Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ৩, ২০২৪

স্বপ্নভঙ্গের বেদনা

অমিত মুখোপাধ্যায়
স্বপ্নভঙ্গের বেদনা

একের পর এক অনন্য চলচ্চিত্র করার জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন কুমার সাহানি। প্রায় প্রত্যেকটি তাঁর নিজস্বতার চিহ্ণ এবং শৈলী বহন করে কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। ছোটো ছবি হোক বা বড়, সংখ্যায় কম হলেও প্রতিটি নির্মাণে তাঁর বাস্তববোধ ও কল্পনার বিস্তার দর্শককে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে, যেখানে যে সত্য তিনি দেখাতে চান, ভাস্বর হয়ে ওঠে। ভারতীয় সিনেমাকে নিশ্চিত ভাবেই তিনি নতুন দিগন্ত দিয়েছেন এবং পর্দার ভাষাকে দিতে পেরেছেন নতুনতর অস্ত্র। 

পাঁচটি ছোটো ছবি করার পরে মায়াদর্পণ সিনেমা (১৯৭২) তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি এবং সেটাই তাঁকে বোঝার জন্য সবচেয়ে জরুরি সৃজন বলা যায়। কেবল মায়াদর্পণ নামটিই তাঁর সৃষ্ট জগতের প্রতীক হয়ে উঠে শিল্পীর সামগ্রিক বার্তার পরিচয় দেয়, অন্তর্গত সংকেতের দ্যোতনা আভাসিত করে। সেই বসুন্ধরা যেন বিভ্রমের আয়না, যেখানে জাগরণে কখন লেগে যায় ঘোর, তখন সেই প্রতিবিম্ব দেখাতে থাকে এমন জগত, যা আমাদের চোখের আড়ালের বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলে। মায়াদর্পণ কাউকে কিছু দেখায় মানে যেন তা  আগামী কোনও বিপর্যয়ের ইঙ্গিত করে, কেমন করে অতীত থেকে বর্তমান হয়ে সেই বিপদ রূপ নেয় আগামী দিনে, তা বুঝিয়ে দিতে চায়।     

আগাগোড়া এক স্বকীয়তা খেলা করে কুমার সাহানির দৃশ্যকাব্যে, যেখানে অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতার সময় বা পরবর্তী জীবন, সর্বত্রই এক ধ্রুপদী সুর বেজে চলে। ছোট ছবি হোক বা বড় কাহিনি, সাহানি ক্রমাগত মগ্নতায় ডুব দিয়েছেন, কখনো অন্তর্ঘাতের পর্যায়ে চলে গেছে তা। প্রায় নিস্তরঙ্গ জীবনের ধারায় কখন কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটে, কোন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়, তা যেন ইতিহাসের নেপথ্য থেকে তুলে আনেন সাহানি। 

চলচ্চিত্রের ভাষা শিখেছেন সাহানি পুনেতে, তাঁর দর্শন বদলে দিলেন ঋত্বিক, অলংকার বর্জন করার শিক্ষা দিলেন ব্রেসঁ, সংযমে শান দিলেন রসেলিনি আর গঠনের ধারণা দিলেন আইজেনস্টাইন। বাইরের আর ভেতরের বাস্তবতা মিলে গেল মেদুর রঙবাহারে আর সূক্ষ্মতায়। মায়াদর্পণ থেকে কসবা, অন্তরঙ্গের স্বল্প আলোর সন্ধানী রেখা চিনিয়ে দেয় বহিরঙ্গের উজ্জ্বলতার জগতকে। 

প্রথম দিকে তিনি সমালোচিত হন ধীর চিত্রগ্রহণ, গল্পের মন্দ লয়ের জন্য। পরে বোঝা যায় সেই শ্লথতার অর্থ, তার মাহাত্ম্য, যখন মায়াদর্পণের তরন মেয়েটি ঘরের ভেতরের সাধারণ নড়াচড়ায়, হাত বা পায়ের আঙুল নাড়ানোয়, লুকিয়ে রাখায়, এমনকি স্রেফ বসে থাকায় প্রকাশ করে যুগসন্ধিক্ষণের দোদুল্যমানতা, ভারত যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চলেছে। দূরাগত শব্দ, অস্পষ্ট গানের আভাস যেন সেই স্বাধীনতার পর্বান্তরের চেহারা ধরতে চায় পাষাণকারার অচলায়তনের ভেতর থেকে। দৃশ্য যখন বাইরের, তখনো সামান্য হরতাল ইত্যাদি কথা, পুলিশের মারার ঘটনা ছাড়া আর থাকে আলোচনার হাহুতাশ। আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি সময় ও পরিসরকে গেঁথে ধরেন, সেই প্রেক্ষিতে বিস্তারের ধারণা দিতে ওই মন্থরতার দরকার ছিল। 

মায়াদর্পণের ধীরতা আরও নানা ভাবে আকর্ষণ করে রসগ্রাহীদের। বিদেশি সাম্রাজ্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাইলেও নতুন ব্যবস্থা অজস্র দ্বিধা নিয়ে এগোয়। শ্রমিক কর্মচারি শাসক বা আধিপত্য হারাতে থাকা ক্ষমতার মালিক, কেউই খুশি নয় সদ্য পাওয়া স্বাধীনতায়। তাই প্রত্যেকে অতি সতর্ক ভাবে পা বাড়ায়। উঠোনের মজলিসে তরনের বাবা এবং অভ্যাগতরা আলোচনা করে নানা কর্মচারি সংগঠনে ঢুকে কেমন সাহস বেড়ে গেছে শ্রমিকদের। পোশাক দেখে বোঝা যায় না, কে জমিদার আর কে জমাদার! সরকারি চাকরিও আর যথেষ্ট সম্মান বহন করে না, কারণ তা এখন পয়সা দিয়ে কেনা যায়।  

তরনের বাবার কাছে আর উমেদারদের ভিড় হয় না। কেউ দেখা করতে আসে না। তরনের দাদা রক্ষণশীল আধিপত্যবাদী বাপের ওপরে রাগ করে আসামের চা বাগানে চলে গেছে। সে তরনকে চিঠিতে বারংবার যেতে লেখে। সেই চিঠির কাব্যিক ভাষা ঘুরে ফিরে মনে করে তরন, সেটাই তার কাছে মুক্তির পরিসর হয়ে ওঠে। চা-জগতের খোলামেলা প্রকৃতির নদী বাতাস গাছ পাতার বর্ণনা জমিদারবাড়ির বদ্ধতাকে আরও প্রকট করে তোলে। তার সঙ্গে হতাশা আনে মেয়ের বিয়ে দিতে বাবার অনীহা। কিছুতে নাকি অভিজাত পাত্র পাওয়া যায় না! তরনের মাসি যখন সাহস করে অন্য কোনও যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দেবার কথা বলে, গৃহকর্তা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ রেলের ইঞ্জিনিয়ার যুবকের আগ্রহ আছে, তাদের দেখা হলে বেশ গল্প করে দু’জনে। কিন্তু কোনও উপায় নেই তরনের!

এমনকি শেষে অনেক ভয় ও দ্বিধার পরে তরন যখন বাবার সামাজিক সম্মান বজায় রেখে নিজের ইচ্ছে মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই যুবকের কাছে যায়, তখনো তা ঘটে অতি শান্ত পরিস্থিতিতে! ভাবুন সেই দৃশ্য, প্রথমে বিছানায় বসে, পরে কলঘরে গিয়ে একের পর এক চুলের কাঁটা খোলে তরন, বেশবাস ঠিক করে। এই কাঁটা বুঝি নবজাতক সময়ের নানা বাধা বিপত্তি আর সমস্যা! বালতিতে পড়া জলের শব্দ স্তব্ধ বাড়িতে বুঝি আলোড়ন তুলতে চায়! সে তারপর সতর্ক পায়ে বাবার ঘরের দিকে যায়। এই অচলায়তনের কেন্দ্র তরনের বাবার ঘরের দরজা জানালার সামনে খসখসের আড়াল থাকে তখনো, ফলে সেখান থেকে ফিরে গিয়ে বাইরে পা বাড়ায় তরন।

আগে অনেক বার তরন ও তার মাসি নানা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হয় এই দরজা বন্ধ দেখে, নয়ত ভারি খসখসের পর্দা নামানো দেখে, কিংবা স্রেফ সাহসের অভাবে ফিরে আসে। এই দরজা সামন্ত প্রভুত্বের কর্তৃত্বের বেড়া, বিধিনিষেধের আগল। এবারও দরজা বন্ধ দেখে তরন যখন স্থির ভাবে বেরিয়ে পড়ে প্রেমিকের ডেরার দিকে, যাবার আগে মাসির প্রশ্নের জবাবে বলে যায় নিজের সিদ্ধান্তের কথা। ঘর ছেড়ে যাবে না, এ কথা সে আর বলে না। তার উক্তি, কোনও ভাবেই তার বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চলে না! সদ্যজাত পরিবেশ ও পরিস্থিতি প্রকাশ্যে ব্যক্তিসিদ্ধান্ত নেবার অনুমতি দেবার সাবালকত্ব অর্জন করে উঠতে পারে নি! সচেতন এবং নাচার ব্যক্তিমানসও খোলামেলা পদক্ষেপ নেবার জমি খুঁজে পায় নি! অর্থাৎ ঘরের অভিমান বজায় রেখেই আপন জীবন গড়ে নিতে চায় তরন।

ট্রেনের চাকার চলে যাবার শব্দকে নানা মাত্রায় প্রয়োগ করেন সাহানি। ইঞ্জিনের শিসও যেন প্রতীকী হয়ে ওঠে। যন্ত্র তার নিত্য অভ্যাসে ডাক দিতে থাকে, কিন্তু দিশেহারা বিভ্রান্ত মানুষ গলা ছেড়ে ডাক দিতে ভুলে যায়। উন্নতির বদলে তারা অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে বিব্রত হতে থাকে। অন্যান্য সময়ও কলের জল বালতিতে পড়ার তীব্র আওয়াজ বাড়ির নীরবতাকে প্রশ্ন করে বুঝি। বাতাসের আওয়াজ বাজিয়ে দেখতে চায় নতুন কাঠামোর অবস্থা। গুমোট কাটাতে তরনের হাঁটতে বেরনো আরেক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। দিনান্তের ম্লান আলোয় নিসর্গের শূন্যতা, রুক্ষ মাটি, বালিয়াড়ি বুঝি সময় ও মানসকে তুলে ধরে। কারণ তেমন এক ভ্রমণ থেকে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে যেতে তরনের বাবা প্রথমে তার হাত থেকে হুঁকো নিতে অস্বীকার করেন। কয়েক দিন তিনি গুম হয়ে থাকেন রাগ বা অপ্রসন্নতা দেখাতে। এক সময় নিজের ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দেন। অসুস্থতার ভান করেন।

এমন রক্ষণশীল সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের মাঝ থেকে জেগে ওঠা তরন যখন প্রেমিকের হাত নিজের বুকে নিয়ে নেয়, তার অভিঘাত অনেক কিছু বলে দেয়। যুবক বলে পাশা খেলায় তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের রক্ত ব্যবহার করা হয়েছে শাসকের স্বার্থে। তরন কিন্তু তখন আর আগের মতো চিন্তিত বা হতাশ নয়। সে উল্টে হাসে, মজা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে পুনরুক্তি করে, সেই রক্ত আদতে কালো রক্ত। যেন বদ রক্ত বেরিয়ে গেছে, ভালোই হয়েছে! শেষ দিকের সেই নাচের দৃশ্যে অনেকেই ভারতনাট্যমের এক লৌকিক রূপান্তরের নাচের সঙ্গে অজন্তার মুদ্রার মিল পেয়েছেন। যেন রাতের আঁধারে নিজেদের উদ্যোগে জনতার সত্তা জেগে উঠে এক হতে চায়! সেই দৃশ্যে জনতার ভূমিকা বুঝি স্বপ্নের মঞ্চায়ন! একেবারে শেষে বিস্তীর্ণ শান্ত জলতলে সাদা জলযানে তরনের এগিয়ে যাওয়াও প্রতীকী হয়ে থাকে।   

“তরংগ্” (১৯৮৪) সেই তুলনায় সরলরৈখিক ভাবে বলা হলেও সেখানেও চোরাগোপ্তা মন্তব্য ও কাজকর্মের চিত্রায়নে সাহানির তীব্র বিশ্লেষণ নজর কাড়ে। যেমন কিছু গান এখানে দর্শককে চমকে দেয়, তেমনই ঘুরে ফিরে আসে শ্রমের মূল্যের প্রসঙ্গ, কল্যাণকর রাষ্ট্রের দায় এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের কথা। যে দৃশ্যে হংসা বলে বউটি নিজের বাবা, সন্তান ও উত্তরাধিকার হারিয়ে আত্মহত্যা করে, তার আগেকার গানের সময়ে অনুমান করার কোনও আভাস থাকে না। স্নানের পাত্রে নিজের ছড়ানো ফুলের (যে ফুল কাজের মেয়ে জানকিকে দিয়ে আনানোর সময়ে সে বলেছিল, একমাত্র তুইই আমার মনের অবস্থা বুঝবি!) মাঝে তার অন্তিম শয়ান গানের মতোই স্বকীয় উন্মোচনে ভাস্বর। চারপাশের দালালি, অবিশ্বাস, হিংস্রতা যেন ইংরেজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে চলে, যার হিমশীতল পূর্বাভাস ছিল মায়াদর্পণে, তাই অমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তরনকে। মায়াদর্পণ যেন এমন অপশাসনের অমঙ্গলের ইঙ্গিত দিতেই চেয়েছিল! নেতৃত্ব, প্রশাসন, মালিক, শ্রমিক তখনো দেখা যায় মারামারি করেই চলেছে!

অসম্ভব নেতির উদাহরণ রাখে অমল পালেকরের রাহুল চরিত্র, দেশের পরের প্রজন্মের অমন রূপ থমকে দেয়। উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে জানকিকে তাড়িয়ে দেবার পরে রাতে দীর্ঘ সেতুর ওপরে যখন রাহুল ফের দেখা পায় তার, সেই দৃশ্য একই সঙ্গে স্বপ্ন এবং সমাপন হয়ে থাকে। এই ধরণের সব চরিত্রের মূল সঙ্কট ধরতে পারে জানকি। সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলে, তুমি আদতে চরম ভয়ে আছ নিজেই! যখন রাহুল তাদের মাঝে চাপা থাকা “সব কুছ আনকহা” খুলে বলতে চায়, হেসে উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় সামান্য মেয়েটি। 

 ছোটো ছবিগুলোর মধ্যে “ভার ভার ভারি” (১৯৮৭) গভীর ভাবে পরীক্ষামূলক সৃজন যেখানে ক্যামেরা আর চরিত্র ও বস্তুর সম্পর্কের রূপান্তর ঘটানোর খেলা আছে, যা পরে বিষয় ও আত্মসমীক্ষার বিবরণ হয়ে দাঁড়ায়। খাঁচাবন্দী কালো রাজহাঁস ছটফট করে যেন আপন সত্তার বাইরে ছুটে চলে যেতে চায়। নায়িকা মিতা বশিষ্ঠ (যাঁকে নানা ছবিতে সাহানি সুচারু ভাবে ব্যবহার করেছেন) এখানে ক্যামেরার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে চতুর্থ দেওয়াল ভেঙে দেন। মিতা যেন সাহানির অবচেতনের নারীসত্তার রূপ দেন, এক দৈনন্দিন চরিত্র, যে আধুনিক ব্যবসামুখী যান্ত্রিকতায় আটকা পড়ে।

বিম্ব, শব্দ, অভিনেতা, আর চিত্রগ্রহণের চলনে আলাদা ভাবে নতুন সংঘবদ্ধ চিত্রভাষা উপহার দিয়ে মিতাকে বাসকসজ্জা নায়িকা করে তোলেন সাহানি ( ভরতের নাট্যশাস্ত্রের আট রকমের নায়িকার এক রূপ, যে সালঙ্কারা সুবেশা হয়ে দূরাগত প্রেমিকের অপেক্ষা করে), অথচ এখানে গৌড়মল্লারের সুর তুলে বৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়ে দেখা দেন ভবঘুরে গুরু। বৃষ্টির জলে নারীর দ্যোতক নদী ভাসে আর তীব্র বাতাস ও অশান্ত শাড়ি নারীর বস্তুচেহারাকে তুচ্ছ করে চৈতন্যের বিলোপ ঘটায়। বলা হয়, সাহানির ধারণায় জন্ম নেওয়া অবচেতনের অন্দরমহলের সঙ্গে বস্তুজগতের উপস্থিতির বিরোধকে নায়িকার শরীরে ফুটিয়ে তোলাই ছিল উদ্দেশ্য। তার সখি জোর করে বলে বৈদ্যুতিন বার্তাকে সংকেতে পালটে দিয়ে প্রেমিককে আকর্ষণ করতে। নায়িকা গয়না ও চুল খুলে ফেলে, যা নারীর ধ্বংসাত্মক শক্তির রূপক হয়ে ওঠে, ফিরে যায় মাতৃমূর্তির আদিরূপে। ভার ভার ভারি শুরুর দিকে নানান যন্ত্রপাতির কাজকর্ম দেখানো থেকে অন্তিমে উল্টো মেরুতে গিয়ে এ ভাবে দৈনন্দিন যাপন থেকে মহাকাব্যের পৌরাণিক অভিযাত্রা করার সম্ভাবনার ধারণা দেয়।          

“কসবা” (১৯৯০) ছবিতেও পরবর্তী সময়ের ব্যাধির প্রকট চেহারা দেখিয়ে চলেন পরিচালক। উত্তরপ্রদেশের ছোটো এক শহরের পটে চেখভের “ইন দ্য র‍্যাভাইন” গল্পের অনুসরণে এক অসৎ পরিবারের জীবন দেখানো হয়। বাবার দুই ছেলের বড়টি দিল্লিতে মিথ্যে পরিচয়ে থাকে, দেখা যায় সে নকল টাকার কারবারে জড়িত। ছোটোটি অপ্রকৃতিস্থ, ঘরে বাইরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়, কাংড়া উপত্যকার ম্যুরাল আঁকা ঘর ও দেওয়ালের জীবন্ত রূপ বুঝি সে! সব ফাঁস হয়ে পরিবার বিপদে পড়লে ছোটো ছেলের বৌ, যে আগেই শ্বশুরের সহকারী ছিল, নিজের অধিকার বুঝে নিতে সব কিছুর দখল নিতে থাকে। দৃশ্যগ্রহণ চলে চরিত্রের বাইরের ও মনের চলনের সমান্তরালে। দরজা জানলাকে ব্যবহার করা হয় বাইরের বাস্তবতাকে প্রকট করতে, সামাজিক অবক্ষয় চূড়ান্ত চেহারায় ফুটে ওঠে। দেশের আরও পরবর্তী সময়ে এ যেন মায়াদর্পণে দেওয়া পুর্বাভাসের আরও কদর্য রূপ! ভালো হবার বদলে সব কিছুই যেন নষ্ট  হয়ে চলেছে। 

“খেয়ালগাথা” (১৯৮৯) আরেক ফলক-নির্মাণ, যেখানে চিত্রকাঠামোর পরপর সজ্জায় রাজত্বের অবসানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তনের রেখা ধরা থাকে খেয়ালের সুরের আবহে। সঙ্গীত যে স্মৃতি ঘিরেই আবর্তিত হয়, তা পর্দায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক সংগীতশিক্ষার্থী শোনে কেমন ভাবে খেয়াল অঙ্গের জন্ম ও বিবর্তন হয়েছে। নারী, বিশেষ করে রাণিদের ভূমিকাও এখানে খানিক বিমূর্ত ভাবে হলেও বলা হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় চরিত্রে এই ভাবে বারংবার নারীকে জোরালো আলোয় দেখতে চান সাহানি। এরাও যে মেঘে ঢাকা তারা! নিজের সমস্যার মাঝেই তারা পোক্ত হয়, সচেতন হয়, নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। 

সিনেমাকে সত্যিই বাস্তবের হাত থেকে উদ্ধার করে, তাকে বস্তুনিরপেক্ষ করে, শিল্পিত আগামীর সংকেত দিয়েছেন সাহানি। এ আরেক ধার্মিকতা, যা সারা জীবন ধরে মগ্ন হয়ে পালন করে গেছেন তিনি, পণ্যব্যবসাকে উপেক্ষা করেই! প্রিয় পরিচালকদের প্রভাব স্বীকার করেও তিনি নিজস্ব ঘরানা অর্জনের মাধ্যমে ধ্রুপদী শৈলীতে বাস্তবের কথা বলতে পেরেছেন।  

♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!