- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ৩১, ২০২২
দশইঞ্চি প্রজাপতি
পর্ব ১১

অলঙ্করণ: দেব সরকার
উ।প। ন্যা।স
সেই-পর্বে যদুনাথের জীবনে বউ সুপ্রভার কপালের জোরে, ধুলোমুঠি সোনা হয়ে শুরু করেছে।ফুট ছেড়ে কিছুদিন স্বীকৃতির জমিতে এবং যদুনাথ ভবিষ্য ? পোক্তঠাঁই এর কথা ভাবছে।
আচমকা একদিন, হরিদাস কুন্দু তার রাস্তার ও পাশের লাগোয়া সাড়ে তিনকাঠা জমি ও বেওয়ারিশ স্ট্রাকচার দেখিয়ে, মেয়ের বিয়ের জন্য পাঁচ হাজার কর্জ করেছিল। যে-কালে হাজার সংখ্যাটি মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে স্বপ্নের পরিমাণ। চারকাঠা জমি সহ এম.আইজির ফার্নিস, ঝকঝকে একতলাগুলোর সরকারি দাম তিরিশ হাজার। বিষয়টা আরও কয়েকটা বছর আগের ঘটনা।
যদুনাথের হাতেও বা অত ক্যাশ কোথায় ? তবুও সে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিল না ।
সদ্য বিয়ে হওয়া সুপ্রভার গলা-কান ও হাতের বালা বেচে দিয়ে পাঁচ হাজার সংগ্রহে যদুনাথকে হন্যে হতে হয়েছিল । ঋণ শোধের মেয়াদ দু-বছরের। ইতিমধ্যে ডামাডোল —চিন ভারত যুদ্ধ।
হরিদাস কুণ্ডুর ছোট্ট একটা রং ঝালাইয়ের আস্তানা ছিল স্ট্রাকচারটার মধ্যে । স্টোভ, বালতি পেতলের ঘটি— টুকটাক নানা গৃহ আসবারের মেরামতি হত ।
হরিদাস কিন্তু যদুনাথকে হাড়ে হাড়ে চেনে। ঘাড়ে টেবিল চেয়ার চাপিয়ে এলাকা ঘোরা থেকে, ফুটে বসে পসার জমানো— তখন শহরের জনসংখ্যা কম—সকলের বংশ ঠিকানা জানে। বিশেষত, বাঙাল ও কলোনির মানুষদের ওপর এ দেশীয়দের কিছু অনাস্থা ছিল।
হরিদাসরা গঙ্গার ধারের, বহ পুরনো কলুপাড়ার বাসিন্দা। বহু কাল আগে ভিটে ছিল হুগলির হরিপালে। চার পুরুষ এখানে আছে।ঋণের কথা নয়, তবু জ্ঞাতিদের সঙ্গে মামলায়-মামলায় হরিদাস তখন জর্জরিত। হঠাৎ একটি সুপাত্র জুটে গেছে— সুযোগটা কি ছাড়ে কেউ? কলুপাড়ায় কর্জ ককরবার সুযোগ সে নিতে চায়নি।
তাই, দুবছরের মেয়াদ ফুরোবার আগেই নানা উৎকন্ঠা ও ধান্দার মধ্যে হরিদাস মতলবে ছিল ঋণ শোধ দিয়ে সম্পত্তি উদ্ধার করবে।
যদুনাথের মিছরির ছুরির মতো ব্যবহার ও নানা ফন্দিফিকিরে তা সম্ভব হয়নি। বড় ছেলে সুধন্যকে দোকানে বসিয়ে রেখে বেশিরভাগ সময় সে উধাও। লোকচক্ষুর অন্তরালে রটানো হত সে নাকি উত্তর বাঙলার –লগ-এর সন্ধানে। আর তখন উত্তর বাংলা দুর্গমই। সরাসরি ট্রেন নেই। ফারাক্কা হয়নি। বিহারের সাহেব গঞ্জ দিয়ে, চওড়া গঙ্গা পেরুতে হোত।
যদুনাথ নাকি ফার্নিচার ব্যবসার পাশাপাশি, শহরে চোড়াই ও কাঠের গোলা বসাবে। এতে লাভ নাকি দ্বিগুণ।
এ-ভাবে, ছলে বলে কৌশলে, সময় উতড়ে গেলে, চুক্তির খেলাপে হরিদাসকে জমি ও দোকান খোয়াতে হয়।তবে, স্ট্রাকচারটার জন্য উল্টে যদুনাথ সাতশ অতিরিক্ত মূল্য দিয়েছিল হরিদাসকে।
হরিদাস আজ নেই। সেদিন অভিশাপ দিয়েছিল যদুনাথকে। একজনের দুষ্কর্মে, সকল কলোনির মানুষদেরও । তবে হরিদাসের ছেলেরা বড় হয়ে পাশেই নতুন করে একখন্ড জমি কিনে, রঙ এর ব্যবসা খুলেছে। সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সম্পত্তি উদ্ধার । মামলার পথে হাঁটা –খানিক সংঘর্ষের পথে এগিয়ে সফল হয়নি। ভাগ্যের অনুকূল্যে, যদুনাথও তখন তরতরিয়ে অর্থবান। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা। যদুনাথ ঠাণ্ডা মাথায় নিজেকে ক্রমাগতসুরক্ষিত করতে করতে একদিন ‘নীলোৎপলা’ ফার্নিচারের রমরমা জেগে উঠল। এ-বূত্তান্ত এখন হারিয়ে গেছে। উল্টে, হরিদাসের ছেলে বৈদ্যনাথ এখন রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের অন্তর্কলহ ও গোষ্ঠী কালচারে যদুনাথেরই পরামর্শে চলে।
আজ উন্নয়নে মোড়া শখের পুরের প্রাণকেন্দ্রে ব্যবসা বাণিজ্যের সায়বাটিতে যদুনাথ ন্যায়-অন্যায়ে বিশ্বাস না করলেও, তারা মায়ের কূপা পেয়েছে। এখন সে আর জমির হাঙ্গর, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব নয়। সকলেই বিপদ আপদ বা সামাজিক সংকটে একবার যদুনাথের সঙ্গ লাভের কথা ভাবে। তপেশ চক্রবর্তীর কাছে পৌঁছনোর খুঁটি হিসেবে নয়। সকলেই জানে, দশদিন অশৌচের … হলেও, দুজনের মধ্যে দুস্তর ইগোর লড়াই ।
শহরের শতবর্ষ প্রাচীন, শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়টি তো স্টেশনের কাছে, ব্যবসাকেন্দ্রের ঘের-এরমধ্যে অতীত জড়িয়ে এখানে দাঁড়িয়ে। একটি চরিত্র হয়ে গেছে। সকলেরই ছেলে-মেয়ে এখানে পড়ে বা এককালে পড়ে গেছে। ফুট ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবসার অনেক মালিকই এ-অতুলের পুরনো ছাত্র।
হেডস্যার একদিন ফোনে যদুনাথকে স্কুলে দেখা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন মুঠোফোনের যুগ দূরে থাক, হুদো হুদো বাড়িতেও ল্যান্ড ফোন ঢোকেনি। সরকারি গ্রান্ট এসছে, কিছু বেঞ্চ, চেয়ার ও বড়বড় টেবিল — গবেষণাগারের জন্য— প্রয়োজন। নীলোৎপলা ফার্নিচার-এর সুনাম আছে, স্থানীয়, স্কুলের এলাকার মধ্যেই দোকানটি— হেডস্যার অনঙ্গ বাবু খুবই বিবেকে ব্যক্তিত্ব। স্কুলের স্বার্থ, এলাকার স্বার্থ— এর বাইরে কিছুই বিবেচ্য নয় তাঁর কাছে।
খুবই শৌখিন মানুষ, দেশভাগের আগের বছর পুরের স্কুলটির হাল ধরেছিলেন। তখন এটিকে গোয়াল ছাড়া আর কিছু বিশেষণ দিত না অঞ্চলের মানুষ। দেশ ভাগের পর, শখথের পুর কলোনি ও রিফ্যুজি এলাকা হয়ে গেলে, নানা আইনকানুন, বিরোধিতার মধ্য দিয়ে স্কুল টিকে ধীরে ধীরে অঞ্চলের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । এ শহরের মানুষ নন তিনি— নৈহাটির শাস্ত্রী বংশের সন্তান— হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয় নামে যে বংশটি গৌরবাহ্নিত।
সুঠাম শরীর। কখনো ফিনফিনে ধূতি-পাঞ্জাবি, হাতে কোচা, কখনো শীতের দিকে স্যুট-কোট পরিহিত ইংরেজ।ছেলেপুলেরা হৈ হট্টগোল চালালে, তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে চুপচাপ এসে দাঁড়াতেন । সব যে যার ক্লাসরুমে ছুট। ছয়ের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-নীতির বদল ঘটতে, নতুন একঝাঁক তরুণ শিক্ষক বিদ্যালয়ে ঢুকলে — অনঙ্গ বাবু তাদের উৎসাহিত করে, একটা টিম বানিয়ে স্কুলের ভোল বদলাতে থাকেন। বছরটা মনে নেই, এগারো ক্লাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরেই শখেরপুর স্কুল থেকে সারা রাজ্যে মৃন্ময় সরকার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল । ধীরে ধীরে অনঙ্গ বাবু শখের পুরের শিক্ষা জগতে একজন ফিগার হয়ে উঠলেন। ‘মাতব্বর’ তপেশ ও বছর দুই এ স্কুলে পড়েছিল । পড়ে অন্যত্র ভর্তি হয়।
হেডস্যারের ডাক পেয়ে যদুনাথ গর্বিত। নিজের গাড়িতে স্কুল গেট চত্বরে ঢুকতে পারত। বিকল্পে হেঁটে এল।সিল্কের একটি পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসে মুগ্ধ তাকিয়ে ছিল। অনঙ্গ সোজা ঝাপটা কথা বলেন ।
যদু বাবু!
হাত জোড় করে ‘বাবু বলবেন না।যদু …বইলে হুকুম করবেন । ’
বড় টাকার কাজ তো ! … কমিটি টেন্ডারের কথা বলতে পারে.. দু চারটে অন্য ফার্নিচারের দোকান থেকে দর নেব…দেখবেন ব্যাপারটা যেন… আমি চাই, হ্যাঁ, তুমিই দায়িত্বটা পাও!
ছার ! …সরস্বতীর এই ছাদের নিচে বসার যে সুযোগ দিলেন আজ…আমার ভাগ্য…আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ ছার! …আমি, লজ্জা নাই আপনার কাছে, লেখাপড়া জানিনা…ওপারের বাস্তু হারা…অনেক কষ্টে একটু দাঁড়িয়েছি…কাজটা আমারে না দিলেও দুঃখ নাই… শখের পুরের এই স্কুল টার কাজে কিছু ডোনেট করার থাকলে হুকুম করবেন। …নীলোৎপলা ধন্য মনে করবে!
তুমিই করবে। ফাইনাল ! প্রধান শিক্ষক আশ্বাস দিলেন । …টেন্ডারের বিষয়টা মামুলি। …আইন বাঁচানো।যা দরকার খবর দিবেন!…আমার লোক মাপ নিয়া যাবে…লেখাপড়ার জন্য কিছু করতে পারলে ধন্য হব ছার !
সেদিনই ঘটনার উপলক্ষ্যে শখেরপুর স্কুলের মধ্যে পা রেখেছিল যদুনাথ।তখন স্টেশন অঞ্চলের সুখ্যাত ব্যবসায়ী হয়ে গেলেও, দুর্বলতার জন্য ভেতরে ঢোকেনি কোনো দিন। প্রয়োজন হয়নি। হেডস্যার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলে। তাঁর সৌজন্যবোধ প্রখর। যদুনাথ এ জন্যও খুব কৃতজ্ঞ । এতটাই অভিভূত হয়েছিল, তার ঘনিষ্ঠ আড্ডার মহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনঙ্গ স্যার, দালানকোঠা, নতুন ইলেভেনের ব্যবস্থায় ঝকঝকে ল্যাবরেটরির কথা…বলতেই থাকে।
রোগাপাতলা, ফেজ ওয়ান, এনব্লকের সুরজিৎ কাঞ্জিলাল শেষ অবধি চাপতে না পেরে, বলে উঠেছিল, আপনি মার কাছে অতো মাসির গপ্প ছাড়বেন না।
দীনবন্ধু বলে, সুরজিৎ ঐ স্কুলে পড়ায় …জান না?
জানবা না কেন! …মাসির বাড়ির বেশি আদর পাইলে, মাকে বলব না?
আড্ডায় হাসির রোল। প্র্যা-কটিকাল! ব্যবসায় মানুষ অনেক প্র্যাকটিকাল হয়।
সুরজিৎ বলে, শুধু পড়াই না! …আমি অনঙ্গ বাবুর ছাত্র…ফাইভ থিকা ওই স্কুলে পড়ি!
যদুনাথ বলে, ফাইভ থিকা? তখন তো আবাসন হয় নাই… আমরা আশ্রমে ঢুকে উৎপাত চালাতাম!
সুরজিৎ, আমরা তো আগরপাড়ার লোক…ফ্যামিলি ভাগাভাগির পর…এই আবাসনে!
পরে স্কুলের প্রথম সুযোগ্য ছাত্র মৃন্ময় যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়। শখেরপুর অঞ্চল ও স্কুলের মধ্যেও এলোমেলো বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল ।এটা পরবর্তীতে, সুরজিৎ এর মুখ থেকে মৃন্ময় শুনতে পায়। অমন একনিষ্ঠ অনঙ্গ স্যারও সময়ের চাপে কেমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন মাঝেমধ্যে।
রাত বিরেতে, যেখানে-সেখানে প্ল্যাটফর্ম চত্তরে নিখিল অচেনা কাউকে দাঁড় করিয়ে বিড়ি চাইত, যুক্তি দিয়ে কথা বলত। কত দাম মশাই একটা বিড়ির ?
মৃন্ময় , আমাদের আবাসনের এস.আই.জি. বল্কের এক উন্নাসিক, ইস্টার্ন রেলের এক বড় অফিসার অনিল দাস এর ছেলে তুহীনকে স্যার সায়েন্সে ভর্তি করলেন। দাসের স্ত্রী মাদ্রাজি ব্রাক্ষ্ণণ। মহিলা দেখতে কি! ফর্সা, লম্বা! উনিও ডি. ভি. সির উচ্চপদে আছে! তামিল রা যে এত ফর্সা হয়, জানতামলা! এখন অবশ্য ভুলটা ভেঙ্গেছে… ছেলেটার পেটানো স্বাস্থ্য, কুস্তিগিরের মতো, ক্লাশে দুর্বিনীতের মতো বুক চিতিয়ে কথার উত্তর দিত। হঠাৎ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, এমন সব প্রস্থ করত মানে হয় না। … তোমাদের সময়-টময় ছেড়ে দাও.. পরেও হুরহাঙ্গামার কালে দেখেছি, শখেরপুর স্কুলের ছেলেরা ক্লাশে স্যারদের ধমকে মাথা নীচু করেই রাখত… তুহীনের মধ্যে কেমন একটা ঔদ্ধত্য… একদিন জীবন স্যার কে বলে কি — তোমাদের আমলের মাস্টারমশাই — আপনি আমার মাথা গরম করবেন না স্যার ! … সত্তরে যে স্কুলটা পুড়েছিল… ওর নেতূত্বে… তখনতো ঝামেলা লেগেই থাকত… একদিন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি… উঠোনে দুদল ছাত্রের মধ্যে খুব হৈচৈ, ঝামেলা চলছে…একদল কারও শহীদ হওয়া পালন করবে, অন্যদল তা করতে দেবে না…এই নিয়ে গড়াতে গড়াতে দেখি কি, তুঁহীন ফুঁসতে ফুঁসতে, চুল খাড়া হয়ে লম্বা, প্রায় ছাদে ঠেকে যাচ্ছে। কোথা থেকে গাঁইতি এনেছে, হাতের পেশী ফুলিয়ে সেটাকে শূণ্যে তুলে আশিসের ব্রক্ষ্ণতালুতে খাড়া তাক করেছে।চোখগুলো দেখে মনে হল আমার সব্বনাশ। … দৌড়ে সিড়িঁবেয়ে নেমে গিয়ে, গাঁইতিটা সরিয়ে দিলাম।…অনঙ্গঁ স্যার পরে এর কোনো স্টেপ নিতে পারেনি।
এই তুহীন দাসই পরবর্তীতে শহরের নিখিল। যে ছদ্মনামটা ব্যবহার করতো – সেটাই পরবর্তীতে স্থায়ী হয়ে যায়।স্কুল পার করে মস্তিস্ক বিকূতির সূচনা।… চিকিৎসাতেও সুবিধে হয়নি। রাত বিরেতে, যেখানে-সেখানে প্ল্যাটফর্ম চত্তরে নিখিল অচেনা কাউকে দাঁড় করিয়ে বিড়ি চাইত, যুক্তি দিয়ে কথা বলত। কত দাম মশাই একটা বিড়ির? চাইলেই নেই নেই করেন কেন ?
অনিল দাস এবং তার পরিবার দেখল মহাবিপদ। খুবই সুন্দরী দুটো মেয়ে আছে।পারিবারিক প্রেস্টিজ, কন্যা দুজনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে –
-—নিঃশব্দে বাড়ি বিক্রি করে চলে গেল। ফেলে গেল নিখিলকে।তবে মাতা পিতার কর্তব্য হিসেবে, স্টেশনের স্টেটব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে, ওর নামে মোটা টাকা গচ্ছিত রেখে গেল।
ময়লা হাত পা, নখ, চুল দাড়িতে এখনও নিখিল ব্যাঙ্কে ঢোকে, মাসখরচের টাকা তোলে।কোথায় আশ্রয়, কী খায়, রাতে থাকে কোথায় —
— এখন শখেরপুরের মানুষ কৌতুহল হারিয়ে ফেলেছে।
তবে অনঙ্গঁ স্যারের মূত্যুর সময় নিখিলের মানসিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না।
অনঙ্গঁ স্যার অকূতদার ছিলেন, অবসরের পর আর নৈহাটির পরিবারে ফিরে যায়নি। বাস্তব, তাঁকে ফিরতে দেয়নি শখেরপুরের অসংখ্য প্রিয় প্রাক্তন ছাত্রকূল, গঙ্গারধারে নিরিবিলি একটি বৃদ্ধাবাসে থাকতেন। এর মালিকটিও অনঙ্গঁ ভট্টাচার্যের প্ৰথমপর্বের ছাত্র।
মূত্যুর পর মরদেহ বিদ্যালয় প্রঙ্গণেই শায়িত ছিল। সম্ভবত বর্ষাকালের কোনো এক দুপুরবেলা।
সকালে প্রবল বর্ষণের পর, বেলা বারোটার পর ধরে গেছল। আকাশটা ছিল মেঘভারে আচ্ছন্ন।তখন শখেরপুর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নতুন একজন।তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র – শিক্ষক হিসেবে অনঙ্গঁ ভট্টাচার্যই তাকে নিয়োগ করেছিলেন। খবরটা পোঁছতেই ছুটি দেয়া হয়। মৃতদেহ অনেক পরে আসে।সামান্য কিছু ছাত্র উপস্থিত, বাকি সকল চলে গেছে।
ফুটের দোকানের অনেকেই উঁকিদিয়ে নমস্কার জানিয়ে চলে গেছে।ট্রেনযাত্রীদের অনেকেই সামনে দিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার পথে তাকিয়ে দেখছে, বিদ্যালয়ের মস্ত গেট আজ হা করে খোল।অঙ্গনে ফুলে মোরা খাটিয়ায় একজন শায়িত। যুগের বদল ঘটে গেলেও, একটু-আধটু পূরণো যুগের স্মরণ যে হয়নি, এমন নয়।
যদুনাথ এসেছিল। অনেক বেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর খবরটা পেতে, এসেছিল।দুপুরের ঢিমেতালের ব্যবস্যাকেন্দ্রে গিয়ে বলেছে, খাটি গুণী একটা মানুষ আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেল ! … উনি দেবতা ছিলেন… এখনতো সব দুনম্বরীর যুগ !
বৃষ্টি যদিও ছিল না, ভিজে আকাশে পশ্চিমের ক্ষীণ রং জেগে উঠতেই, কোত্থেকে তপেশ তার গাদাখানেক দলবল নিয়ে হাজির। তখনও সে জনপ্রতিনিধি নয়। গোপালশংকরের বিরুদ্ধ শক্তি। এই বিদ্যালয়ে তখন ভর্তির চাপ, অনুত্তীর্ণকে উঠিয়ে দেয়ার নরম-অনুরোধে— নতুন প্রধান শিক্ষক ব্যস্ত থাকে।
তপেশ কোত্থেকে হাজির হয়, শ্রদ্ধার ফটাফাটি দেখিয়ে, মোটামোটা মালা, গুচ্ছ গুচ্ছ ধূপে শবদেহ ডুবিয়ে রেখে, কর্তপক্ষের ঘরে ঢুকে নিয়মরক্ষার দায় সারার পর, দেখা গেল পশ্চিমের দরজাটা দিয়েভক্চদের কাঁধে শুয়ে অনঙ্গঁ ভট্টাচার্য চলে গেলেন, সারা রাস্তার দোকানদার, খদ্দের বা পুরনো পরিচিতরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কতগুলো নাক কাটা, কান কাটার কাঁধে চেপে, দুলকি চালে, রূপকার অনঙ্গঁ অনন্তধামে চলেছেন। নদীরধারেই বূদ্ধাশ্রমটি থেকে মিনিট পাঁচেকের পথে ইলেকট্রিক চুল্লি।
যে-কজন পুরনো ছাত্র- শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে ছিল, সন্ধ্যা গড়িয়ে পুরনো দিনের স্মূতি রোমন্থন করছিল।হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠতেই, প্রধান শিক্ষক ধরলেন। ওপ্রান্তে জনপ্রতিনিধি গোপালশংকরের ঝাঁঝালো ধমক ভেসে এল!
কতগুলো ক্রিমিনালের কাঁধে চেপে অনঙ্গঁ স্যারের শেষ কূত্য হল? কে অনুমতি দিল? আপনারা বাধা দিলেন না?
এর ঠিকঠিক কী জবাবা, নতুন প্রধান শিক্ষক হাতড়ে পায়নি সেদিন।
এভাবেই শখেরপুরের অতীত নানা সময়ের ভাঁজে, প্রবালের দ্বীপের মতো জেগে উঠেছে।
এখন যান আপনারা! …. রাত নামলে অসুবিধা হবে।! কী পরামর্শ দেব আমি?.. দিনকাল ভালো না, এইটুকু বলতে পারি! যদুনাথ হাল ছেড়ে দিল। মা তারার প্রতিশ্রুতির সম্মুখে এখন সে নিরিবিলি থাকতে চায়।
ফুটের লোকেরা তালে মানুষ না? পেট-পোঁদ নেই তাদের? কব্জি খোয়ানো ছেলেটা ফস করে বলে ওঠে। মেজাজ হারায়।
পরিমল সমান্য কুন্ঠাবোধ করে প্রশান্তর কথাবার্তার ঢঙে। যদুনাথ কোনো প্রতিক্রিয়া দেয় না। শান্ত নির্বাকার। বোঝে এই মানুষগুলানই ভবিষ্যতে কাজে লাগবে তার।
শুন !..বড় ঝড়ে কেউ ফাল দেয়না প্রশান্ত! মাথা নামিয়ে রাখতে হয়!
লড়াই করি নাই এর আগে?
লড়াই? একাই করছ তুমি? পাশে কেউ দাঁড়ায় নাই?
দাড়িয়েছেন বলেই তো ছুটে এলাম আপনার কাছে!
শোনো হে ছোকড়া ! … র্যাফ, বুলডোজার দিয়া যেভাবে সাজাচ্ছে, নিজেদের যারযার টুকু আছে, সরাইয়া নাও… আগের উচ্ছেদগুলান ছিল ঢোঁরা সাপ…এ জাত কেউটে… যদি মিছা আশায় বইসা থাকো, আমও যাবে, ছালাও পাবে না !
পথে আসেন! …এর মধ্যে রহস্য আছে।
প্রশান্ত জেদ ধরে বসে।
তখন পরিমলকে ধমক দিতেই হয়।
থামবে তুমি? কবছর ব্যবসায় এসছিস তুই ?
আমাদের লিডার আপনারা… এখন থামতে বলেন ?
রহস্যর কি বুঝিস?… যদুদার কথা শোন, বোঝ!…গুলি যদি নাও চলে, লাঠি চার্জের হ্যাপা সমালাতে পারবি ?
প্রশান্তর থুতনিটা ঝুলে পড়ে। গুম মেরে গেল। পরিমলের উকিলি বুদ্ধি বুঝতে পারে, যদুনাথের কাছে উঁচুমহলের গোপন কোনো খবর আছে। চেপে রেখেছে। নইলে, যে মানুষটা বরাবরের বেপরোয়া স্বভাবের, মানুষের অন্নের উৎসে লাথি পড়লে, বাদবিচারহীন লড়াই চালিয়ে যেতে বলে, আজ কেমন যেন সংশয়ের উপদেশ দিচ্ছে।
হঠাৎ যদুনাথ ঘুরে পরিমলকে বলল, ভুলু আইচ যে ! তার সঙ্গে পরামর্শে বসছ?
বুলুদা গুজরাতে।
কেন?
মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে… বছরের হিসাব-নিকাশ মেটানো…পূজা আসছে!
যদুনাথ এইসব ঝামেলাগুলো উপলব্ধি করে। বৈশাখের শেষেইতো ভুলু আইচ আমেদাবাদের বড় বড় কাপড়ের মিলের কর্তূপক্ষের সঙ্গে বসে।আষাঢ়ের আগেই নতুন নতুন স্টক ঢুকবে, বকেয়ার নিকেশ হবে, নতুন করে চুক্তি করবে মিলকর্তূপক্ষ, ব্যবসার হ্যাপা কি কম?
মানুষ ঈর্ষা করে অতিসাধারণ ঘর থেকে ভুলু আইচ এখন শখেরপুরের একজন নয়, রাজ্যে পরিচিত। শান্তিনিকেতনের শাখা এখন চারচার জায়গায় — দুদুটো কলকাতাতেই। টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনে শখেরপুরের পরিচয় একমাত্র শান্তিনিকেতন। পুজোর মরশুমে, এই মহকুমায় নয়, গঙ্গার ওপারের শহর থেকেও লঞ্চে, নৌকায় স্বচ্ছল পরিবাররা আসে। চারতলা দোকান — পুরোই এসি। গাড়ি পার্ক করবার নতুন স্পেসটা দেখলেই টের পাওয়া যায়, দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত দোকানগুলিকে টেক্কা দিচ্ছে। গাড়ির স্পেস নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট ড্রেসপরে দুজন অতিরিক্ত পুজোর আগে থেকেই নিয়োগ পায়। যদুনাথ আলতো মন্তব্য করল, ভুলু ব্যবসাটা বোঝে… কলকাতার বড় বাজারে উপর নির্ভর করলে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেত ! … এখন কর্মচারী কত ?
পরিমল বলে, এখানের? নাকি সব শাখা মিলে?
এখানে!
চল্লিশ-পঞ্চাশতো হবেই ! … তবে অন্যান্য ব্রাঞ্চগুলো তেমন জমেনি ! … ভুলু আইচের এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় যদু দা! বটগাছ!
যদুনাথ হাই তুলল। খানিক ভেবে বলে, তোমাগো বটগাছটাই চোখে পড়ে, আঙুলের যত্নটা চোখে পড়ে না।এই গরমে আমেদাবাদ… লাস্ট ইয়ার বাইপাস হইছে… জানি সবকিছু এসি, হোটেল, গাড়ি গ্যাছে প্লেনে… ভাবছ কি, রাঘববোয়ালদের সঙ্গে বছরের চুক্তি, কি রিশক? একটা ডিসিশন ভুল হইলে, কোটিকোটি টাকার লোকসান। মাথা সবসময় ঠিক থাকে ?
ঘরখালি করে অনিচ্ছাকৃত একে একে উঠে গেল। পুষ্পার উদ্দেশে যদুনাথ আত্মীয়ের মতো বলে, সংসারটা ফুটে টেনে আনলে কেন? পোলাপান, বউদের সব ঘরে পাঠাও.. এবারের আয়োজন উচুঁ মহল থিক্কা… কারও হাত যাবেনা সেখানে… থানার পুলিশতো ছোটখাটো ব্যাপার!
পরিমল চুপ করে শোনে। বিশ্বাস দৃঢ় হয়, যদুনাথ অবশ্যই ভেতরের খবর কিছু জানে। ওদের পোশাক দেখলেই হাড়হিম হয়ে যায়। এত র্যাফ কেন এই ছোট্ট শহরে? আর আছে দৈত্যের মতো বুলডোজার, অ্যাকশনে যাওয়ার আগে কি শান্ত হয়ে আছে। গায়ে তার একটা ছাপ প্রজাপতি স্থির হয়ে বসা।
শহরের সাধারণ মানুষ দেখে মুগ্ধ। এমন সাইজের প্রজাপতির অভিজ্ঞতা নেই তাদের। প্রায় দশ ইঞ্চির মতো লম্বা। ছোটখাট একটি মুঠোফোন যেন।মাংশল। পাখনাদুটি ফরফরে নয়, ভারি। কালচে সবুজের নানা চিত্তির-বিচিত্তির। এটা কোনো দেশের কী জাতীয় চিহ্ন? নাকি নানা দেশের কিছু কিছু মানুষ মিলে এটিকে প্রতীক করেছে? যেমন আমাদের জাতীয় পশু বাঘ, জাতীয় পাখি ময়ূর।
হয়তো প্রজাপতিটা বিশেষ কোন একটা জাতির নয়, বহুজাতিক।
ক্রমশ..
চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us