Advertisement
  • গ | ল্প
  • নভেম্বর ২৮, ২০২০

আলোগুলি একে একে জ্বলে উঠছে

পিঙ্কি ঘোষ
আলোগুলি একে একে জ্বলে উঠছে

চিত্র: অর্পিতা প্রধান

সেদিন আমি হাসপাতালে । সঙ্গে বোন আর ভগ্নিপতি । সিস্টাররা বোনকে চেকআপের জন্য ভেতরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে জানিয়ে দিলেন,  আপনারা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করুন, ডাক্তার এলে ফর্ম ফিলাপ করবেন । ঘড়িতে সকাল নটা। অপেক্ষারত আমি উদ্বিগ্ন, ভীতও। সব ঠিকঠাক হবে তো! বোন ভেতরে, আমি বাইরে। ও শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর আর আমি  অস্থির । সময় কাটছে না। বার বার টয়লেট পাচ্ছে। পেটের ভেতর থেকে একটা অজানা ভয় পাকিয়ে পাকিয়ে গলার কাছে উঠে আসছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পায়চারি করছি, ঈশ্বরকে ডাকছি, মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আর নয়। সদয় হও।

আশেপাশে কোলাহল। সবাই ব্যস্ত। কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পাশ কেটে চলে গেলেন।এনকোয়ারি রুমটা বেশ বড়ো। সামনে দুটো খোপ । কাটা জানালা। জানালার বাইরে লাইন দিয়ে টাকা জমা করছেন রোগীদের বাড়ির লোকজন । একজন মধ্যবয়সি মহিলা  চিৎকার জুড়ে দিলেন । দাবি, তিনি আগে ছিলেন অথচ অন্যান্যরা ঠেলাঠেলি করে আগে ঢুকে পড়েছে । হাসপাতালের  এক ভলেন্টিয়ার  তদারকি করে লাইনটা ঠিক করে দিয়ে গেলেন। আমি বারবার ভগ্নিপতিকে বলছি আমাদের ডাকছে না কেন? ও বলল দিদি, আমি তো ঘন ঘন খবর নিচ্ছি । বারবার বলছে, ওরা জানে না । মনে হচ্ছে, আমি যদি ম্যাজিক জানতাম, তাহলে উড়ান দিয়ে আমার বোনের কাছে চলে যেতাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, শক্ত হ, দেখবি কোনও ভয় নেই। কিন্তু আমি তো বাইরে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে । হঠাৎ কানে বাজল, নীলু দেব, দুলু দেবের বাড়ির লোক, তাড়াতাড়ি লেবার রুমের বাইরে চলে আসুন।  শুনেই দৌঁড় । লিফ্ট আসতে দেরি হচ্ছে তাতে কী। শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই। আমি তো হাওয়ায় উড়ছি। লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেলাম, পাঁচতলায় । লেবার রুমের বাইরে ।

 

“ভেতর থেকে একটা অজানা ভয় পাকিয়ে পাকিয়ে গলার কাছে উঠে আসছে। দুচোখে জল। ঝাপসা দৃষ্টিতে ভাসছে, সদ্যোজাতের সুন্দর লম্বা হাত। ব্যস এরপর ওকে নিয়ে চলে গেল।”

 

একটা ছোট্ট ঘর। মাত্র দুজন ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। আমরা একপাশে বসলাম। তখনও করোনা আসে নি। দূরত্ববিধির ঝামেলা নেই। বসে আছি। দেখছি দেওয়ালের টিকটিকিটা কেমন আপন মনে শিকার ধরছে। ভালো লাগছে না। গলা শুকিয়ে আসছে। আমার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে । এর মাঝে বাড়ির লোক ছাড়াও আমার সঙ্গে নিবেদিতা বৌদির কথা হল । বৌদি বললেন, সব ঠিক হবে, একেবারে চিন্তা করো না। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল মিরাকেল ।  মন চাইল আর ঘরের ভেতরে নয়, বাইরে লেবার রুমের বড় দরজাটার পাশ থেকে একটু হেটে আসি । উপরওয়ালা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। একটু এগোতেই দেখি, দরজাটা ভেতেরের দিক থেকে কেউ খুলছে। আমি সতর্ক। অপলক, চেয়ে রইলাম। সাদা তোয়ালের ভেতরে  একটা ছোট্ট হাত । এরমধ্যে নীলু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সিস্টার বললেন, দেখুন । তবে দূর থেকে। আমার দুচোখে জল। জলভরা ঝাপসা দৃষ্টিতে ভাসছে, সদ্যোজাতের সুন্দর লম্বা লম্বা হাত, ছোট্ট-মিষ্টি পুচকে। ব্যস এরপর ওকে নিয়ে চলে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে নামছে। পাখিরা বাসায় ফিরছে। রাস্তার আলো গুলোএকে একে জ্বলে উঠল। দূরের কোন এক বাড়িতে সন্ধ্যা আরতির শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!