ক্রিনে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেন, মোবাইলে মেসেজ এসছে ?
এই তো ! তাড়াহুড়ো মেসেজ বের করে।
কী নাম ?
কবিরুল হোসেন।
তিনি আরো কিছুক্ষণ কমপিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। হাতের কাছে কাগজপত্তর সব তোলপাড় করেন। তারপর কবিরের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে পড়লেন। ব্যাপারটা কী হল ? ওঁর কি টিফিন শেষ হয়নি ? বোর্ড তো উল্টে দিয়েছেন। তিনি ওভাবে তাকালেন কেন ? একটা ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। কোথাও কোন গোলমাল হল নাকি ? সে তো কাউকে ধরাকরা করে আসেনি। তবে সবকিছু কি মিথ্যে ? পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে ? বুকের ভেতর একটা অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করে। ম্যাডাম কি তাকে জালিয়াত ঠাওরেছে। কাছেই তো পুলিশ। কিছুক্ষণ পর তিনি ভেতরের একটা ঘর থেকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন। তারপর বলেন, কাল এসে ডিআই সাহেবের সঙ্গে অরিজিনাল ডকুমেন্ট নিয়ে দেখা করবেন।
তার যেন বিশ্বাস হয় না।সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,আমার নাম লিস্টে আছে?
তাহলে আর কালকে আসতে বলছি কেন।
সে বুকে হাত দিয়ে বলে,ঠিক বিশ্বাস হচ্চে না।
না হওয়ারই কথা।
কেন ম্যাম ? আবার সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
প্রথম লিস্টে নাম খুঁজে পাইনি।আনেক্সে আছে।
আর কথা বাড়ান না। পরের জনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে কবির যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
সারাদিন ধকলের পর বাড়ি ফিরে মনে হল ডালিয়াকে ফোন করে। ষাট হাজারের গল্প শুনে ফর্ম ফিলাপ করলেও পরীক্ষা দিতে চায়নি। তাদের সেন্টার পড়েছিল নদিয়া জেলার অজ পাড়া গাঁয়ে। অনেক কষ্টে তারা পরীক্ষার ঠিক আগে পৌঁছেছিল। বেশ মজা পাচ্ছিল সে, পরীক্ষা হল খুঁজে না পেলেও তার কিছু যায় আসে না। ডালিয়ার ফোন বেজে গেলেও সে ধরে না। পরে হয়তো ব্যাক করবে।
ষাট লক্ষ ছেলেমেয়ের এই অসম্ভব বাধা পেরিয়ে সফল হওয়া আরব্য রজনীর গল্পের মতো। সে কি সফল হয়েছে ? এখন দিন না রাত ? তার মাথা ঘুরছে। সে তাকিয়ে দেখে বাঁদিকে একটু দূরে একটা বড়ো কদমগাছ। এগিয়ে গিয়ে তার গোড়ায় বাঁধানো চাতালে গিয়ে বসে। ফোন বের করে। ডালিয়া তুমি কোথায় ?
ডি আই সাহেবের বয়েস বেশি না। তরুণ বলা চলে। বেশ হাসিখুশি মুখ। তার সমস্ত মূল কাগজপত্র যাচাই করে বলেন,আপনাকে বাড়ির কাছে দিতে পারব না।
আমার কোন আপত্তি নেই।
ঠিক আছে। তিনি একটা ছাপানো চিঠিতে সইসাবুদ করে তার হাতে তুলে দেন।সে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসে।
আজও খণ্ড খণ্ড জটলা আছে। পুলিশও আছে। বাইরে বেরিয়ে তার পা আর চলে না। সে ভেবে পায় না কোন জগতে আছে। ষাট লক্ষ ছেলেমেয়ের এই অসম্ভব বাধা পেরিয়ে সফল হওয়া আরব্য রজনীর গল্পের মতো। সে কি সফল হয়েছে ? এখন দিন না রাত ? তার মাথা ঘুরছে। সে তাকিয়ে দেখে বাঁদিকে একটু দূরে একটা বড়ো কদমগাছ। এগিয়ে গিয়ে তার গোড়ায় বাঁধানো চাতালে গিয়ে বসে। সে ফোন বের করে। ডালিয়া তুমি কোথায় ? এবারও ফোন বেজে কেটে গেল। তার মাথার ওপর পাতার ফাঁকে একটা হলুদ পাখি ডেকে ওঠে। চটকা ভাঙে তার। আর তখন দেখে সেই চশমা পরা মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে । তাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,পথে অবরোধ ছিল তাই দেরি হয়ে গেল। তার দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে সে ছুটতে ছুটতে অফিসে ঢুকে গেল।
সেদিন অতটা খেয়াল করেনি। আজ মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে। আরো কিছু আবোল তাবোল ভাবনাচিন্তার পর সে উঠতে যাবে তখন দেখল, সে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছে। কবিরকে দেখে হাত নাড়ে মেয়েটা।সে চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।
কোন সার্কেল দিল তোমাকে ? কবির জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটা তখন পাশে এসে বসেছে। কালকে আবার আসতে হবে।
কেন ?
আমার একটু দেরি হয়ে গেচে। তাছাড়া ডিআইসাহেব জরুরি কাজে বিকাশভবন যাচ্ছেন।
পাখিটা আবার ডাকছে। সেদিকে কান পেতে কবির অন্যমনস্ক গলায় বলে,তোমাকে ঠিক চিনতি পারচি না।
আমি আপনাকে চিনি।
সেজন্যে তোমার মুখ যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
টাকি কলেজে আমি আপনাদের এক বছরের জুনিয়ার।আর্টস সেকশানে ছিলাম।
ঠিক ! ঠিক ! মাথা নাড়ে কবির।
তারা পরস্পরের মোবাইল নম্বর জানতে চায়।এ যেন একটা সৌজন্যবোধ।কবির শেফালি খাতুন নামে সেভ করে।
খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সে বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পর ফোন আসে।তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে।কবির নিজেই ফোন করতে যাচ্ছিল তার আগেই বেজে ওঠে।
তুই ডিআই অফিসে গেলি,আমারে বললি নে ?
আমি চাকরির জন্যি যাইনি।
তবে ?
চাকরি যে নেই তাই জানতি গেচলুম।
তা বেশ ! তুই আমাকে হারিয়ে দিলি।
কী যে বলিস ! আমি আর তুই ভিন্ন।
এখন থেকে তাই ভাবব।একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ডালিয়ার।
লক্ষ্মীটি ! তুই এমন বলিস নে।আমি তাহলি আত্মহত্যা করব।
আত্মহত্যা কি অত সহজ ?
আমি তোর জন্যি সবকিছু করতি পারি।
জীবন নাটকের মতো কিন্তু নাটকবাজি নয়।
তোকে আমি সত্যি বিয়ে করতে চাই।
এখনো একটা পরীক্ষার ফল বাকি আছে যে পরীক্ষা তুই দিসনি।লাইন কেটে দেয় ডালিয়া।
মুফতি পাড়া বেশ বড়ো একশো ঘরের মতো বাস। বেশির ভাগ চাষিবাসী মানুষ। তাদের কেউ কোনদিন চাকরিবাকরি করেনি। এ খোশখবরে মকবুলমিয়া যেন ধন্দে পড়ে যায়। সে জুনিয়ার স্কুল পাশ। জমি নির্ভর তার জীবন। মেয়ের বিয়ের সময় একটা বাঁশবাগান বিক্রি করে তার বুকের পাঁজরা খসে গেছে। সে রাজি ছিল না। তাদের এমন কোন রেস্ত ছিল না বেয়াইসাহেবের দু দুটো অসম্ভব শর্ত মানতে পারবে। ছেলে জেদ ধরে, এমন সোনার টুকরো ভূভারতে নেই। বোনের ভবিষ্যত একেবারে হিরে জহরতে মোড়া ! কী যে বাপু তোদের মতিগতি ! তবে হ্যাঁ ! ছেলেরা অবস্থাপন্ন। মেয়ে সুখে থাকবে। তাও ফোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এইট পাশ মকবুলের হাতের স্পর্শে গাছগাছালি জেগে ওঠে। খুশি হয়। কবির কি এসবের মর্ম বুঝবে ? তারা কি অনাথ হয়ে পড়বে না ? তার এসব ভাবনা চিন্তা ধাক্কা খায় টগর বেগমের কথায়।
মেয়েজামাইকে একবার খবর দিলে হত না ?
তাইতো ! তাইতো ! সোৎসাহে বলে ওঠে সে। সব কথা তো গুছিয়ে বলতে পারবে না।খোকা।ও খোকা।
কবির কোন জবাব দেয় না।সে তখন অন্য ফোনে ব্যস্ত।
গুরু ! তুমি দেকচি ছুপা রুস্তম।
এরকম বলচিস কেন ?
আমরাও তো টাকা দিয়েচি।শ্যামল বলে।তাদের গ্রুপে আছে।
তুই কল পাসনি ?
সেজন্যে তোকে ফোন করচি।তুই কাকে টাকা দিয়েচিস ?
বিশ্বাস কর।
বন্ধু হিসেবে তোকে আর দলে রাখা যাচ্চে না।তুই আমাদর সঙ্গে বেইমানি করেছিস।শ্যামল গালাগালি দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
এতক্ষণ বাইরে কামিনিফুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিস। এখন বারান্দায় উঠে বাপের দিকে তাকিয়ে বলে, কী জন্যে ডাকচ ? মন তার বিষণ্ণতায় ভরে গেছে। এমন অভিজ্ঞতা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। শ্যামলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা কারোর চেয়ে কম না।
ওদের একবার খোশখবরটা দিলে হয় না ?
বাপের সঙ্গে তার তোড়াবুড়ি হয়েছিল। মকবুলমিয়া কিছুতেই রাজি না। বিয়ের এ আয়োজন করা ক্ষমতার বাইরে।কিন্তু বাপকে সব কথা ভেঙে বলতে পারেনি। আমির মিঞার যেমন দুটো শর্ত তেমনি তার কাছে আরো দুটো বিষয় খুব তুচ্ছ ছিল না। ফরিদের কাকুতিমিনতি আর বোনের বদনাম।
খবর শুনে ফরিদ লাফ মেরে ওঠে।আমি জানি দাদাভাই,তুমি পারবে।
কী পারব ? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
তুমি ক্যাপ্টেন ধোনির মতো একদিন বিশ্বজয় করবে।
কী যে বলো তুমি ?
ধোনি দশটা দেশের একশো দশজনের সঙ্গে খেলে চ্যাম্পিয়ান হয়েচে আর তুমি কী যে বলব ? তুমি ষাট লাখ খেলোয়াড়ের সঙ্গে পাঞ্জা কষে জিতেচ।
তার কথায় বেশ মজা পায় কবির। আরো কছুক্ষণ বকবক করে ফরিদ।তার ভেতরের গুমোটভাব কেটে যায়।শ্যামলের কথাবার্তায় সে মুচড়ে পড়েছিল।
ঘরে ঢুকতে টগর বেগম বলে,একটু চা খাবি,খোকা ? কেমন যেন মনে হচ্ছে ছেলের ওপর বেশ ধকল যাচ্ছে।
হ্যাঁ ! হ্যাঁ ! সত্যি মাথা ধরেছে।মা ছাড়া এমন স্বস্তি কে দিতে পারে !চা এনে মা তার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়।চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর মা বলে,খোকা ! বালান্দা পরগণায় আমরা তার অধীন।
পীর গোরাচাঁদের কথা বলচ।
একুশ টাকার সিন্নি দেওয়ার কথা বলচি।
পরশুদিন বৃহস্পতিবার মগরেবের সময় গিয়ে আগরবাতি মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে আয়।
বাড়ি থেকে বেরোলে এখন সবাই তাকে সমীহের চোখে তাকায়।তবুও মানুষের মন।কেউ কেউ তাকে অকারণ হিংসে করে। চাষার ছেলে যাবে চাকরি করতে ! আবার অন্যজন বলে,চাকরি করে একেবারে মাথা কিনে নিয়েছে। বাপমাকে আর মানবে ?
মনে একটু দ্বিধা ছিল।তবু ফোন করে।আমার সঙ্গে যাবি ?
কোথায় ?
তোর সময় হবে ?
আগে শুনে দেকি।
কবিরের কথা শোনার পর এক কথায় রাজি হয়ে যায় ডালিয়া।সে বলে,এই ফাঁকে আমিও একটা মানত করে আসব।
রাতেরবেলা ফোন। তাদের গ্রুপের পূজা। একটু ইতস্তত করে। সে আবার কী বলবে তা কে জানে ! রিং হয়ে কেটে গেল। যাকগে,ভালো হয়েছে। এই এক চাকরির দৌলতে সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে শুরু করেছে। দুনিয়ার রীতিনীতি বুঝি এমন। কিন্তু শ্বাস ফেলার সময় পেল না।আবার ফোন।এবার আর না ধরে পারল না।
হ্যালো-পূজা—বল—
তোকে অভিনন্দন জানাই।
কী যে বলিস ! কবির খানিক আপ্লুত হয়ে পড়ে। সে যা আশঙ্কা করেছে তা নয়। সবাই কি আর সমান হয়। এক এক জনের চরিত্র এক এক রকম। গ্রুপে থাকলে সহজে বোঝা যায় না।
এতবড়ো খবরটা চেপে গেলি ?
মোটেই না।তোর খবর কী ?
আমি বোধহয় ঘেঁটে গেলুম।
কেন ? কী হয়েচে ?
কী আর বলব !
তবু শুনি।আন্তরিক গলায় বলে কবির।
সে বিষণ্ণ হয়ে যা বলে,তাতে সহানুভূতি জানানো ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে কবির। বাঁশবাগান বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হাতে থেকে গেছে। হাসনুহেনার বিয়েতে সবটুকু খরচ হয়নি। একবার ভেবেছিল, টাকাটা তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু তারপর পিছিয়ে আসে। তার মনে হয়েছে,বাপ তাহলে কী ভাববে ? বোনের বিয়ে শুধু না জমি বিক্রির পেছনে তারও একটা দুরভিসন্ধি আছে।
পূজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,এখনও তো সব লিস্ট বেরোয়নি।
তুই ঠিক বলচিস ?
সবটাই ধোঁয়াশা।পূর্ণিমা ম্যাডামের কথা মনে পড়ে যায়।
ঠিক বলেচিস।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দেয় পূজা।
এখান থেকে দশকিমি দূর। সোজাসুজি অটো যায়। বিকেল হওয়ার আগে তারা বেরিয়ে পড়ে। হাড়োয়া গঞ্জে বিদ্যাধরী নদীর তীরে পীর গোরাচাঁদের মাজার। বেশ ভিড় আছে। মগরেবের আজান হয়েছে। আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বেলে দেয় কবির। একুশ টাকার বাতাসা কিনে সিন্নি দেয় সে। মাজার শরিফের সামনে বড়ো এক বকুলগাছ। সঙ্গে করে এনেছে ডালিয়া।লাল শালুতে ঢিল বেঁধে বকুলের ডালে ঝুলিয়ে দেয় সে। কৌতূহলী হয় কবির।কী মানত করলি ?
মনে মনে বলতে হয়।মুখে উচ্চারণ করলি তা আর ফলে না।
সঙ্গে সঙ্গে তারা বাড়ি ফেরে না।বিদ্যাধরী নদীর পারে একটা বটগাছের নীচে বসে।প্রথমে মুখ খোলে কবির,কীরে চুপ করে আচিস কেন ?
ভাবচি।
কী ভাবচিস ?
দুনিয়ার রীতি দেক !
আমার চাকরি পাওয়ায় তুই খুশি হোসনি ?
সেকথা বলিনি।
তবে ?
আমরা তো সমান সমান পরীক্ষা দিলুম।
আমার কোন আপত্তি নেই।কবির আনমনা হয়ে বলে।
আমার চাকরি যদি তোকে দিতে পারতুম।
ওসব অবাস্তব কথা বাদ দে।
এই মুহূর্তে এটাই আমার কাচে বাস্তব।
সাঁজবেলাতে পুব আকাশে চাঁদের আভা দেখা যাচছে।সেদিকে তাকিয়ে ডালিয়া যেন মোহ মেদুর হয়ে পড়ে।কান্না ভেজা গলায় বলে,তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস তাই না ?
কবির কোন জবাব দেয় না। তাকে কাছে টেনে নেয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ডালিয়া। এ যেন অচেনা কেউ। সেই পরিচিত ডালিয়া নয়। এমন সময় কবিরের ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়। লাইনটা কেটে দেয় সে। ডালিয়া জিজ্ঞেস করে,কে ? ইতস্তত করে সে। কীভাবে নেবে তা কে জানে ! ডালিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো হারাতে চায় না। আলোআঁধারিতে কবিরের মুখের দিকে কী একটা আন্দাজ করে ডালিয়া। হয়তো কিছু লুকোতে চাইছে সে।পীড়াপিড়ি করে না ডালিয়া।আবার ফোন। এবার সে জোর গলায় বলে,ধর না ফোনটা।
হ্যালো—
হ্যালো–কবিরদা–!
বলো।
আমাকে হাসনাবাদ সার্কেলে দিয়েচে। তোমাকে—?
ওই একই সার্কেলে।
আরো কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। বলা হল না, আচমকা লাইন কেটে দেয় কবির।
কে কথা বলছিল ? ডালিয়া জিজ্ঞেস করে।
তুই তাকে চিনবি ?
কী নাম ?
শেফালি খাতুন।
মাথা নাড়ে সে। এ নামের কাউকে চেনে না।
আমাদের কলেজের একবছরের জুনিয়ার।
তোর সঙ্গে কোথায় আলাপ হল ?
ডিআই অফিসে।
এখন আমাকে ছেড়ে কতজনের সঙ্গে আলাপ হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডালিয়া। কবির কোন জবাব দেয় না।সেও ঠিক স্বস্তি পায় না। এসব কী হচ্ছে সে ভেবে পায় না।ডালিয়ার হাত দুটো ধরে বলে,আমার কোন দোষ নেই।
আমি সে কথা বলিনি। আবার দুজনে চুপচাপ।নোনা বাতাস ভেসে আসে। কোথা থেকে মাঝিমাল্লাদের গান এসে খেই হারায়। ডালিয়া বলে,চল ! উঠে পড়ি।
হ্যাঁ ! নাহলি লাস্ট অটো চলে যাবে।
তারা বটের আলো আঁধারি থেকে বেরিয়ে সদর রাস্তা ধরে।
♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦
ক্রমশ..
প্রথম পর্ব পড়ুন:
❤ Support Us