Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ১০, ২০২৩

প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি। পর্ব ২

ওই মহিলা লেখক প্রেমাঙ্কুরের জীবনের এক নিটোল ভালবাসার প্রেরণা-প্রতীক । যে ভালবাসা কাছে টানে, আবার দূরে সরিয়ে দেয় । কেন দেয়, যে ভালবাসে, সেই-ই সেই-ই জানে... তারপর

বদরুদ্দোজা হারুন
প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি। পর্ব ২

চিত্রকর্ম: দেব সরকার

 

♦ তিন ♦

কাশীর পর রাজস্থান তাঁকে আকর্ষণ করে চুম্বকের মত। ইতিহাসে যে সমস্ত বীর যোদ্ধাদের বীরগাঁথা শুনেছেন তিনি সেই বীর-ভূমি দর্শন না করলেও  যে মনের আশা পূর্ণ হবে না। শুধু বীর নয়, বীরাঙ্গনাদেরও রণভূমি রাজস্থান। এঁদের নিয়ে নানা কিংবদন্তী সারা ভারতব্যাপী ছড়িয়ে আছে। দেশ বা বিদেশের যে কোন বহির্শুত্রুর হাত থেকে জন্মভূমির মাটিকে রক্ষা করার জন্য তাঁদের মত আত্মত্যাগের  নজির বিশ্বের ইতিহাসে নাই বললেই চলে।
 
দুর্ভেদ্য ‘ভরতপুর’ দুর্গের নাম শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যদি কখনও সুযোগ আসে, তবে রাজস্থান গিয়ে সর্বপ্রথম ঐ দুর্গটি পরিদর্শন করেবেন। নইলে তো তাঁর ভারত দর্শন সম্পূর্ন হবে না।
 
স্বল্পমেয়াদী সে দর্শন। বীর বা বীরাঙ্গনাদের স্মৃতি যেন ইতিহাসের ফসিল! অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার ধ্বনি! বীরত্ব নয়, যেন প্রেমের দীর্ঘমেয়াদী দীর্ঘশ্বাস, হন্তা ও হন্তারকের বিলাপধ্বনি!
 
এসব নিয়ে বেশি না ভেবে বাস্তবের রুক্ষ ভূমিকে বেশি করে চিনতে চেয়েছেন তিনি। খুব নিকট থেকে দেখেছেন দেহাতি মানুষদের নিজস্ব চালচলন, জীবিকা নির্বাহ, সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক  জীবনকে। কল্পনার ফানুস আর বাস্তবের মানুষ-এর মধ্যে তফাৎ যেন আকাশ আর পাতাল! তাই কারও দ্বারে হাত পেতে  নয়, যে ক’দিন থেকেছেন খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গে খেটে খেয়েছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’পইসা উপার্জন করেছেন ।
 
না, রাজস্থানে তিনি খুব বেশিদিন থাকেননি। থাকতে মন চায়নি বলে। আসলে বোহেমিয়ান জীবনযাপনে এতখানি অভ্যস্থ ছিলেন যে, সবসময় তাঁর মনে হত, এক জায়গায় বেশিদিন থাকা মানেই বেশি বেশি সময় নষ্ট করা, দেখার সুযোগ হাতছাড়া হওয়া। কারণ জীবন অনন্ত নয়।
 
এরপর তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের পথে,  হৃদয়ে  ও মনে দুরন্ত শক্তির দুর্বার আবেগে। অতীশ দীপঙ্করের ছায়া-উপস্থিতি টের পেয়েছিলে অন্তরের-অন্তর্স্থলে। পদব্রজে সেই শক্তির অবিরাম সঞ্চালন।  তাঁর মনে হয়েছিল, পথের থেকে ভাল বন্ধু আর কেউ  নেই, পথের চেয়ে ভাল শিক্ষকও কেউ নেই। পথের দুপাশের সারি সারি গাছপালা, সারি সারি মানুষের চলাফেরা সবের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃতির লীলা।
 
মহারাষ্ট্রের মাটি ছুঁয়েই তাঁর মনে হয়েছিল, এই সেই  মহারাষ্ট্র, যেখানে প্রবল মোঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন ছত্রপতি শিবাজী। নিজের ভেতরের অমিত-শক্তি তাঁকে মদমত্ত করে তুলেছিল। জন্ম-স্বাধীন তিনি। কে তাঁকে কারাগারের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করতে পারে! বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে হার মানে রাজ-পরাক্রমও। অদ্ভুত সে বৃত্তান্ত, চুম্বকের মত টানে বালক সন্যাসীকে।
 
সন্যাসী তিনি নন হয়ত। ভোগ-বাসনার দ্বার রুদ্ধ করার ইচ্ছাও তাঁর ছিল না বলে। কারণ ওই বয়সেই তাঁর উপলব্ধি জগৎ-সংসার অচল হয়ে যাবে সবাই সন্ন্যাসী হলে। ঈশ্বরের নিয়মেই জগৎ চলে। ঈশ্বরের নিয়মেই মানুষকেও  চলতে হয়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। মেনে নিতে ঈশ্বরসৃষ্ট বৈচিত্র্যসম্ভারকে। শিবাজী মহারাজকে নিয়ে বেশি ভাবনার অবকাশ তাঁর ছিল না। দিন মজুরের বিলাসিতা সাজে না। ভিখীরিদের সঙ্গে যাঁকে বাস করতে হয়, যাদের সঙ্গে খাবার কাড়াকাড়ি খেতে হয়, তারাই হল মহারাষ্ট্রের আদি মানুষ, মাটির গন্ধ তাদের গায়ে। প্রেমাঙ্কুর তাঁর ডাইরির পাতায় এদের কথাই লিখে রাখেন নিপুণ-নির্ভয়তায়। আর ‘মহাস্থবির জাতক’- এ তাঁর এই বুম্বাই ভ্রমণের কথাকে তুলে ধরেন আশ্চর্য  কলম-কুশলতায়।
 

ওস্তাদ কেরামতুল্লাহ খাঁ সাহেব তখন বোম্বেতে সেতারের বেতাজ বাদশা। বহু চেষ্টা চরিত্র করে একদিন পৌঁছে যান খাঁ সাহেবের দরবারে। প্রথম মোলাকাতেই বাজিমাৎ। আনাড়ি হাতের বাজনায় সন্তুষ্ট হন ওস্তাদজি। সাগরেদ হিসেবে স্বীকৃতি দেন তাঁকে

 
শিহরিত রোমাঞ্চকর সে কাহিনী। সে কাহিনী থেকে জানা যায় বোম্বে মহানগরীতে এসে কিভাবে এক সবজি বিক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলে,—’পয়সা এখানে উড়ে বেড়াচ্ছে। তোমার মত পালোয়ান ছেলের আবার খাবারের চিন্তা! মাথা আর হাত যখন আছে তখন  যা তা করে খেতে পারবে। চল, মহাজনের কাছে বিনি পয়সায় তোমাকে ধাম ভরে সবজির ব্যবস্থা করে দিই। মাথায় নিয়ে বিক্রি করে বেড়াবে, মহাজনের দেনা মেটাবে, আর লাভের পয়সার খাবে।’ সব্জি বিক্রেতার কথায় ভরসা জন্মে তাঁর মনে। ফলে বস্তি এলাকায় যেমন সাময়িক আশ্রয় মিলে, তেমনি দু’-চারদিন সব্জি বিক্রেতার সঙ্গে ঘোরার পর সবজি বিক্রেতা তাঁকে একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, ‘আমি হলাম অমুক সাহেবের বাড়ির হাউস সার্ভেন্ট। যদি বল, ওনাদের বাড়ির গ্যারেজে তোমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারি। সকাল সন্ধ্যায় গাড়ি ধোয়া-মোছার কাজ।’ প্রস্তাবটি প্রেমাঙ্কুরের মনে ধরে এবং বেশ সহজেই কাজও জুটে যায় তাঁর। দু’চাকা ও চার চাকা মিলিয়ে গাড়ির সংখ্যা পাঁচ।
 
সকাল সন্ধ্যায় কাজ তাঁর। তারপর হাতে অঢেল সময়। সময়টা নষ্ট করেন না। বই পড়ে কিম্বা ছবি এঁকে কাটিয়ে দেন। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে পড়াশোনা করে অজানাকে জানার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে। এদিকে ভাষা-চর্চার নিরিখে হিন্দি ও উর্দু দু’ই ভাষাতেই চোস্ত হয়ে ওঠেন অচিরেই। কাজ চালাবার মত ইংরেজি বিদ্যাও আয়ত্ত করে ফেলেন। ব্যাগপত্রের মধ্যে একটা পুরনো সেতার থাকে সবসময় তাঁর কাছে। কোন এক ফকির সাহেবের দেওয়া। তিনি বলে দিয়েছিলেন, ‘ব্যাটা মন খারাপ হলে এটা নিয়ে বসবি।’ তাই বাড়িয়ে বাগানের একটি গাছের বাঁধানো বেদিতে বসে মাঝে মাঝে সুর তোলেন সেতারে। সেই বাড়ির ছোট ছেলে দূর থেকে তাঁর সব কার্যকলাপ দেখে। তারপর একদিন স্বেচ্ছায় আলাপ করে তাঁর সঙ্গে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে ছেলেটি তাঁর বাবাকে বলে–’আসলে উনি মাস্টারজি। অনেক কিছুই জানেন।’ ফলে ছেলেটির বাবা প্রেমাঙ্কুরকে গ্যারেজের কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে  ছেলের গৃহ শিক্ষিক হিসেবে  নিয়োগ করেন। খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কিছু টাকা জমতে থাকে হাতে। একটা ভাল সেতার কেনার ইচ্ছা জাগে তাঁর মনে। পরক্ষণেই মনে হয় ভাল করে না শিখে ভাল জিনিস কিনলে তার কদর রাখা যাবে না। তাই তাঁকে আরও সাধনা করে যেতে হবে। সাধনা ছাড়া সিদ্ধি মেলে না, কাশীর ঘাটে সেই ফকির সাহেব যে তাঁকে বলেছিলেন একদিন।
 
ওস্তাদ কেরামতুল্লাহ খাঁ সাহেব তখন বোম্বেতে সেতারের বেতাজ বাদশা। বহু চেষ্টা চরিত্র করে এবং এক সুহৃয় ব্যক্তির সহায়তায় একদিন পৌঁছে যান খাঁ সাহেবের দরবারে। প্রথম মোলাকাতেই বাজিমাৎ। তাঁর আনাড়ি হাতের বাজনায় সন্তুষ্ট হন ওস্তাদজি। সাগরেদ হিসেবে স্বীকৃতি দেন তাঁকে। তারপর ওস্তাদজির ডেরায় নিয়মিত তালিম চলে। খাঁ সাহেব কখনও বুকুনি দেন, কখনও বা আদরে পিঠ চাপড়িয়ে দেন। মাঝে মাঝে আওয়াজ শুনা যায় তাঁর মুখ থেকে–বাহ্ বেটা বাহ্! বহুত খুব!
 
সেতারে সিদ্ধি জোটে তাঁর। কিন্তু সিদ্ধ পুরুষ তো  কোথাও এক জায়গায় বেশিদিন বাঁধা থাকেন না। প্রেমেঙ্কুর সেই অর্থে সিদ্ধ পুরুষ নন হয়ত। কিন্তু সিদ্ধ পুরুষের মন যে তাঁর। তাই একদিন নীরবে বোম্বে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন পথে।
কিন্তু কোথায় যাবেন!  গন্তব্যস্থল বোধহয় পূর্ব নির্ধারিত ছিল। আগ্রায় তাজমহল দেখার বাসনা তাঁর মনে তখনই জেগেছিল, যখন শিশুপাঠ্য বইয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক অন্যতম আশ্চর্য আগ্রার তাজমহল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাজমহলের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
 
মহাকবি তিনি। তিনি জানেন  বীরত্বের মধ্যে অহং থাকে, যা অনেক সময় কদর্য্যে রূপান্তরিত হয়। কিন্ত প্রেম-সৌন্দর্য্য অন্তরের সৌন্দর্য্য; পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য্য ম্লান হয়ে যায় সেই   সৌন্দর্যের কাছে। বীরের তরবারি লুটিয়ে পড়ে সৌন্দর্য্য-ময়ী প্রেমিকা নারীর পায়ের কাছে। মোঘল-গৌরব, দিগ্বিজয়ী সম্রাট শাহজাহানকে বাংলার কবি-সম্রাট সেই সৌন্দর্যের মুকুট পরিয়ে দেন শিরে। মমতাজের প্রতি শাহজাহানের  প্রেম সেই সৌন্দর্য্যের প্রতীক। তাই তাঁর  মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তিলে তিলে তিনি গড়ে তোলেন  তিলোত্তমা  তাজমহলকে–সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি করে। বিশ্ববন্দিত কবি তাঁর হৃদয-সৌন্দর্য্য উজাড় করে আর এক সম্রাট -কবির বন্দনা-গীতি রচনা করেন হৃদয়ের গভীর আবেগ-মূর্ছনায়–
 
“হে সম্রাট কবি,
এই তব হৃদয়ের ছবি
এই তব নব মেঘদূত,
অপূর্ব অদ্ভুত
ছন্দে গানে
উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে
যেথা তব বিরহিনী প্রিয়া….”
 
চিরনবীন, চির সবুজ কবির কাছে তাজমহল যেন-  ‘কালের কপোল তলে শুভ সমুজ্জ্বল’ এক বিন্দু নয়নের জল  বলে প্রতিভাত হয়।
 
কাশী-বৃন্দাবনে ফেলে আসা প্রেমাঙ্কুরের হৃদয়ের হাহাকার স্থিত-প্রাজ্ঞে শান্ত হয় তাজমহলের  সৌন্দর্য্য-গাঙে অবগাহন করে। তাঁর মন ‘spiritually, literally and musically নান্দনিকতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে এখানে। অধ্যাত্মবাদ তো গভীর থেকে গভীরতম উপলব্ধিবাদ। পতঞ্জল যোগসূত্র যেমনটি শ্রেয়বাদের সমাধান করে জীব-জড়র পার্থক্যকে নস্যাৎ করে ঘোষণা করে–’কালক্রমে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরীয় গুণের বিকাশ ঘটবে। প্রতিটি জীবের, এমনকি প্রতিটি প্রস্তর খন্ডেরও।’
ঈশ্বর স্বয়ং স্কল্পনা-প্রবণ, মর্ত্যলোকে মানুষও তার উপাস্য ঈশ্বরের মতই কল্পনাপ্রবণ। বাস্তবই নশ্বর, কল্পনাই অবিনশ্বর। পৃথিবীর একসঙ্গে  আবর্তন ও প্রদক্ষিণের ক্ষমতা আছে, লাটিমের শুধু  আবর্তনের ক্ষমতা আছে, প্রদক্ষিণের ক্ষমতা নেই। তাই কয়েক পাক ঘুরেই সে ছিটকে পড়ে। বৃহৎ-অর্থে পৃথিবীও একটি লাটিম। একদিন না একদিন সেও ছিটকে পড়বে মাধ্যকর্ষণ-চ্যুত অন্ধকারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তবু সৌর জগৎ থাকবে, আরও বৃহত্তর মাধ্যাকর্ষণ তাকে আকর্ষণ করবে। পৌনঃপুনিক-ভাবে এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সবই একসঙ্গে চলছে, চলতেই থাকবে, হয়ত তার ফর্ম বদলাবে, রূপকল্প  বদলিয়ে  অরূপের পথে থাববান হবে।
 
অস্থির আতর্থী! তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে–আমি পুরো সন্যাসী নই, পুরো গৃহী নই, তবে আমি কে? ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মহা-আনন্দময় মুক্তির স্বাদ’— কবিগুরুর অভয়-মন্ত্রে দীক্ষিত প্রেমাঙ্কুরের উতলা-মন  উচ্ছ্বসিত আনন্দে করতালি দিয়ে ওঠে।
এরপর  আগ্রার পথে পথে প্রেম-সৌন্দর্য্যে বুঁদ হয়ে প্রেমাঙ্কুর বেশ কয়েকদিন ঘুরতে থাকেন। খাবার জোটে ভিখিরীদের সাথে। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। কবে কৃষ্ণপক্ষের অবসান হবে, আর  দু’চোখ ভরে দেখবেন জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে তাজের সেই অলৌকিক সৌন্দর্য্যকে অলৌকিক চোখে !
 
কয়েকদিন পরেই প্রতীক্ষার অবসান হলো। তিনি দেখলেন। পুলকিত চিত্তে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে সেই   অপলক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখলেন!  যেমনটি লোককথনে আছে– ‘গভীর রাতে কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে  শাজাহানের ময়ূর সিংহাসন শূন্যে ভাসে, আর অদূরে দাঁড়িয়ে শাহজাহানের দিল-আফরোজ মমতাজমহল  মিটিমিটি হাসে।’
 
সত্যিই কি তিনি দেখেছিলেন ! না, তাঁর প্রাণ-কুহকিনী কাশীর সেই সন্ন্যাসিনী-রাজকুমারী তাঁর চোখে বিভ্রমের মায়াজাল বিস্তার করেছিলেন ! তাই এতদিন পরে আগ্রার তাজমহলের পাশে  এসে  আবারও সেই আলিঙ্গনে ভূপতিত হলেন প্রেমাঙ্কুর ! কিন্তু তাঁর বক্ষ-নিষ্পেষণে বোধহয় শ্বাস আটকিয়ে গেলো তাঁর। শিহরিত যন্ত্রণায় কুব্জ ও ন্যুব্জ হয়ে পড়লো শিরদাঁড়া। একসময় জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইলেন তিনি  ঘণ্টার পর ঘন্টা।
 
সজ্ঞানে ফিরলেন যখন, তখন পাখির কলকাকলিতে  দিগ্বিদিক মুখর। যমুনার প্রেমসিক্ত মিষ্টি হাওয়া যেন ‘প্রেমিকার উড়নি’!  তাঁর গাল, চিবুক ছুঁয়ে রাতের সব গ্লানি মুহুর্তে মুছে দিলো, তারপর আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে যেন কোথায় মিলিয়ে গেলো …! প্রেমাঙ্কুর দুই হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন, পারলেন না।
 

♦ চার ♦

এইরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার ডালি ষোল আনায় পূর্ণ  করে পরিব্রাজন-জীবন সমাপ্ত হলো তাঁর।  ফিরে এলেন  কলকাতায়, কানাইয়ের বাঁশিটিকে  সম্বল করে ।
 
তবে এবার তাঁর অন্তরাত্মা বলল – ‘বাঁশিটিকে রাখতে হবে এখন। কর্মযোগ ডাকছে তাঁকে।’ হ্যাঁ, ঠিকই তো। সে ডাকে সাড়া দিতেই তো তাঁর এই কলকাতায় ফেরা। প্রথমেই শুরু হয়  কলকাতার পথে পথে ঘুরে পুরনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার পালা। চলে কিছুদিন। সেদিনের বারো বছরের বালক আজ পূর্ণ যুবক। তাঁর সেদিনের বন্ধুরা নানা পেশায় যুক্ত এখন। দু’ চারজন লেখাপড়া শিখে ভাল চাকরিও পেয়েছে। তবে বেশিভাগই ছোটখাটো ব্যবসা বা দোকান কর্মচারী হিসেবে নানা জায়গায় নিযুক্ত। আর যেহেতু প্রেমাঙ্কুরের কোন কাজে আপত্তি নেই, তাই তাঁর কাজেরও অভাব নেই। বিচিত্র কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনই তাঁর লক্ষ্য, তাঁর কর্মযজ্ঞের ধারাপাত।
 
এ দুনিয়া এক আজব খেলার জগৎ ! ঘটনাক্রমে তিনি এই খেলার জগতের সঙ্গে আচমকাই জড়িয়ে  গেলেন। চৌরঙ্গীর এক খেলার দোকানে ম্যানেজার পদে চাকরি পেলেন। আর সেই সুবাদে তিনি খেল দুনিয়ার বহু মানুষের সংস্পর্শে এলেন। আর সহসাই যেন খেল-দুনিয়ার ভিল্কি দেখলেন! আর এই ভিল্কি থেকেই   শুরু হয়ে গেল  তাঁর লেখালেখির জীবন।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন তিনি। ‘বৈকালী’, ‘জাদুঘর’, ‘ভারতবর্ষ’,  ‘সংকল্প’, ‘নাচঘর’, ‘হিন্দুস্থান’ ও ‘ভারতীয়
 
পত্রিকা’র মত তৎকালীন সব নামজাদা পত্রিকায় সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে লেখালেখির জগৎ উড়ে  এসে বসল তাঁর হাতের চেটোয়। একে একে প্রকাশ হতে থাকল তাঁর চরিত্র-মানসের সঙ্গে  সঙ্গতিপূর্ণ  লেখার ভুবন।   অচিরেই তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ চমতকৃত করতে  থাকলো বাঙালি পাঠককুলকে।
 
প্রথম ধাপেই সেই চমৎকারিত্বের উদঘাটন ঘটে আকাশবাণীর সঙ্গে তাঁর মানসিক-সংযুক্তিকরণে। লোকপ্রিয়তার নিরিখে এ এক অসাধারণ সংযুক্তিকরণ! তবে শ্লাঘার বিষয় এই যে,   আকাশবাণীর বাংলা মুখপত্র ‘বেতার জগত’-র তিনি হলেন প্রথম সম্পাদক।
 

চলচ্চিত্র ইয়াদো কি লড়কির পোস্টার

১৯২৯ সালের ২৬ শে আগস্ট কলকাতা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচি-জ্ঞাপক পাক্ষিক পত্রিকা ‘বেতার জগৎ-এর প্রথম প্রকাশ হল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের উদ্যোগে। আর তার প্রথম সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁরই উপর। ‘বেতার জগৎ’ নামটি  এসেছিল বীরেন রায়ের মাথা থেকে। আর সেই নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর  দক্ষ সম্পাদনা থেকে। অল্পদিনের মধ্যেই এই পত্রিকার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। বাংলার রসগ্রাহী বুদ্ধিজীবি ও তরুণ সমাজের কাছে বেতার জগৎ তখন যেন মহাকাশের বার্তা নিয়ে ভেসে  আসা দৈবীবাণীর মতই অলঙ্ঘনীয়! অমোঘ তার আকর্ষণ! মাত্র দু’বছর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। আর এর মধ্যে পত্রিকাটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এরপরই নলিনীকান্ত সরকারের হাতে সম্পাদনার দায়িত্বভার  তুলে দিয়ে তিনি ‘নিউ থিয়েস্টারর্স’- এ যোগদান করেন। নলিনীকান্ত সরকার অবশ্য দীর্ঘ ১৩ বছর বেতারজগৎ-এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন  বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।
 
বৃহৎ অর্থে জীবন তাঁর কাছে অর্থবহ ছিল না। জীবন ছিল তাঁর কাছে চলমান স্রোতের মধ্যে ভাসমান একটি বিবর্ণ পাতা বা খড়কুটোর মত অতি সাধারণ নগন্য জিনিসমাত্র। তাঁর মনে হতো চলচিত্রের সঙ্গে  জীবনচিত্রের যেন এক আশ্চর্য মিল রয়েছে। নির্বাক চলচিত্র থেকে যখন সবাক চলচিত্রের যুগ এল, তাঁর মনে হল, প্রথম মানব শিশুর মুখে যেন কথা ফুটলো।  ‘দেহের মৃত্যু হয়, জীবন বেঁচে থাকে’ – এই চিরন্তন স্রোতে–ক্ষুদ্র জীবন ভেসে যায় মহাজীবনের স্রোতে। মহাজীবন  তার বৃহৎ জীবনকে দেখে  নির্লিপ্ত উদাস চোখে, আর অনুজীবনগুলো  প্রেক্ষাগৃহের বিভিন্ন আসনে বসে উত্তাল হাওয়ায় কেঁপে ওঠে, কখনও বা হেসে ওঠে, কখনও বা দমকা-ঘূর্ণিতে উড়তে থাকে। কারণ বৃহৎ জীবনের আসন বা সিংহাসন প্রেক্ষাগৃহের  অনেক উপরে, এক বিশেষ সংরক্ষিত স্থলে, যেখান থেকে কেবল তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজই শোনা যায়। মানব-জীবনের তখন পুনর্জন্ম হয়, একবার নয়, বহুবার, একটু একটু করে অবয়ব বদলায়। এই বোধ তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’-এর স্তরবিন্যাসে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে এবং তার প্রথম সূচনা  হয় ‘পূর্ণজন্ম’  নামক বাংলা চলচিত্রে। এখান থেকে যে বোধ  তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল হয় এবং সেই বোধই  তাঁর জীবন-নৈবেদ্য হিসেবে অনুঘটকের কাজ করে। ‘পুনর্জন্ম’ চলচিত্রটি নির্মাণের মধ্যেই  তাঁর  ডাক আসে লাহোরের এক বিশিষ্ট চলচিত্র প্রতিষ্ঠানে থেকে।
 
তবে লাহোর-বাস তাঁর জীবনে স্বল্পস্থায়ী বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। কারণ  অল্প কিছুদিন পরই নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড কোম্পানি তাঁকে  কলকাতায় ফিরে এসে চিত্র-পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব পাঠায়। তিনি সে প্রস্তাব  গ্রহণ করে লাহোরের পাট চুকিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। এখানে একের পর এক চলচিত্র-সৃজন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর পরিচালিত চলচিত্রগুলির মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে–’দেনাপাওনা’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দিকশূল’, ‘ভারত কী বেটি’, ‘ইহুদী কী লড়কি’, ‘সুধার প্রেম’ – এর মতো চলচ্চিত্র জগতের অনবদ্য সৃজনগুলি।
 

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পর্দায় দেখে  ধরাছোঁয়ার বাইরে জগতের মানুষ  বলে দর্শক যখন মনে করতো, তখন তাঁদের থিয়েটারে নিয়ে এসে  আমজনতার সঙ্গে পরিচিতিকরণের অনুঘটকের কাজটিও  করে দিয়েছিলেন প্রেমাংকুর আতর্থী, স্বপ্নের মানুষদের নামিয়ে এনেছিলেন মর্তের মাটিতে

 
শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাস নিয়ে ‘দেনাপাওনা’ চলচিত্রটিক বাংলার প্রথম চলচিত্রায়ণের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা উঠে তাঁর শিরে। যদিও এর কয়েকমাস আগে ‘বিল্বপত্র’ নামে চিত্রটি সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল, কিন্তু গ্রহণ-যোগ্যতার নিরিখে  ‘দেনাপাওনা’ই প্রথম জনচিত্তস্পর্শী সেই অতলস্পর্শী চলচিত্র, যা জন-মানসকে জয়  করেছিল।  কারণ হিসেবে বলা চলে কাহিনিকার ও পরিচালক উভয় মনের  মণিকাঞ্চনযোগের মধুর রসায়নই এর কারণ।  ‘দেনাপাওনা’-কে  প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নিজের প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় যেভাবে জীবন্ত করে তোলেন, তা শুধু সমসাময়িক কাল বলে নয়,  শুধু বাংলা বা ভারত বলে নয়, বিশ্ব-চলচ্চিত্র জগতেও এক নন্দিত  ঘটনা ।
 

প্রেমাঙ্কুর আতর্থি পরিচালিত, নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত উর্দু চলচ্চিত্রের পোস্টার ।

অন্যদিকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পর্দায় দেখে  ধরাছোঁয়ার বাইরে জগতের মানুষ  বলে দর্শক যখন মনে করতো, তখন তাঁদের থিয়েটারে নিয়ে এসে  আমজনতার সঙ্গে পরিচিতিকরণের অনুঘটকের কাজটিও  করে দিয়েছিলেন প্রেমাংকুর আতর্থী, স্বপ্নের মানুষদের নামিয়ে এনেছিলেন মর্তের মাটিতে। সেকালে ‘নিউ থিয়েটার’-এর জনপ্রিয়তার জন্য তাঁর এই অভিনব প্রবাস যে একটি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল   সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। নিউ থিয়েটারে নাটক দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে যেভাবে হুড়োহুড়ি পড়ে যেতো তা ছিল এক রেকর্ড ঘটনা। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপ্ত’ নিউ থিয়েটার্স হয়ে উঠেছিল সেকালের বাঙালিদের ‘বিনোদনের ইডেন’।
 
১৯৩১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, ‘বীরেন্দ্রনাথ সরকার’ নাম যুক্ত করে যে স্টুডিওটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে কাজ করার সুবাদে বাংলার স্বর্ণযুগের বহু খ্যাতনামা শিল্পী  সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা অভিনেত্রী, কলাকুশলী ও যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর।  প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে  আসেন কুন্দলাল সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ছবি বিশ্বাস, পৃথ্বীরাজ কাপুর, বসন্ত চৌধুরী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, কানন  দেবীর মত  কিংবদন্তি শিল্পীরা।  প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু, নীতিন বসুর মত প্রখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে অবাধ বন্ধুত্ব ও মত বিনিময়ের অঢেল সুযোগ হয় তাঁর। ‘দেনাপাওনা’র চিত্রগ্রাহক ছিলেন নীতিন বসু, সুরকার নৃপেণ মজুমদার ও রাইচাঁদ বড়াল। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৩১।
 
বাংলার চলচিত্র জগতের ইতিহাসে ‘জামাইষষ্টি’ প্রথম সবাক রম্যছবি হিসেবে পর্দায়  প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ‘ম্যাডান থিয়েটার’ কোম্পানির দৌলতে। এই ছবিটি প্রদর্শিত হয় ‘ক্রাউন সিনেমা’ হলে। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন অমর চৌধুরী, প্রযোজনায় ছিল ম্যাডান থিয়েটার। কিন্তু ‘দেনাপাওনা’ই সর্বপ্রথম দর্শক-মন জয় করে শীর্ষে পৌছেছিল। কারণ সেখানে দুই অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র ও প্রেমাঙ্কুরের   মানস-যোগ ছিল।
 
ক্রমশ…

♦—•—♦♦—•—♦♦—•—♦

 
আগের পর্ব পড়ুন»

প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!