শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
শেষ পর্ব
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…
রাত কেটে গেল নিমেষের মতোই । ভোরের আলো ফুটতেই সকলে হলধরকাকুর গাড়িতে চড়ে লঙ্কাগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল । যাবার আগে রঙ্গীল এক অদ্ভুত কাজ করে বসল । এমনিতেই অমূল্যজ্যেঠু দুটি জিনিস হাতে নিতে ভোলে নি । প্রথমটি তার অনেকদিন বাদে বের করা শিকারী বন্দুক। আর দ্বিতীয়টি মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির থেকে পাওয়া ত্রিশূলের চাবিটি । কিন্তু ঠিক যখন জ্যেঠু উঠতে যাবে গাড়িতে,ঠিক তখনই রঙ্গীল বলল,”জ্যেঠু । একটা রিকোয়েস্ট আছে ।”
–কী ? বলো রঙ্গীল ?
জয়দুর্গা মন্দিরে ঘন্টা বাজছে ঢঙ ঢঙ । সকালের আরতি তড়িঘড়ি সেরে নিচ্ছে বামাচরণ । সকাল সাড়ে এগারোটায় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ লাগবে । থাকবে দেড় দু ঘন্টা । সেই সময় কোনও পুজাপাঠ করা চলবে না বলেই তার এই ব্যস্ততা ।
–আমার মনে হয় চন্দন ঠিক বলেছিল । ত্রিশূলই গুপ্তধনের একমাত্র চাবি নয় ।
–তাহলে ?
–পুজো শেষ হলে আপনি বামাচরণকাকুকে বলুন । তিনি যেন জয়দুর্গা মূর্তিটিকে আরেক বার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ।
–কেন এমন বলছ রঙ্গীল । তবে কি ?
–হ্যাঁ জ্যেঠু । জয়দুর্গা আর ত্রিশূল,দুটোই চাবি ।
–অর্থাৎ ডাবল লক । ব্যাঙ্কের লকারে যেমন থাকে ?
–ঠিক তাই ।
অতএব রঙ্গীলের কথা মতো জয়দুর্গা মূর্তিকেও চাপানো হলো গাড়িতে । গাড়িতে মাম ছাড়া সকলেই চড়ে বসল । মাম কিছুতেই যাবে না । তার মনে এখনও পুরনো দিনের বিশ্বাস । সূর্যগ্রহণের দিন ঘর ছেড়ে বেরনো যাবে না । দিদিমা শিখিয়েছেন । কিছুতেই বোঝানো গেল না । তাছাড়া গাড়িতে আরও চাপাচাপি করে বসতে হতো হয়তো । সে জন্যই হয়তো মাম গেল না । মুখে বলল।
–সবাই মিলে চলে গেলে হবে ? দুপুরের খাবার তৈরি করতে হবে তো গ্রহণের আগে। তোমরা ফিরে এসে বলো কী হলো । আমি রাধুনিমাসির সঙ্গে রান্নাটা সেরে নিই ।
গতকাল রাতে বিভীষণ মণ্ডল যে মিথ্যে আশ্বাস দেয়নি তার প্রমাণ রঙ্গীলরা পেল রাজবাড়ি থেকে বেরিয়েই । রাজবাড়ির সিংহদুয়ার থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র । সবখানে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ । অবশ্য রঙ্গীলদের কেউই আটকাল না । লঙ্কাগড়ে জলহরির কাছে এসে জ্যেঠু দেখল ঘাটের কাছে মাত্র একটিই নৌকো বাঁধা । তার ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে এক বুড়ো মাঝি ঢুলছে । আশপাশের দোকানপাট সব পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ভয়ে বন্ধ । রঙ্গীল ভাবল,যুগের পর যুগ,এমন কত ধারণা ভুল কুসংস্কার হয়েই চলে আসছে এই দেশে । ঘড়িতে বাজে দশটা কুড়ি । অর্থাৎ গ্রহণ লাগতে আরও ঘন্টা কুড়ি।
মাঝিটি অমূল্যজ্যেঠুকে দেখে প্রণাম করল । তারপর ওরা সকলে একে একে চড়ে বসল নৌকোর উপর । জলহরিতে নোঙর করতেই রঙ্গীলরা সবাই প্রবল উৎসাহে দৌড়ে গেল মধ্যিকার বিগ্রহবেদির দিকে । কিছুদিন আগে এখানেই তো মার্বেলপাথরের স্ল্যাব দেখতে এসেছিল তারা । এখন অবশ্য সে স্ল্যাবটি নেই । জয়রাম সিং নিশ্চয়ই এতোদিনে সেটা কলকাতায় কোথাও বিক্রি করে দিয়েছে । সে যাই হোক,আপাতত সকলে মনোযোগ দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বেদির ওপর । ঠিক যেমন রাসমঞ্চর পঞ্চম দরজার উপরের ছবিতে ছিল,ঠিক তেমনই এই সিংহাসনের মতো বেদির উপরে একটি ইংরাজি ভাষার ‘ইউ’ আঁকা । অমূল্যজ্যেঠু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রথ দেখিয়ে বললেন,”আমার পূর্বপুরুষদের সময় ঠিক এই বেদির উপরেই বসে রাজসভা করতেন রাজা মহেন্দ্রলাল খান । সেই রাজসভার দিন রামচন্দ্র বিগ্রহর মালা পরিয়ে দেওয়া হত রাজার গলায় । যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই প্রথার নাম ‘শোভাভরণ’ ।”
–”তার মানে ওই ইংরাজির ‘ইউ’ আসলে বৈষ্ণব তিলক । রঘুপতি রামচন্দ্রর চিহ্ন ।” সুনন্দাদিদি বলে । “ওইখানে বসেই রাজামশাই হয়তো তাঁর রাজসভা চালাতেন ।”
বাইরে গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই । এই ভোরসকালেই বেশ বিকেল বিকেল লাগছে চারদিক । একটু পরেই চারপাশ রাতের মতো অন্ধকার হয়ে যাবে । তার আগে ফিরতেই হবে । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রঙ্গীল বলল,”আচ্ছা জ্যেঠু । রাজা মহেন্দ্রলাল খান যখন সভা করতেন,তখন তার প্রজারা কোথায় বসত?”
জ্যেঠু একটু ভেবে তফাতে থাকা একটি বেদি দেখিয়ে বলে,সম্ভবত ওইখানে ।
– বেশ । তবে ওইখানে চল সকলে ।
বেদির উপর এক অদ্ভূত ছবি আঁকা । এক দেবতা যার দুটো মুখ । নিচে চিনা হরফের মতো কিছু লেখা । এমন অদ্ভুত ঠাকুর রঙ্গীল কখনও এর আগে দেখেনি । কিন্তু অমূল্যজ্যেঠু সে ছবি দেখে অবাক হল না ।
– এ হল দুবরাজপুর গ্রামের প্রধান দেবতা দুবরাজ । লোকে বলে ইনি হলেন জাহাজের দেবতা । হয়তো চারপাশে জল রেখে এই জলহরি তৈরি করতে গিয়ে রাজা মৌহনলাল খান দুবরাজকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন ।
সুনন্দাদিদি হঠাৎ হাততালি দিয়ে ওঠে ।
– বাবা । শুধুই সেই কারণ নয় । দুবরাজপুরের মানুষের বিশ্বাস কোনও কিছু হারিয়ে গেলে দুবরাজ ঠাকুরের পুজো দিতে হয় । আর আমরা তো সেই হারানো গুপ্তধনই খুঁজতে এসেছি!
সকলেই বিস্ময়ে ঘাড় নাড়ে । রঙ্গীলের বাপি বলে এইবার ।
– মতান্তরে এই দুবরাজ হলেন শিব ও দুর্গার প্রতীক । আমাদের হরপার্বতীর মতো । তাই তার দুই মাথা ।
বাপির কথা শোনা মাত্র রঙ্গীল হঠাৎ হাততালি দিয়ে উঠল ।
– মিলে গেছে । আমার অঙ্ক মিলে গেছে ।
চন্দন বলল,”কোন অঙ্ক রঙ্গীল ?”
রঙ্গীল বলে চলে । “রাসমঞ্চর তৃতীয় দরজার উপর আমরা যে অদ্ভুত শালাম্যু দেখেছিলাম তার উপর আটটা ত্রিশূল আঁকা ছিল । তাদের মধ্যে সাতটা ছিল এক জায়গায় । আর একটি তফাতে । একই রকম একটা ছবি পাওয়া গিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দিরেও । সেখানেও এই সাত যুক্ত এক ত্রিশূল । কিন্তু আমার একটা সন্দেহ হয় । হয় বলেই দ্বিতীয়বার আমি ওই রাসমঞ্চ দেখতে যাই ।
– কেমন সন্দেহ রঙ্গীল ?
– মথুরামোহন তৎকালীন যুগের একজন জিনিয়াস আর্কিটেক্ট ছিলেন । তিনি এই সাত আর একের ভিতর একটা ক্লু রেখে গেছেন । সাতটি ত্রিশূলের ধরন যেমন,তার থেকে একটি আলাদা ত্রিশূলের ধরন সামান্য অন্যরকম । খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে,তফাতে থাকা ত্রিশূলটির ত্রিফলার ঠিক নিচেই একটি মুঠো করা হাত আছে । ত্রিশূল থাকে মহাদেবের আসনের পিছনে । কিন্তু দুষ্টনাশে সেই ত্রিশূল যিনি ধারণ করেন তিনি দেবী দুর্গা ।
সকলেই রঙ্গীলের এই বিশ্লেষণে চমকিত হয়ে বাহবা দিতে থাকে । রঙ্গীল সকলকে শান্ত করে বলে,”এই সন্দেহ কিন্তু চন্দনের প্রথম হয়েছিল । সেই কারণেই সে জয়দুর্গার মূর্তি চুরি করেছিল । তাই বাহবার অর্ধেক চন্দনের প্রাপ্য । কী চন্দন ?”
চন্দন লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে । সুনন্দাদিদি তার পিঠ চাপড়ে দেয় । কিন্তু এইবার ?রঙ্গীল বলতে থাকে ।
– আমাদের দেখতে হবে দুবরাজ ঠাকুরের পায়ের কাছে কোনও চাবির ছিদ্র রয়েছে কিনা ।
বাইরে অন্ধকার ক্রমশ গাঢ়তর হচ্ছে । তবু সকলেই বেদির উপরে থাকা দুবরাজঠাকুরের পায়ের কাছে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে রঙ্গীলের কথা মতোই দুটো গর্ত খুজে পেল । রঙ্গীল বলল ।
– দুবরাজঠাকুরের যে দিকটা শিব,সেই ছিদ্রে ঢুকবে ত্রিশূল । আর যে দিক পার্বতী,সেখানে রাখতে হবে জয়দুর্গা মূর্তি ।
বাপি রঙ্গীলের কথামতো ত্রিশূল আর মূর্তি রাখল সেই অংশে । ঠিক যেন পাজরের মতোই খাপে খাপে মিলে বসে গেল দুটি চাবিই । বসে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জলহরির নীচ থেকে ‘ঘটাঙ’ করে একটা যান্ত্রিক শব্দ হল । এরপর ? রঙ্গীল বলে চলে ।
– যে হেতু শ্যাল্যম্যুতে সাতটি ত্রিশূল এক জায়গায়,আর তা বাজাচ্ছেন স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুর,আমাদের ঘড়ির কাঁটার মতো সাতবার ত্রিশূলটা ঘোরাতে হবে। তারপর জয়দূর্গা মূর্তিকে ঘোরাতে হবে একটিবার । এটি কিন্তু ঘড়িকাটার উল্টোদিকে । অর্থাৎ ‘অ্যান্টিক্লকওয়াইজ’।
রঙ্গীলের কথা মতো চাবিদুটো ঘোরাতেই এইবার মূল বেদিটি থেকে ‘ঘড়ঘড়’ আওয়াজ শুরু হল । আলোআঁধারির ভিতরেও সকলে দেখল বেদির উপরের পাথরের ফলকটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে । আর সেখানে একটা চওড়া সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে । সকলেই ভিতর ভিতর রোমাঞ্চিত হচ্ছিল । এই সিঁড়ির অপরপ্রান্তেই হয়তো অপেক্ষা করছে লঙ্কাগড়ের সুপ্রাচীন গুপ্তধন ।
গ্রহণ লেগে গেছে চারপাশে । মিশমিশে আঁধার নেমে যেন চারপাশে সন্ধ্যা নেমে আসছে মনে হচ্ছে । অথচ ঘড়ির কাঁটা বলছে,সময় এখন মোটে দুপুর বারোটা । সকলে কালবিলম্ব করে নিচের দিকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে । বাপি তার মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেয় । সিঁড়ির শেষে একটি বড় ঘরের মধ্যিখানে একটি সিন্দুক । অমূল্যজ্যেঠু সেই সিন্দুকের ডালা খুলতেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল । অন্ধকার ঘরে হঠাৎ যেন সূর্যর আলো জ্বলে উঠল । এতোটাই জোরালো সেই আলো যে বাপির মোবাইল টর্চের আর প্রয়োজন রইল না । সকলেই একসঙ্গে সেই আশ্চর্য আলোর কারণ ধরে ফেলল ।
‘সামন্ত্যক মণি’!!! লঙ্কাগড়ের বুকের ভিতরেই এর অর্থ এত বছর ওই আশ্চর্য হীরেটি লুকিয়ে ছিল । সিন্দুকভর্তি হীরে জহরত সে মণির কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল যেন । সকলেই সেই সিন্দুকের চারদিক ঘিরে অবাক হয়ে সেই মণি দেখছিল । ঠিক তখনই ঘটে গেল আরেক বিপদ ।
রঙ্গীলরা খেয়াল করেনি,তাদের প্রতিটা পদক্ষেপ আর কথাবার্তা আরও একজন দেখে ও শুনে চলেছিল । সে ওই জলপারাপারের বুড়ো মাঝিটি । এইবার সেই কখন সকলের অজান্তে ঘরের ভিতর এসে অমূল্যজ্যেঠুর কপালে বন্দুক তাক করে বসে আছে ।
–আপনার রাইফেলটা ফেলিয়ে দিন রাজাবাবু । খেলা শেষ ।
অমূল্যজ্যেঠু তার হাতের হান্টার রাইফেল মাটিতে ফেলে দেয় । রঙ্গীল দেখে মাঝিটার ডান হাতে ত্রিশূল আঁকা একটা উল্কি ।
–জয়রাম!!!
–হ্যাঁ । যাক । এইবার দাড়ি গোঁফ খুলে ফেলি । তোমাকে সাবাশি দেব রঙ্গীল । চন্দনবাবুকেও । তোমরা না থাকলে আমার এই অবধি আসা হতো না।
অমূল্যজ্যেঠু রাগে হিস হিস করে বলে,”খেলা তোমার শেষ জয়রাম । পুলিশ তোমাকে খুঁজছে । পালাবার পথ তোমার নেই । এতো বড় সিন্দুক নিয়ে তুমি কোথায় পালাবে ?”
–সিন্দুক কে চেয়েছে রাজাবাবু ? আমার এই মণিটা দরকার ছিল । ব্যাস । আপনাকে বিষমাখা মিষ্টি পাঠালাম,আপনি বেঁচে গেলেন । তারপর ভাবলাম থাক না । ওদের ফলো করি । সমাধান করুন আপনারা । ফসল ফলাবেন আপনারা । খাবো আমি । তাই রাসমঞ্চ দোলমঞ্চ,কতো জায়গায় কতো সুযোগ পাবার পরেও কারোকে কিছু করিনি ।
–জয়রাম । ওই মণি তুমি নিও না । ওটা ব্লাড ডায়মণ্ড । অভিশপ্ত । অভিশপ্ত বলেই এতোদিন ওকে জলের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন নাড়াজোলের রাজারা । কর্ণগড়ের ধ্বংস হবার কারণও হয়তো ওই মণি ।
–বকওয়াস । ও মণি হামি নিব । বাইরে আপনার অনাদি ইন্তেজার করছে । বাই বাই এভরিওয়ান ।
দরজা অবধি এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জয়রাম সিং । তারপর অমূল্যজ্যেঠুর দিকে তাকিয়ে বলে,”অমূল্যবাবু । আপনার ফোরফাদার আমার ফোরফাদারের জান বক্স দিয়েছিল একদিন। তাই আমিও আপনাদের জান বক্স দিলাম । হিসাব বরাবর । আলবিদা ।”
জয়রাম সামন্ত্যক মণি নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই গরের ভিতর আবার অন্ধকার নেমে এল । গুপ্তধনের ভিতর থেকে একটি হীরের আঙটি তুলে নিলেন অমূল্যজ্যেঠু । তারপর সেটা পরিয়ে দিলেন চন্দনের হাতে ।
–আজ থেকে তুমি আমার রাজবাড়ির ছোটকুমার । কী রাজি ?
চন্দনের চোখ ছলছল করে । হীরের আঙটি নয় । তার কাছে আসল সামন্ত্যক হলো অমূল্যজ্যেঠুর ভালোবাসা । প্রণাম করতে গেলে তাকে জরিয়ে ধরে জ্যেঠু ।
–আর রঙ্গীল । তোমার জন্য এইটা থাক ।
রঙ্গীল অবাক হয়ে দেখে এক আশ্চর্য কলম অমূল্যজ্যেঠুর হাতে । সেই কলম সোনায় মোড়া । তার উপর লাল নীল সবুজ,কতো রকম পাথর ।
–এই কলম পুরুষাণুক্রমে নাড়াজোল রাজবাড়িতে প্রবর্তিত হয়ে আসছে । এই কলমেই রাজা মহেন্দ্রলাল খান তার অসামান্য বইগুলি লেখেন । এই কলম তোমার ।
আজ পুরো নাড়াজোলবাসীর নেমন্তন্ন অমূল্যজ্যেঠুর বাড়িতে বড়ি উৎসবে । বিউলির ডাল বাটা দিয়ে তৈরি হচ্ছে গহনার মতো দেখতে বড়ি । একটি গহনাবড়ির মাথায় সিঁদুর দিয়ে তার সঙ্গে আরেকটি বড়ির বিয়ে দেওয়া হবে । এই গহনাবড়ি খেয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চমকে গিয়েছিলেন । হিরণ্ময়ী দেবীকে লিখেছিলেন,”ইহার শিল্প নৈপুণ্য বিস্ময়জনক ।” এসব দেখে রঙ্গীলের মনে হয়েছে অতিমারী আসলে একটা ভাইরাস নয় । মানুষের ,ঘৃণা,হিংসা আর অজ্ঞানতাই হল আসল অতিমারী যা মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে খেঁপিয়ে তোলে ।
আর তিন্নি ? সে কী পাবে ?
– তোমার জন্য এই ছোট্ট চুলের কাঁটা । এই কাঁটাটি রাণী শিরোমণি ছোটবেলায় ব্যবহার করতেন । তবে তুমি নিজে ব্যবহার করলে হাতে ফুটে যাবে । তাই তোমার মেসোর হাতে দিলাম ।
হাতির দাঁত আর সোনায় মোড়া সেই চুলকাটা রঙ্গীলের মেসোর হাতে দিল জ্যেঠু । বাকি সিন্দুক আপাতত পড়ে থাক । জ্যেঠু বলল ।
–ওটা রাষ্ট্রের সম্পদ । বিভীষণকে বলি । ও যা করার করবে ।
সকলে জলহরির উপরে উঠে এসে দেখে চারপাশ ঝলমল করছে । গ্রহণ কেটে গেছে । জলহরির সিঁড়ির ধাপে নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছেন রামতনু কাহার । অমূল্যজ্যেঠু বিস্মিত হন ।
–একি ! আপনি ?
–আমার কপালে আমার পূর্বপুরুষদের দেওয়া ব্রত রয়েছে । রাজাদেশ পালনের ব্রত । আমি সেই ব্রত খণ্ডন করতে দেব না রাজাবাবু । আমি সত্যিই নির্দোষ ।
–জানি তো । তুমি চিন্তা করো না রামতনু । বরং আমাকেই ক্ষমা করো ।
নৌকো অবশেষে পারে ভিড়তে না ভিড়তেই তিন্নি বলে ওঠে,”ব্যাটা জয়রাম শুধু পালিয়ে গেল । “রামতনুকাকু সে কথা শুনে ফেলে বলল,”পালাবে কী করে ? আমি তার ব্যবস্থা করেছি ?”
–কী ব্যবস্থা ?
রামতনু মুচকি হেসে বলে,”যখন অবনী ওর গাড়িটা জঙ্গলে পার্ক করে রেখেছিল,আমি তক্কে তক্কে ছিলাম । সুযোগ বুঝেই ওর ফুয়েল ট্যাঙ্কে পাঁচকিলো চিনি ঢেলে দিয়েছি । আমার নাম করে বিষমিষ্টি পাঠানো ? এবার বুঝবে বিষাক্ত মিষ্টির ঠেলা ।”
নাড়াজোলের রাজবাড়ি আজ যেন গমগম করছে । এরই মধ্যে রাজবাড়ির রাধুনের সঙ্গে মাম আর সুনন্দাদিদি মিলে আজ জমিয়ে তৈরি করেছে গহনাবড়ি । বিউলির ডাল বাটা দিয়ে তৈরি অবিকল গহনার মতো দেখতে বড়ি । রাজবাড়িতে অনেকদিন পর অনেক লোক সমাগম হয়েছে । কারো মুখে আপাতত অতিমারীর ভয় নেই । গ্রামের বউয়েরা এসে রাজবাড়িতে রান্নাঘরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । আজ পুরো নাড়াজোলবাসীর নেমন্তন্ন অমূল্যজ্যেঠুর বাড়ি । এসব দেখে রঙ্গীলের মনে হয়েছে অতিমারী আসলে একটা ভাইরাস নয় । মানুষের দারিদ্র, ঘৃণা, হিংসে আর অজ্ঞানতাই হল আসল অতিমারী যা মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে খেঁপিয়ে তোলে । একটি গহনাবড়ির মাথায় সিঁদুর দিয়ে তার সঙ্গে আরেকটি বড়ির বিয়ে দেওয়া হবে । এরই মাঝে সুনন্দাদিদি বলল,”জানো রঙ্গীল? এই গহনাবড়ি খেয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চমকে গিয়েছিলেন । হিরণ্ময়ী দেবীকে লিখেছিলেন,”ইহার শিল্প নৈপুণ্য বিস্ময়জনক ।” বড়ি উৎসবের পাশাপাশি আরেক উৎসবের মেজাজ অমূল্যজ্যেঠুর দরবার ঘরে । আজ নাড়াজোলের রথ আবার লঙ্কাগড় থেকে ফিরে আসছে । কিন্তু সেই আনন্দর সঙ্গে মিশে আছে এক অন্য আনন্দর খবর । বিভীষণ মণ্ডল আর তার দলবল লঙ্কাগড়ের গুপ্তধন উদ্ধার করেছে । সেই গুপ্তধনের অর্থমূল্য পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা । সরকার অমূল্যজ্যেঠুকে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশেই লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । এই অর্থমূল্যের বড় একটি ভগ্নাংশ ব্যবহৃত হবে এই অঞ্চলের উন্নয়নে । এলাকায় মস্ত বড় রাস্তা,হাসপাতাল,আর লঙ্কাগড়ের সংস্কার । এর সঙ্গেই সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে নাড়াজোল আর লঙ্কাগড়কে একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য । চন্দনের মুখ ঝলমল করছে । তার আজ খুব আনন্দ । তার স্কুল আরও বড় হয়ে উঠবে । পাশে তৈরি হবে কলেজ । চিত্রকর পাড়াই বা বাদ যাবে কেন । সেখানকার প্রত্যেক শিল্পীকে সরকার বিশেষ ভাতা দেবে । এতো সব খুশির খবরের ভিতরে বসেও বিভীষণ মণ্ডলের মুখ ব্যজার । গোমড়া মুখে সে মুগের জিলিপি আর গহনা বড়ি খেয়ে চলেছে । সাঁওতালি কেন,কোনও ভাষাতেই তার মুখে কোনও টুঁ শব্দ নেই । তিন্নি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল । “কী গো বিভীষণকাকু । তোমার মন খারাপ কেন ? রহস্য সমাধান হয়ে গেছে তো ?” উত্তরে বিভীষণ শুধুই ভেঁউভেঁউ করে কাঁদে আর মুগের জিলিপি খায় । মাঝেমাঝে শুধু বিড়বিড় করে বলে “সারহাও। আডি সারহাও রঙ্গীল ।”আর ‘থুড়ি থুড়ি’ বলে না কাকু । ব্যাপারটা কী ? বাপিকে জিজ্ঞেস করতে বাপি বলে ‘সারহাও’ শব্দর অর্থ ‘সাবাশ’। অর্থাৎ বিভীষণ মণ্ডল বলছে ‘সাবাশ রঙ্গীল’। সে না হয় হলো । কিন্তু তার মন খারাপ কেন? মাম বলল,”লঙ্কাগড়ের কেসে সাফল্য পাবার পর বিভীষণ মণ্ডলের ডবল প্রমোশন হয়ে গেছে । তাই সামনের মাস থেকে তার পোস্টিং সোজা দাসপুর থেকে লালবাজার পুলিশ স্টেশনে । এর অর্থ আর তার ঘনঘন মুগের জিলিপি খাওয়া হবেই না । নাড়জোলের রাজবাড়ি আসাও হবে না ।” এসব শুনে অমূল্যজ্যেঠু বলল,”কেন হবে না বিভীষণ ? লঙ্কাকাণ্ডর পর লঙ্কাগড়ের আসল রাজা তো তুমিই । যখন খুশি তখন চলে আসবে । তোমার জন্য নাড়াজোল রাজবাড়ির দরজা সবসময়ই খোলা ।”
আর জয়রাম সিং? তার কী হলো ? সে আরেক কাণ্ড । রামতনু কাহারের কৌশল বিফলে যায়নি । অবনীকাকু আর জয়রামের গাড়ি গড়বেতার দিকে যাচ্ছিল । যেই না কেটে নদী পার হতে যাবে,অমনি সে গাড়ি হুটোপাটি খেয়ে পড়ল নদীতে । অবনীকাকু হাত ভেঙেছে । আর জয়রাম সিংহের দুই ঠ্যাঙ। অবশ্য এভাবে না ভাঙলে পুলিশই হয়তো তার দুই ঠ্যাঙ ভাঙত! আপাতত তারা দুজন মেদিনীপুর জেলে বন্দি । আর সামন্ত্যক!জয়রাম বা অবনী,কারো কাছেই সামন্ত্যক মণি পাওয়া গেল না । তাহলে সেই মণি কোথায় গেল?জয়রাম বলেছে সে মণি কেটের জলে ভেসে গেছে । কে জানে সে সত্যি বলছে কিনা । কিন্তু রঙ্গীলের মনে হয় সে সত্যিই বলছে । কারণ সামন্ত্যকের অভিশাপ তার কপালে লেগে থাকলে হয়তো ঠ্যাঙ নয়,আর কী কী সব ভাঙত যেন ওই জয়রামের ।
মন ভালো নেই রঙ্গীলেরও । এতোদিনের আনন্দ,রহস্য,রোমাঞ্চর পর আবার কাল তাকে কলকাতা ফিরে যেতে হবে । অবশ্য রঙ্গীল ঠিক করেছে বাড়ি ফিরেই সে অমূল্যজ্যেঠুর দেওয়া ওই কলমটায় কালি ভরে নাড়াজোল নিয়ে একটা গল্প লিখবে । তিন্নির মনটাও ভালো নেই । তার বন্ধু দুগ্গার যেন আর সেদিনের পর কোথাও দেখাই মেলে না । কী হল মেয়েটার ? একবার মেয়েটার সন্ধানে সেই নদীপাড়ের দোতলা বাড়িটা খুঁজতে গিয়েছিল তারা । গিয়ে তো সকলেই হতবাক । কোথায় বাড়ি !চারপাশে ধুধু করছে ধানক্ষেত! এ কী করে সম্ভব । এসব শুনে নাড়াজোল রাজবাড়ির জয়দুর্গা মন্দিরের পুরোহিতমশাই বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় হাপুস নয়নে কান্না জুড়ে দিল । বলল,”ও যেসে দুগ্গা নয় গো । ও যে সাক্ষাৎ আমার জয়দুগ্গা । মানবী রূপে এসেছিল । তোমরা চিনতে পারোনি ।”কে জানে বামাচরণের কথা সত্যি কিনা । কিন্তু রঙ্গীলের লঙ্কাগড়ে এসে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি চন্দন । একদিন ফিরে যাবার আগে চাঁপাবাগানের মাঠে জোর ক্রিকেট খেলা হলো দুজনের । চন্দন যেমনি জোরে বল করে,রঙ্গীল তেমনই জোরে ব্যাট চালায় । ওদের খেলা দেখে আশেপাশের সকলে ‘হোহো’ করে উঠল । খেলা শেষে নাড়াজোলের নতুন ছোটো কুমারকে জরিয়ে ধরল রঙ্গীল ।
–কলকাতায় এলে আসতে হবে কিন্তু ।
–আসবো তো । আর তোমাকে আবার আসতে হবে সামনের বছর । রথের মেলায় ।
ফেরার পথে গাড়ির ভিতর কথা বলে না কেউ । শুধু আকাশে বাতাসে ভেসে ওঠে সুর । কেউ যেন গাইছে ।”জ্যৈষ্ঠেতে চাঁপাচন্দন ব্রত করেন পার্বতী/আমি এখন ব্রতী,শিবের মতো পাব পতি/খুশি হয়ে দেবেন হর মনের মতন বর/রাজার ছেলে হবে স্বামী বাঁধব সুখে ঘর ।”
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34