- Uncategorized খাস-কলম
- ডিসেম্বর ২৩, ২০২১
অঙ্গীকারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অপ্রতিহত বাংলাদেশ
জিডিপি ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। মাথা পিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। গড় আয়ু ৭২.৬। দক্ষ নারী শ্রমিক ২৬ শতাংশ। প্রসূতি মৃত্যু প্রতি এক লাখে ১৭৩ ।

গুরুসদয় দত্ত বলেছিলেন, বিশ্বমানব হবি যদি আগে তবে বাঙালি হো। বাঙালি হবার পথে আমরা কতটা এগিয়েছি, এ প্রশ্নের উত্তর অনেকটা সংশয়াচ্ছন্ন হলেও বাংলাদেশ তার কর্মে ও মর্মে, তার জাতি সত্তাকে, তার আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নকে নিয়ে ক্রমাগত বড়ো হতে চাইছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ লৌকিক সুর ছড়িয়ে যে সজল সবল মানচিত্র এঁকেছিলেন, তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ দাবি করছে বাংলাদেশের সমাজ। পূর্ববঙ্গের এই সাধনা ত্রিশের দশকে প্রগাঢ় চিত্তে অনুভব করেছিলেন এস ওয়াজেদ আলী। ১৯৩৭ সালে, নোয়াখালি সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গ একদিন স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হয়ে উঠবে। অজান্তে হলেও, ওয়াজিদ আলীর ভবিষ্যতবাণী আর অঙ্কিত স্বপ্নের প্রত্যক্ষ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একদিন জাপানের মতো উন্নত দেশ হবে। তাঁর আরেকটি বিবৃতি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক—আইন পরিষদে খসড়া সংবিধান পেশ করে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন —এই দেশ সকলের। এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সবাই নিজ নিজ ধর্মপালন করবেন। অবাধে।
বাংলাদেশ জাপানের মতো কতটা উন্নত হয়ে-উঠছে বা তার ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতা কতটা মসৃণ, তা প্রশ্নাতীত নয়, তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু সার্বিক উন্নয়ণে তাঁর ৫০ বছরের অর্জন আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে। আমরা আশাবাদী, বলিষ্ঠ জাতির নির্মাণে সে কখনও কক্ষচ্যূত হবে না এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত, স্বপ্ন আর নির্মাণের যে অভিমুখ ছিল, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উভয়ক্ষেত্রে, তা প্রতিনিয়ত শিখরকে স্পর্শ করতে চাইছে। মাথা উঁচিয়ে জন্মলগ্নের সব বিদ্রুপ, সব হাসি, সব তামাশাকে মুছে দিয়ে বলছে যে, মুক্তিযুদ্ধের ভাবাবেগ আর অঙ্গীকারে আমরা ঐক্যবদ্ধ। তিরিশ লাখ মানুষের হত্যা আর ৩ লাখ মহিলার ইজ্জতহানির প্রতিশোধ নেব নির্মাণে, সমূহ সৃষ্টিতে । কিছু কিছু অন্তর্ঘাত সত্ত্বেও, বাংলাদেশের ঐক্য, বাংলাদেশে জাতিপ্রেম, বাংলাদেশের সঙ্কল্প যে-কোনও নির্মীয়মাণ জাতিরাষ্ট্রের সামনে আজ এক অপ্রতিহত দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে, প্রায় তিনদশক পর্যন্ত, গণহত্যা, সামরিকতন্ত্র আর সাম্প্রদায়িকতা নির্ভর রাজনীতি বাংলাদেশকে বারবার বিচ্যূত করেছে। সংখ্যালঘু পীড়ন ও আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। গত দুই দশকে বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শের প্রত্যাবর্তন এবং সার্বিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম উন্নয়ণশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত। ভারত এখানে বাংলাদেশের নিবিড় সহযোগী। বাণিজ্যে, কূটনীতিতে দুই দেশের আত্মীয়তা ক্রমশ বাড়ছে। সমূহ উন্নয়নের ক্ষেত্রে, কোথাও কোথাও বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর তা কোন পরিসরে, তা জানানো জরুরি। ৭১ সালে, বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দারিদ্র সীমার অনেক অনেক নীচে। সে অবস্থা আজ ধূসর স্মৃতিমাত্র।
স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে বাংলাদেশের আয় ছিল সীমিত। কিন্তু গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে।
মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা—এরকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানকে অতিক্রম করেছে। গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে তার উন্নতি, তার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চাইতে তার বর্ধমান শ্রীবৃদ্ধির বিস্ময়কর, বিশেষ করে মাথা পিছু আয়ে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণও তুলনামূলক বেশি, যা তাঁদের ক্ষমতায়নকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলাদেশে এরকম অগ্রগতির কারণ কী? একসময় তাকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তখনকার মার্কিন বিদেশ সচিব কিসিঞ্জার। ৭১-এ তার অভ্যুত্থানের পর সে ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটি। ধীরে ধীরে উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এতে সাধারণের অংশগ্রহণ ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। এই জনগণই উন্নয়নের প্রধান কারিগর। বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘ বাংলাদেশ ইস অ্যা টাইগার ফোর্স।’ যে কোনো উন্নয়ণশীল দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ঢুকে পড়বে। অর্থনীতিক ও সামাজিক অর্জনের মূল কারণ— খাদ্যে নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তি, রপ্তানি বূদ্ধি, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি। মহিলাদের উন্নয়ন ‘ইস দ্যা সেন্ট্রাল স্টোরি অফ ডেভলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ।’ বলেছেন বহু অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক।
গড় উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর ধরে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। গত অক্টোবরে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক সমীক্ষায়’ আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি ২০২১ সালে বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ভারতের জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। বাংলাদেশ ২০২০ সালে প্রথম মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার স্পর্শ করেছে। করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতি খানিকটা সঙ্কুচিত। বাংলাদেশেও সঙ্কোচণের প্রভাব পড়েছে। অন্তত এক শতাংশ কমেছে। তবু তার উদ্দীপনা থমকে যায় নি। জিডিপি দিয়ে দেশের সমগ্র মানুষের আয় কি নির্ধারিত হয়? সম্ভবত হয় না কিন্তু এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রমাণিত হওয়া স্বাভাবিক। জন্মালগ্নে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে তখন ছিলেন শতকরা ৭০ শতাংশ সম্পন্ন। আজ এই হারেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। মাথা পিছু আয়েও ব্যাপক তারতম্য। পাকিস্তানের ২০০০ ডলার।
স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে বাংলাদেশের এ আয় ছিল সীমিত। কিন্তু গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে। বাংলাদেশ প্রথম ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। ইকোনমিক সার্ভে অব পাকিস্তানের হিসাব, ওই বছর পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬৭১ ডলার। আর বাংলাদেশের (পরিসংখ্যান ব্যুরোর) ১ হাজার ৭৫১ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় আড়াই হাজার ডলারের বেশি। অতি সম্প্রতি পাকিস্তান দুই হাজার ডলার অতিক্রম করেছে।
জাতিসংঘের ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)র প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২. ৬ বছর। সেখানে ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৬৭ .৭ বছর ও ৬৭ . ৩ বছর। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সাফল্যের আয়তন যে কোনও উন্নয়ণশীল দেশর চেয়ে অনেক বড়। ৩৬ শতাংশ নারী শ্রমশক্তির সঙ্গে জড়িত। শুধু পোশাক শিল্পেই মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ২০-২২ লাখ । ভারত ও পাকিস্তানে মহিলাদের অংশগ্রহণ ২০- ২২ শতাংশ। দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মহিলাদর মধ্যে দক্ষ শ্রমিকের হার ২৬ শতাংশ । সেখানে ভারতে ২১ ও পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ। পাকিস্তানে মূল্যবূদ্ধির হার বিপজ্জনক মাত্রাকে স্পর্শ করেছে। ৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশেও বেড়েছে, কিন্তু পাকিস্তানের চেয়ে অনেক অনেক কম। ৫.৯ শতাংশ। পাকিস্তানে এক ডলারের দাম ১৭৮ রুপি। বাংলাদেশে ৮৫ টাকা। ভারতে ৭৫.৯১ টাকা।
স্বাস্থ্য রক্ষার কিছু কিছু ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য বিস্ময়কর। জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ শিশুই বেঁচে থাকে। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমছে। ভারতে এই হার ৯৬, আর পাকিস্তানে ৯৩ শতাংশ। প্রসবকালীন মায়ের মৃত্যু প্রতি এক লাখে ১৭৩ জন। প্রতি ১০ হাজারের জন্য হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৮, সেখানে ভারতে ৫ ও পাকিস্তানে ৬। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবায় বাংলাদেশ অনেক অনেক পিছিয়ে। দক্ষ ডাক্তার ও অত্যাধুনিক হাসপাতালের অভাব বড্ড প্রকট।
শিক্ষাক্ষেত্রের অগ্রগতিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছেন। ২৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মাধ্যমিক পাস। পাকিস্তানে এই হার ২৭ শতাংশ। মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পরিধিকেও বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। জাতীয় সংসদের সদস্যসংখ্যার ২১ ভাগ মহিলা। ভারত ও পাকিস্তানে এই হার যথাক্রমে ১৩ শতাংশ ও ২০ শতাংশ।
এই সব ক্ষতিয়ান প্রামণ করছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। তার অঙ্গীকারে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ বিরোধীতা এবং বৈষম্যহীনতা। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মনোহর স্বপ্ন। কখনও কখনও বিচ্যূত হলেও আজ বাংলাদেশ তাঁর স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গনির্মাণে বদ্ধপরিকর। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে অর্জন তাকে ঋদ্ধ করেছে, ভারতের মতো মহান গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে। ভারত যে পথেই এগোক না কেন, নিকটতম আত্মীয় এবং প্রতিবেশি দেশটিকে গুরুত্ব দিয়েই সে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলবে।
❤ Support Us