- ধা | রা | বা | হি | ক
- এপ্রিল ৩, ২০২২
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড
পর্ব ২৩
অলঙ্করণ: দেব সরকার
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…
দুগ্গার ছোট্ট মাটির দোতলা কুটীরটি সত্যিই ভারি সুন্দর । একতলায় একটা বড় ঘর । ঘরে তেমন কিছুই নেই । একটা ছোট দড়ির খাটিয়া পাতা । একপাশে কয়েকটি লাল আর হলুদ বস্তার ভিতর আলু পেঁয়াজ ভর্তি।ঘরের ভিতর আর তেমন কিছু নেই । মাঝবরাবর একটা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় । রঙ্গীলদের একতলায় রেখে দুগ্গা আবার পালিয়ে গেল । যাবার সময় বলে গেল,”ঘর থেকে কেউ বেরোও নি যেন ।”
বাইরে খটখটে রোদ্দুরের ভিতরেও এই দুগ্গার ঘরটিতে মনে হচ্ছে যেন এসি চলছে । রঙ্গীল তার ভবানীপুরের বাড়ি থেকে কখনও এমন দৃশ্য দেখতে পায়নি । জানলা বরাবর যতোদূর দৃষ্টি যায়,ঠিক অঙ্কখাতার মতো আলপথ সাজানো । তার দুই পাশে হলুদ ঢেউ খেলানো ধান । মাঝে মাঝে জমিতে ডাঁই করে ধান গুছিয়ে রাখা । অনেক দূরে কাজলের টিপের মতো একটা কালো বিন্দু । বাপি বলল,”ধান হবার পর ধানের গোড়াটা পুড়িয়ে দিতে হয় । না দিলে পরের ফসল করা যাবে না । “তিন্নি বলল,”সেই জন্যই এই জায়গার নাম নাড়াজোল ।”সুনন্দাদিদি হেসে বলল,”ঠিক তাই।ধানের নাড়া ঘিরে জল জমে থাকা জমিকেই ‘নাড়াজল’ নাম দেওয়া হল ।” রঙ্গীল দেখছিল আর ভাবছিল । কতো বিচিত্র সুন্দর তার দেশ । সেখানে হঠাৎগঞ্জের জাহাজবাড়ি যেমন আছে,তেমনই আছে মোল্লাহাটির নদী । আবার আছে সুজলাসুফলা এই ধানক্ষেত । আরও কতো কিছু যে আছে । দেখে শেষ করা যাবে কি কোনওদিন?
– ওটা কী বাপি?
ধানক্ষেতের ভিতরেই বেশ খানিক দূরে একটি মহিলা একটা বড় সাঁড়াশির মতো যন্ত্র দিয়ে মাটিতে একটা সরলরেখা বরাবর কী যেন করছে।
– ওটা মাটিখুঁড়া মেশিন ।মাটিতে যাতে আগাছা লতাপাতা না গজিয়ে উঠতে পারে,সেই কারণে ওই মাটিখুঁড়া দিয়ে চাষের আগে জমি পরিষ্কার করে নিতে হয় ।
রঙ্গীল অবাক চোখে দেখে এই ক’দিনেও সে তার দেশের এই অপূর্ব দৃশ্য যেন দেখেও দেখতে পায়নি । হঠাৎ তার পিঠে কারও হাত অনুভব করেই সে পিছনে তাকিয়ে দেখে চন্দন আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ।
– কেমন আছো বন্ধু?
– একটু মাথা ঘুরছে । কিন্তু এখন অনেক ভালো । তোমরা আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও । আমি না বুঝেই তোমাদের আমার শত্রু ভেবে বসেছিলাম।
সেসব তো হল । এদিকে বেলা বাড়ছে । অথচ ঘরের বাইরে যাবার উপায় নেই । কে বলতে পারে কোথায় জয়রাম সিং তার গুণ্ডাবাহিনী লুকিয়ে রেখেছে ! এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে খিদেও যে বাড়ছে পাল্লা দিয়ে । অমূল্যজ্যেঠুকে খবর দেবার উপায় নেই । কীকরে খবর দেবে কেউ?সবকটা মোবাইল তো ওই দুষ্টু লোকটা তার ঝোলায় পুড়ে রেখেছে ।
ঘরের এক কোণে একটা মাটির কুঁজো রাখা । সেখান থেকেই সকলে জল খাচ্ছিল । এ ছাড়া কীই বা উপায় । এমন সময় হঠাৎ তিন্নি জানলার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ।
– দেখ দেখ ।গাড়ি আসছে ।
সকলের মুখেই তিন্নির কথায় আবার আতঙ্ক ফিরে এল এক নিমেষে । পালাবার উপায় নেই । দুগ্গা যে কোথায় গেল কে জানে!এখন তারা কী করবে?জয়রাম নির্ঘাত তাদের এই গুপ্তস্থানের সন্ধান পেয়ে ছুটে আসছে । ভাবতে ভাবতেই তিন্নি লাফিয়ে উঠল খুশিতে,”মাসি মেসো দাভাই,সবাই দেখ । বিভীষণকাকু!”
সত্যিই সবাই দেখল ওই গাড়িটা একটা পুলিশের জিপ । তার চালকের আসনে বিভীষণ মণ্ডল । আর তার পাশের সীটে অমূল্যজ্যেঠু । অমূল্যজ্যেঠুর হাতে একটা লম্বা শিকারী বন্দুক । সে দৃশ্য দেখে সুনন্দাদিদি চোখ বন্ধ করে হাত জোর করে আপনমনে বলে উঠল,”জয় মা জয়দুর্গা । মা ।”
বিভীষণ মণ্ডল জিপটা রঙ্গীলদের মাটির ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল মাটিতে ।সকলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই হাত জোর করে বলল,”সানাম ক জহার থুড়ি থুড়ি ।সবাইকে নমস্কার ।”বিভীষণকাকুর এই সাঁওতালি ভাষা বলার মুদ্রাদোষে সকলে এই প্রথম তার সামনেই প্রকাশ্যে হেসে উঠল ।সুনন্দাদিদি দৌড়ে গেল অমূল্যজ্যেঠুর দিকে ।সকলকে অক্ষত দেখে জ্যেঠুও যেন অবশেষে শান্ত হতে পারল ভিতর থেকে।
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ শতানীকবাবু ।আপনার মোবাইলে ট্র্যাকার ফলো করে আমরা রেইড করি ।জয়রাম সিং এর সবকটা সাগরেদ ধরা পড়েছে ।এই নিন আপনাদের সকলের মোবাইল ।
– আর জয়রাম সিং?
– সেও ধরা পড়বে শিগগিরই ।আমি চন্দ্রকোণা আর মেদিনীপুর সদর থেকে ফোর্স চেয়ে পাঠিয়েছি ।লঙ্কাগড়ের এই ঘটনা এখন আর ইগনোর করবার জায়গায় নেই ।
চাপাচাপি করে সকলেই জিপে চেপে বসল ।জিপটা আধারনয়ন বনবিভাগের ।তাই পিছনটা হুডখোলা ।রঙ্গীল মনে মনে ভাবে ।এই বিভীষণ মণ্ডলকে তারা যতোটা বোকামানুষ ভেবেছিল,সে ততোটা নয় তাহলে ।কিন্তু জয়রাম সিং এখনও ধরা পড়েনি ।তার মন বলছে,লোকটা আবার হামলা করবে তাদের ওপর । তাই সতর্ক থাকতেই হবে । আর দুগ্গা ? সেই বা কোথায় গেল কে জানে?সেকথা বলতে অমূল্যজ্যেঠু বলল,”ওমা । ওই মেয়েটাই তো আমাদের তোমাদের এই বাড়িটার কথা বলে দিল । না হলে এই দিকটা আমার তেমন চেনা ছিল না ।” কিন্তু তারপর মেয়েটা গেল কোথায় ?কে জানে !
ক্রমশ..
যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে গত রবিবার রোব-e-বর্ণ প্রকাশ করা যায়নি,এজন্য আমরা দুঃখিত।
❤ Support Us