Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৯

হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছালাম কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে। এখানে সকলের সচিত্র পরিচয়পত্র এবং পার্ক ফি জমা দিলে তবেই গোচেলার পথে হাঁটবার আদেশনামা পাওয়া যাবে...তারপর

ফাল্গুনী দে
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৯

অলঙ্করণ: দেব সরকার


ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ 

♦ পর্ব ৯ ♦

পশ্চিম সিকিমের প্রান্তিক শহর ইয়াকসম একসময় সে দেশের চোগিয়াল রাজত্বের প্রাচীন রাজধানী ছিল। অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এই শহরের পাইন জঙ্গলে, তমসাঘোর পোখরির জলে, আর বৌদ্ধ গুম্ফার দেওয়ালে আজও লেগে আছে ইতিহাসের ধুলো। প্রায় চারশো বছরের পৌরাণিক সেই আখ্যান ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সিকিমের রাজতন্ত্র। ১৬৪১ সালে বৌদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সিকিম রাজ্যের প্রথম চোগিয়াল বা ধর্মীয় রাজা হিসেবে ফুন্টসোগ নামগিয়াল নামক এক শাসকের অভিষেক হয়। ঝুলন্ত পাহাড়ি অর্কিডে সুসজ্জিত এবং বিশাল ডালপালা ছড়ানো সিকিমের প্রাচীনতম একটি পাইন গাছের নিচে প্রশস্ত চাতালের উপর প্রস্তুত করা হয় পাথরের তৈরি রাজ সিংহাসন। চাতালের মুখোমুখি ঠিক উল্টোদিকে নির্মাণ করা হয় রাজবাড়ির ঐতিহ্য বহনকারী উঁচু সাদা নরবুগাং চোর্তেন। অদূরে পবিত্র হ্রদ কাথোগ পোখরি। সিকিমের প্রথম রাজার রাজ্যাভিষেক স্থান হিসেবে বিখ্যাত এই জায়গাটির নাম ‘করোনেশন থ্রন অফ্ নরবুগাং’। অভিষেক কার্য পৌরহিত্য করতে লালচে গেরুয়া পোশাকে এবং হলুদ উত্তরীয় গায়ে তিব্বত পাহাড়ের তিন দিক থেকে এলেন তিনজন পবিত্র বৌদ্ধ লামা। উত্তর দিক থেকে প্রধান লামা লাতসুন চেম্বো (ঘটনাস্থলে পাথরের উপর যাঁর ডান পায়ের ছাপ আজও অমর অক্ষয়), পশ্চিম দিক থেকে শেম্পা চেম্বো এবং দক্ষিণ দিক থেকে রিগজিং চেম্বো। উত্তর পশ্চিম আকাশে অনন্ত শয্যায় শায়িত শ্বেতশুভ্র স্বয়ং ভগবান গৌতম বুদ্ধকে সাক্ষী রেখে রাজার মাথায় পবিত্র জলসিঞ্চন এবং সম্মিলিত জয়ধ্বনি দিয়ে অভিষেক সম্পন্ন হয়। প্রেয়ার ফ্লাগ এবং তিব্বতি স্কার্ফ দিয়ে সাজানো সমগ্র এলাকাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় সিকিমের রাজতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে। এই ঘটনার অর্ধ শতাব্দীর পরে, ১৭০১ সালে সিকিমের প্রথম বৌদ্ধ গুম্ফা ‘দুবদি মনেস্ট্রি’ স্থাপন করা হয় চোগিয়াল রাজাদের আমলে। ১২ জন রাজার বংশ পরম্পরায় প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের রাজত্বে (১৬৪১ –  ১৯৭৫) বৌদ্ধ ধর্মের জন্য নিবেদিত প্রাণ চোগিয়াল শাসকেরা নানান সংস্কার মূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।
 
বর্তমানে প্রায় হাজার চারেক মানুষের বসতি এই ইয়াকসম শহরের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে ইকো ট্যুরিজিমের ওপর। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক এখানে ভিড় করেন অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে। এই ইয়াকসম থেকেই উত্তর অভিমুখে জংরি-গোচেলার পথে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় পবিত্র কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এবং সিকিমের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হয়। তাই সিকিমের দিক থেকে ট্রেকিং করা অথবা HMI এর বেসক্যাম্প পরিচালনা অনুমোদিত হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর আরোহণ প্রবল ভাবে নিষিদ্ধ।
 
আজ ১৯ অক্টোবর। উষ্ণ চা পানের এই মনমরা সকালে ইয়াকসমের দূরতম পাহাড়ি হোটেলে আমরা আটকে পড়েছি প্রকৃতির প্রবল নিষেধে। অনেক দেরিতে ঘুমাতে গেলেও উঠে পড়েছি বেশ সকাল সকাল। চারতলা এই হোটেলের প্রায় সব ঘরেই গোচেলার পথে হাঁটতে আসা ট্রেকিং দল জায়গা করে নিয়েছে। সময় গড়িয়ে গড়িয়ে বেলা আটটা। ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দেবার জন্য আমরা ছটফট করছি কিন্তু গাইডের তরফ থেকে এখনও কোনও সবুজ সংকেত আসেনি। হোটেলের জানলা থেকে রওনা দিয়ে আমাদের দৃষ্টি একহাতও এগোতে পারে না এই অনন্ত ফুলস্টপ বৃষ্টিকে ভেদ করে। অগত্যা বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখি এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যেও স্কুলের পথে ছেলেমেয়েরা হেঁটে চলেছে বাহারি ছাতা মাথায়। পরিশ্রমসাধ্য পাহাড়ি জীবনে এই সামান্য ঝড় বৃষ্টি খুব একটা প্রভাব না ফেললেও, ট্রেকিংয়ের অজানা পথে ধ্বস নেমে বিপদ বাড়বার সমূহ আশঙ্কা। বেলা ন’টা, আপাতত আমাদের দলের মনোভাব সবুর করো মেওয়া ফলবে। নিচে নেমে হোটেলের ড্রয়িং রুমে সোফায় পা দুলিয়ে চাপ দিলাম টিভির রিমোটে। পশ্চিম থেকে পূর্ব সমগ্র হিমালয় জুড়ে প্রবল ঝড় বৃষ্টির খবর টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে। হঠাৎ বাইরে বিশাল শোরগোল। উল্টোদিকের ঘরে তখন হন্তদন্ত হয়ে আপাদমস্তক কাক ভিজে একটি দল পাহাড় থেকে এইমাত্র নেমে এলো। ফিরেই ব্যাগপত্র জুতো জামা যেদিকে খুশি ছুড়ে ফেলে প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় ছুটে বেড়াচ্ছে ঘরের এদিক-ওদিক। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গোটা গায়ে কড়ি আঙ্গুলের মত মোটা মোটা অন্তত খান দশেক রক্তে পুষ্টল জোঁক ছেঁকে ধরেছে লোকটিকে। টেনে ছাড়িয়ে লবণ দিয়ে মারতেই রক্তারক্তি কাণ্ড। গতকাল রওনা দিয়ে এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে সাচেনের জঙ্গল ক্যাম্পে একপ্রকার উপায়হীন ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেছে এরা। সময় বেলা এগারোটা। আমরা কার্তিক ঠাকুরের মতো সেজে বসে আছি। অন্যদিকে আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে দলে দলে ট্রেকাররা নেমে যাচ্ছে আরও নিচে। তাদের চোখে পাহাড়ের আরও উপরে ভয়াবহতার ছবি স্পষ্ট। এসব দেখে শুনে আমাদের দলের মনোবল প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
 

উত্তর দিক থেকে প্রধান লামা লাতসুন চেম্বো, পশ্চিম দিক থেকে শেম্পা চেম্বো এবং দক্ষিণ দিক থেকে রিগজিং চেম্বো। উত্তর পশ্চিম আকাশে অনন্ত শয্যায় শায়িত শ্বেতশুভ্র স্বয়ং ভগবান গৌতম বুদ্ধকে সাক্ষী রেখে রাজার মাথায় পবিত্র জলসিঞ্চন এবং সম্মিলিত জয়ধ্বনি দিয়ে অভিষেক সম্পন্ন হয়। প্রেয়ার ফ্লাগ এবং তিব্বতি স্কার্ফ দিয়ে সাজানো সমগ্র এলাকাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় সিকিমের রাজতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে

 
এরই মধ্যে দুর্যোগ খানিক শান্ত হলে, অবশেষে বেলা বারোটা নাগাদ রেনকোট গায়ে এবং ছাতা মাথায় আমরা পায়ে পায়ে দুরুদুরু বুকে সাচেনের পথে রওনা দিলাম। এই অনন্ত নেমে যাওয়ার বিপরীতে আমাদের এগিয়ে চলা দেখে গ্রামবাসীদের চোখে বিস্ময়। নির্দিষ্ট সময়ের থেকে আমরা পিছিয়ে রইলাম অন্তত ঘন্টা চারেক। দ্রুত হেঁটে ক্ষতি যে খানিক মেরামত করে নেব সে উপায় নেই। কারণ পাথুরে এবড়ো খেবড়ো পথ তার উপর বৃষ্টি ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে পিছোল এবং প্রায় হাঁটু অব্দি কাদা। মাত্র ২২ বছর বয়সে অকাল প্রয়াত কল্পনা লিম্বুর স্মৃতিবিজড়িত যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে ব্যাগপত্র আরেকবার শক্ত করে বেঁধে নিয়ে দেখি গ্রাম ছাড়িয়ে খাড়া রাস্তা উঠে গেছে আরও উপরে। বৃষ্টি থামবার কোন লক্ষণ নেই। খাদের বহু নিচে পাহাড়ি প্রতিরোধকে অগ্রাহ্য করে বয়ে চলেছে খরস্রোতা রাথং চু নদী। ইয়াকসম, পেলিং পেরিয়ে তাসিদিংয়ের কাছে এই নদী মিলিত হয়েছে রঙ্গীতের সঙ্গে। সিকিমের বিখ্যাত ‘বুম চু’ বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পবিত্র এই নদীর জল ব্যবহারের রীতি আজও প্রচলিত। অথচ এই নদীর উপরে সরকারি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত স্থানীয় মানুষদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করে পরিবেশ আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে।
 
বৃষ্টির জন্য সমস্ত রকমের প্রস্তুতি থাকলেও হাঁটতে হাঁটতে দেখি ভিজে জুতো মোজা পায়ে দলের প্রায় সকলেই যারপরনাই বিরক্ত। এই বৃষ্টির মধ্যে পোয়াবারো জোঁকের ভয় বুকে নিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় বাঁক ঘুরতেই দেখি চামচে দই তোলার মত এক ফালি ধ্বস তলিয়ে গেছে নিচে। সাবধানে সেই পথটুকু পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম একটি ঝুলন্ত লোহার ব্রিজের সামনে। ইয়াকসম থেকে সাচেনের পথে এইরকম মোট তিনটি ব্রিজ পার হতে হয়। ফা-খোলা ( Pha Khola) নামক প্রথম এই ব্রিজ টপকাতেই বিশাল তোরণ সাজিয়ে স্বাগত জানায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পুরস্কার হিসেবে ব্রতীন’দাও সবাইকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে স্বাগত জানালে। এরই মধ্যে চেয়ারের মতো দেখতে একটি জায়গায় একটু বসবার চেষ্টা করতেই অতীন’দার রেনকোট ফড়ফড় আওয়াজ করে ফেটে গেল ভাজা পাঁপড়ের মতো। তবুও হাঁটার বিরতি নেই। বৃষ্টির তোড়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল জায়গাগুলি জঙ্গলের কাটা ডালপালা ঠেকিয়ে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। অবিরাম এই বৃষ্টির সুযোগে পাইন ওক ফার ইত্যাদি গাছের গায়ে মৃতপ্রায় শ্যাওলাগুলি আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বৃষ্টিস্নাত এই কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের মায়াময় রূপের আকর্ষণ পথ ভুলিয়ে যেকোনো দিকে টেনে নিতে পারে। মোটামুটি একটু শক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশ মন ভরে তাকিয়ে স্মৃতির পাতায় স্ক্যান করে নিতে হয় সারা জীবনের জন্য। চলতে চলতে নানান প্রজাতির অদ্ভুত দর্শন ফুল ফল পাতা অর্কিড নাকের চারপাশে সুগন্ধ ও সৌন্দর্য ছড়ায়। সদ্য কাটিয়ে ওঠা ফুলের মরসুম শেষে রডোডেনড্রন গাছগুলি যেন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে আগামী বসন্তের অপেক্ষায়। ব্রতীন’দা, অর্পণ, সপ্তর্ষি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। এই বৃষ্টির রিভাইটাল টনিক খেয়ে পাহাড়ি ঝোরাগুলি যেন বড় বড় ঝর্ণায় পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের যেখান সেখান দিয়ে নেমে আসছে বেগবতী ঝরনা ধারা। পথ চলবার প্রায় সমগ্র রাস্তাই জলে জলময়। অস্বাভাবিক এই বৃষ্টির জেরে আচমকা আমার জুতোর সোল গেল খুলে। জুতো খুলতেই দেখি তালপাতার সেপাই মাফিক একটি টিংটিংয়ে জোঁক আমার দিকে তাকিয়ে শুঁড়ের আস্ফালন দেখাচ্ছে। বিপদমুক্ত হয়ে জুতোটিকে গাছের লম্বা শিকড় দিয়ে পায়ের সঙ্গে বেঁধে পুনরায় হাঁটবার মতো ব্যবস্থা করতেই দেখি দলের বাকি সদস্যরা এসে পড়েছে।
 

পথপার্শ্বে হঠাৎ একটি ভাঙাচোরা আস্তানা দেখে প্রথমে আন্দাজ করতে পারিনি আমরা পৌঁছে গেছি সাচেন ক্যাম্প। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে মোট নয় কিলোমিটার এই যাত্রা পথে আমরা উঠে এলাম ৭৩১০ ফুট উচ্চতায়। পাহাড়ি ঢালের গায়ে জঙ্গল কেটে রঙিন তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ক্যাম্প। আপাতত বৃষ্টি একটু থামলেও হাঁটু অব্দি কাদায় আর মিউলের পায়খানায় ক্যাম্প সাইটের চেহারা ভয়ানক এবং বীভৎস

 
একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো গাইড ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের যাত্রাপথের দ্বিতীয় ব্রিজ সুষে খোলা ( Tshushay Khola) ঝর্ণার পাড়ে। ঝুলন্ত সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে অপরূপ এই ঝর্ণা যেকোনও পথিকের ক্লান্তি মুহূর্তে দূর করে দেবে। বিকট এবং বিধ্বংসী আওয়াজ করতে করতে ঝরনা নেমে যাচ্ছে আরও নিচে কিন্তু আমরা চলেছি আরও আরও উপরে। ঘড়ির কাঁটায় সময় বেলা আড়াইটা। একদল মিউল এই বৃষ্টির মধ্যে পিঠে বোঝা নিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার এক পাশে। পরিচালক তাদের মুখে গুঁজে দিচ্ছে কিছু শুকনো খাবার। পাশ কাটিয়ে আমরা উঠে গেলাম খাড়া ঢাল বেয়ে। বৃষ্টি মাথায় ক্লান্ত পায়ে পথে দু’দণ্ড দাঁড়াবার সময় নেই অথচ এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ইশারা কি অবহেলায় ফেলে দেওয়া যায়? এরই মধ্যে একটি বিশাল ঝর্ণা উপর থেকে একেবারে পুষ্পবৃষ্টির মতো রাস্তায় প্রতিটি আগন্তুক পথিকের মাথায় ঝরে পড়ছে ঝরঝর শব্দে। সবাইকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে জিভ কেটে তাকিয়ে আছে অপার সৌন্দর্য নিয়ে। তারই ডানপাশে কোমর ভেঙে রাস্তা অবরোধ করে এলিয়ে পড়েছে একটি প্রকাণ্ড পাইন গাছ। গাছটির তলা দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ না থাকলে আমাদের যাত্রাপথ এখানেই শেষ হয়ে যেতো। দলের সদস্যরা গাছের উপর দিয়ে এবং মিউলগুলো তলা দিয়ে সহজেই পার হয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। পাথরের উপর অনবরত জলের স্রোত রাস্তাকে আরও পিছোল করে তুলেছে। তার উপর রাস্তাটি জায়গায় জায়গায় শুকনো কাঠ দিয়ে বাঁধানো। যে একদিন ক্ষীণতম ঝোরা ছিল সে আজ বেগবতী নদী হয়েছে। যে জীবন শুষ্ক মরুপ্রায় ছিল সে আজ ভিজে গেছে আকন্ঠ, যৌবনের ভরপুর উন্মাদনায়। কুয়াশাঘন স্যাঁতস্যাঁতে প্রায়ন্ধকার বৃষ্টি অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার এমন অভিজ্ঞতা বিরল থেকে বিরলতম।
 
এই পথের তৃতীয় পারাপার মেন্টোগ্যাং খোলা ( Mentogang Khola) পৌঁছালাম তখন বেলা প্রায় চারটে। এই তিনটি সেতু আদতে গিরিখাত দিয়ে বহু নিচে বয়ে চলা নদীর একদম বুকের উপর অবস্থিত। সুতরাং এই সেতুর কাছে পৌঁছাতে পথ যেখানে নেমে গেছে, পরবর্তী সেতুর কাছে পৌঁছাতে ইংরেজি বর্ণমালার W অক্ষরের মতো উঠে আসতে হবে একই চড়াই পথ। পথপার্শ্বে হঠাৎ একটি ভাঙাচোরা আস্তানা দেখে প্রথমে আন্দাজ করতে পারিনি আমরা পৌঁছে গেছি সাচেন ক্যাম্প। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে মোট নয় কিলোমিটার এই যাত্রা পথে আমরা উঠে এলাম ৭৩১০ ফুট উচ্চতায়। পাহাড়ি ঢালের গায়ে জঙ্গল কেটে রঙিন তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ক্যাম্প। আপাতত বৃষ্টি একটু থামলেও হাঁটু অব্দি কাদায় আর মিউলের পায়খানায় ক্যাম্প সাইটের চেহারা ভয়ানক এবং বীভৎস। ইতিপূর্বে বহু দল গতকাল রাত থেকেই এখানে অপেক্ষা করছে এবং আমাদের পেছনে একে একে আরও বেশ কিছু দল উঠে আসতেই জায়গাটি জনবহুল হয়ে উঠলো।
 
আমাদের টেন্ট এবং মালপত্র এখনও এসে পৌঁছায়নি। এই প্রচন্ড ঠান্ডায় কোথাও একটু মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। একটি ছোট্ট কিচেন ঘরের ভেতর রান্না হচ্ছে। জ্বলন্ত কাঠের আগুনকে ঘিরে অনেক মানুষ উত্তাপে সেঁকে নিচ্ছে এই মহার্ঘ্য জীবন। একমাত্র পয়সার বিনিময়ে কিছু কিনে খেলে তবেই এই কাঠের ঘরে বসবার অনুমতি পাওয়া যাবে। সিগারেট জ্বালিয়ে ওরা গা গরম রাখবার চেষ্টায় ব্যস্ত। চায়ের অর্ডার দিলেও এই ভিড়ে ভেতরে বসবার আর জায়গা নেই। শো পুরো হাউসফুল। উল্টোদিকে একটি অস্থায়ী আস্তাবলের মধ্যে বহু বাঙালি এবং অবাঙালি ছেলেমেয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মশগুল। এদের অনেকেই পেশায় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এবং বিভিন্ন নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত অথবা নেহাৎই শখের পাহাড়িয়া। লিডার গোছের একজনের হাতে স্যাটেলাইট ফোন এবং কথাবার্তা আন্দাজ করে বুঝলাম এরা ‘ইন্ডিয়া হাইকস’-এর তত্ত্বাবধানে এই পথে এসেছে। এই মুহূর্তের বিশেষ খবরটি হলো, কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে বিশাল একটি ওক গাছ ভেঙে পড়ে রাস্তা আড়াআড়িভাবে দখল করে পথ আটকে বসে আছে। এতই ভারী সে গাছ জনা কুড়ি লোক মিলে তাকে বাগে আনা মুশকিল। ট্রেকাররা চেষ্টা করলে লাফিয়ে টপকে চলে যেতে পারবে কিন্তু মালবাহক মিউলগুলো পারবে না। একমাত্র বন বিভাগের কর্মীরা এসে গাছ কেটে সাফ না করলে অভিযান এখানেই শেষ। উপস্থিত সকলের মাথায় চিন্তার ভাঁজ।
 
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন টেন্টের ভেতর কোনক্রমে গা এলিয়ে শুয়েছি আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। এবং সব আশঙ্কাকে সত্যি করে আমাদের জামা কাপড়ের ভেতর, টেন্টের দেওয়াল মেঝে সর্বত্র জোঁক ছেঁকে ধরেছে আমাদের। ভিজে জামা কাপড় পাল্টে শুকনো কিছু গায়ে চাপিয়ে চায়ের আড্ডায় সবেমাত্র টর্চ জ্বেলে আমরা বসেছি। দেখি অতীন’দার প্যান্টের ভেতর জোঁকের জ্বালাময় সুড়সুড়ি। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে গাছ থেকে পাতা পড়ার মতো আমাদের টেন্টের ছাদে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে অগণিত সংখ্যক জোঁক। টেন্টের নিচ দিয়ে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির জল। ঘুম তো দূরের কথা টেন্টের ভিতর বসবার জায়গা পর্যন্ত নেই। জলে ভিজে আমাদের গায়ে একটি জামা কাপড়ও আর শুকনো নেই। মোবাইলের সিগন্যাল হারিয়ে সমতলের জনজীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এই প্রচন্ড আওয়াজের মধ্যে ডাক পাড়লে পাশের টেন্ট থেকেও কেউ শুনতে পায় না। জোঁকের পিছন পিছন নুন নিয়ে তাড়া করে করে আমরা সারারাত জেগে বসে রইলাম। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মধ্যে সে এক সাক্ষাৎ মৃত্যুর ভয়াবহ আতঙ্কের রাত।
 

ক্রমশ…

 
আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৮


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!