Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জুন ৩০, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ১১ : সীমান্ত যুদ্ধ থেকে বজ্রনির্ঘোষ

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ১১ : সীমান্ত যুদ্ধ থেকে বজ্রনির্ঘোষ

 
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

পর্ব এগারো

ইতিহাসের পাসকোর্সের ক্লাস৷ দোতলায় প্রফেসরস লাউঞ্জের উলটোদিকে বড়োসড়ো হলঘর৷ ষাট-সত্তর জন কি তারও বেশি পড়ুয়া বসতে পারে৷ এই হলঘরে পাসকোর্সের ক্লাসই হয় সাধারণত৷ ফুটখানেক উঁচু কাঠের প্লাটফর্ম৷ তার ওপর চেয়ার-টেবিল৷ অধ্যাপকের আসন৷ ইতিহাস পড়তে আমার ভালো লাগে৷ হায়ার সেকেন্ডারিতে সিক্সটিফোর পার্সেন্ট নম্বর ছিল৷ এখনকার নয়, আটান্ন বছর আগে৷ বিএ ক্লাসের বই থেকে নিজে নোট তৈরি করেছিলাম৷ বিমলদা (বস্তিজীবনের এক দাদা, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফের চাকুরে, যিনি ঘুপচিঘরে ষাট ওয়াটের বালবের নীচে সেক্সপিয়র পড়তেন ছুটির সন্ধেয়) বই এনে দিয়েছিলেন৷ কলেজে এসে সেই ইতিহাস কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল৷ এর জন্য পূর্ণ কৃতিত্ব সেই অধ্যাপকের৷ বেল বাজবার গায়ে গায়ে তিনি ক্লাসে ঢুকতেন৷ ক্লাসরুম তখন কানায় কানায়৷ রোল কল করতেন লম্বা একটা সময় নিয়ে৷ তারপর বই খুলে রিডিং পড়ে যাওয়া বাকিটা সময়৷পড়ার মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাতেন পড়ুয়াদের দিকে৷ কোনও প্রশ্ন নেই৷ তাঁর মাথা গুঁজে রিডিংয়ের ফাঁকে ডানদিকের বাঁদিকের দরজা দিয়ে ছাত্ররা একে-একে কেটে যায়৷ অ্যাটেন্ডেন্সের কড়াকড়ি থাকায় রোল কল-এর সময় প্রায় সবাই হাজির থাকত৷ এই অধ্যাপকের ক্লাসে প্রক্সি দেবার উপায় নেই, গলা চেনেন দারুণ, ঠিক ধরে ফেলেন৷ তাই রোল কল শেষ হতেই কেটে পড়া শুরু৷ ক্লাস শেষ হবার সময়, হল প্রায় ফাঁকা, অধ্যাপক খেয়াল করতেন কিনা জানি না, হয়তো তিনিও চাইতেন যারা যাবার তারা যাক৷
 

১৯৬৮-৬৯। কলকাতায় নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল।

  একদিন মনে আছে, শীতের দুপুর, পুজোর ছুটির পর, সেই হলঘরে সেই অধ্যাপকের ক্লাসের জন্য বসে আছি, হঠাৎ ঢুকে পড়ল জনা চার-পাঁচ আমাদেরই বয়েসি৷ তাদের একজন প্লাটফর্মে অধ্যাপকের জায়গায় উঠে বলতে শুরু করল, কমরেডস, আজ আমরা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভালো একটা সময়ে, প্রবেশ করছি৷ নতুন যুগে প্রবেশ করছি৷ নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়ে গেছে৷ স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের শাসক ও শোষক আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে৷ খাবার চাইলে গুলি করে মারছে৷ প্রতিবাদ করলে গারদে ভরছে৷ যারা মানুষের স্বার্থে কাজ করবে বলে ভোটে জিতেছে, তারাও মানুষ খুন করছে৷ এই একতরফা আক্রমণের বিরুদ্ধে কৃষকরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে সামিল হয়েছে৷ উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে জোতদার-জমিদার-পুলিশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ভয়ে কাঁপছে৷ ক্ষেতে খামারে মশালের ফুলকি উড়ছে৷ ছাত্রসমাজকে এই কৃষক যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ আমাদের নেতা কমরেড চারু মজুমদার ডাক দিয়েছেন…৷ নকশালবাড়ি লাল সেলাম৷ কৃষিবিপ্লব দিচ্ছে ডাক, সংশোধনবাদ নিপাত যাক৷ ইত্যাদি৷ তারা বেরিয়ে গেল, অধ্যাপক ক্লাসে ঢুকলেন৷ এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন দরজার বাইরে একপাশে৷ কল রেজিস্ট্রার খুলতে খুলতে বললেন, আরেক উৎপাত জুটল৷ 
 
   বক্তৃতার কথাগুলো হুবহু এরকম ছিল, এমন দাবি নেই৷ তবে বক্তব্য এটাই ছিল৷ এই লেকচার-এর একটা শব্দ সেদিন অচেনা৷ ‘সংশোধনবাদ’৷ ‘প্রতিক্রিয়াশীল’-এর অর্থ ঠিকঠাক না জানলেও চেনা ছিল৷ পরে জেনেছি, সেদিন যিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তিনি তপন সাহা চৌধুরী, থার্ড ইয়ারের ছাত্র৷
 
   দিনকয়েক বাদে ক্যান্টিনের পাশে আরেক ছাত্রদলের সভা৷ এদের জমায়েত বড়ো৷ বক্তা ‘অতি-বিপ্লবী হটকারীদের ঘৃণ্য চক্রান্ত ব্যর্থ করবার ডাক দিচ্ছেন৷’ তাঁর বক্তব্য, জনগণের রায়ে গঠিত জনগণের সরকারের পতন ঘটিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে৷ হটকারী অতি-বিপ্লবীরা এদের দোসর হয়ে কাজ করছে৷ সভা স্লোগান দিল, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ৷ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ৷ মার্কসবাদ লেনিনবাদ জিন্দাবাদ৷ সিআইএ-র দালাল দূর হটো৷ এই সভার বলা সব কথাই যে সেদিন বুঝেছি তা নয়৷
 
   সেইসময়ের কিছু ঘটনা সালতারিখ সমেত এইসময়ের পাঠকের জন্য এখানে উল্লেখ করা মনে হয় দরকার৷ কারণ, এক. ষাট বছরেরও বেশি আগেকার সময়৷ দূরত্ব অনেকটাই৷ দুই. ঘটনা অনেক এবং প্রতিটিই রাজনীতির প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ৷
 

১৯৫৫, ইন্দোনেশিয়ায়। জওহরলাল নেহরু এবং চৌ এন লাই

সাল ১৯৬২

ভারত-চিন সীমান্ত সঙ্ঘর্ষ এবং সারা দেশে কমিউনিস্ট বিরোধী জেহাদ৷ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচিত৷ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল লিখছেন, যখন চিন-ভারত সীমান্ত সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়, আমার ধারণা ছিল ভারত নিরপরাধ এবং চিনই আক্রমণকারী৷ নেহরু ও চৌ এন লাই দু-জনকেই তারবার্তা পাঠিয়ে আমি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিই৷ এই সূত্রে ভারত ও চিন দু-পক্ষের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করে নিজেদের সরকারের বক্তব্য ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-দলিল আমাকে দেন৷ তখন আমি দেখি যে চিনের দাবি গোড়ায় যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি যুক্তিসঙ্গত৷ এমনকি চিনকে আক্রমণকারী বলা যায় কিনা তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে৷ আমি শুধু যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলতে থাকি৷ নেহরু কিন্তু আমার কথায় কান দেননি৷ চৌ এন লাই যা করেছেন আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি৷ (Unarmed Victory) ২০ নভেম্বর চিন একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল৷ চিনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক হারে গ্রেফতার করা হল ভারতরক্ষা আইনে৷
 
সাল ১৯৬৪

 ভাগ হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি৷ কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন লিখছেন, চিন-ভারত প্রশ্নে পার্টি তখন পরিষ্কার দু-ভাগ হয়ে গেল, কোন পক্ষ ‘ন্যায়যুদ্ধ’ করছে আর কোন পক্ষ ‘অন্যায়যুদ্ধে’ লিপ্ত তার বিচার করতে আমরা নিজেরাই ঘায়েল হলাম৷
 
সেদিনের কথা

এই বছরই একটি ধর্মীয় গুজবের প্ররোচনায় দাঙ্গা হল ভারতে ও পাকিস্তানে৷ পূর্ববাংলা থেকে উদবাস্তু স্রোত আবার আছড়ে পড়ল পশ্চিমবঙ্গে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ ক্রেতার হাতের বাইরে যেতে শুরু করে৷
 
সাল ১৯৬৫

 ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ নিষ্প্রদীপ কলকাতা৷ সাইরেন বেজে যায়৷ যুদ্ধের খবরে মাতে দেশ৷ আবার উদবাস্তু প্লাবন৷ জিনিসপত্রের আকাল৷ রেশনে চাল-গম অমিল৷

 


 
সাল ১৯৬৬

 পশ্চিমবঙ্গ চালের চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্য৷ শুরু হয় খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন৷ পুলিশের লাঠিচার্জ গুলি৷ বসিরহাটে গুলিতে নিহত ছাত্র নুরুল ইসলাম৷ কৃষ্ণনগরে গুলিতে নিহত আনন্দ হাইত৷ খাদ্য আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে মিছিলে হাঁটলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ এই বছরের ৩০ আগস্ট থেকে হিন্দু হোস্টেলের সুপারের অপসারণের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন, যা ক্রমে প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে ও অন্যান্য কলেজেও ছড়িয়ে পড়ে৷ সেদিনের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা বহু বছর পর এক মূল্যায়নে বলেছেন, প্রেসিডেন্সি নামক যে অচলায়তনটি এতদিন ঐতিহ্য নামে বহাল ছিল, তার বদলে জন্ম নেয় এক নতুন ঐতিহ্য, নতুন সংস্কৃতি, নতুন প্রেসিডেন্সি কলেজ৷ ফলে আজ প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে বা রাজনীতির ক্ষেত্রে এক পিছিয়ে-পড়া নাম নয়, বরং অগ্রসর নতুন চিন্তা-ভাবনার অগ্রদূত, যা বিংশ শতাব্দ অতিক্রম করে আজও বহাল রয়েছে৷

 

১৯৬০। অজয় মুখোপাধ্যায় এবং জ্যোতি বসু

নকশালবাড়িনামা, সাল ১৯৬৭

 ২০ বছরের কংগ্রেসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট সরকার৷ অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী৷ সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত লিখছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিরাট আশা-ভরসা৷ অনেকেই মনে করলেন, এবার বাংলাদেশের ভালো হবে৷ ধরে নিলেন এখন থেকে বড়লোকের কর্তৃত্ব কমবে, গরিবের মর্যাদা বাড়বে, দুর্নীতি বন্ধ হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে এবং সব মিলিয়ে বেশ একটা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করা যাবে৷
 
পালা বদলের পালা

এই বছর ২৪ মে উত্তরবঙ্গের তরাই অঞ্চল নকশালবাড়িতে কৃষক অভ্যুত্থান৷ পরদিন, ২৫ মে, নকশালবাড়ির প্রসাদুজোতে গণহত্যা চালায় পুলিশ৷ ২ শিশু, এক কিশোর এবং ৮ প্রান্তিক শ্রমজীবী মহিলাকে খুন করে৷ ২৬ মে, প্রেসিডেন্সির গেটে পোস্টার ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’৷ ৫ জুলাই, চিনের পিপলস ডেইলি সম্পাদকীয় ছাপে, ভারতের বুকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ৷ 
 
   ভারত-চিন সীমান্ত সঙ্ঘর্ষের সময় আমার বয়স আনঅফিসিয়ালি ১০৷ বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের সময় ১৫ প্লাস৷ চিরকালের ব্যাকবেঞ্চার আমার পক্ষে এত সব ঘটনা, বিশেষ করে নকশালবাড়ির মতো যুগান্তকারী আন্দোলনের তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হয়নি তখন, এখনও৷ তবু ওই সময়ের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি, এটা তো ঘটনা৷ নকশালবাড়ি কোথায়, কী ধরনের আন্দোলন হচ্ছে সেখানে, কৃষি বিপ্লব কী, কেন কৃষি বিপ্লব এসব প্রশ্ন নিয়ে প্রথম যাঁর কাছে হাজির হই এবং যিনি তাঁর মতো করে বোঝাবার চেষ্টা করেন, তিনি অচিন্ত্য গুপ্ত, বঙ্গবাসীর থার্ড ইয়ারের ছাত্র তখন৷ অচিন্ত্যদার সঙ্গে বিদ্রোহ-স্পন্দিত প্রেসিডেন্সিতে গিয়েছি৷  
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১০

ভোর ভয়ি। পর্ব ১০: দুই বন্ধু, আমি শিক্ষক মানি


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!