- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৩

৭
বর্তমান গো-শকটটি প্রকৃতপ্রস্তাবে অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন হলেও এখন তা যেন মৃদু- মন্থর গতিতে অর্থাৎ ঢিমেতালেই চলছে । আরোহীর প্রতি আকারে-ইঙ্গিতে একটা সন্দর্ভ : বাছা, যাচ্ছ যাও, সবকিছুই ধীরেসুস্থে অবলোকন করতে করতে যাও! আর তো তোমার ফিরে দেখার অবকাশ আসবে না!
আরোহণও তেমন কষ্টকর বা পীড়াদায়ক নয় । তুলনায় বেশ আরামপ্রদই মনে হয় । তবে প্রথমাবধি এ পর্যন্ত সেই-‘একমেবা দ্বিতীয়ম নাস্তি’ ।
গাড়িটি আগাগোড়া চালক- বিহীন । প্রকারান্তরে এখানে দামড়া বলীর্বদ্দটাই বোধকরি একই সঙ্গে বলদ ও চালক । সে-ই তো গাড়ি চড়াইস্তক আমাকে কেমন আড়চোখে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে যাচ্ছে ।
কী আর করি! আমিও দেখতে দেখতেই যাচ্ছি । নাহ্, জল থেকে উত্থাপিত হওয়ার পরে পরেই গ্রামটিকে প্রথমদর্শনে আমার নিজের গ্রাম বলে ভ্রম হচ্ছিল বটে । তবে তা তো তাৎক্ষণিক! পরক্ষণেই বোধ হল -না, না । এ তো অন্যরকম, অন্যরকম ।
কেমন যেন পুরাতন, পুরাতন । প্রত্নতাত্ত্বিক । চারধারটা ধোঁয়াশামাখা । রাস্তায় ঘাটে একটাও লোক দেখি না । যতই যাই হোক, তবু গ্রামটিকে একেবারে জনহীন, লোকশূন্য বোধ হল না ।
ওই, ওই তো বেলতলা, বাবলাতলা, তালতলা । বাটীর সমুখে উঠোনের একধারে দণ্ডায়মান সুবিশাল আমগাছ, জামগাছ । কেউ যদি নাই-ই থাকে, তবে এই সাতসকালে ঝাড়ু মেরে গাছের ‘তলা’-গুলি ঝেঁটিয়ে সাফা করল কে?
তদুপরি বৃক্ষচ্ছায়াতলে দড়ির খাটিয়া পাতা । এমনকি হাত-মুখ ধোওয়ার , বাইরে কৃষি- কার্যে গিয়ে, কাষ্ঠাদি আহারণে বনে গিয়ে, ঘরে ফিরে এসে ধূলাধ্বস্ত পা ধোওয়ার জলও যে আঙিনায় মাটির কলসিতে প্রস্তুত!
খামারে বোধকরি রাতভর ‘পতলি’ চলেছে । ‘পতলি’ তারমানে একাধিক গরু জুতে, তারমধ্যে একটা বয়স্ক গরুকে ‘মেনা’ অর্থাৎ মোড়ল সাজিয়ে ধান মাড়ানো । একদা ঝেড়ে নেওয়া ‘ধানবিঁড়া’-র যৎকিঞ্চিৎ থেকে যাওয়া ধানের দানাগুলিকে ফের ছাড়িয়ে নেওয়া আর কী!
ছাড়ানো ধান এখনও খামারেই পড়ে আছে । একটু বাদেই হয়তো বেলার দিকে গৃহস্থের ‘মাহিন্দর’ এসে ধান ও খড় আলাদা করে দেবে । আলাদা খড় গরুমোষের খাদ্য ও ঘর ছাওয়ার কাজে লাগবে ।
সময় সময় কি সময়ান্তরে এমন তো হতেই পারে । ধরো, কোনও এক সুনসান মধ্য- দিনে আমাদেরই গ্রামের দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে আমাদেরই গ্রামে প্রবেশ করলাম । কৃত্তিকা ভরণী মেঘা অশ্বিনী –‘মেঘপাতাল’-এ অর্থাৎ আকাশে তখন কোন্ নক্ষত্র থাকবে, কোন্ তিথি হবে -বলতে পারি না ।
‘কুলহি’ রাস্তার দুধারে ঘর, গৃহস্থের ঘরবাড়ি । গ্রামের মাথায় একধারে বাঞ্ছানিধিদের ঘর, আরেকধারে রঁভাকাকাদের ঘর । দুধারেই উঁকি মেরে দেখলাম -নাহ্! নেই কেউ ।
জঙ্গল থেকে সদ্য তুলে আনা খুঁটিতে বাঁধা গোছা গোছা শালপাতা ছেড়িছাগলগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছিল কালীকাকাদের বাইরের উঠোনে । ওই ছাগলগুলোই- কই, কোনও মানুষজনকে তো আলাদা করে দেখলাম না? এখন, এখান থেকে গ্রামের হরিমন্দির পর্যন্ত একটানা একদিকে ভুট্টা খেত আরেকদিকে উপর্যুপরি মানুষের ঘর- গৃহস্থালি । এতদূর হেঁটে হেঁটে এলাম -কই, কোনও মানুষজনই দৃষ্টিগোচর হল না, দুয়েকটা কুকুর-বেড়াল কী গরু-ছাগল ছাড়া?
অতঃপর ডাইনে মোড় নিলেই আমাদের ‘বাখুল’ । চিনের প্রাচীরের মতো মাটির তৈরি দেয়াল -চলছে তো চলছেই! প্রাচীর ভেদ করে এক্ষণে লোক দেখা যাবে কী করে? আশ্চর্য, নাচদুয়ারে এসেও খলাখামারে বসমান অথবা দণ্ডায়মান একটা ‘জনমাম্মি’কেও দেখা গেল না? এমনকি, আমাদের নবতিপর পিতামহী যিনি কিনা দড়ির খাটিয়ায় বসে বসে অষ্টপ্রহর কাঁসকুটের বাটি বা তাটিয়ায় এটা-ওটা খেতে থাকেন আর উড়ে এসে জুড়ে বসা কাক-চড়ুইয়ের সঙ্গে অনর্গল কথা বলেন, তিনিও নেই! নেই, নেই । খালি যা তার ফেলে যাওয়া বাটি বা তাটিয়ায় কয়েকটা কাক ইত্যবসরে সুযোগ বুঝে মুখ গুঁজে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে চলেছে!
রাস্তার ধারে চালায় বসে কাঠমিস্ত্রি প্রমথ ঠুকঠাক করে সারাদিনই তো হাল-লাঙল- জোয়াল, গরুর গাড়ির চাকা-আরা-ধুরি, ঢেঁকি, হাল-ডিজাইনের চেয়ার-টেবিল তৈরি করে -সেও যেন এইমুহূর্তে চুপ! বোধকরি কক্ষান্তরে গমন করেছে ।
তার বিপরীত পার্শ্বে প্রায় রাস্তার উপরেই খেজুরপাতার পাটিয়া পেতে দশরথের বউবুড়ি জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা মহুল, কচড়ার বীজদানা রৌদ্রে শুকোতে দেয় । পাছে পথচলতি গরুছাগল মুখ দিয়ে গসা গসা খেয়ে ফেলে -তাই কাছেই বসে থেকে “হেই-হেট- হুট”আওয়াজ করে সর্বক্ষণ পাহারা দেয় ।
আজ রাস্তায় পড়ে পড়ে মহুল-কচড়া পাটিয়ার উপর যথারীতি শুকোচ্ছে । পথচলতি ছেড়িছাগলও তার উপর দিয়ে যাচ্ছে-আসছে । তবুও পাহারাদার দশরথের বউবুড়ির পাত্তা নেই! কোথায় গেল রে? কোথায়?
দুধারের গৃহ-গৃহস্থালি পর্যবেক্ষণ করতে করতে দৌড় দিলাম -দৌড়, দৌড়! পেরিয়ে এলাম শ্রীমন্ত-বসন্তদের ঘর । ‘দুশা’ বা দুঃশাসন, যাত্রাপালায় ‘কৃষ্ণ’ সাজা প্রফুল্ল, হারান- পরাণদের আবাসগৃহ । বাড়ির সামনে খেতিবাড়িতে ঝিঙা-কাঁকুড়ের চাষ করেছে উল্লু-ভুল্লুরা । এখন নয়, মধ্যাহ্ন গত হয়ে আসবে অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণ গড়িয়ে সায়াহ্নের মুখে মুখে রদো বদো করে ঝিঙাফুল ফুটবে ।
তখন ঝিঙা-কাঁকুড়ের মাচানতলে এসে জড়ো হবে উল্লু-ভুল্লুদের বউড়িঝিউড়িরা । অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ করে শিংয়ের কাঁকইয়ে অর্থাৎ চিরুনিতে চুল আঁচড়াবে । পায়ে আলতা, কপালে টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর পরবে । ছেঁড়াখোঁড়া, ঝরন্তি-পড়ন্তি চুল জড়ো করে তারউপর থুতু ছিটিয়ে উড়িয়ে দেবে হাওয়ায় ।
এইমুহূর্তে তাদের একজনকেও দেখা গেল না । খুঁটিতে বাঁধা একটা যা ছেড়িছাগল মুখে ফেনা তুলে জাবর কাটছে । একটা কাক বুঝি বা পোকার লোভে বসি-বসি করেও বসতে পারছে না ছাগলটার গায়ে ।
গ্রামের শেষপ্রান্তেও এসে পৌঁছালাম । সত্যি সত্যিই ভারি আশ্চর্য বোধ হল । ভোজ-বাজির মতো লোকগুলো উধাও হয়ে গেল কোথায়?ম্যাজিসিয়ান যেমন হাতের কারসাজিতে একটা আস্ত ট্রেনগাড়িকে ‘ভ্যানিশ’ করে দেয়, সেই আর কী !
গাঁমুড়োয় ক-ঘর সাঁওতাল পরিবার । অবশ্য সচরাচর তারা গৃহে থাকে না । প্রায়সময় ‘নামাল’ খাটতে ‘পুবাল’ যায় । ‘পুবাল’ তারমানে পুবদেশ । যেখানে সংবৎসর বিভিন্ন সময়ে ধানচাষ হয়, ধান কাটা হয় । নামাল না গেলে গাঁয়েরই মাঠেঘাটে কাজেকামে থাকে । কাজ না থাকলে জমির আল তেড়েখুঁড়ে ‘উন্দুর’ ধরে ।
এহেন সুনসান মধ্যাহ্নে গৃহে তাদের না থাকাই স্বাভাবিক । শুধু যা কতক ‘ঘুসুর’ বা শূওর বাহির উঠোনে জল-কাদা-জমা গর্তে পেট চুবিয়ে শুয়ে আছে । মাঝেমাঝে সুখানুভূতির যেন আওয়াজ দিচ্ছে –“ঘোঁত্! ঘোঁত্!!”
গ্রাম ছেড়ে আরও কিছুটা হেঁটে মুগচনার খেত অতিক্রম করে নদী সমীপে এলাম । নদী, নদী । বর্ষার মরশুম ব্যতীত প্রায় বালুকাময় এই নদী যে শুধু আমাদের গ্রামেরই বা কেন, আরও কতশত, হাজার হাজার গ্রামের, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনজীবিকার আশ্রয় ও সাশ্রয়কারী -তা কহতব্য নয় ।
নৌকাপরিবহন, ঘাটপারাপার, নদীস্নান, নদীতে মৎস্যশিকার, নদীবালিতে স্বর্ণসন্ধান, বালিখাদান, ‘রিভার-লিফটিং’ বা কৃষিকার্যে জলসেচাদি, দিনেরাতে নিত্যকর্ম পূজাপদ্ধতির মতো আরও যে কত কাজে লাগে নদী!
সেদিন সেই মুহূর্তে মনুষ্যপদবাচ্য কোনও কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়নি বটে । তবে কাবা- কুইরি উড়েঘুরে বেড়াচ্ছিল । দূরে মাথার উপরে ভ্রাম্যমান চিলেরা আকাশে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে ‘কূপ’ খুঁড়ছিল ।
একটা নৌকা ঘাটে বাঁধা ছি ল । আরেকটা আলকাতরা মাখাবার নিমিত্ত বালিতে উপুড় করা । তার তলদেশে, এখন পৃষ্ঠদেশ, একটা ‘ঢ্যাপচু’ অর্থাৎ ফিঙেপাখি বসে বসে “ভু-ই-চু-ঙ” “ভু-ই-চু-ঙ” আওয়াজ দিয়ে তার লম্বা ল্যাজটা দোলাচ্ছিল তো দোলাচ্ছিল ।
এসময় দূরদেশ থেকে নদীর আড়াআড়ি কদোপালের চর অতিক্রম করে, অথবা নদীর সমান্তরালে, পূর্ব ও পশ্চিম, দুই তীর ধরে এ-গাঁয়ের সে-গাঁয়ের কুটুম্ব কেউ না কেউ আসেই -আজ একজনও এল না? একজনও না? কেউই না?
ফের গ্রামের দিকে প্রত্যাবর্তনে সমূহ দৃশ্যপট পাল্টে গেল । ‘পাটা’-য় ছপাৎ ছপাৎ করে কাপড় কাচার আওয়াজ পেলাম । ধোপাদের দুই ভাই -সুধীর শীট আর সুবোধ শীট -শ্রাদ্ধে, বিবাহে, তেল-খোলে, নত্যায় যজমানি কাপড় কাচছে সীতানালা খালের জলে দেখতে পেলাম ।
কুমোরদের ‘মাটিখানা’-য় একটানা “খুপ্” “খুপ্” শব্দ । তারমানে খুলিগুহার মতো মাটি- খানায় ঢুকে কুমোররা ‘বারশি’-কোদালে হাঁড়ি-কলসি গড়ার জন্য মাটি কোপাচ্ছে “খুপ্” “খুপ্”!
দেখতেই পাচ্ছি তাদের বাড়ির বউড়িঝিউড়িরা বগলে ঠেকা-পাছিয়া নিয়ে বসে বসে আড্ডা মারছে মাটিখানার মুখটায় । আড্ডা কী আর, কখন একেকটা ঝুড়ি-পাছিয়া মাটিভরতি হবে আর সে-মাটি মাথায় করে নিয়ে ফেলবে খলায় খামারে ।
বাছাবাছি করবে, রৌদ্রে শুকোতে দেবে । কিন্তু, এতক্ষণ তারা কোথায় ছিল? যাওয়ার সময় একজনকেও তো দেখতে পেলাম না?
শুধু কী তাদের? এখন উত্তর প্রান্ত দিয়ে যখন ফের গ্রামে ঢুকছি, তখন ‘মেঘপাতাল’-এ বিজ্ বিজ্ করে অজস্র তারা ফোটার মতো মানুষজনেরও উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি ।
কেউ ঝিঙা-কাঁকুড়ের মাচানতলে, কেউ বা মকাইয়ের খেতিবাড়িতে । কেউ কেউ খলা- খামারে খাটিয়ায় বসে খালি গজল্লা করছে । কেউ তো মুখে ফেনা তুলে আরেকজনকে সমানে বকে যাচ্ছে । আর যে বকুনি খাচ্ছে সে একটাও কথা না বলে গালাগাল হজম করে চলেছে ।
গালাগালই বা শুধু হবে কেন?একজন তো বেড়ার এধারে দাঁড়িয়ে ওধারের মানুষটিকে ‘নাম-মাধুরী’ নাকি ‘পদাবলী কীর্ত্তন’ শোনাচ্ছে! গ্রামের হরিমন্দিরে শ্রীশ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তনে এ-হেন পদ তো কতই শুনি –
’হেনক সময়ে এক সখী আসি
হাসি হাসি কহে কথা ।
উঠ উঠ ধনি ও চাঁদবদনি
ঘুচাব মনের ব্যথা । ।
তবে দূরদিন সব দূরে গেল
উঠিয়া বৈঠহ রাই ।
তোমার মাধব নিকটে আওল
দেখহ নয়ন চাই ।।‘
আজ এতদিন বাদে এহেন গ্রাম কী গঞ্জে এসে সেই সেদিনের মতো আজও কোথাও অনুরূপ লোক দেখি না । ভূ-ভাগটি যেন ইতিহাসের পাতা থেকেই সংগৃহীত । যেন কবেকার এক ধূসর পাণ্ডুলিপি !
তবে কি গ্রামনামও হতে পারে তথৈবচ? ‘বল্লিকন্দর’ ‘বাল্লহিটঠা’ ‘ব্যাঘ্রতটি ’ ‘খেদিরবল্লি’ ‘কন্তেড়দক’ ‘নাদভদক’ ‘কুক্কুট’ ‘বিলকিন্দক’ – যদিও এখন পর্যন্ত গ্রামনামের কোনও ‘বোর্ড’ কোথাও ঝুলতে দেখিনি ।
গ্রাম কী, গঞ্জটি আড়ে-বহরে বেশ বিস্তৃততর । গো-শকট এতক্ষণ চলছে তো চলছেই । এখন না হয় – গজ, মাইল, ক্রোশ, মিটার, কিলোমিটার । তখন তো রাস্তা মাপা হত – যোজন, ভূপাটক, দ্রোণ, আঢক, উন্মান আর কাকে ।
সে হিসেবে কত কী বলতে পারি না । তবে একটা ‘শুভঙ্করী আর্যা’ পড়েছিলাম –
“ খেতে মাঠে রশি না পাই ।
সাল ছেষে কাহন বলাই । ।
চারি কানে লয়ান হয় ।
পঞ্চাশ উয়ানে আড়ি ।
চারি আড়িতে ডোন হয় ।
আঠাশ হাত দড়ি । । “
যাহোক, হয়তো সওয়া মাইলটাক আসা হল । গঞ্জটি একেবারে নিরবচ্ছিন্ন নহে । মাঝে মাঝে বাস্তুভিটা, মাঝে মধ্যে খিলক্ষেত্র অর্থাৎ কৃষিভূমি ।
৮
কিম্ আশ্চর্যম্! বিজ্ঞানবিভাগের শিক্ষানবিশ হয়েও কলাবিভাগের যাবতীয় বিষয়াদি, অ্যা টু জেড, আমি এইমুহূর্তে অবলীলায় রপ্ত করছি কীভাবে? যদিচ ইস্কুলে ক্লাস এইট্ পর্যন্ত সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই শ্রীসুধাংশুশেখর ত্রিপাঠি মহাশয়ের নিকট ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ‘ব্যাকরণ কৌমুদি’ বইদুটির পাঠ কায়ক্লেশে গ্রহণ করেছি । তবু, তবুও –
কোথাও যেন একটা বাস্তববর্জিত অলৌকিক কিত্তিকাণ্ড তলে তলে ঘটে চলছে, তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছি । এই যে গো-শকট, চালকবিহীন, একটুও দিকবিভ্রম না করে সোজাই ছুটে যাচ্ছে, মনে তো হয় গন্তব্যহীন ।
আমাদের মাঝুডুবকার জঙ্গলরাস্তা বরাবর কি কুমারডুবির জলার ‘লিক’ বরাবর ‘উধাস্’ ভাবে গাড়ি চললে এতক্ষণে সে গাড়ি কোথায় কোন্ অঝোরঝর ‘ঢঢ়হা’, অথবা ‘কাঁদর’-এ ঢুকে পড়ত । পড়তই ।
যাহোক, ইতিহাস বলে -অদূরে কোথাও, সন্নিকটে, একদা ‘তামলিত্তি-তাম্রলিপ্তি-দামলিপ্তি’ বা ‘তমোলুক-তমোলিতি-তমোলিপ্তী’ এবং ‘দণ্ডভুক্তি-তণ্ডবুত্তি-দন্তভূমি’ তথা ‘দান্তন-দাঁতন’ -নামের পৃথক দুটি বিখ্যাত জনপদ ছিল । ছিল কী, তার ভগ্নাবশেষ তো এখনও আছে ।
সেখানে যেতে হলে কি অতীতে এইপথ পরিক্রমা করেই যেতে হত? চৈনিক পরি- ব্রাজক ফা-হিয়েন, কী য়ুয়ান্-চোয়াঙ এই পথ ধরেই কি গিয়ছিলেন তাম্রলিপ্তে? দণ্ডভুক্তিতে?
তাম্রলিপ্ত থেকে বুদ্ধগয়া যেতে অথবা অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্ত-দণ্ডভুক্তিতে আসতে – আর কোনও বিকল্প পথ কি ছিল না?
‘বিবরণ’-এ আছে -গঙ্গার ধারা অনুসরণ করে পুবে, আরও পুবে, ফা-হিয়েন প্রায় আঠার যোজন পথ অতিক্রম করে নাকি এসেছিলেন চম্পানগরে । চম্পানগর তো এখনকার ভাগলপুর! হ্যাঁ, ভাগলপুরে গঙ্গাও আছে বটে ।
তারপর সেখান থেকে আরও পঞ্চাশ যোজন পথ উজিয়ে ফা-হিয়েন এসে পৌঁছেছিলেন তাম্রলিপ্তে । সেখানে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে দু বৎসরকাল কাটিয়েছেন ।
পাটলিপুত্র বা বর্তমান পাটনানগরের সন্নিকটে গঙ্গা এখনও বহমান । ওই পাটনা থেকে মুঙ্গের,মুঙ্গের থেকে ভাগলপূর । ভাগলপুর থেকে সুলতানগঞ্জ-সাহেবগঞ্জ হয়ে গঙ্গা এবার দক্ষিণ- পূর্বমুখী ।
অপর পরিব্রাজক য়ুয়ান-চোয়াঙ পাটলিপুত্র-বুদ্ধগয়া-রাজগৃহ-নালন্দা-অঙ্গ-চম্পা হয়ে পদার্পণ করেছিলেন ‘কজঙ্গল’-এ । কোথায়, কোন ভৌগোলিক অবস্থানে -এই তৎকালীন ‘কজঙ্গল’?
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভূ-আন্দোলন চলছে । তোল্ মাটি ঘোল্ হচ্ছে । পুরাতনভূমি ভেঙে নব্যভূমি গড়ে উঠছে । রাজমহল পাহাড়, সাঁওতালভূম-মানভূম-সিংহভূম—ধলভৃমের মালভূমি, এমনকি মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর হয়ে সমুদ্র পর্যন্ত – এই পুরাতন বা পুরাভূমি ।
উত্তর-রাঢ় অর্থাৎ বাঁকুড়া-বীরভূম এবং দক্ষিণ-রাঢ়, তারমানে রানিগঞ্জ-আসানসোল, মেদিনীপুরের শালবনি-ঝাড়গ্রাম-গোপিবল্লভপুর-নয়াগ্রাম, তাম্রলিপ্তি-দণ্ডভুক্তিও সেই পুরাভূমি । এরমধ্যেই কোথাও আছে ‘কজঙ্গল’ যা কিনা ‘জাঙ্গলময়, অজলা এবং অনুর্বর’ । যার তিনভাগ জঙ্গল, একভাগ গ্রাম ও জনপদ!
অঙ্গের রাজধানী চম্পা, অধুনা ভাগলপুর থেকে গঙ্গা ও ভাগীরথী বেয়ে গঙ্গাবন্দর বা তাম্রলিপ্ত আসার জলপথ তো তখনও ছিল, এখনও আছে । শুধু কি জলপথ, স্থলপথে গো-শকটের লহর চলত, তার প্রমানও তো আছে ।
চম্পা থেকে পঞ্চাশ যোজন পথ অতিক্রম করে ফা-হিয়েন এসেছিলেন তাম্রলিপ্তে, সে তো জলপথে, গঙ্গার ধারা অনুসরণ করে । আর য়ুয়ান-চোয়াঙ এসেছিলেন নাকি স্থলপথে চম্পা হয়ে কজঙ্গলে । কজঙ্গল থেকে পুন্ড্রবর্ধনে । পুন্ড্রবর্ধন থেকে কামরূপ, কামরূপ থেকে সমতট, সমতট হয়ে তাম্রলিপ্তে । অনেকটা ঘুরপথে ।
কিন্তু এহো বাহ্য আগে কহো আর । কোথায় থাকল কজঙ্গল, কোথায় বা দণ্ডভুক্তি? হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ভট্টভবদেব ‘রাঢ়ীখণ্ডজাঙ্গল’ ভূমির কথা উল্লেখ করেছেন, যা কিনা অজলা জাঙ্গলময় । এই কি তবে ‘কজঙ্গল’? ‘দামোদর-অজয়-ভাগীরথী উপত্যকা’-র রাজ্য?
ইতিহাসবিদেরা এর সুষ্ঠু মীমাংসা দিতে পারেননি । আমার মনে হয় বর্ধমানভুক্তি আর দণ্ডভুক্তির নিকটেই কোথাও ‘কজঙ্গল’ ছিল । চম্পা বা ভাগলপুর থেকে প্রকাণ্ড স্থলপথ এসে তো মিলিত হয়েছে বর্ধমানে সেই কবে থেকে! দণ্ডভুক্তি একসময় বর্ধমানভুক্তির মধ্যেও ছিল, ছিল তাম্রলিপ্তে-উৎকলেও ।
য়ুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণে আছে – কজঙ্গলের উত্তর সীমা গঙ্গা থেকে খুব বেশি দূরেও নয় । বর্ধমানভুক্তির অম্বিকা-কালনাতেও গঙ্গা তো ছলাৎছল ! শুধু কি কালনা, কাটোয়া-পূর্বস্থলি-মন্তেশ্বরেও গঙ্গা বিরাজিত স্বমহিমায় ।
সেই সার্থবাহ গো-শকটের লহর তোলা পথেই কি তবে বর্তমান গো-শকটও চলেছে ! অনুমান বর্ধমানভুক্তি ও কজঙ্গলের কাছাকাছি কোথাও ছিল দণ্ডভুক্তি রাজ্য ।
সপ্তম শতকের গোড়ায় তাম্রলিপ্তের পতনের পর নাকি দণ্ডভুক্তি রাজ্য ব্যাপক বিস্তারলাভ করেছিল । রূপনারায়ণের দক্ষিণ সুবর্ণরেখার উত্তর ভূভাগ, উৎকলের বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জ আর ছোটনাগপুরের কিয়দংশও তার অন্তর্গত ছিল । তাম্রলিপ্ত জনপদও তখন দণ্ডভুক্তি জনপদের নামেই পরিচিতি পেত ।
সেই দণ্ডভুক্তি দেশটি য়ুয়ান্-চোয়াঙের সময়কালে বোধকরি রাজা শশাঙ্কেরই অধীনে ছিল । এতবড় জনপদ, পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত সেখানে ‘দন্তবন মহা-বিহার’ও বর্তমান, তবু তার উল্লেখ য়ুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণে পাই না কেন ?
য়ুয়ান্-চোয়াঙ তৎকালীন বঙ্গের চারটি জনপদে ভ্রমণ করেছেন – ‘পুন্-ন-ফ-টন্-ল ( পুন্ড্রবর্ধন ), ‘সন্-মো-তট’ (সমতট ), ‘তন্-মো-লিহ্-তি’ ( তাম্রলিপ্ত ),
‘ক-লো-ন-সু-ফ-ল-ন’ ( কর্ণসুবর্ণ ) । উঁহু, আরও একটি – ‘ক-চু-ওয়েন্-কি-লো ‘
( কজঙ্গল ) !
তবে কি কজঙ্গলই বর্ধমানভুক্তি যুক্ত দণ্ডভুক্তি? অথবা বিযুক্ত দণ্ডভুক্তি? ‘কজঙ্গল’ প্রসঙ্গে য়ুয়ান্-চোয়াঙ নিজে বলেছেন – ‘রাজ্যটি পররাষ্ট্রের অধীন, রাজধানীতে লোক ছিল না এবং লোকেরা গ্রামে এবং নগরেই বাস করত । ‘
আবার কজঙ্গলকে ‘রাঢ়ীখণ্ডজাঙ্গল’ ধরলে সে তো উত্তর রাঢ় – বৈদ্যনাথ, বক্রেশ্বর, বীরভূম, অজয়নদের দেশ ! কেননা, ‘রাঢ়ীখণ্ডজাঙ্গল’-এর কথা যিনি শুনিয়েছেন, তিনি তো বীরভূমের সিদ্বলগ্রামের ভূমিপুত্র ‘পণ্ডিত-মন্ত্রী ভট্টভবদেব’ । উৎকলেরই মহামন্ত্রী । আর বর্ধমানভুক্তি, তাম্রলিপ্তি, দণ্ডভুক্তি তো একদা উৎকলেরই অধীন । ‘অজলা ঊষর জাঙ্গলময়’ বলে ভট্টভবদেব নিজেরই গ্রামে একটা মস্ত দীঘি খুঁড়িয়েছিলেন ।
উত্তর-রাঢ় সমগ্র একদা বর্ধমানভুক্তিরই অন্তর্গত ছিল । বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’ অন্য কথা বলছে, বিহারের পূর্বপ্রান্তস্থ রাজমহলের নিকটবর্তী ‘কজঙ্গল’ । ছয়শত একচল্লিশ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন এই কজঙ্গল থেকেই নাকি তাঁর বিজয়াভিযান চালিয়েছিলেন ওড়িষায় ।
এসব নিয়ে অনেক গল্পও আছে । হর্ষবর্ধন ওড়িষার কোঙ্গোদ, অধুনা গঞ্জাম, জয় করে দুবছর পরে কজঙ্গলে পৌঁছে য়ুয়ান্-চোয়াঙের কামরূপ যাবার কথা শুনে ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়েছিলেন ।
তাঁকে নাকি তারসঙ্গেই বাস করতে বলেছিলেন হর্ষবর্ধন । য়ুয়ান্-চোয়াঙ শোনেননি । কামরূপ অধিপতি ভাস্করবর্মার কাছে অনুরোধ গেল তাঁকে তৎক্ষণাৎ ফেরত পাঠাতে ।
উত্তরে ভাস্করবর্মা য়ুয়ান্-চোয়াঙকে ফেরত তো দিলেনই না, তদুপরি দূতমারফৎ বলে পাঠালেন, “ তার মস্তক দিতে পারেন, কিন্তু য়ুয়ান্-চোয়াঙকে ফেরত দিতে পারবেন না । “…
অতঃপর বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে হর্ষবর্ধন আদেশ পাঠালেন ভাস্করবর্মার কাছে, “বেশ আপনার মুণ্ডুই পাঠিয়ে দিন । এই দূত সেটা যেন অবিলম্বে এখানে নিয়ে আসতে পারে । “
অগত্যা অবস্থা বেগতিক দেখে ভাস্করবর্মা স্বয়ং কুড়ি হাজার হস্তি ও তিরিশ হাজার নৌকা নিয়ে গঙ্গাপথে য়ুয়ান্-চোয়াঙকে সঙ্গে করে কজঙ্গলে এসেছিলেন । তখন ভাস্করবর্মা হর্ষের অনুগত মিত্র । ক’মাস দুজনে কজঙ্গলে কাটিয়েছিলেনও বেশ !
‘দিব্যাবদান’ যদি মানতেই হয় তবে তো কজঙ্গল রাজমহল পাহাড়ের নিকটেই । গঙ্গার পশ্চিমে । শুধু কজঙ্গল কেন, রাঢ়, কঙ্কগ্রাম, কর্বট, সুহ্ম, বর্ধমান-ভুক্তি , তাম্রলিপ্তি, দণ্ডভুক্তিও তো গঙ্গার পশ্চিমে !
গঙ্গা বেয়ে রাজমহলের তেলিগড়ি-সিক্রিগলির সংকীর্ণ গিরিবর্ত্মের ভিতর দিয়েই তো গঙ্গার পশ্চিমে আসা । আসা কজঙ্গলে, বর্ধমানভুক্তি-দণ্ডভুক্তিতে, আসা তাম্রলিপ্তিতে !
য়ুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণে কজঙ্গল আলবাৎ আছে । কিন্তু বর্ধমানভুক্তি- দণ্ডভুক্তির কোনও উল্লেখ দেখি না । আমার তো মনে হয় বর্ধমানভুক্তি-দণ্ডভুক্তিই ‘কজঙ্গল’ । সেখান থেকে রাজমহল আর কতটুকুই বা দূর ! ফারাক্কা থেকে হাত বাড়ালেই তো রাজমহল !
ইতিহাসে যতই তর্ক-বিতর্ক থাক কজঙ্গল নিয়ে, আমার আগ্রহ যতটা না কজঙ্গল, তার থেকেও বেশি আমাদের ঘরের ধারে সুবর্ণরেখার তীরে অবস্থিত দণ্ডভুক্তি-দন্তভূমি-দান্তন বা দাঁতন নিয়ে ।
নৌকার নাউড়িয়া বড়োডাঙার হংসী বধুক একবার তার ‘নৌকাবিলাস’ যাত্রায় সত্যি সত্যিই আমাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল দাঁতনে । পুরাকালের সে-সমৃদ্ধি কী আর আছে ?
কাতা ধারে ধারে কতক বাঁশঝাড়, চিমনির ধোঁয়া উদ্রেককারী ইটভাটা, ধীবরদের গৃহসংলগ্ন বাঁশের বেড়ার গায়ে রৌদ্রে মেলে দেওয়া মাছধরার ‘বেড়- জাল’ ‘বেঁহুদি জাল’ ‘সারানি জাল’ ।
জালুয়া কৈবর্তের ন্যাঙটো-পোঁদো ছেলে তাতা বালির উপর সেদিন এঁকে বেঁকে হিসু করতে করতে এসে নদীজলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । দেখাদেখি তার পিছনে আরও ‘কত্গা’ ‘কতগা’ ন্যাঙটো-পোঁদো ! তাই নিয়ে ‘নৌকাবিলাস’-এর নৌকায় বসে আমাতে-হংসীতে জব্বর হাসির গপ্পো হয়েছিল ।
কী-ই ছিল আর কী হয়েছে ! দণ্ডভুক্তি তো একসময়, বোধকরি সপ্তম শতকে, এতটাই সমৃদ্ধি ও বৃদ্ধি পেয়েছিল যে , তাম্রলিপ্তি জনপদও তার আওতায় থেকে তার নামেই পরিচিতি পেত ।
হর্ষবর্ধন ও শশাঙ্কের আমলেও তার রমরমা বেশি বৈ কম ছিল না । সপ্তম শতকেই গৌড়রাজ তথা কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কের অধীন ছিল দণ্ডভুক্তি । শশাঙ্কের আমলের , আনুমানিক ছ শো খ্রিস্টাব্দ থেকে ছ শো পঁচিশ খ্রিস্টাব্দ, পাওয়া তাম্রশাসন-গুলিতে শশাঙ্কের নাম, ‘মহাপ্রতিহার’ শুভকীর্তি, ‘সামন্ত’ সোমদত্তের নাম, এমনকি তার কার্যালয় বা অধিকরণগুলোর নামও পাওয়া যাচ্ছে ।
‘দাঁতন’ নামের মূলে দুটি কিংবদন্তি আছে । তবে তা ইতিহাসও বটে । ‘দাঠাবংশ’ বৌদ্ধগ্রন্থে ‘ক্ষেম’ নামের এক শিষ্য বুদ্ধের চিতা থেকে একটি দন্ত কুড়িয়ে পান, যা কিনা বুদ্ধের দন্ত হিসাবে বিবেচিত হয় ।
সে দন্ত তিনি কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তকে দেন । সমাদরে বুদ্ধদন্ত প্রতিষ্ঠা করে মন্দির নির্মাণ করেন ব্রহ্মদত্ত । স্থানটির সে কারণে নামকরণ করা হয় ‘দন্তপুর’ ।
দন্তপুর যে পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ধর্মস্থান রূপে প্রতিষ্ঠিত হবে, সে তো ইতিহাস! দেখা যাচ্ছে, ‘ কার্তাকৃতিক-কুমারামাত্যরাজানক’ বিজয়বর্মা দক্ষিণ-মেদিনীপুর অঞ্চলে অবস্থিত দণ্ডভুক্তির ‘উপরিক’ ছিলেন, তখন ‘ আর্য-অবলোকিতেশ্বরাধ্যাসিত বোধিপদ্রক-মহাপ্রহারের বিহার’ নির্মানের জন্য মহাযানী বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে দান হিসাবে ‘ শ্বেতবালিকাগ্রাম’-টি কিনে নেওয়ার প্রার্থনা জানাচ্ছেন মহাসামন্ত মহারাজ অচ্যুত । আর, শ্বেতবালিকা গ্রামটি বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী ‘শ্বেতবালিকাবীথির অন্তর্গত ।
একথা গোপচন্দ্রের ফরিদপুর শাসন থেকে জানা যাচ্ছে । গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন বাঙলায় তখন গোপচন্দ্র । তাঁর অধীন দণ্ডভুক্তিও । সময়টা পাঁচ শো ঊনসত্তর । তারপরই তো শশাঙ্ক !
যাহোক, সেই ব্রহ্মদত্ত বংশের ণৃপতি শিবগুহ ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভক্ত । পরে তিনি বৌদ্ধ হন । তাতে রাজ্যের ব্রাহ্মণ্যেরা রুষ্ট হয়ে পাটলিপুত্ররাজের শরণাপন্ন হলেন । পাটলিপুত্ররাজ বুদ্ধদন্তসহ শিবগুহকে বন্দী করে নিয়ে এলেন পাটলিপুত্রে ।
কিন্তু, অতঃপর রাজ্যে দৈবের বশে অঘটনের পর অঘটন ! ভীত সন্ত্রস্ত পাটলিপুত্ররাজ বুদ্ধদন্তসহ শিবগুহকে ফের ফেরত পাঠালেন দন্তপুরে । পরবর্তী সময়ে, পাটলিপুত্রাধিপতির মৃত্যুর পরে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের জনৈক রাজসেনাপতি শিবগুহকে হত্যা করেন ।
তখন দন্তপুরের রাজকুমারী হেমবালা এবং রাজমাতা উজ্জ্বয়িনী ছদ্মবেশে বুদ্ধদন্ত নিয়ে তাম্রলিপ্তের পথে সিংহলে পালিয়ে যান । সিংহলরাজ মেঘবাহন মন্দির নির্মাণ করে অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে দন্তটির প্রতিষ্ঠা করেন ।
সিংহলে আজও আছে ‘ দেবানামপ্রিয়’ তিস্য নির্মিত সেই দন্তমন্দির । ফা- হিয়েন নিজে সে- মন্দিরের প্রতিষ্ঠার বার্ষিক উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন ।
তবে তর্ক আছে পণ্ডিতমহলে । দাঁতনই কি ‘ দন্তপুর’ ? রোমক পণ্ডিত প্লিনী, কানিংহামের মতে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজমহেন্দ্রীই দন্তপুর নগর । ফার্গুসনের মতে আবার পুরীই নাকি দন্তপুর ।
আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক রাজেন্দ্রলাল মিত্র, প্রাচ্য-বিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসুর মত হল – দাঁতনই দন্তপুর । কেননা, তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে করিঙ্গপত্তন রাজমহেন্দ্রী আর দাঁতনের দূরত্ব বিবেচনা করলে দাঁতনই ধর্তব্য ।
পুরী কিংবা রাজমহেন্দ্রী, যা-ই হোক, পুরীবন্দর দিয়েই দন্তটি প্রেরিত হওয়ার কথা । তা নয়, ‘ দাঠাবংশ ‘-এ পরিষ্কার কধিত আছে – তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়েই বুদ্ধদন্ত সিংহলে প্রেরিত হয়েছিল ।
আবারও বলা হয়, ওড়িশা যাবার পথে শ্রীচৈতন্যদেব এইস্থানে দাঁতনকাঠিতে দাঁত মেজেছিলেন বলেই স্থাননাম ‘ দাঁতন’ । সে হতেই পারে, সেও তো ইতিহাস । তবে এ তো এই সেদিন পঞ্চদশ শতকের কথা । আর দন্তপুর তো যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে !
যেভাবেই হিসাব করা যাক না কেন, দন্তপুর-দন্ডভুক্তি-দাঁতন যে বহু পুরাতন স্থান – সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী । ফা-হিয়েন য়ুয়ান্-চোয়াঙের আমলেও সেখানে বহু বৌদ্ধবিহার ছিল । মহাযানী বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে দান করার নিমিত্ত শ্বেতবালিকা গ্রামটি ক্রয় করাই তার যথোপযুক্ত প্রমাণ ।
তাহলে চালকবিহীন বর্তমানের গো-শকটটি তবে কি সেই সার্থবাহ গো- শকটের চিরাচরিত পথেই পরিভ্রমন করে যাচ্ছে? হয়তো পথিমধ্যে কোথাও দেখা মিললেও মিলতে পারে ‘বৃহৎছত্তিবন্না’ ‘ক্ষুদ্র ছত্তিবন্না’ ‘বল্লিকন্দর’ ‘কুম্ভারপদ্রক’ ‘বাল্লাহিটঠা’ ‘সিদ্ধল’ ‘শ্বেতবালিকা’ ‘দণ্ডভুক্তি’ গ্রাম ও নগরাদি ।
এতদ্ অঞ্চল ব্যতিত ধ-আসন-আঁটারি-চুরচু-ডকা-ভাদু-ইক্ষু-সর্ষপ-মধুকঃ বা মহুয়া-গুবাক-সহকার-পনস-পান-নাড়িয়েল বৃক্ষ, তদুপরি লবণ ও মৎস্য – আর কোথায় পাওয়া যাবে?
সমুদ্রের লবনাক্ত জল, উত্তাল ঢেউয়ের আন্দোলনে তাড়িত হয়ে খাঁড়িতে, খালে-বিলে-জমিনে জমা জল জ্বাল দিয়ে এমন লবণই বা তৈরি করবে কে?
নদীপথের দুইধারে পথিক যত পথই পরিক্রমা করবে, এদিক-ওদিক দুইদিকে দৃষ্টি ফেলবে, ততই তার চোখে পড়বে পল্লিতে পল্লিতে গৃহস্থের ঘরের চালে বেড়ার গায়ে উঠোনে দুই খুঁটিতে রজ্জুযুক্ত হয়ে শুষ্ক হচ্ছে জালুয়াদের মাছ ধরার জাল !
নাকে আসবেই আসবে শুকা বা শুঁটকিমাছের গন্ধ । এত, এ-ত্ত পুঁটিমাছ রাতভোর জালে পড়েছে, কত আর খাবে কত আর সাই-পড়শিদের মধ্যে দান- ছত্র করবে, কত আর বেচবে, অবশিষ্টাংশ তো উনুনের মাথায় খইচালায় শুকোবে !
মাছের আঁশযুক্ত মেলে দেওয়া ‘বেড়াজাল’ ‘বেঁহুদি জাল’ ‘সারানি জাল’ ‘জগৎবেড় জাল’ ‘ভাসানি জাল’ ‘ঝুলিজাল’ ‘চার-গোড়িয়া-জাল’ ‘মাথা-ফাবড়ি-জাল’- এর আঁশটে গন্ধ, তদুপরি শুকামাছের ভুর ভুর গন্ধ – “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি !”
সেই দেশের ভিতর দিয়েই কী চলেছে বর্তমান চালকবিহীন গো-শকট? ওই ওই তো, একটা সুবিশাল পুষ্করিণী যার জলের ধারে কলমি-শুশনি “লহ লহ” করছে । ডাহুক, জলপিপি উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
ওই, ওই তো একটা কাদাখোঁচা একবার এদিক একবার ওদিক, একবার উঁচু একবার নিচু, ঢেউখেলানো ভাবে উড়তে উড়তে “ চিক্-চিক্ চিকা-চিকা-চিকা” রবে মুহুর্মুহু ডেকে চলেছে ।
গঞ্জটির মাঝামাঝি একটা ঈষৎ প্রশস্ত জোটিকা বা খাল বয়ে গিয়েছে পশ্চিম থেকে পুবে, পুবে পুবে, বুঝিবা বড়নদীর সমান্তরালে । খালের ধারে ধারে বিরাজিত একটি-দুটি পর্কটি বা পাকুড়গাছ, পিপ্পলি গাছ । বিশেষত ডুমুরগাছ ।
উপস্থিত জেটিকার ঘাটে বাঁধা জালুয়াদের মাছ ধরার জেলেডিঙি ‘পাটিয়া’ । যেন এইমাত্র জাল টেনে ঘরে ফিরল মাঝি । পায়ের ফেলে যাওয়া চাপে পাটিয়ার পাছা এখনও নড়ছে ! কোত্থেকে একটা কাক এসে ঈষৎ দুলতে লাগল ।
ঘরে ফেরার সময় মৎস্যানন্দে জালুয়া কী কোনও গীত গাইতে গাইতে আসছিল? এহেন গীত –
“ হেদে হে নাগর চতুর-শেখর
সবারে করিবে পার ।
যাহা চাহ দিব ও-পার হইলে
তোমার শুধিব ধার । ।
মনে না ভাবিহ তোমার মজুরী
যে হয় উচিত দিয়ে ।
তবে সে গোপিনী যত গোয়ালিনী
যাব ত ও-পার হয়ে । । “
না না , চতুর্থ-সপ্তম শতকে যখন ফা-হিয়েন য়ুয়ান্-চোয়াঙ এসেছিলেন এখানে, এতদ্ অঞ্চলে তখন মাঝি মাল্লারা এ ভাষা পাবে কী করে? এ তো চণ্ডীদাসের আমলের কথা, এই সেদিনকার !
তখন তবে কী ভাষায় কথা বলত এখানকার মানুষ? এইরকম কী? –
“ তার থান গিআঁ বোলে রাধা গোআলিনী ।
কেহ্ন মনে পার হয়িব ছোট নাঅ খানী । ।
একেঁ একেঁ পার যাইব যাইব মথুরা ।
সহ্মাই চড়িলে নাঅ না সহিব ভরা । ।
শুন ঘাটিআল নাঅ চাপায়িআঁ ঘাটে ।
সহ্মা পার কর যাইউ মথুরার হাটে । । “
উঁহু, তাও না । এ তো বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর পদ । তবে আমাদের পাশের গ্রামের ‘হাটুয়া’ জনমানুষরা অনেকটা এই ভাষাতেই কথা বলে । যেমন ‘নৌকাবিলাস’-এর গীতে –
“ সোবু সখীকু পারঅ করাইতে
নিমু আনা আনা ।
শ্রীরাধাকু পারঅ করাইতে
নিমু কানর সোনা । । … আ গো ”
৯
অবশেষে গো-শকটটি আপনা-আপনিই এসে দাঁড়াল একটি পোড়ো মন্দিরের সন্নিকটে । গঞ্জের সীমানা-চৌহদ্দি শেষ হতে তখনও বাকি বোধকরি ।
পোড়ো মন্দিরই তো বটে ! নাকি আবাসগৃহ? না না, ওই তো মন্দিরের একাধিক চূড়া দৃশ্যমান । সাত, সতেরো না পঁচিশ চূড়া? এমনটি কোথায় যেন দেখেছি !
পরিত্যক্ত রাজবাড়ির কোনও রাসমঞ্চ নাকি? ভিতরে ঢুকলেই দেখা মিলবে একাধিক কক্ষযুক্ত অন্দরমহলের ? নাচমহল? ঘুঙুরমহল? খিলান?
রাসমঞ্চটি কী সাত, সতেরো না পঁচিশ চূড়াবিশিষ্ট? কতক তো ভেঙে হেলে পড়েছে ! আচমকা ভদভদিয়ে একঝাঁক পায়রা বেরিয়ে এল । ডানা ফেটিয়ে উড়ে চলল আকাশে । পায়রা তো নয়, যেন পারাবত । ঈষৎ স্থূলকায়া ।
কত ঝুরকা, ঝোরোকা ! ভালো কথায় গবাক্ষ । কত ‘পিঁড়া’, কত
বারান্দা ! ভালো কথায় অলিন্দ । কত আঁকাজোকা, টেরাকোটা কত ! তবে অধিকাংশই ভগ্নপ্রায় । কিছু লেখাজোকাও খোদিত আছে দেখছি । যেমনটা সচরাচর দেখি মন্দিরগাত্রে, জমিদারবাটীতে, হরিমন্দিরে, তুলসিচৌরায় ।
এই যেমন –
“ শ্রীশ্রীঁ৺ পঃ শ্রীমহে
দধিপাব শ চন্দ্র রায়
ন চন্দ্র জী সন ১২৯৭
উ স্বহায় সাল সাঙ্গ
সকাব্দ ১৮১২
না না, বাংলা কেন হবে, এ যেন অন্য হরফ, অন্যরকম । দেবনাগরী কী?
“ আবাসবাটী যৎউত্তরশ্যাম
গোপশ্চ যৎ পশ্চিমদিগ্বিভাগে ।
কংসাবতী ধাবতি দক্ষিণে চ
সা মেদিনীনাম পুরী শুভেয়ম্ । । “
উঁহু, দেবনাগরী তো এ নয় । রোহিণী হাইস্কুলের পণ্ডিতমশাই শ্রীযুক্তবাবু হিমাংশুশেখর ত্রিপাঠির নিকট “নরঃ নরৌঃ নরাঃ” মুখস্ত করে যৎকিঞ্চিৎ হলেও সংস্কৃতের পাঠ তো নিয়েইছি ! তবে কী ‘ব্রাহ্মীলিপি’?
নাকি মৌর্যযুগে ব্রাহ্মীলিপি সর্বত্রই প্রচলিত ছিল । অশোকের অনুশাসন ব্রাহ্মলিপিতেই লেখা হত । মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের পরে তা বিবর্তিত হয় প্রদেশ থেকে প্রদেশে । হয়তো ব্রাহ্মিও নয়, মাগধির অপভ্রংশ । বাংলা ভাষা ও লিপির প্রপিতামহেরা?
ধরেই নিচ্ছি পোড়ো মন্দির, রাজগৃহ, সামন্তবাটীটি গুপ্তোত্তর পালযুগেই নির্মিত । ততদিনে ‘তন্-মো-লিহ্-তি’ বা তাম্রলিপ্তির দিন শেষ । কিন্তু ‘তণ্ডবুত্তি’ বা দণ্ডভুক্তির গৌরবসূর্য মধ্যাহ্ন গগনে জ্বল জ্বল করছে ! তাম্রলিপ্তি তো তাম্রলিপ্তি, উৎকল, এমনকি ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চলও তার অধিগত ।
এহেন সময়কালে দণ্ডভুক্তি বা দাঁতনের সন্নিকটে এই গঞ্জে যেখানে হালিক-জালিক কৈবর্তরা, পণ্ডাসুর বা পঁড়াসুর তথা মহিষাসুরের পূজাকারী ইক্ষুচাষীরা, ‘ক্ষেত্রকরান্’ ‘কর্ষকান্’ ‘কৃষকান্’ ইত্যাদি গোত্রধারী মানুষেরা বসবাস করত, সেখানে এই গৃহও যে নির্মিত হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী !
তাছাড়া ভূমি দান-বিক্রয়, গৃহনির্মাণার্থে রাজা-রাজড়া, উপরিক, প্রতি-হার-মহাপ্রতিহাররা এই বলে বিজ্ঞপ্তিও যে জারি করেছেন –
“ এষু চতুর্ষু গ্রামেষু সমুপগতান্ সর্বানেব রাজ-রাজনক-রাজপুত্র-রাজামাত্য-সেনাপতি-বিষয়পতি-ভোগপতি-
ষষ্ঠাধিকৃত-দণ্ডশক্তি-দণ্ডপালিক-চৌরোদ্ধরণিক-দৌস্-সাধসাধনিক-দূত-খোল-গমাগমিকা-ভিত্বরমান-হস্ত্যশ্ব-
গোমহিষাজীবিকাধ্যক্ষ-নাকাধ্যক্ষ-বলাধ্যক্ষ-তরিক-শৌল্কিক-গৌল্মিক-তদায়ুক্তক-বিনিয়ুক্তকাদি-রাজপাদ-
পোজীবি-নোহন্যাংশ্চা- কীর্তিতান-চাটভট-জাতীয়ান্-যথাকালধ্যাসিনো-জ্যেষ্ঠকায়স্থ-মহামহত্তর-মহত্তর-
দাশগ্রামিকাদি-বিষয়-ব্যবহারিণঃ-সকরাণান্-প্রতিবাসিনঃ-ক্ষেত্রকরাংশ্চ-ব্রাহ্মণ-মাননাপৃর্বকং-যথার্হং-মানয়তি
বোধয়তি সমাজ্ঞাপয়তি চ । । “
গৃহগাত্রে খোদিত অক্ষর-বৃত্তান্ত তবে কি পালি ভাষায় লিখিত? হতেও পারে । হয়তো ভগ্নপ্রায় পোড়োবাড়িটা কোনও বৌদ্ধ সংঘারামই বটে । থ্রি-ফোরের ইতি-হাস পড়াইস্তক জেনে আসছি চৈনিক পরিব্রাজক ফা- হিয়েন, য়ুয়ান্-চোয়াঙের কথা ।
তাঁরা কেউ কেউ তাম্রলিপ্তি-দণ্ডভুক্তিতে একাধিক বৎসরকাল বসবাসও করে-ছিলেন । দশটা-বাইশটা বৌদ্ধ সংঘারামও দেখেছিলেন । সেখানে শিক্ষার্থে বসবাসকারী দুশো-সাতশো বৌদ্ধভিক্ষুকেও চাক্ষুষ করেছিলেন । এই পোড়ো গৃহ সেরকম কোনও একটা সংঘারামও হতে পারে ।
সেনযুগে যেমন তেমন, পালযুগে বৌদ্ধধর্মের রমরমা খুব কম ছিল না । ধর্ম- পাল, দ্বিতীয় গোপাল, মহীপাল, নয়পাল, রামপালের মতো পাল রাজাদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় নানান বৌদ্ধ শাস্ত্রাদি রচিত হয়েছিল ।
মহাচার্য অতীশ দীপঙ্কর, পণ্ডিত শীলভদ্রও তো এই সময়কালেই বিদ্যমান ছিলেন ! তার পরে পরেই ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাগান’ । লুইপাদ, ভুসুকুপাদ, কুক্কুরী- পাদ, সরহপাদ, কাহ্নপাদ । তাঁদেরই রচিত –
“ কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠ কাল ।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ
লুই ভণই গুরু পুছিঅ জান । । “
ইত্যাদি ইত্যাদি । এই পোড়ো সংঘারামগাত্রে নিশ্চয় ‘ত্রিশরণ’ মন্ত্রই খোদিত আছে ? –
“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”
“ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি”
“সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি”
যাহোক, এক্কা গাড়ি অর্থাৎ এক বলদের গো-শকটটি এহেন পোড়ো বাড়ির সন্নিকটে আমাকে নামিয়ে দিয়ে অসমাপ্ত গঞ্জের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হল । তারপর কোথায় যে হারিয়ে গেল কে জানে !
বেলা বুঝি দ্বিপ্রহর । ক্ষুধা-তৃষ্ণায় এতক্ষণে কাতর বোধ হচ্ছে । সেই কখন খেয়েছি, মায়ের হাতের রান্না ! এত বড় গঞ্জ, আড়ে-বহরে যে কত ! তাও একটা লোক দেখি না ।
ভগ্নপ্রায় সংঘারামের মতো গোটা গ্রামটাও মনুষ্যবিবর্জিত, পোড়ো নাকি? তা তো মনে হয় না । কিয়ৎক্ষণ আগেও নধর গতর কতক পায়রা তো উড়ে উঠল আকাশে, ওই তো এখনও সঞ্চরমাণ !
উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কাক-চিল, সামুদ্রিক পাখি । ঘুরপাক খাচ্ছিল চড়ৈ-চটি । নলখাগড়ার দঁকে ঘাপটি মেরে বসেছিল ‘মাছরাঁকা’ । তারমানে মাছরাঙা । সেও তো দেখেছি একটু আগে ।
তবে? তার বেলা ?
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ২
❤ Support Us