- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ১৬, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন
জঙ্গল সাফ করে, বন্য জন্তু, বিষাক্ত পোকা মাকড়ের সঙ্গে লড়াই করে জমিকে চাষযোগ্য করে তুলেছেন, সোনার ফসল যুগিয়েছেন সর্বপ্রান্তে। তাঁদের পরিশ্রম, তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের নিষ্ঠাকে কি আমরা মূল্য দিয়েছি ? তাঁদের সন্তানসন্ততির লেখাপড়া করার সংস্থান কি তৈরি করেছি ?
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
কেন শিক্ষার মতো সামাজিক ব্যবসাকে বেছে নিয়ে, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মেধাবি পড়ুয়া ড. জাকির হোছে্ন শূণ্য জমিতে গড়ে তুলেছিন একডজনেরও অধিক বিদ্যানিকেতন, একথা এই প্রথম নিজের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করলেন, এবং বললেন, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অশিক্ষার ঘুটঘুটে অন্ধকার আর দুর্বিসহ দারিদ্র্য, শৈশবে তার ভেতরে, নিঃশব্দ আলোড়নের জন্ম দেয়। যা এখনো অপ্রতিহত। আগের চেয়ে অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ। বোধ আর বুদ্ধির সংযোগ তাঁর অন্যতম ভরসা। বোধের ভিত্তি সমাজের দুঃখজনক অবস্থান। এসব ডালপালাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী শিক্ষার কর্মসূচি।
সম্পাদক। ১৬.০৬.২০২৪
• পর্ব-৩৪ •
নিজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই প্রশ্ন করি, ১৯৮৯ সালে, হায়দরাবাদ থেকে বিজনেস অ্যাডামিনিস্ট্রেশনের ডিগ্রি নিয়ে অসমে ফিরে এসে চাকরি কিংবা অন্যরকম ব্যবসার পেছনে ছুটিনি কেন ? কেন দূর শিক্ষার (ডিসটেন্স এডুকেশান) মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিই। অনেক বিকল্প ছিল। কন্ট্রাক্টরি, কাঠের ব্যবসা, কিংবা বড়ো প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কর্মসংস্থান। এরকম কোনো পেশার হাতছানি আমাকে আকৃষ্ট করেনি। সম্পূর্ণ অপপ্রচলিত শিক্ষা ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। যার আটঘাট চিনি না, ভবিষ্যৎ জানি না। শুধু এইটুকুই বুঝতে পারি, যে সমাজে আমার জন্ম, তার চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে। ঘরে ঘরে কুসংস্কার শিক্ষা গ্রহণের সব পথ আটকে দিচ্ছে। প্রকৃত পঠন-পাঠন বলতে যা বোঝায়, তার কোনো সুবন্দোবস্ত গড়ে ওঠেনি। গরিব ঘরের ছাত্রদের খারিজি মাদ্রাসা টেনে নেয়। এক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা। সেকেলে, অনাধুনিক পরিবেশে সংস্কারহীন ব্যবস্থার গোলকধাঁধায় বিদ্যার্থীরা পথ হারায়। বেকার, না হয় মসজিদের ইমাম কিংবা মোয়াজ্জিনের নামকে ওয়াস্তে চাকরি। নিয়মিত বেতন মেলে না। থাকার ব্যবস্থা মসজিদে কিংবা কারো বাড়িতে। পালা করে এ-ওর বাড়ি থেকে খাবার পাঠায়। দুঃসহ পরিস্থিতি। সমাধানের রাস্তা নেই। মাদ্রাসায় যাঁরা পড়ত, তাদের শিক্ষাগ্রহণ বেশিদূর এগোত না।মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াত — অথবা মজুরি খাটত। প্রাথমিকে, মিডল স্কুলে, হাইস্কুলে লেখাপড়া করে উচ্চতর শিক্ষার খোঁজে ছুটছে, এরকম পড়ুয়ার সংখ্যা নগণ্য। কেউ যদি কদাচিত মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করল, তাহলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তাকে ছুটতে হত গুয়াহাটি, ধুবড়ি, কোকরাঝাড় অথবা অন্য শহরে। এক্ষেত্রেও অর্থের অভাব, যোগাযোগের ঘাটতি। যাদের পরিবারে টাকা পয়সা ছিল, তারা মাধ্যমিকে জন্য শহরে গিয়েও কুল পেত না। হস্টেলে জায়গা নেই। নানা রকম বাছ-বিচার আর বৈষম্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। গুয়াহাটির— কটন কলেজে হস্টেল ছিল আলাদা আলাদা। মুসলিম ছেলেরা থাকত কটন মুসলিস হস্টেলে।
অন্যান্য কলেজ, যেমন বি বরুয়া, আর্যবিদ্যাপীঠ, পাণ্ডু মহাবিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থাও ছিল না। রাজ্যের প্রতিটি কলেজেই একধরনের অঘোষিত, দুঃখজনক ব্যবস্থা অনগ্রসর শ্রেণীর ছাত্রদের আলাদা থাকতে বাধ্য করত। আমিও মাধ্যমিকের পর কোকরাঝাড় কলেজে পড়তে এসে একটি মসজিদের পাশে মেসে থাকতাম। সাইন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য অন্ধ্রপ্রদেশ গিয়ে বুঝতে পারি, পরিবেশ মুক্ত। সম্প্রদায়দত হীনমন্যতার প্রশ্রয় নিই। চিন্তার জগত ক্রমশ খুলছে। সবার সঙ্গে মিশতে পারছি। ঘুরতে যাচ্ছি। মত বিনিময় হচ্ছে।
চারপাশের বাঙালি বংশোদ্ভূত, রাজবংশী, বড়ো ও চা শ্রমিকদের মধ্য অশিক্ষা আর দারিদ্র সমানভাবে অবস্থান করত, যুগযুগ ধরে। তাঁদের শিক্ষার কথা, দারিদ্র্য মোচনের চেষ্টা প্রায় কেউই করেননি। নিম্ন অসমের সবর্ত্র ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পাড়ে মিশ্র বসবাস। বৃহত্তর অংশ মুসলিম। জঙ্গল সাফ করে, বন্য জন্তু, বিষাক্ত পোকা মাকড়ের সঙ্গে লড়াই করে জমিকে চাষযোগ্য করে তুলেছেন, সোনার ফসল যুগিয়েছেন সর্বপ্রান্তে। তাঁদের পরিশ্রম, তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের নিষ্ঠাকে কি আমরা মূল্য দিয়েছি ? তাঁদের সন্তানসন্ততির লেখাপড়া করার সংস্থান কি তৈরি করেছি ? তাঁদের দারিদ্র্যমুক্তির কথা কি ভেবেছি ? না কেবল ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছি তাঁদের সংখ্যার শক্তিকে?
বহু জাতির, বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আর ধর্মাবলম্বীর বাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও কেন কেবল কতিপয় ভাগ্যবানের সন্তানসন্ততির জন্য অসমের সর্বমুখী দরজা খোলা ছিল, তা খতিয়ে দেখিনি। আশা করি, সামাজিক ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব ভবিষ্যতে বিষয়টি ভেবে দেখবে, মেধাবীরা গবেষণা করবেন। মিঁয়ারা, চরুয়ারা, রাজবংশীরা, বড়ো ও অন্যান্য অনুন্নত শ্রেনীর লেখাপড়ায় আগ্রহ নেই, এ রকম নেতিবাচক উদাসীনতার খপ্পরে পড়ে যাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেনে, তাঁদের বোধোদয় ঘটবে।
ঘটনা চক্রে, প্রান্তিক এলাকার কৃষিজীবী মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। বাবা শিক্ষকতা করতেন বলে, উত্তরাধিকার সূত্রে লেখাপড়ার প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। আমাদের সব ভাই লেখাপড়া করেছে। কিন্তু চারপাশের বাঙালি বংশোদ্ভূত, রাজবংশী, বড়ো ও চা শ্রমিকদের মধ্য অশিক্ষা আর দারিদ্র সমানভাবে অবস্থান করত, যুগযুগ ধরে। তাঁদের শিক্ষার কথা, দারিদ্র্য্ মোচনের চেষ্টা প্রায় কেউই করেননি। নিম্ন অসমের সবর্ত্র ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পাড়ে মিশ্র বসবাস। বৃহত্তর অংশ মুসলিম। জঙ্গল সাফ করে, বন্য জন্তু, বিষাক্ত পোকা মাকড়ের সঙ্গে লড়াই করে জমিকে চাষযোগ্য করে তুলেছেন, সোনার ফসল যুগিয়েছেন সর্বপ্রান্তে। তাঁদের পরিশ্রম, তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের নিষ্ঠাকে কি আমরা মূল্য দিয়েছি ? তাঁদের সন্তানসন্ততির লেখাপড়া করার সংস্থান কি তৈরি করেছি ? তাঁদের দারিদ্র্যমুক্তির কথা কি ভেবেছি ? না কেবল ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছি তাঁদের সংখ্যার শক্তিকে?
এসব বিষর, শৈশব থেকে আমাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রশ্ন জাগায় ভেতরে। অসম আন্দোলনে পরিচিতির রাজনীতি যখন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে, যখন গণহত্যা সঙ্ঘটিত হতে থাকে, হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে পড়ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ঘরবাড়ি ছেড়ে, ভিত্তিহীন বিদেশি অপবাদ নিয়ে, অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটছে, আমি তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র। চারপাশের অঘটন আমাকে প্রভাবিত করছে। ভাবছি, মুক্তির জন্ম কোথায় ? রাজনীতি নয়। সামাজিক দ্রোহ নয়। দরকার সংস্কার। প্রয়োজন বৃহত্তর সমাজে লেখাপড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা। এ তো একার কাজ না। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অনেকের। এরকম ভাবনাচিন্তাই প্রথমে সামাজিক শূন্যতা পূর্ণ করার পরোক্ষ দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে দেয়। সম্ভবত তখনই ভাবতে থাকি, প্রথমে নিজের যোগ্যতা অর্জন দরকার। টালমাটাল পরিস্থিতিতে মাধ্যমিকে উত্তীর্ন হই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে নিয়ে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার বসি। ব্যর্থ হই। অসমে সুযোগ মিলল না। সোজা পৌঁছে গেলাম অন্ধ্রপ্রদেশে। ভর্তি হলাম, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। দুবছর পড়ার পর বুঝতে পারি, এটা আমার ফিল্ড নয়। অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে। বাড়ি ফিরব না, ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটার্নাল ছাত্র হিসেবে পড়ব। সঠিক সিদ্ধান্ত। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ল। ওখান থেকে বিএ পাশ করি। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে এমএ। ভালো রেজাল্ট। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। ওসমানিয়া থেকে সোজা গুয়াহাটিতে। শুরু কঠিন লড়াই। এসব কথা, আমার আত্মবৃত্তান্তের শুরুতেই বলেছি। আবার বলতে হচ্ছে, ওপরওয়ালা সামাজিক ইচ্ছাপূরণের অঘোষিত যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তা আমাকে পালন করতে হবে। শুরু হল আমাদের শিক্ষামূলক কর্মসূচি — ‘ডিসটেন্স এডুকেশন” ব্যবস্থা। যা অচেনা, অসমে অপ্রচলিত।
শৈশবে, উঠতি বয়সে বাড়ির আশপাশে যে নৈরাজ্য, যে দিশাহীনতা, শিক্ষাগ্রহণে যে-সব অনীহা লক্ষ্য করেছি, সম্ভবত আমার অবচেতনকে ব্যথিত করত, সে-সবই পরে এক হয়ে আমাকে সমাজমনস্ক করে তোলে। এটা ব্যক্তিবিশেষের গৌরব প্রচারের নয়, আত্ম উপলব্ধির বিষয়। প্রথমে চোখ কান খোলা রেখে পারিপার্শ্বিক দেখতে হয়, তার সুখ-দুঃখের সংলাপ শুনতে হয়। এভাবেই সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠে। ব্যক্তি নিজের অগোচরে এখনই স্থির করে নেয় তার ভবিষ্যতের কর্ম, কীভাবে, কী করবে? আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে? না সঙ্গবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে এমন কোনো রাস্তা, যা সমষ্টির চাহিদা মেটাবে, সমাজকে এগিয়ে যাবার পরামর্শ দেবে, বলবে শিক্ষা নাও, অতীতের কাছ থেকে, সময়ের দ্বারস্থ হয়ে।
আমি কখনো নিজের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করিনি। অর্ধশতক পেরিয়ে, এখন অনুভব করছি, সামাজিক অশান্তি, চারপাশের দারিদ্র্য আর শিক্ষাগ্রহনের ব্যাপক অন্তরায় আমার অন্তরে যে দুঃখবোধ তৈরি করেছিল, তাকে স্পর্শ করেই আমরা গত শতাব্দীর শেষের দিকে এন.ই.এফ সোসাইটি গড়ে তুলি এবং শিক্ষাকে ঘিরে অসমে প্রথম সামাজকেন্দ্রিক ব্যবসার জন্ম দিই। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের জনক আর নোবেল জয়ী অর্থশাস্ত্রী মহম্মদ ইউনূস যে অর্থে বহুজনের মালিকানাধীন সামাজিক ব্যবসার তত্ত্ব খাড়া করেছেন, তামাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেরকম তত্ত্বনির্ভর নয়। বনজ গাছপালার মতো জন্ম নিয়েছে, প্রকৃতির কোলে কোলে, সেরকমই বাড়ছে, সব শ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত তার দরজা জানলা। শাখা-উপশাখা। বিলকুল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। ব্যক্তি এখানে একজন সাধারণ সংগঠক। মহাপ্রকৃতি তাঁকে শূন্যতাপূরণের যে-দায়িত্ব দিয়েছেন, সে তা পূর্ণ করছে। সমাজ-মনস্কতাই তার শক্তি, তার যাবতীয় কর্মসূচির ভিত্তি।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-৩৩
❤ Support Us