Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড 

পর্ব-১৯

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড 

অলঙ্করণ: দেব সরকার

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…

ক্রমশ রাজবাড়ির পরিবেশ আরও থমথমে হয়ে উঠছে।রঙ্গীল সিংহতোরণ পার হতে হতে দেখল সকালের সেই উৎসবের আমেজ যেন আর নেই।রাজবাড়ির ঠিক বাইরে হলধরকাকু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।সকলে ভিতরে ঢুকতেই অমূল্যজ্যেঠুর দেখা পেল।রাজা অমূল্যনারায়ণ খানকে এই কদিনে এতোটা ভেঙে পড়তে এই প্রথম দেখল রঙ্গীল।টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে বসে আছেন তিনি।সুনন্দাদিদি তার পিঠে হাত রাখতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন।সকলে বিস্মিত হয়ে দেখল তার দুচোখ জলে ভরা।
-নাড়াজোলে এ কী সর্বনেশে দিন এলো বল দিকি।ইব্রাহিম নূর সাতপুরুষ ধরে আমাদের রাজপরিবারের আশ্রয়ে রয়েছে।আজ আমি তকেও বাঁচাতে পারলাম না!
সুনন্দাদিদি তার বাবাকে সান্ত্বনা দেয়।
-তুমি তো চেষ্টা করেছ তোমার মতো করে।পুলিশ নিশ্চিত এর তদন্ত করবে।
-কে ? ওই দাসপুর থানার ওসি বিভীষণ মণ্ডল ? পারবেনি।রঙ্গীল।তুমি এইবার লালবাজার থেকে সুব্রতবাবুকে ডেকে পাঠাও।ওইই এর তদন্ত করুক।
লালবাজারের স্পেশাল অফিসার সুব্রত রায়চৌধুরী এর আগেও বহুবার রঙ্গীলের তদন্তে সাহায্য করেছে।কিন্তু এই মুহূর্তে বিভীষণকে একেবারেই বেতালের খাতায় ফেলতে তার মন করছিল না।
-একবার চিত্রকরপাড়ায় যাওয়া যাবে না জ্যেঠু? চাচার ঘরের লোকের সঙ্গে কথা বলে দেখা যেত কী হলো ?কীভাবে হলো।
-আমি তো যাচ্ছিলামই।হলধর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।তোমরাও চলো তবে।
সুনন্দাদিদি মাম আর তিন্নি বাড়ি থেকে যাবে ঠিক করল।বাকিরা সবাই গাড়ি চেপে চলল চিত্রকরপাড়া।রঙ্গীল অমূল্যজ্যেঠুর মধ্যে এক অসহিরাজার চিত্র দেখতে পাচ্ছিল।ঠিক যেন সেই কাহিনীর রাজা অযোধ্যারাম খানের মতো।

সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একের পর এক বিপদ সংকেত নাড়াজোল রাজবাড়ির উঠোনে যেন অশনি সংকেত বয়ে আনে।


চিত্রকর পাড়ার সরু গলির সামনে গাড়ি রেখে ওরা বাধানো সরু রাস্তা দিয়ে ভিতরে নূরচাচার বাড়ির দিকে চলল।রাহ্তার দুইপাশে বেশ কিছু লোকজমায়েত হলেও চারপাশের পরিবেশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট।সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেল বিভীষণ মণ্ডলের কন্ঠস্বর।রামতনু কাহারকে গ্রেপ্তার করবার সময় তার ভিতর যে দাপট ও গাম্ভীর্য দেখা গিয়েছিল,আজ সেই স্থানে যেন চরম অস্থিরতা ভীড় করেছে।বিভীষণ তার পল্টনের পুলিশ অফিসারদের নজরদারির জন্য পোস্টিং করাচ্ছিলেন।উত্তেজনায় তার কথার ভিতর সাঁওতালি ভাষা বলে ফেলা ও তারপর ‘থুড়ি থুড়ি ‘ বলে পরিস্থিতি সামাল দেবার কু অভ্যাস আরও বেশি করে চোখে পড়ছিল।
-এই দারে থুড়ি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কী হবে।হানকিন থুড়ি ওরা কী তোমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খুন করতে আসবে?
যেন শত্রুপক্ষের আক্রমণ আসন্ন।সেই শত্রুপল্টনের সামনে মীরমদন মোহনলালের মতো কামান সাজাচ্ছেন একা বিভীষণ।কর্ম তৎপরতায় তার ভুঁড়িখানা নেচে উঠছে ঘনঘন।
অমূল্যজ্যেঠুদের দেখা মাত্র সে স্যালুটের ঢঙে দাঁড়িয়ে পড়ল।জ্যেঠু জানাল সে একবার নূরচাচার বাড়ি যেতে চায়।বিভীষণ মাথা চুলকে বলল,”বেশ।যান।তবে বডি এখনও ভিতরেই আছে।হাসা দা থুড়ি মাটি জলে অস্থিরতা খুব।বেশিক্ষণ নয়।
সকলে বিভীষণের নির্দেশে মাথা নেড়ে নূর চাচার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।সেখানে পুলিশ আগেই লোকসমাগম সরিয়ে রেখেছে।তারই ভিতর সাদা কাপড় ঢাকা নূর চাচার দেহটা ঘিরে ঝড়বিদ্ধ বনস্পতির মতো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরচাচার বিবি।তার পাশে মিজান আর তার মা।কথা বলবার অবস্থা নেই কারো।দেহর পাশেই বসে থাকা এক অল্পবয়সী পুলিশ কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করল বাপি।
-কী করে হল?
-আততায়ীকে বোধহয় উনি চিনতেন।ওর নাতি মিজান শুনেছে।উত্তেজিত কথাবার্তাও হয়েছে দুইজনের।তারপর আততায়ী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে ভিক্টিমকে।
-অস্ত্র তাহলে বন্দুক।
-হ্যাঁ।
-আর কিছু?
-ওনার নাতি মিজান নাকি মৃত্যুর ঠিক আগে ওনাকে কিছু একটা বলতে শুনেছিল।সেকথা ও বলতে পারবে।
অমূল্যজ্যেঠু ইতিমধ্যেই চাচার নাতির পাশে দাঁড়িয়েছে।এরই মধ্যে রঙ্গীল ঠিক করল একবার মিজানের সঙ্গে কথা বলবে।মিজান তারই বয়সী।একটা সুযোগের অপেক্ষায় রইল সে।সে সুযোগ মিলেও গেল সহজেই।মিজান নিজেই তার কাছে এসে কিছু বলতে চাইল।রঙ্গীল কিছু মনের ভিতরে ভীড় করা প্রশ্নর উত্তর খুঁজে চলেছিল।
-একটা কথা বলো তো মিজান।যে লোকটা তোমার নানার ঘরে ঢুকেছিল,তাকে তুমি দেখেছিলে?
-দেখিনি।তবে যখন গুলির শব্দ হলো,আর নানা লুটিয়ে পড়ল,তখন আমি দৌড়ে ঘরে গিয়েছিলাম।
-ঘরে গিয়ে কী দেখলে?
-দেখলাম নানা রক্তে লুটিয়ে আছে।…
মিজান চুপ করে যায়।রঙ্গীলেরও এবার বুকের ভিতর ধুকপুক করতে থাকে।এসব দৃশ্য রাতের হরর সিনেমায় দেখায়।রঙ্গীল সেসব দেখে না।মিজানের কষ্ট হচ্ছে।সে তার নানাকে খুবই ভালোবাসত।কিন্তু রঙ্গীল যে নিরুপায়।তাকে জানতে হবেই।মিজান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে চলে।
-নানা ঠিক ইন্তেকালের আগে একটা কথা বারবার বলে একটা ছবি দেখাচ্ছিল।
-কোন শব্দ মিজান?
-কি
-‘কি’?এটাই তোমার নানা বলছিলেন?
-হ্যাঁ।
-আর যে ছবিটা তোমার নানা দেখাতে চাইছিল সেই ছবি আমাকে একবার দেখাতে পারবে তুমি।
মিজান একবার তার আম্মির দিকে তাকায়।তারপর ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে।বাপির সঙ্গে রঙ্গীল ভয়েভয়ে সেই ঘরটায় ঢোকে যেখানে ইব্রাহিম নূরচাচার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল।এখানেই আততায়ী চাচাকে হত্যা করে।এর আগে কখনও এমন সরাসরি খুনের ঘটনার তদনাত সে করেনি।ঘরের দরজার বাইরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।যেখানে চাচার দেহটা পড়েছিল,সেই জায়গাটা পুলিশ সাদা চক দিতে চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।ঘরে কোনও কিছু হাত দিতে বারণ করে দিল বাইরের পুলিশ অফিসারটি।শুধু বিভীষণ মণ্ডলের ইশারায় রঙ্গীলদের ঘরে ঢুকতে আটকানো হলো না।মিজান ঘরে যে দিকে চাচার হাত নির্দেশ করছে সেই দেয়ালটি দেখাল।
-ওই ছবিটা দেখিয়ে নানা ‘কি’ ‘কি’ বলে চুপ হয়ে গেল।
রঙ্গীল মিজানের কাঁধে হাত রেখে তার দু চোখ মুছিয়ে দিল।মনে মনে সংকল্প করল।শুধুই গুপ্তধন নয়।নূরচাচার খুনিকে সে খুঁজে বার করবেই।রঙ্গীলের বাপি শতানীক দূর থেকে দেখল,দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো দুটি বিপর্যস্ত বালক একে অপরের সহায় হয়ে বেরিয়ে আসছে।সত্যিই এমনটা যদি বড় বয়সের মানুষগুলিও করত,এদেশের মানচিত্র তাহলে অন্যরকম হতে পারত।
-কী দেখলি ঘরে রঙ্গীল?
-একটা ত্রিশূলের ছবি।ওটা দেয়ালে আঁকা ছিল।
-ওই ত্রিশূলের দিকে তাকিয়েই চাচা ‘কি’ বলে উঠেছিল? তবে কি এখানেও সেই মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির।
-বুঝতে পারছি না বাপি।চলো বাড়ি যাই।আমার এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
শতানীক সহমত হয়।বালক মনস্তত্ত্বে এতোটা মানসিক চাপ সামলানো সহজ নয়।সে রঙ্গীলকে চেনে।আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে সে।
              ঘরে ফিরবার পথে অমূল্যজ্যেঠু কোনও কথা বললেন না।এই কদিনে যেন নির্থর মার্বেলের স্ল্যাব বনে গেছেন জ্যেঠু।রঙ্গীলের বারবার মনে হচ্ছিল চাচার ছেড়ে যাওয়া শেষ সূত্রে কোথাও একটা সমাধানের ইঙ্গিত আছে যা সে ধরব ধরব করেও ধরতে পারছে না।ভাবতে ভাবতে রাজবাড়ির দোরগোড়ায় তাদের গাড়ি করে পৌছে দিল হলধরকাকু।সেখানে তারা গাড়ি থেকে নেমে দেখে গোপাল ঘড়ুই শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাদের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছেন।অমূল্যজ্যেঠু গাড়ি থেকে নামতেই তিনি তার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন।সকলে হতচকিত।কী হলো আবার?সুনন্দাদিদি কি তবে গোপালকাকুকে সব বলে দিয়েছে!
-আমাকে বাঁচান রাজাবাবু।আমার যে সব সর্বনাশ হয়ে গেল।
-কী হয়েছে তোমার গোপাল?
-আমার চন্দনকে আপনি বাঁচান?
-কী হয়েছে চন্দনের?
-ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও!
সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একের পর এক ঘটনা নাড়াজোল রাজবাড়ির উঠোনে যেন অশনি সংকেত বয়ে আনে।সকালের পর চন্দন বলেছিল সে নিজেই চলে আসবে।তবে কি সকালের পর সে বাড়িই ফেরেনি।
-কখন থেকে চন্দনকে পাওয়া যাচ্ছে না?
-আজ্ঞে সেই যে সাতসকালে বের হল,তার পর থেকেই।
সকলেই হতচকিত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।নূর চাচার মৃত্যু আর চন্দনের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া কী তবে কোনও অশুভ ইঙ্গিত এনে দিচ্ছে রঙ্গীলদের কাছে?সেই দোলাচলেই রাজবাড়ির জয়দুর্গা মন্দিরে সন্ধ্যারতির ঘন্টা বেজে ওঠে।মা জয়দুর্গার  আরতির শব্দে সকলের মনে যেন আশার মঙ্গলদ্বীপ নতুন করে জ্বলে ওঠে।
ক্রমশ …

❤ Support Us
error: Content is protected !!