- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মে ২৫, ২০২৫
হিরণবালা । পর্ব ৬
কাঁথিতে মানিয়ে নিতে খানিকটা মুশকিলই হচ্ছে হিরণের । অঞ্চলটার জলহাওয়া রুক্ষ । এখানকার ভাষা বুঝতেও তার বেশ অসুবিধে হয় । পেশেন্টদের কাউকে কাউকে নিয়ে ও বড়োই সমস্যায় পড়ে । রামকৃষ্ণবাবু মাঝে মাঝে ওর বিপদতারণ হয়ে ওঠেন । আর নিঃস্বার্থ, পরোপকারী মানুষ বামাপদ তার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সেতু... তারপর

৮
শীত এসেছে । ওদের দেশের মতোই শীত এখানে কনকনে । তবে এখানে শীতের রুক্ষতা যেন একটু বেশি । মনে হয় কামড়ও । কনকনে শীত পড়ে গেলে মনে হয় মানুষের রোগজ্বালা একটু কম হয় । হাসপাতালে তাই ভিড় কমতে থাকে এ সময় । হিরণরা অনেকটা ফাঁকা সময় পায় নিজেদের মধ্যে একটু গল্পগুজব করার জন্য । আজও তেমনই একটি দিন । ডাক্তার দেখাতে যে-কজন এসেছিল তারা ওষুধপত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেছে ।
হাসপাতালের বারান্দায় অল্প রোদে চেয়ার পেতে গল্পে মেতেছে ওরা চারজন । কেরোসিন স্টোভে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে হিরণ। এই কাজটা প্রায়ই রেবাদি বা হিরণই করে । চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছে রামকৃষ্ণ ভট্চাজ, বামাপদ, হিরণ আর ডাক্তার রায় । ডাক্তারবাবুর পুরো নাম রঞ্জন রায় । কিন্তু ওঁকে সবাই ডাক্তার রায় বলেই জানে । এই অঞ্চলের লোকেরা বলে উনি নাকি কাঁথির বিধান চন্দ্র রায় । হিরণ ওকে ডাকে ‘স্যার’।
স্যার বললেন, এই ইলেকশনের রেজাল্ট থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হল। ভারত ভাগ হবেই। হিন্দু আর মুসলিমরা একইসঙ্গে এই দেশে থাকতে পারবে না।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বললেন, মোল্লারা তো সবাই ঝেড়ে ভোট দিয়েছে লিগকে।
বামাপদ বলল, এই কথাটা ঠিক বললেন না ভট্চাজকাকু। মুসলমানদেরকে মোল্লা বলা একেবারেই ঠিক না। আর কে বলল, যে ওরা সবাই ভোট দিয়েছে লিগকে ? কংগ্রেসে কত জন মুসলিম নেতা আছে জানেন ? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কি হিন্দু নাকি ?
রামকৃষ্ণ ভট্চাজ বললেন, দ্যাখ বামা, তোর সঙ্গে তর্কে যাব না। মোল্লারা আমাদের কী নামে ডাকে জানিস ? বাংলায় তোর কংগ্রেসের কী অবস্থা ? তিরিশটা সিট লিগ কোথা থেকে পেল ?
কংগ্রেসে মাতঙ্গিনী হাজরার মতো মহিলা ক-জন আছে ? নেতারা তো প্রায় সবাই ছেলে । অথচ মিছিল-টিছিল হলে তো মেয়েদের ভালোই অংশগ্রহণ থাকে । তাহলে গান্ধীজির কি উচিত ছিল না মেয়েদের মধ্যে থেকেও একজন দু-জনকে নেতাজি বা জহরলাল নেহেরুর মতো নেত্রী বানানো ? লিয়াকতভাই রোজা রাখত না অথচ রবীন্দ্রনাথ যেদিন মারা যান সেদিন ও সারাদিন উপবাস করেছিল । রবীন্দ্রনাথ তো মুসলমান ছিলেন না । মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এই সব কথা ও আড্ডাগুলোতে বলে । কিন্তু শেষমেশ চুপ করেই থাকে। আড্ডাগুলোতে ওর ভূমিকা চা বানানোর আর শ্রোতার
রামকৃষ্ণকাকুর সঙ্গে বামাপদর প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে খিটিমিটি লেগে যায় । রামকৃষ্ণকাকু মুসলিমবিদ্বেষী নন, কিন্তু হিন্দুধর্মের প্রতি ওঁর অগাধ শ্রদ্ধা । নিয়ম করে পুজোআচ্চা করেন । হিরণ দেখেছে, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ না থাকলেও মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না রামকৃষ্ণকাকু । ওঁর ধারণা জিন্নাই মুসলিমদের উস্কে দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করতে চাইছেন । উনি এর আগেও বেশ কয়েকবার বলেছেন, দেশ ভাগ হলে তার জন্য দায়ী থাকবেন মহম্মদ আলি জিন্না । বামাপদ আর রামকৃষ্ণকাকুর মধ্যে তর্ক হলে, হিরণ দেখেছে, সাধারণত স্যার কোনো পক্ষ নেন না । ওদের তর্ক বরং তিনি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেশ উপভোগ করতে থাকেন । তবে এবার কেবল মিটিমিটি হেসেই ক্ষান্ত হলেন না স্যার । বললেন, দ্যাখো বামাপদ, একটা কথা কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু ভুল বলছেন না । জিন্না মুসলিম ভোটকে এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। আসন কম পেলেও অ্যাডভ্যান্টেজ গোজ টু জিন্না । আরেকটা কথাও কিন্তু সত্যি । কংগ্রেসে মোটামুটি উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদেরই দাপট । মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ক-টা আছে তোমার কংগ্রেসে, বলো দেখি ?
বামাপদ বলল, ডাক্তারবাবু, সাতান্নটা আসন পেয়েছে কংগ্রেস । এরপরও যদি আপনি বলেন যে জিন্না অ্যাডভান্টেজ পেয়েছেন, তাহলে আর কী বলি !
স্যার বললেন, আসলে তোমরা ব্যাপারটাকে যত সহজ করে দেখছ, ব্যাপারটা তা নয় । যেমন জিন্নাই কেবল দেশভাগ চাইছেন – এ কথাটা পুরো ঠিক নয় । কংগ্রেসের হাইকমান্ডও দেশভাগ মেনেই নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে । তুমি যদি লাহোর প্রস্তাব খুঁটিয়ে পড়ো বামাপদ, তাহলে দেখবে সেখানে কিন্তু দেশভাগের কথা স্পষ্ট করে বলা নেই । পাকিস্তান চাই মানেই দেশভাগ চাই — ব্যাপারটা ঠিক এত সহজ নয় । রামকৃষ্ণবাবু রাজনীতির লোক না । কিন্তু, তুমি তো রাজনীতি করো । তোমার তো এসব মাথায় রাখা উচিত । রাজনীতিতে সবসময় দুই আর দুইয়ে চার হয় না বামাপদ ।
বামাপদ বলে, আমি দেশভাগের পক্ষে নই । একেবারেই নই । সে কথা আমি দলে বলেছি ।
স্যার বলেন, দল কি তোমার কথা শুনবে ? তুমি তো এক সামান্য কর্মী মাত্র, তাই না ?
বামাপদ এবার চুপ করে যায় ।
এইসব আলোচনা হিরণও চুপ করে শোনে । খুব একটা মতামত দেয় না । রাজনীতি নিয়ে ওর তেমন যে আগ্রহ আছে তা নয় । তবে দেশভাগ নিয়ে তো আছেই । আর দেশভাগ নিয়ে ভাবতে গেলেই রাজনীতির কথা চলে আসেই । গান্ধীজিকে ওর মোটের ওপর ভালোই লাগে । আবার নেতাজিকেও ওর বড্ড পছন্দ । গান্ধীজি নেতাজির সঙ্গে যা করেছেন বলে স্যার মাঝে মাঝেই এই সমস্ত আড্ডায় জানান, সেসব আবার ওর একেবারেই ভালো লাগে না । ওর এটাও মনে হয় যে, কংগ্রেসে মাতঙ্গিনী হাজরার মতো মহিলা ক-জন আছে ? নেতারা তো প্রায় সবাই ছেলে । অথচ মিছিল-টিছিল হলে তো মেয়েদের ভালোই অংশগ্রহণ থাকে । তাহলে গান্ধীজির কি উচিত ছিল না মেয়েদের মধ্যে থেকেও একজন দু-জনকে নেতাজি বা জহরলাল নেহেরুর মতো নেত্রী বানানো ? এইসব ও ভুল ভাবে না ঠিক ভাবে ও জানে না । মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে করে এই আড্ডাগুলোতে ওর নিজের মত দিতে । কিন্তু স্যার, বামাপদ বা রামকৃষ্ণকাকু কেউই ওর মত জানতে চান না । মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, গোয়ালন্দ আর নড়িয়াতে মুসলিমদের মধ্যে ভালো মানুষ যে ও দেখেছে, সেটা জানায় । মানুষটার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসত লিয়াকত ভাই । একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াত লিয়াকত ভাই । মানুষটার সঙ্গে লিয়াকত ভাইয়ের কথাবার্তা মাঝে মাঝেই চুপ করে বসে শুনত হিরণ । দেখত লিয়াকত ভাইও দেশভাগ চায় না । লিয়াকতভাই রোজা রাখত না অথচ রবীন্দ্রনাথ যেদিন মারা যান সেদিন ও সারাদিন উপবাস করেছিল । রবীন্দ্রনাথ তো মুসলমান ছিলেন না । মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এই সব কথা ও আড্ডাগুলোতে বলে । কিন্তু শেষমেশ চুপ করেই থাকে । আড্ডাগুলোতে ওর ভূমিকা চা বানানোর আর শ্রোতার । কোনোদিন যদি ওর মত এই তিনজনের কেউ চায়, তাহলে ও নিশ্চয়ই ওর বিশ্বাসমতো কয়েকটা কথা বলবে ।
আড্ডা ভেঙে গেল একজন পেশেন্ট আসায় । গায়ে জ্বর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির হয়েছে আশি বছরের বৃদ্ধ শওকত আলি । তর্ক ভুলে সবাই মিলে লেগে গেল শওকত আলির চিকিৎসায় । এই অঞ্চলে মুসলমানবসতি তেমন নেই । মাত্র কয়েকজন মুসলিম পেশেন্টই ওরা পায় । শওকত আলি তাদের মধ্যেই একজন । শরীরের ছোটখাটো যে কোনো সমস্যায় হাসপাতালে চলে আসেন । হিরণ দেখল ও নড়েচড়ে ওঠার আগেই হাসপাতালের বারান্দাতেই পেশেন্টের জ্বর মাপবেন বলে থার্মোমিটার নিয়ে চলে এসেছেন রামকৃষ্ণকাকু । কে বলবে যে, একটু আগে তিনি মুসলিমদের বলছিলেন মোল্লা ! একটা দুটো বাক্য বা শব্দের ব্যবহার থেকে কি একজন মানুষকে চেনা যায় ? যায় না । হিরণ ভাবে, মানুষ ঠাকুরের মতো । তার নানা রূপ ।
♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: হিরণবালা । পর্ব ৫
❤ Support Us