Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • জুলাই ১৪, ২০২৪

শতবর্ষে রক্তকরবী: বহিরঙ্গ ও অন্তর্নিহিত তত্ত্বসত্য

পাকীজা মঞ্জরী চৌধুরী
শতবর্ষে রক্তকরবী: বহিরঙ্গ ও অন্তর্নিহিত তত্ত্বসত্য

১৯২৩-এর এপ্রিল। বৈশাখের তীব্র দহনে পুড়ছে শান্তিনিকেতন। ষাটোর্ধ্ব কবি গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে শরণ নিলেন গারো পাহাড়ের কোলে। রবিজীবনীকার জানাচ্ছেন : “এবার গরমের প্রকোপে রবীন্দ্রনাথ আগেই শান্তিনিকেতন ত্যাগে বাধ্য হন।” ২৩ এপ্রিল কবি শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা এসে পৌঁছলেন। ২৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে রওয়ানা হন শিলং এর উদ্দেশ্যে। সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গী কন্যা মীরাদেবী, নাতনি নন্দিতা, পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমা দেবী, তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী এবং কবির প্রিয় রানু অধিকারী। এক মাস পর শিলঙে বসে কৌতুক করে লিখলেন ‘গর্মি যখন ছুটল না আর পাখার হাওয়ায় শরবতে,/ ঠাণ্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলঙ-নামক পর্বতে।/ মেঘ-বিছানো শৈলমালা গহন-ছায়া অরণ্যে,/ ক্লান্তজনে ডাক দিয়ে কয়, ‘কোলে আমার শরণ নে’।‘ [শিলঙের চিঠি]। এমন বৃষ্টিস্নাত শহরে পা রেখেই কবির মনোবীথিকায় ঘনিয়ে উঠল সৃজনের গহন মেঘ। সে মেঘ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বারিধারা বর্ষণে রচিত হলো এক অপূর্ব নাটক, যাকে আমরা পরে ‘রক্তকরবী’ নামে জানব। দীর্ঘ সময় বলতে হলো কারণ, এই নাটকের খসড়া বহুবার পরিমার্জিত হয়েছে কবির হাতে; একাধিক বদল ঘটেছে সূচনা, সংলাপ, বিন্যাস এবং চরিত্রের নামে। বারবার সংস্কারের কারণে নাটকটির মূল পাণ্ডুলিপির সংখ্যা দশ ছাড়িয়েছে। এমন উদাহরণ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল !

প্রবাসী শারদীয় সংখ্যায়, আশ্বিন ১৩৩১ এ রক্তকরবী নাটকের প্রথম প্রকাশ । সঙ্গে কবির পান্ডুলিপির একটি পৃষ্ঠা

‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লেখেন, “ যক্ষপুরী নাটকটি প্রবাসীর পূজা সংখ্যায় প্রকাশ না করিয়া ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে প্রকাশের যদি ব্যবস্থা করেন, তবে ভালো হয়। অভিনয়ের পূর্বে আমি উহা বাহির করিতে ইচ্ছা করি না।” তবে প্রথম থেকে তৃতীয় খসড়া অবধি কোথাও নাটকের এই নামটির উল্লেখ নেই। ‘রক্তকরবী’ নামটি পাওয়া যায় অষ্টম খসড়ায়। খসড়াটি রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লেখা। সংশোধনও তাঁরই করা। এই খসড়া থেকে রক্তকরবী ফুলটি কেন্দ্রীয় প্রতীকরূপে নাটকে উঠে আসে

রক্তকরবীর ইংরেজি সংস্করণ ধরলে পাণ্ডুলিপি বারোটি । এগুলোর মধ্যে চতুর্থ পাণ্ডুলিপি বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনে নেই। ১৯৮৬ সালে বহুরূপী নাটক করবার প্রয়োজনে সেটি নিয়ে যায়। পাণ্ডুলিপিটির মুদ্রিত রূপ ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় সে বছরই মে সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পাঠান্তর সম্বলিত সংস্করণে গোটা দশেক পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত রূপ পাওয়া যায়। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন অধ্যাপক প্রণয়কুমার কুণ্ডু। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে রবীন্দ্র ভবন থেকে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্র বীক্ষা’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় প্রথম খসড়া সহ কয়েকটি পাণ্ডুলিপির তথ্য সংক্রান্ত আলোচনা প্রকাশিত হয়। সেগুলি লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রথম খসড়ায় নাটকের কোনো নাম ছিল না। এমনকি সংলাপ কথক হিসেবে কোনো চরিত্রেরও নাম-নির্দেশ দেননি রবীন্দ্রনাথ। তবে নাটকের কথোপকথনে উঠে এসেছে কয়েকটি চরিত্রের নাম—চন্দ্রা, ফাগুলাল, বিশু, সর্দার, অধ্যাপক, গোঁসাই ঠাকুর, মকররাজ, রঞ্জন, পুরাণবাগীশ ইত্যাদি এবং অবশ্যই নাটকের প্রধান নারী চরিত্র খঞ্জনী বা খঞ্জন। এই খসড়ায় গোকুল, চিকিৎসক, কিশোর চরিত্রগুলি ছিল না। দ্বিতীয় খসড়া থেকেই নাটকের প্রতিটি সংলাপ পাত্রপাত্রীর নামে চিহ্নিত হয়েছে। বিশু চরিত্রটি প্রথম খসড়ায় মাতাল ছিল, দ্বিতীয় খসড়া থেকে হলো পাগল—বিশু পাগল। প্রথম খসড়ায় রঞ্জনের সঙ্গে মিলিয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছিল খঞ্জনী বা খঞ্জন, সে দ্বিতীয় খসড়া থেকেই ‘নন্দিনী’ নামে চিহ্নিত হয়। অবশ্য এখানে অল্প সময়ের জন্য ‘সুনন্দা’ নামটি ব্যবহার করে আবার বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ। নন্দিনী নামটিই স্থায়ী হয় শেষ পর্যন্ত। প্রথম খসড়ায় নাট্য পরিচয় নেই, তা যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় খসড়ায়। চতুর্থ খসড়ায় নাটকের নাম হলো ‘নন্দিনী’। এর আগে বিভিন্ন জনের উক্তিতে ও নাট্যকারের বয়ানে এর নাম ‘যক্ষপুরী’ রূপে উল্লিখিত। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৩-এ ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত রবীন্দ্রনাথের চিঠির কয়েকটি ছত্র এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যেতে পারে : “যক্ষপুরী নাটকটি প্রবাসীর পূজা সংখ্যায় প্রকাশ না করিয়া ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে প্রকাশের যদি ব্যবস্থা করেন, তবে ভালো হয়। অভিনয়ের পূর্বে আমি উহা বাহির করিতে ইচ্ছা করি না।” তবে প্রথম থেকে তৃতীয় খসড়া অবধি কোথাও নাটকের এই নামটির উল্লেখ নেই। বস্তুত, তৃতীয় খসড়া পর্যন্ত নাটকটি নামহীন আর ‘রক্তকরবী’ নামটি পাওয়া যায় অষ্টম খসড়ায়। খসড়াটি রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লেখা। সংশোধনও তাঁরই করা। এই খসড়া থেকে রক্তকরবী ফুলটি কেন্দ্রীয় প্রতীকরূপে নাটকে উঠে আসে। এর আগে সপ্তম খসড়া থেকেই ফুলটির গুরুত্ব বাড়ছিল। কারণ উক্ত খসড়ায় আটবার সরাসরি ফুলটির প্রসঙ্গ এসেছে। অষ্টম খসড়ায় তা বেড়ে উনিশবার হয়েছে। নবম খসড়াটি নীল কালিতে রানুর হাতের লেখায় পাওয়া যায়। অষ্টম ও নবম খসড়ার পাঠে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। নাটকের নামও একই আছে। দশম খসড়াতেও তাই। তবে এখানে কিশোর নামের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি সংযোজিত হয়েছে। এই সংযোজন খসড়া পরিমার্জনের সময় ঘটেছে। মূল খসড়ায় কিশোর চরিত্র ছিল না। সব দিক বিচার করে বলা যায়, গোকুলের প্রথম প্রবেশের দৃশ্যটি বাদ দিলে দশম খসড়ায় প্রচলিত রক্তকরবী নাটকের চূড়ান্ত পাঠকে স্পর্শ করেছে। বাকি সংযোজনের জন্য প্রবাসী শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত (আশ্বিন ১৩৩১) পাঠ পর্যন্ত আমাদের প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল।

গানের ক্ষেত্রেও অনেক সংযোজন-বিয়োজন চোখে পড়ে। প্রথম খসড়ায় মোট গান ছিল এগারোটি। এছাড়াও দুটি গানের একটি করে পঙ্‌ক্তি ছিল। সেগুলো হলো—১) ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই’ ২) ‘মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’। দ্বিতীয় খসড়াতেও এগারোটি গান আছে। তবে প্রথম খসড়ার তিনটি গান এখানে বর্জিত হয়েছে। সেগুলো হলো— ১) কাজ ভোলাবার কে গো তোরা’ ২) ‘তোর পাকা ফসল জমিয়ে কেন রাখিস’ ৩) ‘এতদিন পরে/ আপন হাতে দিলে বেঁধে মুক্তি ডোরে’। এর পরিবর্তে তিনটি নতুন গান সংযোজিত হয়েছে—১) ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ ২) ‘নাই বা এলে সময় যদি নাই’ ৩) ‘আমার মনের বাঁধন ঘুচে যাবে’। তৃতীয় খসড়ায় আবার তিনটি গান বর্জিত হওয়ায় গানের সংখ্যা দাঁড়ায় আট। বর্জিত গানগুলি হলো—১) ‘নাই বা এলে সময় যদি নাই’ ২) ‘নূতন পথের পথিক আসে’ ৩) ‘আয়রে মোরা ফসল কাটি’। চতুর্থ খসড়ায় গানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তৃতীয় খসড়ার অনুরূপ আটটি গানই আছে এখানে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ খসড়াতেও তাই। অর্থাৎ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ খসড়ায় গানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো বদল ঘটেনি। সপ্তম খসড়ায় সমাপ্তি সূচক ‘যে পথ দিয়ে গেল রে তোর’ গানটি এবং নাটকের শেষে সংযোজনের উদ্দেশ্যে লেখা খসড়া পরিকল্পনায় ‘আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো’ গানটি নিয়ে মোট দশটি গান আছে। অষ্টম খসড়ায় দেখা যায়, সপ্তম খসড়া যে গান দিয়ে শেষ হয়েছিল, তা এখানে বাদ দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে নাটকের শেষে ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ গানটি সংযোজিত হয়েছে। আলোচ্য খসড়ায় এই গানটি থিম সঙের মর্যাদা পেয়েছে বললে ভুল হবে না। এছাড়া আরেকটি গান যা বিশুর কণ্ঠে শোনা যায়, ‘যুগে যুগে বুঝি আমায়’ অষ্টম খসড়ায় যুক্ত হয়েছে।

দশটি পাণ্ডুলিপির পর ১৩৩১ এর আশ্বিন সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে নাটকের যে মুদ্রিত পাঠ দেখা যায়, তা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশম খসড়া থেকে ভিন্ন। ছেদ ও যতি চিহ্নের প্রয়োগে, শব্দ ব্যবহারে, এবং কিছু সংলাপেও এই ভিন্নতা নজরে আসে। গ্রন্থ সংস্করণে যে নাট্য-নির্দেশনা রয়েছ, তা প্রবাসীর পাঠেই প্রথম দেখা গেছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, দশম খসড়ার পরও একাদশতম আরেকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি

নবম খসড়ায় অষ্টম খসড়ার সব গানই রয়েছে; তবে একটি গান ‘আমার মনের বাঁধন’ এখানে বর্জিত। লক্ষণীয়, এই খসড়াতে গানগুলি যেভাবে আছে, ঠিক সেভাবেই রক্তকরবীর গ্রন্থ সংস্করণে পাওয়া যায়। দশম খসড়াতেও গানে কোনো বদল ঘটেনি। এই দশটি পাণ্ডুলিপির পর ১৩৩১ এর আশ্বিন সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে নাটকের যে মুদ্রিত পাঠ দেখা যায়, তা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশম খসড়া থেকে ভিন্ন। ছেদ ও যতি চিহ্নের প্রয়োগে, শব্দ ব্যবহারে, এবং কিছু সংলাপেও এই ভিন্নতা নজরে আসে। গ্রন্থ সংস্করণে যে নাট্য-নির্দেশনা রয়েছ, তা প্রবাসীর পাঠেই প্রথম দেখা গেছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, দশম খসড়ার পরও একাদশতম আরেকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে এখানে গানের ক্ষেত্রে কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি।

রক্তকরবীর গ্রন্থ সংস্করণে কোনো অঙ্ক বা দৃশ্যভাগ নেই। প্রথম খসড়াতেও এসব ছিল না। দ্বিতীয় খসড়ায় প্রথম পর্বভাগ এসেছে। মোট ছটি পর্বে নাটকটি বিন্যস্ত হয়েছে । তৃতীয় খসড়ায় একটি পর্ব কমে হলো পাঁচটি। দ্বিতীয় খসড়ার অন্তিম পর্বকে তৃতীয় খসড়ায় আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। চতুর্থ এবং পঞ্চম খসড়াতেও পাঁচটি পর্ব। ষষ্ঠ খসড়া থেকে নাটকের পর্বভাগ বা দৃশ্যভাগ বর্জিত হয়েছে; যা পরবর্তী খসড়াগুলিতেও অনুসৃত হয়েছে। বর্তমানে রক্তকরবীর গ্রন্থ সংস্করণে যে পর্বহীন বিন্যাস দেখা যায়, তা ষষ্ঠ খসড়া থেকেই নাট্যকারের ভাবনায় দানা বেঁধেছিল। তবে পর্বভাগের রীতি অনুসৃত না হলেও ষষ্ঠ থেকে দশম পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত অনেক সংশোধন-সংযোজন-পরিমার্জন ঘটেছিল। যার ফলে খসড়াগুলোর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মূলত এ নাটকের এ যাবৎ প্রাপ্ত বাংলা দশটি পাণ্ডুলিপিতে দশ রকম পাঠ দেখা যায়। ১৯২৩-এর গ্রীষ্মকালে শিলঙে বসে রবীন্দ্রনাথ নাটকটি লিখতে শুরু করেন এবং ষোল মাস পর প্রবাসীতে তার প্রথম মুদ্রিত রূপ পাঠকের সমক্ষে আসে। এই দেড় বছরে নাটকটির এগারোখানা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন কবি। বোঝা যায়, কতটা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তিনি নাটকটিকে বার বার মার্জনা করেছেন। এতগুলো পাণ্ডুলিপি শুধু যখন একটি নাটককেই ঘিরে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা গভীর চিন্তা ভাবনা ও মমতা তিনি লালন করেছিলেন এই সৃষ্টির প্রতি।

রক্তকরবীর প্রথম খসড়া ঠিক কবে লিখতে শুরু করেছিলেন, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ১৯২৩-এর ১১ মে শিলং থেকে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে কবি বলছেন : “একটা নাটক গোচের একটা কিছু লেখবার ইচ্ছে আছে।” এই ইচ্ছেটাই সাকার রূপ নিল সম্ভবত মে মাসের শেষের দিকে—এমনটাই অনুমান প্রশান্ত কুমার পালের। ১২ জুন একটি চিঠিতে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে কবি জানাচ্ছেন : “নাটকটা একরকম শেষ হয়েছে। একে নাটক নাম দেওয়া যায় কি না জানিনে।” অর্থাৎ ১২ জুনের মধ্যে রক্তকরবীর প্রথম খসড়া সম্পূর্ণ—এটা অনুমান করতে কোনো অসুবিধা নেই। শিলং থেকে কবি কলকাতায় ফিরে আসেন জুন মাসের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এবং কিছুদিন সেখানেই থেকে যান। তাহলে হিসেব অনুযায়ী, দ্বিতীয় খসড়া যদি শিলঙে লিখতে শুরুও করেন, শেষ করেছেন কলকাতায় এসে। এই সময়কালে ঠাকুরবাড়িতে একটি সাহিত্য সভা হয়, যেখানে তিনি নাটকটি পাঠ করেছিলেন। ২ জুলাই শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি আশ্রমিকদের কাছে নাটকটি পড়ে শোনান। অনুমান করা চলে, পঠিত নাটকটি রক্তকরবীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় খসড়া। ১৯২৩ এর ২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রবীন্রনাথ শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এই পর্বে রক্তকরবী নাটকটি অভিনয় করার কথা ভাবছেন ও পাশাপাশি এর ইংরেজি অনুবাদের কাজও চলছে। ৬ সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে রানুকে লিখছেন—“বেনোয়া (Fernand Benoit) কে নিয়ে এখনও আমরা নন্দিনীর তর্জ্জমা করে চলেছি। কাল সকালে বোধহয় শেষ হয়ে যাবে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নাটকটির একটি মাত্র ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত আছে। পাণ্ডুলিপিটি হাতে লেখা নয়, টাইপ করা। টাইপটিতে বহুল পরিমাণে সংশোধনের চিহ্ন রয়েছে। এই সংশোধনের কাজটি করেছেন প্রধানত ইন্দিরা দেবী এবং অংশত রবীন্দ্রনাথ। এই ইংরেজি টাইপ কপির সঙ্গে বাংলা ষষ্ঠ খসড়ার পাঠ হুবহু মিলে যায়। যদিও ইংরেজি পাণ্ডুলিপি আগে ও ষষ্ঠ খসড়া পরে লিখিত। রক্তকরবী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ Red Oleanders ১৯২৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ মূল বাংলা নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই তার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়। যদিও নাটকের মুদ্রিত রূপ পাঠকের কাছে ১৯২৪ এই পৌঁছে গেছে শারদীয় প্রবাসী পত্রিকার হাত ধরে। যাই হোক এই ইংরেজি পাণ্ডুলিপি সমেত রক্তকরবীর মোট বারোটি পাণ্ডুলিপির কথা জানা যায়, যেগুলোর মধ্যে চতুর্থ ও একাদশ পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্র ভবনে নেই।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু বর্ণ চিত্রে রক্তকরবী গাছ সঙ্গে বিশ্বভারতী ত্রৈমাসিকে মুদ্রিত রক্তকরবী নাটকের ইংরেজি রূপান্তর

 

রক্তকরবীর প্রধান সম্পদ তার সত্যমূলক ঘটনায়, তার সাঙ্কেতিকতায়। যন্ত্রদানবের হাত থেকে মনুষ্যত্বের মুক্তি হওয়া চাই—এ কথাই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন নাটকে। শিলঙে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কাছ থেকে কবি জানতে পারেন মুম্বাইয়ের শিল্পকেন্দ্রের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা, যা তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার বলেছেন, যান্ত্রিকতা মানুষের সহজ শক্তি ও সৌন্দর্যকে নষ্ট করে স্তূপীকৃত বস্তুপিণ্ডের উপর তার সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রবৃত্ত; সেই বেদনাই রূপকের আড়ালে রূপায়িত হয়েছে ‘যক্ষপুরী’ তথা ‘রক্তকরবী’ নাটকে

এ তো গেল নাটকের বহিরঙ্গের কথা। এবার আসা যাক এর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও সত্যের প্রসঙ্গে। রক্তকরবী নাটকের মূল বিষয়টি খুব সোজা ভাষায় বলতে হয় দুই ভিন্ন শ্রেণির সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস বলা যায়। নাট্যকার এদেরকে কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী সভ্যতা বলেছেন। অর্থাৎ কৃষিনির্ভর সভ্যতার সঙ্গে যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার দ্বন্দ্ব। এটি একটি আধুনিক সমস্যা; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে “আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ নেই। মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের।” এই সমস্যার অস্তিত্ব যে কত আগে থেকে আমাদের ভারতবর্ষে ছিল, সে কথার প্রমাণ দিতে গিয়ে নাট্যকার রামায়ণের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর বিশ্বাস, রামায়ণের রাম-রাবণ দ্বন্দ্বের মধ্যে এই চিরকালীন সমস্যার তৎকালীন রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। রক্তকরবীর প্রচলিত সংস্করণের প্রস্তাবনায় তিনি এ সম্পর্কে আলোচনাই শুধু করেননি, আলোচ্য নাটকের সঙ্গে রামায়ণের ঐক্যের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, রামায়ণের সমস্যাই রক্তকরবীর সমস্যা। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য প্রস্তাবনা অংশের কিছুটা উদ্ধৃত হলো : “কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে। এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্পীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্ৰম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো। আমার মুখের এই বচনটি কবি তার রূপকের ঝুলিতে লুকিয়ে আত্মসাৎ করেছেন, সেটা প্ৰণিধান করলেই বোঝা যায়। নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের বক্ষসংলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধীশ্বর দশানন হরণ করে নিয়েছিল সেটা কি সেকালের কথা, না একালের? সেটা কি ত্ৰেতাযুগের ঋষির কথা, না আমার মতো কলিযুগের কবির কথা ? তখনো কি সোনার খনির মালিকরা নবদুর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল ?”— এই উদ্ধৃতি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রবীন্দ্রনাথ রামায়ণ ও রক্তকরবীর মধ্যে তত্ত্বগত ঐক্যকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সম্পূর্ণ নাটকটিকে রামায়ণের ছাঁচে ঢালাই করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাই নাটকে রাজার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন : “আমাদের পালায় একটি রাজা আছে। আধুনিক যুগে তার একটার বেশি মুণ্ড ও দুটোর বেশি হাত দিতে সাহস হলো না। … বৈজ্ঞানিক শক্তিতে মানুষের হাত পা মুণ্ড অদৃশ্যভাবে বেড়ে গেছে। আমার পালার রাজা যে সেই শক্তি বাহুল্যের যোগেই গ্রহণ করেন, গ্রাস করেন, নাটকে এমন আভাস আছে। ত্রেতা যুগের বহুসংগ্রহী বহুগ্রাসী রাবণ বিদ্যুৎ বজ্রধারী দেবতাদের আপন প্রাসাদদ্বারে শৃঙ্খলিত করে তাদের দ্বারা কাজ আদায় করত। তার প্রতাপ চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকতে পারত! কিন্তু তার দেবদ্রোহী সমৃদ্ধির মাঝখানে হঠাৎ একটি মানব কন্যা এসে দাঁড়ালেন, অমনি ধর্ম জেগে উঠলেন। মূঢ় নিরস্ত্র বানরকে দিয়ে তিনি রাক্ষসকে পরাস্ত করলেন। আমার নাটকে ঠিক এমনটি ঘটেনি কিন্তু এর মধ্যেও মানবকন্যার আবির্ভাব আছে। তাছাড়া কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে, এমনও একটা সূচনা আছে।

… আমার স্বল্পায়তন নাটকে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি এক দেহেই রাবণ ও বিভীষণ; সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে।”

বোঝা যায় নাটকটি রচনাকালে প্রতিপদে রামায়ণের সঙ্গে সাদৃশ্যের কথা ভেবেছেন নাট্যকার। রামায়ণে রাম রাবণের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছে সীতাহরণ। এই ঘটনাটি ভাবরূপে রক্তকরবীতে প্রকাশ পেয়েছে। এখানে কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবীর দ্বন্দ্বের ঠিক মাঝখানে আছে নন্দিনী। এই নন্দিনী কে? নাট্যকার বলছেন : “রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি ‘নন্দিনী’ বলে একটি মানবীর ছবি। চারিদিকে পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। …মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়, মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের নৃত্য, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের।” অর্থাৎ দুই ভিন্ন সভ্যতার দ্বন্দ্বের মাঝখানে প্রেম ও সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে নাটকে নন্দিনীর অবস্থান। সে বার বার চেয়েছে, রাজাকে দানবীয় যন্ত্রশক্তির লুব্ধ জাল থেকে, অতল ঐশ্বর্যের অন্ধকার গহ্বর থেকে মুক্ত করতে। সেই মুক্তির পথে নন্দিনীর একমাত্র মন্ত্র ছিল বিশুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ প্রেম; যে প্রেমের প্রভা ছড়িয়ে আছে সোনালি ফসলের মাঠে, নীল আকাশের গায়। নন্দিনীর এই সক্রিয়তা, এই প্রয়াস রামায়ণের সীতার মধ্যে ছিল না। এই সচেতন প্রবর্তনা একান্তই তার নিজস্ব বা বলা ভালো রবীন্দ্রনাথের মৌলিক ভাবনা প্রসূত, যা নন্দিনী চরিত্রটিকে স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ

রক্তকরবীর প্রধান সম্পদ তার সত্যমূলক ঘটনায়, তার সাঙ্কেতিকতায়। যন্ত্রদানবের হাত থেকে মনুষ্যত্বের মুক্তি হওয়া চাই—এ কথাই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন নাটকে। শিলঙে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কাছ থেকে কবি জানতে পারেন মুম্বাইয়ের শিল্পকেন্দ্রের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা, যা তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার বলেছেন, যান্ত্রিকতা মানুষের সহজ শক্তি ও সৌন্দর্যকে নষ্ট করে স্তূপীকৃত বস্তুপিণ্ডের উপর তার সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রবৃত্ত; সেই বেদনাই রূপকের আড়ালে রূপায়িত হয়েছে ‘যক্ষপুরী’ তথা ‘রক্তকরবী’ নাটকে।

১৯২০-২১ সালের মধ্যে কবি আমেরিকা গিয়ে পুঁজিবাদের শোষণ ও যন্ত্র সভ্যতার নগ্ন রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ‘রক্তকরবী’ নাটক রচনার সময় এইসব অভিজ্ঞতাও ক্রিয়াশীল ছিল কবি-চেতনায়। নাট্যপরিচয়ের সূচনাতে তাই নাট্যকারের প্রত্যয়ী উক্তি— “এই নাটকটি সত্যমূলক।” সে সত্য আজও তার বৃহৎ অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সভ্যতার যক্ষপুরীতে রাজত্ব করে চলেছে। আজও যন্ত্র সভ্যতার সর্বগ্রাসী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যায় দেশজোড়া কৃষক সমাজ। শতবর্ষ পেরিয়েও রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী সমান প্রাসঙ্গিক। আজও এই নাটক আমাদের ভাবায়, আমাদের স্বপ্ন দেখায় শোষণমুক্ত এক উদার ও মহৎ মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার। সে সমাজে লোভ নয়, প্রেমই হবে বেঁচে থাকার বীজমন্ত্র।

তথ্যঋণ: রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ [পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ], প্রমথনাথ বিশী, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানিরক্তকরবী: আলোকিত উদ্ভাসন, সন্তোষ কুমার মণ্ডল সম্পাদিত, উদ্দালক সাহিত্য প্রকাশনরক্তকরবী: পাঠ ও পাঠান্তরের ভাবনায়, মলয় রক্ষিত, দে’জ পাবলিশিং

♦—•—♦♦—•—♦♦—•—♦

 

লেখক পরিচিতি: লেখক রবীন্দ্র-গবেষক। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-চিন্তায় , সৃজনেও বৈষ্ণব কবিতা আর উপনিষদ কীভাবে মিশ্রিত হয়ে, কবির মনের হাওয়া তৈরি করেছিল, সুগভীর গবেষণা গ্রন্থে তা বিশ্লেষণ করেছেন শান্তিনিকেতনের নব প্রজন্মের এই স্থায়ী বাসিন্দা।

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!