- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- অক্টোবর ১, ২০২৩
চর >।পর্ব ১৩।

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স
•২৫•
সফর আলির ঘুম ভাঙল বেলা করে। সারা রাত ঘুম হয়নি তার। ঘুম এসেছিল শেষ রাতে। পাগলের মতো উদাসীনভাবে পদ্মার পাড় আর মাঠে মাঠে ঘুরে ঘরে ফিরেছিল রাত একটার দিকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু, কত ধরনের ভাবনা এসে তার মাথা ভারী করে তুলেছিল। রূপসীর সাথে তারা শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল একেবারে হঠাৎ। আকস্মিকভাবে। তারজন্য তার পূর্ব কোনও প্রস্তুতি ছিলনা। এমনকি রূপসীর সাথে শারীরিক সম্পর্কের কথা তার ভাবনাতেই আসেনি। যা হয়েছে সব রূপসীর ইচ্ছেয়। রূপসীই তাকে বাধ্য করেছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রূপসীর যৌন আবেদনের কাছে সে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছে। সেই সময় তার আর কিছুই করার ছিলনা। কিন্তু এখন রূপসী কী চায়! বসির রূপসীর সন্তান কোনোদিন মেনে নিবেনা। সে ভালোভাবে জানে কোনোদিন সে বাবা হতে পারবেনা। তাহলে! রূপসীকে সে যদি ডিভোর্স দেয়! তাহলে কি সে রূপসীকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিবে! রূপসী কি তাতে রাজী হবে! সে তো বলে গেল কিছুতেই সেটা সম্ভব নয়। তাহলে কী চায় সে? সে বলে গেছে এটাই তার শেষ দেখা। সে কি আত্মহত্যা করবে? এইসব নানান ভাবনা তার মনের মাঝে লাইন দিয়ে একটার পর একটা আসছিল আর যাচ্ছিল। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল বেলা হয়ে।
গতরাত থেকেই সফর আলি ঠিক করেছিল আজ সে চেম্বার খুলবে না। ঘরে বসে থেকে রেস্ট নিবে। ঘরে বসে থাকতে ভালো না লাগলে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে যাবে। মনের মধ্যে যে একটা উদাসীন ভাব এসেছে – তাকে যেভাবেই হোক কাটাতে হবে। শরীরে ও মনে গভীর ক্লান্তি দেখা দিয়েছে তার।
ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছেড়ে সে চটিটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে বেরিয়ে গেল।
কিছুটা এগোতেই সামনে দেখতে পেল পরাণ, পরাণের বউ মালতী আর ছোট মেয়েটি রাস্তা ধরে খুব জোরে জোরে এদিকেই হেঁটে আসছে। পরাণের কাঁধে একটি চামড়ার ব্যাগ। হাতেও একটা ব্যাগ আছে। তবে কিসের তা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছেনা। মালতী আর মেয়ের হাতেও ছোট ছোট ব্যাগ।
পরাণ কাছে আসতেই সফর আলি জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় চললে গো তোমরা পরাণ ভাই?”
পরাণ খুব উৎসাহের সাথে উত্তর দিল, “এই একটু বম্বাই যাব সফর ভাই। মেয়ের কাছে যাব।”
“সারির কাছে। তা হঠাৎ! কী ব্যাপার! মেয়ে ভালো আছে তো?” সফর আলি জিজ্ঞাসা করল।
“হঠাৎই বটে। গত পরশু দিন ফোন করে ডেকে পাঠাল। সাথে টিকিটও পাঠিয়েছে। আজ রাত আটটায় হাওড়া থেকে ট্রেন।” পরাণ বলল।
“তা হঠাৎ কেন? কী হয়েছে?” সফর আলি জিজ্ঞাসা করল।
পরাণ বলল, “একেবারে হঠাৎ না সফর ভাই। আগে থেকেই মেয়ে বলে রেখেছিল। সারির আবার ছেলে হয়েছে। তাই আমরা সবাই মিলে যাচ্ছি। জামাইই টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে আমাদের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে।”
সফর আলি একটু হেসে বলল, “খুব ভালো খবর তো! তা এতদিন বলনিতো! কবে ফিরবে তোমরা?”
“ওরা তো বলেছে একমাস থাকতে হবে। আমাদের পক্ষে একমাস থাকা সম্ভব হবেনা। এই দশ বারো দিন পরই চলে আসব। কোনোদিন তো সেভাবে বাইরে থাকিনি। এই দশ বারো দিনই থাকতে পারব কিনা জানিনা!” পরাণ একটু তাড়া দেওয়ার মতো করে কথাগুলি বলল।
সফর আলি বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যাও।”
পরাণেরা চলে গেলে সফর আলি আরও কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার মন যেন কোনও খবরের জন্য অপেক্ষা করছে। তার চোখ যেন কাউকে খুঁজছে। কিন্তু নতুন কোনও কিছুর খবর সে পেলনা। আর কাউকে সে দেখতেও পেলনা।
হাঁটতে হাঁটতে সফর আলি থানের কাছাকাছি চলে এসেছিল। দূর থেকে দেখল বসির মাটির উঁচু চাতালে একটা মাদুরের উপর বসে কিছু একটা করছে। আর এগোলনা সফর আলি। বসিরের মুখোমুখী হতে তার আর ইচ্ছে হলনা। কোন কথায় কোন কথা উঠে আসবে। এদিকে বেলা বাড়ছে। বাড়ছে রোদের তেজও। আর এগোলনা সফর আলি। ঘরে ফেরার জন্য পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে।
ফেরার পথে সফর আলি ইচ্ছে করেই রাস্তা বদলাল। যে পথটি রূপসীদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেছে সেই পথে পা রাখল সফর আলি। কিছুটা এগিয়ে গেলে একজন লোক উল্টোদিক থেকে এসে বলল, “আপনার চেম্বার থেকেই আসছি। আপনার চেম্বার বন্ধ আছে?”
সফর আলি কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বলল, “হ্যাঁ আজ চেম্বার বন্ধ আছে। আজ চেম্বার খুলব না।”
“কিন্তু গতকাল থেকে জ্বর। শরীরটা খুব খারাপ।” লোকটি কিছুটা আকুতির মতো করে বলল।
সফর আলি কিছুটা দাঁড়িয়ে লোকটির গায়ে হাত দিয়ে জ্বর মাপার চেষ্টা করল। বলল, “খুব বেশি জ্বর নেই। পারলে এই ট্যাবলেটটি খাবে। এইসব ট্যাবলেট এখন সবার বাড়িতেই থাকে। না ভালো হলে সন্ধ্যার পর এসো। তখন নাহয় দেখে দিব।” পকেট থেকে একটা কলম বের করে সাদা চিরকূটে ওষুধ লিখে দিলে সে।
লোকটি চলে গেলে সফর আলি আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছুটা এগোলেই সামনে রূপসীদের বাড়ি। মনের ভেতরটা হঠাৎ ঢিপ ঢিপ করতে লাগল তার। যদি রূপসীর সাথে দেখা হয়ে যায়! যদি রূপসী ডাকে! যদি সে কথা না বলে! মনের ভেতরে নানা কথা চিন্তা করতে করতে সফর আলি সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রূপসীদের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখল রূপসীদের বাড়ির দরজা বাইরে থেকে লাগানো। আশেপাশেও রূপসী নেই। রূপসীর বাড়ির দিকে তাকিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সফর আলি।
যখন সে ঘরে পৌঁছল, অনেক বেলা হয়ে গেছে। দরজা খুলে ঘরে ঢুঁকল সফর আলি। টেবিলের নিচের দিকে একটি ছোট্ট চিরকূট মতো কিছু একটা দেখতে পেল সে। চিরকূটটা হাতে তুলে সফর আলি দেখল গোটা গোটা হাতের অক্ষরে লেখা একটি চারকোণার চোট্ট চিরকূটে কয়েকটি লাইন লেখা আছে – ‘আমি চলে গেলাম। কোথায় যাব জানিনা। তোমার সাথে রাতের দেখায় আমার শেষ দেখা। তুমি আমাকে খুঁজে পাবেনা। তাই অযথা খুঁজবেনা। তোমাকে আমি কোনও বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলতে চাইনি। তোমার ফোন নম্বর আমার কাছে আছে। যদি আমার কোনোদিন তোমাকে প্রয়োজন হয়, আমি ফোন করে নিব। যদিও সে সম্ভাবনা খুব কম। রূপসী।’
চিরকূটটা কয়েকবার পড়ে বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ল সফর আলি। তার মুখ দিয়ে একটা লম্বা গভীর শ্বাস বের হল। রূপসী কোনও কিছু আড়াল রাখেনি। দু একটি কথায় সে অনেক কথা বলে ফেলেছে। সে যা বলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাইই করে। তাই তাকে খোঁজা বা খুঁজতে যাওয়া সত্যি সত্যিই বৃথা। তাকে খুঁজে কোনও লাভ হবেনা।
তারপরেই তার মনে পড়ে গেল আজ সকালে তো পরাণেরা মুম্বাই গেছে। রূপসী ওদের সাথে চলে যায়নি তো! পরাণকে জিজ্ঞাসা করলেই তো সব জানা যেত। কিন্তু তখন সে কিছু জানত না। সফর আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। তারমানে পরাণেরা এতক্ষণ কতদূর যেতে পারে। এতক্ষণ নিশ্চয় আখরিগঞ্জের ঘাট পার হয়ে গেছে বা হচ্ছে। সাইকেলটা নিয়ে একবার এগিয়ে গেলে কেমন হয়!
ভাবতে ভাবতেই সফর আলি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। খুব জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে সে পৌঁছে গেল আখরীগঞ্জের ঘাটে। ঘাটের সবাই সফর আলিকে চেনে। একজন জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার ডাক্তার বাবু! এমন উদ্ভ্রান্তভাবে যাচ্ছ কোথায়?”
সফর আলি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, “এই কিছু আগে পরাণ পার হল কী? পরাণ! আমাদের গ্রামের পরাণ! সাথে বউ আর তার মেয়ে আছে!”
লোকটি বলল, “এই তো এর আগের খেয়াতে ওরা পার হল।”
“ওদের সাথে কী আর একটি মেয়ে ছিল! দেখতে মাঝারি। গায়ের রং ফর্সাঃ।” সফর আলি কিছুটা তাড়াতাড়ি করে কথাগুলি বলছিল।
পাশ থেকে একজন বলল, “কার কথা বলছ? রূপসীর! মানে বসিরের বউ!”
এখানে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। এই চরের মানুষ এখান দিয়ে পার হয়, আবার ফিরে আসে। ফলে কেউ কাউকে চিনতে ভুলেনা।
সফর আলি বলল, “হ্যাঁ। রূপসীর কথায় বলছিলাম!”
লোকটি বলল, “সে তো সকালের আগেই পার হয়েছে!”
সফর আলি কিছুটা অসহায়ের মতো জিজ্ঞাসা করল, “ওর সাথে কী কেউ ছিল?”
লোকটি উত্তর দিল, “ওর সাথে কেউ ছিল বলে তো মনে হচ্ছেনা। তবে খেয়াতে তো অনেক মানুষের চলাচল। কে কার সাথে যাচ্ছে বলা খুব মুশকিল।”
সফর আলি মনে মনে ভাবল লোকটি যা বলল, সে তো ঠিকই। প্রতিদিন খেয়াতে এত লোক যাওয়া আসা করছে। এখন কে কার সাথে এল, আর কে কাকে নিয়ে চলে গেল, সেতো বলা মুশকিল। খেয়া ছেড়ে গেছে। পরের খেয়া ছাড়তে কমপক্ষে আরও আধ ঘন্টা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সফর আলি কিছু ভাবল। ঘাট পার হয়ে একবার রেল ষ্টেশন গেলে কেমন হয়। পরাণেরা তো রেল ষ্টেশনেই গেছে। ওদের সাথে তো রূপসী ষ্টেশনে যোগ দিতে পারে। আবার ভাবল, তা কী করে হয়! রূপসী তো ভোর হবার আগেই পার হয়ে গেছে। আর পরাণেরা তো সবে এইমাত্র গেল। পরাণের সাথে রূপসীর দেখা কীভাবে হবে?
সাইকেল গ্যারেজে রেখে সফর আলি কখন অজান্তেই খেয়ায় চেপে বসল এবং ঘাট পার হয়েও গেল। ঘাট পার হলে সার সার ট্রেকার দাঁড়িয়ে থাকে। সফর আলি দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেকারে চেপে বসল। ট্রেকারে প্যাসেঞ্জার ভর্তি হলে ট্রেকার ছেড়ে দিল ভগবানগোলার উদ্দেশ্যে।
সফর আলি ভগবানগোলা ষ্টেশনে যখন পৌঁছল, দুটো বেজে গেছে। কলকাতা যাবার ট্রেন আর মিনিট পনের বাকী আছে। সফর আলি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্মে উঠে এল। চারিদিকে প্যাসেঞ্জার থিক থিক করছে। প্ল্যাটফর্মে পা রাখার জায়গা নেই। দেখে মনে হচ্ছে এলাকার সব মানুষ আজ এই ট্রেনে চেপে চলে যাবে। সফর আলি চুপিসারে খুঁজতে লাগল পরাণদের। রূপসীকেও। যদি রূপসী এই ট্রেন ধরে যায়। কিছুটা এগিয়ে শেডের দিকে এগোতেই সফর আলি দূর থেকে দেখল শেডের নিচে বেঞ্চে বসে আছে পরাণ, বউ মালতী ও মেয়ে। এদিক ওদিক কোনোদিকে রূপসী নেই। সফর আলি চুপি চুপি প্ল্যাটফর্মের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে হেঁটে দেখল কোথাও রূপসী আছে কিনা! না! কোথাও রূপসীকে দেখা গেলনা।
সফর আলির মনে হল পরাণদের কাছে গিয়ে একবার রূপসীর কথা জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়। ওরা হয়তো রূপসীর কথা জানে। পরাণদের কাছে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়াল সফর আলি। না। এই অবস্থায় পরাণদের কাছে যাওয়া ঠিক হবেনা। পরাণের কাছে কী বলে জানতে চাইবে রূপসীর কথা! তারাই বা কী ভাববে! এত দূর্বল হওয়াটা কী ঠিক হবে? বরং ট্রেন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। সফর আলি লুকিয়ে থাকার মতো করে পরাণদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু পরে ট্রেন এসে দাঁড়াল ষ্টেশনে। মুহুর্তের মধ্যে প্ল্যাটফর্মে পড়ে গেল ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি। সবাই একইসাথে ট্রেনে উঠতে চায়। ফলে কেউ উঠতে পারেনা। একজন আরেকজনকে হাতে টেনে ঠেলে ফেলে উপরে উঠতে চায়। যাদের গায়ে শক্তি বেশি তারা তাড়াতাড়ি সবার আগে উঠে পড়ল ট্রেনে। তারপর মেয়ে, বুড়ো আর বাচ্চাদের দল। সফর আলি দেখল ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি করতে করতেই কখন পরাণেরা উঠে পড়েছে ট্রেনে। তবে কোথাও রূপসীকে দেখা গেলনা।
একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিল। যে প্ল্যাটফর্মে এতক্ষণ পা রাখার জায়গা ছিলনা, কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই সেই প্ল্যাটফর্ম একেবারে জনশূণ্য। চারিদিকে জনা চার পাঁচেক মানুষ ছাড়া কোথাও কোনোদিকে কেউ নেই। হয়তো এরা তাদের আত্মীয়দের ছাড়তে এসেছিল। এখন ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
নিজের কাছে নিজেকে খুব হতাশ লাগল সফর আলির। সে কারজন্য সেই সাত সমুদ্র তের নদীর পারের মতো করে সেই সুদূর চর থেকে এখানে, এই রেল ষ্টেশনে এসেছে! কাকে বিদায় দিতে সে এখানে এসেছে! যারজন্য সে এখানে সে এসেছে, সে তো নিষেধই করেছে খুঁজতে। তাহলে কেন সে এতদূর ছুটে এল! ছুটে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?
সফর আলি হাঁটতে হাঁটতে শেডের নিচে গিয়ে ফ্যানের নিচে বেঞ্চে গিয়ে বসল। তার মনে হল একটা গভীর শূণ্যতা যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাকে। একটা চরম অসহায়তা তার মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে গুমরে গুমরে উঠছে। সকাল থেকে স্নান নেই, খাওয়া নেই, চালচুলোহীনভাবে এসব কী করে বেড়াচ্ছে সে! রূপসীকে সে কি কোনোদিন ভালবেসেছিল? কথাটা ভাবতেই হঠাৎ করেই তার মনের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠল। এর উত্তর কী হতে পারে সফর আলি যেন বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করল। উঠে পড়ল সফর আলি। ঘরে ফিরতে হবে তাকে।
আর ষ্টেশনে দাঁড়ালনা সফর আলি। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল সে।
•২৬•
সূর্য অস্ত গেছে কিছু আগে। সফর আলি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দেখল তার চেম্বারের উঠোনে জনা কয়েক বসে আছে। সফর আলিকে দেখে উঠে দাঁড়াল সবাই। দুজন দাঁড়ালনা। তারা হয়তো রোগী। তাদের মধ্যে একজন বলল, “কী ব্যাপার সফর ভাই! তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কেউ তোমার কথা বলতে পারছেনা!”
সফর আলি দেখল আনসার আলি। আনসার আলিকে দেখে সফর আলি বলল, “এই একটু বাজারের দিকে গেছিনু আনসার ভাই। তোমারা একটু বস। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”
ঘরে প্রবেশ করতেই ছুটে এল মা, “কোথায় গিয়েছিলি সফর? সবাই জিজ্ঞাসা করছে। আমি তো কাউকে কিছু বলতে পারছিনা।”
“এই একটু বাজারে গেছিলাম মা। কিছু কাজ ছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।” তার থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল সফর আলি।
মা বলল, “এত বড় দিনটা চলে গেল! কোথাও কিছু খেয়েছিস?”
সফর আলি বলল, “হ্যাঁ মা। দুপুরে বাজারে খেয়েছি। তবু খিদে লেগেছে। তুমি কিছু টিফিন রেডি কর মা। আমি স্নান করে বেরিয়ে খাব।” সফর আলি আর বেশি দেরি না করে বাথরুমে ঢুঁকে গেল।
কিছু পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে সফর আলি দেখল, মা দুটি ডিম সিদ্ধ, দুটি রুটি, আর একটি আপেল কেটে রেখে চা বানাচ্ছে। সফর আলিকে বেরতে দেখে মা বলল, “টিফিন রেডি আছে। তুই খেতে থাক। আমি চা নিয়ে আসছি।”
সফর আলি টিফিন খেতে বসলে একটু পরে চা হাতে করে মা এল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মা বলল, “তোকে আজ এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনরে সফর? কিছু হয়েছে নাকি তোর?”
সফর আলি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “না মা। কিছু হয়নি। এই গরমে বাজারে গিয়েছিলাম তো! তাই হয়তো ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
এবার মা বলল, “না রে সফর। তোকে এর আগেও তো দেখেছি। কত কাজ করেও তোকে এত ক্লান্ত লাগেনা।”
সফর আলির চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বলল, “বললাম তো মা। আমার কিছু হয়নি। বাইরে সব রোগী বসে আছে। আমি আসছি। রাতে তোমার সাথে কথা বলব।”
চেম্বারে ঢুকল সফর আলি। জনা চারেক রোগী ছিল। তারমধ্যে সকালের সেই লোকটি। জ্বর ছাড়েনি। সফর আলি সকালে যে ওষুধটি লিখে দিয়েছিল, সেটি কোথাও পায়নি সে। সফর আলি সবাইকে ওষুধ দিল। শেষে এল আনসার আলি। বলল, “ছেলেটার হালকা হালকা জ্বর হচ্ছে। তাই ভাবলাম একবার সফরের কাছে যায়। ওষুধটাও নেওয়া হবে। আর কিছু গল্প করেও আসা যাবে।”
সফর আলি বলল, “কবে থেকে জ্বর?”
আনসার আলি বলল, “কাল থেকে। তবে খুব বেশি না। মাঝে মাঝে গা গরম হয়ে থাকছে।”
সফর আলি একটা সিরাপ হাতে দিয়ে বলল, “এটা নিয়ে যাও। জ্বর এলে খাওয়াবে। না এলে খাওয়াবে না। এমন কিছু হয়নি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
আনসার আলি এবার একটু উৎসুক্য নিয়ে বলল, “সফর ভাই। তুমি কিছু শুনেছ?”
সফর আলি বলল, “কী শুনেছি?”
আনসার আলি একটু কাছে ঘেঁসে বলল, “বসিরের বউ রূপসীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তুমি জাননা এ খবর?”
সফর আলি একটু দম নিয়ে বলল, “আসলে সকাল থেকে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কারও কোনও খবর নেওয়ার সময় পাইনি।”
“তুমি এ বিষয়ে কিছু জাননা। বল কী! গোটা গ্রামের মানুষ জানে। সবাই বলছে…”
আনসার আলির কথাটা শেষ করতে দিলনা সফর আলি। বলল, “সবাই কী বলছে?”
“সবাই বলছে রূপসীর পেটে যে সন্তান এসেছে, তা বসিরের নয়। অন্য কারও। কিন্তু কে সে কেউ বলতে পারছেনা।” আনসার আলি মুখ টিপে হাসির মতো করে বলল কথাগুলো।
“তাই নাকি! লোকে আর কী বলছে?” সফর আলি কিছুটা অন্যমনস্কের মতো বলল কথাটি।
আনসার আলি বলল, “লোকে আর কী বলবে! ঐ যেমন কানাকানি! ফিসফিসানি! তার কোনও মূল্য আছে নাকি!”
সফর আলি মুখে সামান্য হাসির ভঙ্গি করে বলল, “কানাকানি! ফিসফিসানি! সেটা আবার কীরকম?”
আনসার আলি বলল, “সে সব কথার কোনও মূল্য আছে। এই যেমন, কার সাথে রূপসী এমন কান্ড বাধাল? কে হতে পারে? ভেতরে ভেতরে রূপসী এমন নোংরা চরিত্রের ছিল! এইসব।”
এবার সফর আলি কিছুটা সাবধানী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা কার নাম শোনা যাচ্ছে কিছুটা শুনেছ নাকি?”
আনসার আলি কিছুটা তাচ্ছিল্যের মতো করে বলল, “ছাড়ো ওসব কথা। ওসব শুনে তোমার কোনও লাভ নাই। কিন্তু তোমাকে এত চিন্তিত আর অন্যমনস্ক লাগছে কেন? তোমার কিছু হয়েছে নাকি?”
“না না আনসার ভাই। আমার আবার কী হবে! আসলে সারাদিনের ক্লান্তিতে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আজ এসো! কাল কথা বলব! এখন একটু ঘুমাব!” সফর আলি খুব শান্তভাবে বলল কথাগুলি।
আনসার আলিও আর বিশেষ কিছু বলল না। সফর আলির দিকে বার কয়েক তাকিয়ে উঠে পড়ল। বলল, “ঠিক আছে সফর ভাই। তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত লাগছে। চেম্বার বন্ধ করে রেষ্ট কর।”
আনসার আলি বেরিয়ে গেল।
রাত আটটার কাছাকাছি। সফর আলি চেম্বার বন্ধ করে ঘরে ফিরে এল। মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “খেতে দাও মা।” একটু পরে মা রুটির থালা হাতে এসে পাশে বসল। সফর আলি বেশি কিছু খেলনা। একটি রুটি খেয়ে উঠে গেল।
মা জিজ্ঞেস করল, “কিরে সফর? কিছুই খালি না যে!”
“এই তো খেলাম মা। আর কত খাব!” সফর আলি হেঁটে শোবার ঘরের দিকে চলে গেল।
একটু পরে মা ঘরে প্রবেশ করে বলল, “কিরে সফর ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
সফর আলি বিছানায় উঠে বসল, “না মা! ঘুমোই নি! কিছু বলবে তুমি?”
মা সফর আলির বিছানার একপাশে বসে বলল, “সফর, কী হয়েছে তোর? তোকে আজ এত ক্লান্ত লাগছে কেন? তুই কি কিছু চিন্তা করছিস?”
সফর আলি কোনও উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, “মা। তুমি একটু আদর করে দাওতো। তোমার আদর পেলে আমার চিন্তা দূর হয়ে যাবে।”
মা সফর আলির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে হেঁসে বলল, “পাগল ছেলে।”
সফর আলি কোনও কথা না বলে চুপ করে মায়ের আদর খেতে থাকল। মা আবার বলল, “তোর এবার একটা বিয়ে দিব। তোর কি কোনও মেয়ে পছন্দ আছে? না হলে আমিই মেয়ে খুঁজব। পুরুষ মানুষের একবার বিয়ে হলে কি আর বিয়ে হয়না? না বিয়ে করেনা?”
সফর আলি একথারও কোনও উত্তর না দিয়ে ছোট্ট ছেলের মতো মায়ের কোলে আরও জোরে মুখ গুঁজে দিল। যেন এখানেই তার শেষ আশ্রয়। এখানেই যেন জীবন ও জগতের সমস্ত শান্তি ও সান্ত্বনা লুকিয়ে আছে।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর ।পর্ব ১২।
❤ Support Us