Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • অক্টোবর ২১, ২০২৩

চর >।পর্ব ১৫।

আনসার আলির কথা শুনে সফর আলি কেমন চুপ করে গেল। ‘কথা তো আর চাপা থাকে না। ঠিক সময়ে বেরিয়ে যায়।’ এ তো মারাত্মক কথা। তার মনটা কেমন ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে গেল... তারপর

সাইদুর রহমান
চর >।পর্ব ১৫।

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স

 

•২৯•

সন্ধ্যার দিকে আনসার আলি খবর দিল, পদ্মার জল সামান্য বেড়েছে। আর ভীষণ ঘোলাটে জল। লক্ষণ ভালো নয়। ক্রমে গ্রামে রটে গেল কথাটি। কথা শুনে পদ্মার পাড়ে সবাই একবার গেল আর ফিরে এল। কেউ বলল, নানা। কই কোথায় পদ্মার জল বেড়েছে ? জল তো এরকমই থাকে। আনসারের যত সব বাড়াবড়ি কথা। আবার কেউ বলল, সত্যিই তো। পদ্মার জল কেমন লাগছে দেখতে। ও বড় রহস্যময়ী। কখন কী কান্ড করে ঠিক নাই। সাবধান হওয়া ভালো।

কথাটি সফর আলির কানেও গেল।

 

সারাদিন বসে থেকে রোগী দেখার পর রাতের দিকে সফর আলির সময় হয়। আজও সফর আলি রোগী দেখা শেষ করে রাতের দিকে বিছানায় যাবার আগে কী মনে করে পদ্মার দিকে হেঁটে গেল। সারাদিন রোগী দেখলেও তার মন ঘুরপাক খাচ্ছিল রূপসী আর বসিরকে নিয়ে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল ! কে ভেবেছিল এভাবে একটা সংসার ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাবে। কোথায় গেল রূপসী আর কোথায় বা বসির! ভাবতে ভাবতে কোনও দিশা তার সামনে আসেনি। এভাবেই সারাটি দিন কেটে গেছে।

 

সফর আলি ধীরে ধীরে হেঁটে গেল পদ্মার দিকে, যেখানে সে মাঝে মাঝেই বসে থাকে। যাবার পথে বাঁদিকে সামান্য বাঁক নিলেই রূপসীদের বাড়ি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে বাড়িটির দিকে তাকাল সে। অন্ধকারের মাঝে খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে বাড়িটি। কোনোদিকে কোনও সাড়া শব্দ নেই। উল্টে পড়ে থাকা চালা আর নিরাবরণ দেয়াল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের অস্তিত্বটুকু জানান দিচ্ছে।

 

সফর আলি সেদিকে আর পা না বাড়িয়ে পদ্মার দিকে এগিয়ে গেল। পদ্মার দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে আসছে। সেই হাওয়াতে সফর আলির মাথার চুল একবার সামনের দিকে একবার পেছনের উড়ে উড়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে। পদ্মার পাড়ে বসল সে। সবার মতো সেও শুনেছিল পদ্মার জল সামান্য বেড়েছে। আর জল ঘোলা হয়ে উঠেছে। সফর আলি একদৃষ্টে পদ্মার জলের দিকে তাকিয়ে থাকল। অন্ধকারের মাঝে সেভাবে বুঝতে পারল না। প্রতিদিনের মত আজও তার হাতে একটা টর্চ ছিল। পদ্মার বুকে টর্চ মেরে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু সেভাবে কিছু বুঝতে পারল না। তবে সে একটা জিনিস বুঝতে পারল জল কিছুটা ঘোলাটে হয়েছে। আর জলের ভেতরে একটা স্রোত তীব্রভাবে বইছে। এই স্রোত যদি বাড়তে থাকে, তাহলে বিপদের গন্ধ আছে বটে। এখন সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কাল সকালে দেখতে হবে জলের অবস্থা কেমন দাঁড়াচ্ছে। পদ্মা ভালোর ভালো, আবার কখন যে মাথা গরম করে রাক্ষুসী হয়ে ওঠে কে বলতে পারে ! পদ্মাকে বিশ্বাস করা কঠিন।

 

হঠাৎ করে বসিরের থানের দিকে চোখ গিয়ে পড়ল সফর আলির। থানের দিক থেকে একটা মৃদু আলোর শিখা ভেসে আসছে। দূর থেকে সফর আলি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না আলোটা কিসের। মনে হচ্ছে কেউ একটা ছোট্ট প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। তাহলে কি বসির ফিরে এসেছে? সফর আলির মনের ভেতরে একটা কোতূহল তৈরি হল। দেখা দরকার কে ওখানে আলো জ্বেলে গেল। বসির কি সেখানে আছে?

 

উঠে পড়ল সফর আলি। থানের দিকে পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে কিছু পরেই পৌঁছে গেল থানের কাছে। তারপর থানের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগল থানের ভেতর কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখতে পেলনা সে। শুধু দেখল থানের ভাঙা অংশগুলো কে বা কারা এসে এক জায়গায় জড়ো করে রেখেছে। তবে সেভাবে কিছু কাজ করে রাখেনি। সফর আলি আরও কিছুটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। নাহ্‌। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।

সফর আলি আরও এগিয়ে থানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে আসতে করে ডাক দিল, “ও ভাই কেউ আছ নাকি!”

 

সফর আলির কথা বাতাসে এদিক ওদিক ভেসে গেল। কেউ উত্তর দিলনা।

 

সফর আলি আবার ডাক দিল, “বসির! বসির আছ নাকি!”

 

সফর আলির কথা আবারও পদ্মার বাতাসে এদিক ওদিক ভেসে গেল। কিন্তু কেউ উত্তর দিলনা।

 

দূরে পদ্মার ওপারে কোনও এক অজানা জায়গা থেকে ধীরে ধীরে বাঁকা চাঁদ উঠছে। চাঁদের মৃদুমন্দ আলোয় পদ্মার জল ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পূব দিক থেকে বাতাস আসছে জোরে জোরে

 

সে বুঝতে পারল থানে কেউ নেই। ওদেরই হয়তো কেউ এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছে। পরে বোঝা যাবে ব্যাপারটা। যদি বসির এসে থাকে, তাহলে তাকেতো দেখা যাবেই। আর যদি ফিরে না আসে, তাহলে ওর সঙ্গী সাথীরা অন্তত আসবে থানের দখল নিতে।

 

থানের পেছনে পদ্মার পাড়ের দিকে একটা উঁচু মতো জায়গা করা আছে। এখানে পদ্মা কিছুটা চওড়া। এখান থেকে পদ্মাকে লম্বা আর ভালোভাবে দেখা যায়। সফর আলি ধীরে ধীরে হেঁটে এসে সেখানে বসল। দেখল দূরে পদ্মার ওপারে কোনও এক অজানা জায়গা থেকে ধীরে ধীরে বাঁকা চাঁদ উঠছে। চাঁদের মৃদুমন্দ আলোয় পদ্মার জল ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পূব দিক থেকে বাতাস আসছে জোরে জোরে। পূব দিকটা বাংলাদেশের রাজশাহী। কতদূর আর হবে ! খুব বেশি হলে আট থেকে দশ কিলোমিটার। অথচ কতই না দূর! রাজসাহী যেতে হলে কমপক্ষে চারশো থেকে পাঁচশো কিলোমিটার ঘুরে যেতে হবে। আধ ঘণ্টার রাস্তা। লাগবে পুরো একটা দিনেরও বেশি। লোকে বলে এক নদী হাজার ক্রোশ। এখানে নদী নয়। সীমান্ত। সেই কবে একদিন কে যেন এসে ঠান্ডা ঘরে বসে রুল পেন্সিলে সীমান্তের দাগ কেটে দিল, আর অমনি সবাই ভাগ হয়ে গেল। যে যেখানে ছিল, সে সেখানেই থেকে গেল। একই মানুষ, একই জাতি, একই ভাষা, একই পোশাক, একই খাদ্যাভ্যাস, একই চিন্তা চেতনা – শুধু পেন্সিলের একটা আঁচড়ে সব আলাদা হয়ে গেল। ভাবতে ভাবতে কখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারলনা সফর আলি। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এসে তার মাথার চুল এলোমেলো করে জোরে ছুটে গেল। সে দেখল পূব দিকে চাঁদটাও অনেক উপরে উঠে এসেছে। চাঁদের আলোতে এখন পদ্মার জল আরও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। এবার সফর আলি বুঝতে পারল, পদ্মার জল কত ঘোলা হয়ে উঠেছে, আর পাক খাচ্ছে।

 

সফর আলি উঠে পড়ল সেখান থেকে। পদ্মাকে পেছন করে হাঁটতে থাকল সামনের রাস্তা দিয়ে। আর এই সময়েই সেই শব্দটা কানে ভেসে এল, হিস হিস। হিস হিস।

 

সফর আলির মনে হল পেছন থেকে কে যেন তাকে মুখ ভেংচে কথা বলছে আর ঠাট্টা করছে। যেন উত্তর দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর। সফর আলি এই শব্দকে চিনে। কতদিন থেকে এই শব্দের সাথে সে পরিচিত। সে পেছন দিকে না ফিরে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু তার মনে হল পেছনের পদ্মা থেকে উঠে আসা শব্দ ক্রমে মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ভেসে যাচ্ছে। তারপর সামনের দিকে থেকেও ভেসে আসতে শুরু করল, হিস হিস। হিস হিস।

 

সফর আলি জোরে জোরে এগিয়ে যেতে থাকল বাড়ির দিকে। এই পথে রূপসীর বাড়ি। অন্য কোনও পথ নেই। বাড়ি যেতে হলে এই পথেই যেতে হবে। এগিয়ে যেতেই সফর আলি শুনতে পেল রূপসীদের বাড়ির পেছন দিকে মাঠের দিক থেকে ভেসে আসছে একটা মৃদু কান্নার সুর। মনে হচ্ছে মাঠের কোন এক অজ্ঞাত জায়গায় কোন এক মহিলা কান্না করে যাচ্ছে। ক্রমে সেই কান্না বেড়েই যাচ্ছে। বেড়েই যাচ্ছে। একসময় সেই কান্না হাহাকারে পরিণত হল। সফর আলি জোরে জোরে পা চালাতে শুরু করল বাড়ির দিকে। কিন্তু তার পা যেন আর চলছেনা। কে যেন তার পা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। যতই সে চেষ্টা করছে জোরে হাঁটার, ততই তার গতি কমে যাচ্ছে।

 

কিছু পরে রূপসীদের বাড়ির সামনে চলে এল সফর আলি। খাঁ খাঁ করছে বাড়িটি। সফর আলি জোরে জোরে পা বাড়াল বাড়িটি পার হবার জন্য। এমন সময় তার মনে হল পাশ থেকে কে যেন ডেকে উঠল, “কিগো সফর ভাই। খুব জোরে জোরে পালিয়ে যাচ্ছ যে। আমাকে যে চিনতেই পারছনা।”

 

আর সফর আলি আনমনে বলে উঠল, “না রে না রূপসী! তোকে এড়িয়ে যাবার উপায় আছে। আমি গেলেও তুই যে যেতে দিবিনা, সেতো জানাই আছে। কিন্তু তুই কোথায় গিয়েছিলি?”

 

পাশ ফিরে তাকাল সফর আলি। দেখল পাশে কেউ নেই। তার কথাগুলো রূপসীদের খোলা দেয়ালের গায়ে লেগে ফিরে ফিরে তার কানে এসে লাগছে। নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হল সফর আলি। জোরে জোরে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছে এসে তার মনে হল পদ্মার দিক থেকে কে যেন উঠে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসতে পারছেনা। মাথায় কালো চুলের লম্বা ঝুটি বাঁধা। মুখে ক্ররু হাসি আর হিস হিস শব্দ। সেই শব্দ তার কানের পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে।

 

সফর আলি এক দৌড়ে ঢুঁকে গেল ঘরের ভেতর।

 

•৩০•

দিন দুয়েকের মধ্যে পদ্মার জল বেশকিছুটা বেড়ে গেল। এবারের পদ্মার জলের চেহারা আলাদা। প্রচণ্ড তার গতি। খুব বেশি ঢেউ নেই। কিন্তু প্রচণ্ড গতির ফলে যে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে, তার মাথায় সাদা সাদা ফেনা। আর প্রচণ্ড ঘোলাটে জল খুব জোরে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে।

 

প্রচণ্ড ঘূর্ণির পাক দেখে আনসার আলি বলল, “মহিরুদ্দি ভাই। এবারের অবস্থা কিন্তুক ভালো ঠেকছেনা। মনে হচ্ছে পদ্মা এবার ভালোই ভোগাবে।”

 

মহিরুদ্দি পদ্মার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমিও তো সে কথা ভাবছিরে আনসার। পদ্মার চেহারা দেখ্যা আমারও ভালো লাগছেনা। কি যে হবে!”

 

“আমি ভাবছি বাড়িঘর আবারও পদ্মার প্যাটে চল্যা যাবে কি না!” আনসার আলি পদ্মার দিকে তাকিয়ে বলল।

 

“লোকে বলে, ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারোমাস’। আর পদ্মার ধারে বাস করলে তো সারা জীবন ধরে ভাবনা থাকে। সব সময় মনে হয়, কী হয়! কী হয়! রাতে ঘুমিয়্যাও ঘুম আসেনা।” পদ্মার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল মহিরুদ্দি।

 

এই সময়ে সেখানে এসে পৌছল পরাণ। কিছুদিন হল সে মুম্বাই থেকে ফিরে এসেছে। আরও কদিন মুম্বাইয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার মুম্বাইয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল চারিপাশের বাড়িঘর, উঁচু উঁচু বিল্ডিং সব বুকের উপর এসে চেপে বসেছে। একটা খাঁচার মধ্যে পাখি যেমন উড়ার জন্য পাখা ঝটপট করে, তেমনি মুম্বাই নামক একটি খাঁচার মধ্যে ঢুঁকে পড়ে পরাণ এই কদিন যেন ধড়ফড় করেছে। একটা হাঁসফাঁস অবস্থা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল পরাণের। তাই সে কয়েকদিন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য বউ মালতী আর মেয়েকে রেখে এসেছে। মালতীও থাকতে চাইছিল না। জামাই বলেছে সপ্তাহ খানেক পরে মালতীকে রেখে যাবে।

 

পরাণ এসে খবর দিল, “আনসার ভাই। শুন্যাছ! টিকলিচরের দিকে ভাঙন শুরু হয়্যাছে!”

 

আনসার বলল, “না তো ! শুনিনি ! কবে শুরু হল?”

 

“আজ সকাল থাক্যা। পদ্মার পাড় ভাঙা শুরু হয়্যাছে। আমাকে গোলাম বলল।”

 

আনসার বলল, “গোলাম আবার কখন টিকলিচর গ্যাল! ওর কথা বিশ্বাস করাও কঠিন।”

 

পরাণ বলল, “না না ! গোলাম সত্যিই টিকলিচর গেলছিল। ও নিজের চোখে দেখ্যা আস্যাছে। ওখানকার লোকেরা বাড়িঘর, গোরু ছাগল, আসবাপত্র সব সরাতে লাগ্যাছে।”

 

আনসার আর কিছু বলল না।

 

মহিরুদ্দি বলল, “চলনা আমরা অ্যাকবার যায়। লিজের চোখে দেখ্যা আসি।”

 

পরাণ বলল , “আমিও তাই বলছুনু। চলো অ্যাকবার যায়। তালে আমরাও আগে থাক্যা সাবধান হতে পারব।”

 

হাঁটা পথে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের পথ। তিনজনে হাঁটা শুরু করল। এই পথে তারা আগে কত যাতায়াত করেছে। তখন তাদের ছেলেবেলা। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা – কোনও মানামানি নেই। ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়ত তারা। এখন বড় হয়ে সংসার জগতে ঢুঁকে গিয়ে আর সেভাবে কোথাও বেরিয়ে যাওয়া হয়না। এখন সংসার ধর্মই বড় ধর্ম।

 

যেতে যেতে আনসার বলল, “এত তাড়াতাড়ি ফির‍্যা আলিরে পরাণ? বম্বাই ক্যামুন লাগল?”

 

হাঁটতে হাঁটতে পরাণ বলল, “আমার ভালো লাগেনি ভাই ! যায়্যা থাক্যা মুনে হচ্ছিল একটা বড় খাঁচার ভিতরে ঢুঁক্যা পড়্যাছি। চারিদিকে পাহাড়ের সুমান উঁছ্যা উঁছ্যা সব বাড়ি। বাড়িতো লয়। সব এক একটা খাঁচার দেয়াল। আর চারিদিকে খালি চিৎকার চেঁচামেচি। রাস্তায় হাট্যাও সুখ নাই। হাজার হাজার সব গাড়ি। শুধু ভাঁ ভুঁ শব্দ করছে আর শুধু এদিকে ওদিকে ছুট্যা বেড়াচ্ছে। উখানে আমরা থাকতে পারি মহিরুদ্দী ভাই!” মহিরুদ্দীর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল পরাণ।

 

ভাঙন সবে শুরু হয়েছে। সকাল থেকে তিনটি চাপ ধ্বসেছে। ভাঙনের পাড়ে দাঁড়িয়ে মহিরুদ্দী পদ্মার দিকে তাকিয়ে বলল, “আনসার। গতিক ভালো না। জলের দিকে তাকিয়্যা দেখ্যাছ ! জলের ডগায় কেমন ফোঁস ফোঁস শব্দ ! এই শব্দের সুর ভালো না

 

চুপ করে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলি শুনছিল মহিরুদ্দি। হাঁটতে হাঁটতেই সে বলল, “মালতীকে রাখ্যা আল্যা ক্যান পরাণ ? উর উখানে ভালো লাগবে?”

 

“আমি রাখতে চাহিনি গো। মালতীও থাকতে চাহেনি। শুধু মাইয়্যাটার দিকে তাকিয়্যা উকে রাখ্যা আসতে হয়্যাছে। আসার সময় ও কত কাঁদছিল! আমি সান্ত্বনা দিয়্যা বুললাম, “সপ্তাহ খানেক থাক্যা যাও। সারি একটু সুস্থ হলে চল্যা আসো। জামাই তো রাখ্যা আসবে বুলছে’।” পরাণ হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলি বলল।

 

এইরকম নানা ধরণের কথাবার্তা বলতে বলতে তারা টিকলিচর পৌঁছে গেল। তারা হাঁটছিল পদ্মার পাড় বেয়েই। যতই তারা এগিয়ে যাচ্ছিল, ওদিক থেকে মানুষজনকে আসতে দেখছিল। গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দেখল পেল ওদিক থেকে সাইকেলে চেপে আসছে গোলাম মিঞা। গোলাম সকালের দিকে খবর পেয়ে একাই চলে এসেছিল ভাঙন দেখতে।

 

গোলামকে দেখে আনসার আলি বলল, “কী ব্যাপার গোলাম ভাই ! তুমি কখন আস্যাছ এদিকে ?”

 

গোলাম মিঞা সাইকেল থামিয়ে বলল, “এই তো সকালের দিকে আসনু। শুননু টিকলিচরে ভাঙন শুরু হয়্যাছে। তাই চলে আসনু। তোমরাও কি ভাঙন দেখতে আস্যাছ?”

 

আনসার আলি বলল, “হ্যাঁ। আমরাও ভাঙন দেখতে আস্যাছি। চল আবার আমাদের সাথে।”

 

গোলামও ওদের সাথে হাঁটতে শুরু করল।

 

কিছু পরে তারা পৌঁছে গেল ভাঙনের কাছে। ভাঙন সবে শুরু হয়েছে। সকাল থেকে তিনটি চাপ ধ্বসেছে। ভাঙনের পাড়ে দাঁড়িয়ে মহিরুদ্দী পদ্মার দিকে তাকিয়ে বলল, “আনসার। গতিক ভালো না। জলের দিকে তাকিয়্যা দেখ্যাছ ! জলের ডগায় কেমন ফোঁস ফোঁস শব্দ ! এই শব্দের সুর ভালো না !”

 

আনসার বলল, “আমারও তাই মুনে হচ্ছে মহিরুদ্দী ভাই। জলের লক্ষণ ভালো ঠেকছেনা!”

 

পরাণ বলল, “জলের গতি দেখ্যাছ ! কী প্রচণ্ড গতিতে পাক দিছে আর ফোঁস ফোঁস করছে। পদ্মা যে রাক্ষুসী হয়্যা উঠছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে!”

 

চারজনে গাঁয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে রওনা দিল। ফেরার সময় তারা দেখল গ্রামের মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠছে। এরমধ্যেই কেউ কেউ ঘরের ভেতর থেকে আসবাব পত্র বের করে দূরে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখছে। তা দেখে পরাণ বলল, “এসব কর‍্যা কুনু লাভ হবেনা। রাক্ষুসী যখন খাতে শুরু কর‍্যাছে, তখুন বাড়িঘর, মাঠঘাট কিছুই সে বাদ রাখবেনা। সবশুদ্ধ্যা তার পেটের ভিতরে লিয়্যা তবেই থামবে।”

 

আনসার বলল, “এই সময় এইসব অলুক্ষুণে কথা বুলিস না তো পরাণ। আমার শুনতে ভালো লাগছেনা। বাড়িঘর সব চল্যা গেলে আমরা কোথায় যাব বলতে পারিস? আমার তো কিছুই ভালো লাগছেনা।”

 

পরাণ আর কথা না বলে চুপ করে গেল। শুধু মহিরুদ্দী বলল, “শুধু তোমার লয় আনসার ভাই ! এই চরের সব মানুষের একই অবস্থা। ভাঙনে সব চল্যা গেলে সবাই কুথায় যাবে! কারও তো কুথাও জায়গা নাই।”

গোলাম যোগ করল, “কোথায় আর যাওয়া যাবে ! সেই ওপারে রাস্তার ধারে, না হয় রেল ষ্টেশনের কাছে, না হয় কোনও সরকারি লঙরখানায়।”

 

মহিরুদ্দী বলল, “সবই ঠিক আছে। শুধু সরকারি লঙরখানার কথা বলনা। সরকারি লঙরখানা ক্যামুন হয় আমার আগে জানা আছে। তখুন আমি ছোট ছিনু। এখুনও মুনে আছে। উখানে থাকার জায়গা থাকেনা, শোবার জায়গা থাকেনা, থাকেনা ঠিকমতো খাবার ব্যবস্থা। দুপুরের খাবারের লাগ্যা সকাল থাক্যা লাইন দিয়্যা দাঁড়াতে হয়। আর কদিনই বা উখানে খাবার জুটবে। একদিন তো বন্ধ হয়্যা যায়। তারচেয়ে হাতে একটা কৌটা আর ঘাড়ে ছিড়্যা ব্যাগ লিয়্যা ভিক্ষা করতে বারিহ্যা যাওয়া ভালো। কিছু টাকা পয়সাও জুটবে, জিনিসপত্রের সাথে খাবারটাও জুট্যা যাবে।”

 

পরাণ বলল, “শুন্যাছি আগের ভাঙনে অনেকেই ভিক্ষ্যা কর‍্যা খায়্যাছিল। এখুনও তাদের অনেকেই আসেনি। কেউ কেউ এখুনও ভিক্ষ্যা কর‍্যা খায়।”

 

কথা বলতে বলতে তারা বাড়ির কাছে চলে এসেছিল। আপন আপন বাড়ি চলে গেল তারা।

 
ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর >।পর্ব ১৪।

চর >।পর্ব ১৪।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!