- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ২, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
সংযতভাষী ড. জাকির হোছেইনের আত্মজীবনী কেবল তাঁরই অভিজজ্ঞতা আর জীবনবোধের বিবৃতি নয়, পীড়িত, অবিকার-বর্যিত সমাজেরও কন্ঠস্বর হয়ে উঠছে। কথা ছিল, বড়োজোর ১০ পর্বে শেষ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, যত কথা, যত গান আছে তাঁর, ছোটো গল্পের মতো যা শেষ হয়েও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ধারাবাহিক, অনিঃশেষ জাকিরি জিকির। আমাদের অনুমান, মিশ্র সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমিক আর সুফি সাধক আজান ফকিরের মরমিয়া আর গানের মতো চিরন্তনতা জাকিরকে। তাঁর ঐকান্তিক মানব-দরদকে।
এন.ই. এফ এর স্থপতি সমাজ পটুয়া আর বন্ধন মুক্ত শিক্ষার কারিগর। বলতে হয়, উচ্চারহীন প্রত্যাশার একজন নিপুণ কবি তিনি। কী তাঁর কবিতার গুণমান আর বাকপ্রতিমার সম্পাদক।
সম্পাদক। ২.০৬.২০২৪
• পর্ব-৩৩ •
এনইএফ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়, অনেকের অংশদারিত্বে নির্মিত সামাজিক ব্যবসাও নয়, আবার ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা বলতে যা বোঝায় [মুনাফা অর্জন আর পুঁজিসঞ্চয়ী] সেটাও না। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে, বিশেষ করে সমাজের সব অংশকে শিক্ষিত করে তুলতে সে অঙ্গীকারবদ্ধ। এখানে আপোস নেই, কারো সঙ্গে সমঝোতা নেই, নিজেই তৈরি করেছে তার খোলা পথ, তার কল্যানধর্মী অভিমুখ। এক্ষেত্রে সংশয়, পিছুটান, দায়সারা মনোভাবের বিলকুল প্রশ্রয় নেই।
আমরা জানি, নিজেদের খানিকটা ওজন করেও দেখেছি, গম মে উহ্ রাওয়ানি হ্যায়, খুদ রাহ বনা লেগা, বেহতা হুয়া উহ্ পানি হ্যায় (বশির বদর) – চিন্তার ছড়িয়ে আছে এমন এক স্রোত, বহমান জলের মতো যে তার রাস্তা তৈরি করে নেবে।
আত্ম সন্তুষ্টির শিকার হতে রাজি নই, নিজেকে গৌরবদান করতে গিয়ে নিজের অবমাননা দেখতে অভ্যস্ত নই, স্বগৌরবে মুখরিত হবার মতো ভোঁতা কিংবা আত্মঘাতী হয়ে উঠবার মানসিকতা নেই, কখনো হবে বলে মনে হয় না।

আর জে ইউ মুট কোর্ট ২০২৪ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা হাতে এনইএফ ল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা
সামান্য সম্বল হাতে নিয়ে, সামাজের অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্ধকারকে যথাসম্ভব হটাতে আমরা শিক্ষা আন্দোলন শুরু করি এবং ৩১ বছর জুড়ে অসমের বিভিন্ন এলাকায় পরপর বিদ্যানিকেতন গড়ে তুলেছি। এন.ই.এফ ল কলেজ এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাহুবলে বা প্রচারে নয়, কার্যময়তায় সে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেরা এবং জাতীয় স্তরে নন্দিত আইন মহাবিদ্যালয়। আশা করি, আমাদের নির্মীয়মাণ আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল কলেজের গ্রহণযোগ্যতাও অনুরূপ চেহারা ধারণ করবে। এ জন্য যে ভাবনাচিন্তা প্রযোজন, গুণগত যে পরিকল্পনা, পরিকাঠামো, অবকাঠামো আর পাঠ্যসূচি দরকার, সে-মবের ভিতের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ।নিঃশব্দে অন্যান্য আয়োজন চলছে।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এরকম আবাহনের উৎস কী? সমাজ থেকে উদ্ভুত স্বর্নিভরতার আহরিত অভিজ্ঞতা? না ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচেষ্টার স্বতস্ফূর্ত, নির্মেদ, সংযত উন্মেষ? কারণগুলি যাই হোক যা হোক না কেন, অধরাকে কাছে, আয়ত্তের নাগালে নিয়ে আসার বিমুক্ত শৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ হয়েছে। সমাজের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাঁরা আমার উচ্চারিত, অনুচ্চারি ডাকে সাড়া দিয়েছেন
পরম ভরসার কথা, সমাজের নির্বিশেষ আর সচেতন অংশ আমাদের উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন। তাঁরা অসমের প্রথম বেসরকারি আয়ুর্বেদিক মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতালের ঝকঝকে ক্যাম্পাস, পঠন-পাঠনের সুব্যবস্থা, সূর্যমুখী চিকিৎমার উচ্ছ্বলতা দেখতে চান। আমরাও একনিষ্ঠ। এবং দায়বদ্ধ। যেহেতু একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণে আমাদের স্বপ্নময়তা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, যেহেতু ব্যর্থতা ছায়া ফেলেনি, যেহেতু আমাদের আরম্ভের আড়াল নেই, থমকে যাওয়া নেই, স্বাস্থ্যময় সম্পর্কের মতো যা অনুভূত আর দৃষ্টিগ্রাহ্য, সে কারণে সংশয় কিংবা অবিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিক চলনশক্তির ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এরকম আবাহনের উৎস কী? সমাজ থেকে উদ্ভুত স্বর্নিভরতার আহরিত অভিজ্ঞতা? না ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচেষ্টার স্বতস্ফূর্ত, নির্মেদ, সংযত উন্মেষ? কারণগুলি যাই হোক যা হোক না কেন, অধরাকে কাছে, আয়ত্তের নাগালে নিয়ে আসার বিমুক্ত শৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ হয়েছে। সমাজের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাঁরা আমার উচ্চারিত, অনুচ্চারি ডাকে সাড়া দিয়েছেন। মুখচ্ছবি আর দৃষ্টিপাতের কিছু চোখ দেখে বুঝতে পেরেছেন যে, লোকটিকে বিশ্বাস করা সম্ভব, আরদ্ধ কাজ ফেলে রেখে পালিয়ে যাবে না, মেরুদন্ড সোজা রেখে হাঁটবে, অন্ধকারের সংযোগী হবে না; গুহার ভেতরে যে- আঁধার জমে আছে, তাকে ভেদ করে, সরিয়ে সমাজকে আলোকিত করবার উপযোগী বাতিক্ষেত্র গড়ে তুলবে। নির্বিশেষের নিশ্চুপ, অভিব্যক্তি ৩০ বছর আগেই ধরা পড়ে আমাদের চোখে, চোখের ভেতরের অদৃশ্য চোখেও।
আমার এই বয়ানে, বয়ানের চিত্রলেখায় আত্মতৃপ্তি কিংবা আত্মস্ততির জায়গা নেই। নিজেকে নিজে বড়াই করবার প্রবণতাকে কখনো আমল দিতে চাই না। ভাসমান, গৃহহীন, বিত্তহীন যে- সমাজকে দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি, এখনো দেখতে হচ্ছে, তাদের কাছে কাজই আমাদের বিবৃতি। প্রকৃতির উদ্দেশে আমরা বড়োজোর এইটুক বলতে পারি, ডোবাও চোখের জলে। হ্যাঁ, আমি আরো বেশি ডুবতে চাই, ভাসতে চাই সব প্রতিবেশীর বোবা কান্নার সঙ্গী হয়ে। স্পর্শ করতে চাই তাঁদের আজন্ম দাহ, রক্তক্ষরণ আর সামগ্রিক দুঃখবোধকে। মরতে আমি রাজি, মৃত্যুর পরেও সমূহের জন্য স্বপ্ন দেখব, বিলিয়ে যাব কাঙ্খিত স্থাপত্যের ইট, রড বালিসহ সমস্ত উপকরণ। অর্থাৎ আমার কাজ শেষ হবে না, অবহেলায় পড়ে থাকবে না। এন.ই.এফের উত্তরসূরীরা হাল ধরবেন। নৌকো ছুটছে জোরে, আরো জোরে ছুটবে। খেয়াঘাটে, বন্দরে তাঁরা নোঙর ছড়াবেন। সাময়িক বিরতি নিয়েই আবার স্টার্ট দেবেন ইঞ্জিনে। নতুন উৎসাহ, সৃষ্টি করবে ভবিষ্যতের নিশানা।
আমরা যারা পঞ্চাশ পেরিয়ে শতবর্ষের পথে রওনা দিয়েছি, এঁদের সৌভাগ্য, কর্মঠ একদল উত্তরাধীকারি বাহুকে ছুঁয়ে আছে অসীমের ইচ্ছে আর নির্বিশেকের সঙ্কল্প। হৃদয়ের বিওে তারা বলবান। পরিশ্রম আর নিষ্ঠার একাগ্রতা। দৃষ্টিতে বহুমাত্রিক, বহুভাষিক, বহুধর্মীয় সমাজের প্রত্যাশা। যা মৃত্যুহীন, নির্মোহ প্রেমের মতো নিঃশংসয় নির্ভয়।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-৩২
❤ Support Us