Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জুন ১৫, ২০২৫

হিরণবালা । পর্ব ৯

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, তবু প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সাপে কাটা, জলবাহিত রোগের প্রকোপে হাসপাতালে কাজের চাপ বেড়েছে, তবু কাজের ফাঁকে একথা ওকথায় উঠে আসে কলকাতার দাঙ্গা নিয়ে আলোচনা । স্যার বলেছেন এই দাঙ্গার রেশ গড়াবে অনেক দূর । শুনে আবার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে হিরণের... তারপর

অংশুমান কর
হিরণবালা । পর্ব ৯

অলঙ্করণ : দেব সরকার

 
১৩

 
নোয়াখালিতে ভয়ংকর দাঙ্গা লেগেছে। স্যার যেমন বলছিলেন ঠিক তেমনটাই হয়েছে। ভয় করছিলেন যে, এপারের দাঙ্গা ওপারে ছড়াবে। হয়েছেও তাই। স্যার বলছিলেন যে খবর কাগজে লিখেছে, কলকাতার দাঙ্গার চেয়েও অনেক বড়ো দাঙ্গা হয়েছে নোয়াখালিতে। ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার হিন্দু। গান্ধীজি নিজে গিয়ে পৌঁছেছেন নোয়াখালিতে। ওঁর সঙ্গে গিয়েছেন ওঁর অনেক শিষ্যরাও। গান্ধীজি নিজে থাকছেন নোয়াখালিতে। গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। ওঁর শিষ্যরাও থেকে যাচ্ছে সেই সব গ্রামে। দাঙ্গা আটকাতে। মানুষের মনে বিশ্বাস আর ভরসা ফেরাতে। সবকিছুর মধ্যে শান্তি একটাই যে, গোয়ালন্দে হিরণের বাবা-মায়ের গায়ে এই দাঙ্গার আঁচটুকুও লাগেনি। ওর দুই বোনও ভালোই আছে। বাবার চিঠিতেই এইসব খবর ও পেয়েছে। তবে আগে একটা চিঠি এসে পৌঁছত দশ-বারো দিনের মাথায়। এখন চিঠি আসতে এক মাস সময় লাগছে।
 
এদিকে অন্তর্বতী যে-সরকার তৈরি হয়েছে, সেই সরকারও চলছে নড়বড় করে। হাসপাতালে স্যার, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আর বামাপদর কথাবার্তা থেকে হিরণ এসব বুঝতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগ যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু তাতে দেশের ভালো কিছু হয়নি। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জহরলাল নেহেরু। স্বরাষ্ট্র বিভাগের সদস্য আছেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। আর অর্থ দফতরের সদস্য হয়েছেন মুসলিম লিগের লিয়াকত আলি। এই তিনজনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সরকার ঠিক মতো কাজ করতে পারছে না, এমনটাই বলছিলেন স্যার। বলছিলেন যে, লিয়াকত আলি পদে পদে বাধা দিচ্ছেন নেহেরু আর বল্লভ ভাই প্যাটেলকে।
 

স্বাধীনতা দিবসটিকে হিরণ কোনোদিন ভুলতে পারবে না তার কারণ এটা নয় যে, সেদিন সকালের প্রভাতফেরির দৃশ্য এখনও ওর চোখে লেগে আছে । স্বাধীনতা দিবসটিকে ও কোনোদিনই ভুলতে পারবে না কারণ ওই দিনই বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিল সত্য । কলকাতার দাঙ্গার সময় সেই যে অপারেশন করতে দেরি হয়েছিল, সেই দেরিটুকুই মারাত্মক ক্ষতি করে দিয়েছিল সত্যর চোখের

 
আস্তে আস্তে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলও দেশভাগের পক্ষেই জোর সওয়াল করছেন। তিনি নাকি বুঝতে পারছেন যে, মুসলিমরা সংখ্যাগুরু যেসব জায়গায়, দেশ অখণ্ড থাকলে সেসব জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তিনি পারবেন না। হিরণ আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে, বামাপদ আর ওর মতো মানুষরা দেশভাগ না চাইলেও, দেশভাগ হয়তো আর আটকানো যাবে না। ও বুঝতে পারছে দেশভাগ হলে বর্ধমান, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া — এসব জায়গা পশ্চিমবঙ্গেই থাকবে। কিন্তু মালদা, মুর্শিদাবাদ, যশোর, খুলনা –এসব জায়গার কী হবে ও জানে না। এসব কথাও হাসপাতালের আড্ডাতে স্যাররাই আলোচনা করছিলেন। এসব জায়গাতে যেমন হিন্দু আছে, তেমন মুসলমানও আছে। দেশভাগ হলে এইসব জায়গা ভারতেই থাকবে না পাকিস্তানে চলে যাবে তাও হিরণ জানে না। তবে গোয়ালন্দ বা নইড়্যা মনে হয় পাকিস্তানেই থাকবে। কী হবে তাহলে ওর বাবা-মা বোনেদের ? কী হবে নির্মলার ? বেশ কিছুদিন পর ওর নির্মলার কথা মনে পড়ে। এদেশে আসার সময় কেমন ওর কোমরে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা, মনে পড়ে। ওর মন খারাপ করে। কেমন একটু অপরাধবোধও হয় নির্মলাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসার জন্য। ও তো হিরণের মেয়েই। নির্মলার জন্য অপরাধবোধ হলে হিরণ খানিকক্ষণ মুষড়ে পড়ে। তারপর নিজেই নিজেকে বোঝায় যে, ওর দেওররা যেমন বাধা দিয়েছিল তাতে করে নির্মলাকে ও নিয়ে আসতে পারত না। মন খানিক হালকা হয় এভাবে ভাবলে।
 

১৪

 
স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক এখন হিরণবালা কর। তেত্রিশ বছর বয়সি নতুন ভারতবর্ষের একজন মহিলা নাগরিক। দেশ যেদিন স্বাধীন হল, সেই দিনটাকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না হিরণ। নাহ, মধ্যরাতে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর বক্তব্য সে শোনেনি। শুনলেও ইংরেজিতে দেওয়া সেই বক্তৃতার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারত না হিরণ। নার্সের চাকরিটা করার জন্য যেটুকু ইংরেজি বোঝার প্রয়োজন হয়, ও শুধু সেটুকুই বোঝে। ওর ইংরেজির জ্ঞান ওইটুকুই। স্বাধীনতা দিবসটিকে ও কোনোদিন ভুলতে পারবে না তার কারণ এটা নয় যে, সেদিন সকালের প্রভাতফেরির দৃশ্য এখনও ওর চোখে লেগে আছে। স্বাধীনতা দিবসটিকে ও কোনোদিনই ভুলতে পারবে না কারণ ওই দিনই বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিল সত্য। দাদার বাড়িতে ছিল সেদিন হিরণ। পরের দিনই ডাক্তার বাবুর কাছে সত্যকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই কাঁথি থেকে হাওড়ায় এসেছিল হিরণ।
 

“ মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হল বলিদান/লেখা আছে অশ্রু জলে ”। শুনতে শুনতে হিরণ ভেবেছিল, গানে  সকলের কথা লেখা থাকে না। ওই গানটাতেও স্বীকার করা হয়েছে স্বাধীনতা আনতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন যে-বীর শহিদরা। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের জন্যই হিরণের মতো মানুষদের যে-ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা কি কোনোদিনই  কোথাও স্বীকৃতি পাবে ?

 
কলকাতার দাঙ্গার সময় সেই যে অপারেশন করতে দেরি হয়েছিল, সেই দেরিটুকুই মারাত্মক ক্ষতি করে দিয়েছিল সত্যর চোখের। অপারেশন করানো গিয়েছিল অক্টোবর মাসে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন অপারেশন সাকসেসফুল, কিন্তু বেশ কিছু জটিলতা আসতে পারে। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল ডাক্তারবাবুর কথা। এই ক-মাসে কতবার যে ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে সত্যকে তার ঠিক নেই। ধীরে ধীরে বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে আসছিল সত্যর। ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট সকালে ও হিরণকে বলে, মা, আমি বাঁ চোখে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সত্য যখন তাকে এই কথা বলছিল, ঠিক তখনই দাদার ভাড়াবাড়ির পাশ দিয়েই চলেছিল প্রভাত ফেরি। গান হচ্ছিল, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। শুনে অত  ।। জ্যোতি বসুর দলও তখন বলেছিল, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। হিরণকেই তো স্বাধীনতা রাজা বানিয়ে দেয়নি। যে-দাঙ্গার পথ ধরে এল স্বাধীনতা, সেই দাঙ্গার কারণেই তো সত্যর চোখটা নষ্ট হয়ে গেল। যদি ঠিক সময়ে সত্যর চোখে অপারেশনটা করা যেত, তাহলে ওকে চোখটা হারাতে হত না। চোখটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুদিন ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল সত্যকে। সেই রকমই আরেকবার সত্যকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে হিরণ শুনেছিল আরেকটা গান। কানা কেষ্টর কণ্ঠে। মাইকে বাজছিল, “ মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হল বলিদান/লেখা আছে অশ্রু জলে ”। শুনতে শুনতে হিরণ ভেবেছিল, গানে  সকলের কথা লেখা থাকে না। ওই গানটাতেও স্বীকার করা হয়েছে স্বাধীনতা আনতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন যে-বীর শহিদরা, তাঁদের অবদান। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের জন্যই হিরণের মতো মানুষদের যে-ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা কি কোনোদিনই  কোথাও স্বীকৃতি পাবে ? সত্যও কি এক ধরনের শহিদ নয় ? দাঙ্গার জন্যই তো ওর চোখটা নষ্ট হয়ে গেল। বাকি জীবনটা কি ও আর আগের সত্য হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবে ? চোখটা নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সত্যরও তো মৃত্যুই হয়েছে।
 

♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: হিরণবালা । পর্ব ৮

হিরণবালা । পর্ব ৮


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!