Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ২১, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান । দশম পর্ব

স্নেহলতা যেন অকস্মাৎ কঠিন হয়ে উঠেছে, গম্ভীর নাদে তার আদেশ শুনতে পেলো নীলু— খোঁজো । যিখান থেকি পারো, খুঁজি বায়ের করো । আর অকল্যেণ বাড়ায়ো না...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান । দশম পর্ব

।। ছ্যাতলাকান্ড ।।

 

।। যাপিতালক্ষীর বরতো পাঁচালী ।।

হেমশশী ক্যাম্প ঘরের সামনে চিলতে উঠোনে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে কাঠ, শুকনো ডাল পাতা জ্বালানির উনুন বেঁধেছেন। ভাত রাঁধছিলেন। তিনঝিকের ফাঁক গলে যজ্ঞাগ্নিসদৃশ শোভমান হচ্ছে।

ঘরে রান্নার বন্দোবস্ত করা যায় না। ঘর একটাই, মাথা আর পাশদেয়াল করোগেট টিনের, ছাদ তো নয়, যেন নৌকোর গলুই। এখন মরসুম নয় ,তাই জানা যাচ্ছে না, তেমন জল পড়লে, ঝড়বাদল হলে, ঘরে ছাদগলে জল পড়বে কিনা। ভিতরে টেকা যায় না, শরীর হাঁসফাঁস করে। জালখুপি জানলাগুলো বড়ো নয়, বাতাস খেলে না তেমন। ভাগ্য ভাল ঘরের গায়ে একটা অর্জুনগাছ আছে, ছাদের উপর ছাতা মেলে ছায়ার জোগান দেয়। একটু আরাম।

চন্দ্রমোহন এই ভ্যাপসাপোড়ানি সইতে পারেন না, শীতেও উদল গায়ে থাকতে হয় তাঁকে। একখানা তালপাতার পাখাও ঘরে নেই, ধুতির কোঁচা খুলে তাই ব্যজনপ্রয়াস।

হেমশশীর ভয় লাগে। চন্দ্রমোহনের ঠান্ডার ধাত, সর্দি বুকে জমে যায়, কাশির দমক থামতে চায় না। শরীর নিয়েও রসিকতা করতেন দেশে থাকতে— ডাক্তারে কবে আমারে ব্রোংকাইটিস ধরিছে। এ রোগে মরণ নাই , তাই কয়ে নিত্যি মারণ বাদ নাই। হেডমাস্টারি করে আমারই মতোন। সবসময় জো হুজুরি ভয় পায়ি চলতি হবে।

হেমশশী উনুনধার থেকেই ঘরের দিকে কথা ছুঁড়লেন, — গেনজিখান গায়ে দেন না।

চোদ্দো পোনেরো হাজারেরও বেশি পরিবার নাকি এখানে ঠাঁই পেয়েছে। গিজগিজ ! গিজগিজ ! নরকরাজ্য। কাচ্চাবাচ্চাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে রোদে ,মাটিতে, ধুলোয়, উদোম ন্যাংটো। মেয়েবউদের লজ্জাঢাকার বসনের অভাব।

— হ্যাঁ , দেই , নীলুর মা – মুখ ফসকে নামটা খসে পড়লো। পারতপক্ষে স্মরণে আনেন না। সচেতন থাকেন। জানেন– হেমশশী কষ্ট পান, মুখে অবশ্য কিছু বলেন না । আড়ালে নিশ্চয়ই অশ্রুপাত করেন, করবেনই, মা যে তিনি। নীরবে চোখের জল ফেলার আর্ট এই বয়সে এসে রপ্ত করে ফেলেছেন। যাতনা কি চন্দ্রমোহন স্বয়ং অনুভব করেন না? হৃদয় নিংড়ে বিষণ্ণ রক্তপতনের টুপটুপ ধ্বনি। জন্মদান করেন বলেই যে পিতার নাম জনক ! চিকন সূঁচের ফুটোয় দাগ টেনে যায়, কোন কুঠুরির দেওয়ালে কে দেখতে পায় ! তবে তিনি কষ্টটাকে চিবুতে জানেন, ছ্যাঁচা পান যেভাবে জিভে ঠেলে দাঁতের এ গোড়ায় ও গোড়ায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিতেন, তেমনই। এখন তিনি আর পান খান না। আসলে পান না। নেশা তো ছাড়াই উচিত, তাই নয় ! মানুষকে যে বারবার বদলাতে হয়। কত বদলে গেছেন তিনি। এখন কেউ তাঁকে চিনবে যে এ লোকটা নলিনবিহারী উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ের একদা হেডমাস্টার মশাই ! মুক্তোকান্দির সর্বজনমান্য সুধীজন! হেমশশী বদলাননি? এই দুনিয়াটাই যে ভোল বদলে কেমন বনবনিয়ে নতুন হল! মুক্তোকান্দি নয়, চন্দ্রমোহনের চোখে ভাসে ক্যাম্পটা। এ…ত…ব…ড়ো ! শুনতে পেয়েছেন চোদ্দো পোনেরো হাজারেরও বেশি পরিবার নাকি এখানে ঠাঁই পেয়েছে। গিজগিজ ! গিজগিজ ! নরকরাজ্য। কাচ্চাবাচ্চাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে রোদে ,মাটিতে, ধুলোয়, উদোম ন্যাংটো। মেয়েবউদের লজ্জাঢাকার বসনের অভাব। চন্দ্রমোহনের মনে হয়– সভাপর্ব। সহস্র সহস্র যাজ্ঞসেনী, নিবারক বাসুদেব অন্তর্হিত। শোনা যায় কিছুলোক, ভলান্টিয়ারদের মতোই , আসে, ফুসকানি দেয় মেয়েবউদের।নতুন শব্দ শিখেছেন চন্দ্রমোহন– ফুসকানি, টাউট , ভাড়ামাল…। ক্যাম্পের পুরুষগুলো কেমন খেঁকোকুকুরের মতো হিংস্র হয়ে উঠছে, যখন তখন বউ ছেলেমেয়েকে পেটায়, মা বাপকেও ছাড়ে না। তখন কান্নার শব্দ লোপ পায়, আর্তনাদ জেগে ওঠে, টিনের পাঁচিল ছাদ ফুঁড়ে ইথার ঢেউমালায় ছড়িয়ে যায়। সেই প্রতিরোধহীন ভয়াল কোরাস কান পেতে শোনেন চন্দ্রমোহন।একটা গোঙানি ভাষা পেতে থাকে – , উঁ…উঁ…উঁ…গান্ধিবুড়েরে গলি করি মারিছে…মরহুম হয়ি গিছে কায়িদি…। হো হো হেসে ওঠেন চন্দ্রমোহন– চতুর্দশসহস্র পরিমান…পঞ্চদশসহস্র…একক দশক শতকে…অযুত…গণিতের সংখ্যা…গনিতবিজ্ঞান…মানুষ নাই…হ্যাঃ হ্যাঃ…সব রিফোজি— উঠে পড়লেন চন্দ্রমোহন।

একী! কুথায় চললেন, আপনি?
— এট্টু বাথরুমে যাবো, হেম। – চন্দ্রমোহনকে এখন বারবার ওই বাইরে যেতে হয়। ঘরের পিছনে তিনপাশ টিনঘের, মাথায় আকাশ, নিচে অমসৃণ ক্ষয়া শান, সামনেটা খোলা, চটঝোলানো দরজায় আবরু। ঢুকে পড়লেন চন্দ্রমোহন।

হেমশশী ভয়ার্ত চোখে সেদিকে চেয়ে রইলেন। মানুষটা তার চোখের আড়ালে সুড়ুত করে আবার বেরিয়ে না পড়েন। রোগ যে এখনও পুরো সারেনি। হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার বলেছেন অনেকদিন ওষুধ খেতে হবে। তবে সেরে যাবে নিশ্চিত।

হাঁড়ির জল থল থল উথলাচ্ছিল।

হেমশশী ত্বড়িৎ একঘটি জল তার মধ্যে ঢেলে দিলেন। রাঁধছেন জাউ। চাল সেদ্ধ হতে সময় নেয়। ডোলের চাল। মোটা। আর ভারি ।এতটাই ওজন যে পুরোফুট ভাত ফেটে যায়, নরম হয় না। মোলায়েম করতে মানুষের দাঁত নয়, লোহা পিতলের হামানদিস্তার ডাক পড়ে।চন্দ্রমোহনের বেশ কয়েকটা দাঁত পড়ে গেছে, খেতে অসুবিধা হয়। তাই হেমশশীকে সেই ভাত নুন ছড়িয়ে হাতে চটকে চটকে দিতে হয়। চন্দ্রমোহনের গুণের অভাব নেই , বিনা ওজরে মুখে জিভে নাড়তে পারেন। হেমশশীর বুক ফেটে হাহাকার করে উঠতে চায়, — বিটাছেলি কি এমুন খাতি পারে ? – উদগত কান্নার তরঙ্গকে বাগে বশ করতে তিনি ব্যগ্র হয়ে ওঠেন। তার চোখে জল দেখতে পেলে চন্দ্রমোহন বড়ো কাতর হয়ে ওঠেন। পন্ডিত মানুষ, হয়তো স্ত্রীকে বলে বসবেন, —- তুমি তো গীতা পড়ো নাই ,জানো না। ভগবান কয়েছেন—-মা ফলেসু কদাচন। — সত্যি কি মানুষটা নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারেন! জানেন না হেমশশী। এখনও তাঁকে চেনা হলো না তার। ভেবে বেদিশ হয়ে পড়তে চায় মন।

শুধু চাল কেন ! ডালও একই রকম। গলে না, ছ্যাকরা পড়ে থাকে গরম জলের নিচে। একেকসময় আলোচাল। সে আবার এমন যে গলে মন্ড হয়ে যায়, গ্রাস মুখে না ঢুকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়।

দিনের হিসাবে দেড়পো চাল দুজনের প্রাপ্য, এছাড়া দুছটাক ডাল, মুসুর, না হয় বুট। টুকিটাকি বাজার, মশলাকড়ি, আনাজপাতি, সরসের তেল ইত্যাদির জন্য দৈনিক পাঁচ-আনা কড়ারে দুজনের দশ-আনা। কালচে আটা পাওয়া যায় একপোয়া । ক্যাম্পের লোকেরা বলে, এ আটা নাকি দূর আমরিকি থেকে আসে। সাদা চামড়ার লোক, কালো আটা খায় না , কালো লোকদের দয়া করে বিলোয়। একেকসময় উটকো পচাটে গন্ধ থাকে তার মধ্যে। রুটি চন্দ্রমোহনের সহ্য হয় না একেবারেই। পেট ফুলে ওঠে, ব্যথা করে। হেমশশীকে সারারাত অন্ধকারে তাঁর পাশে বসে পেটে তেলজল ডলতে হয়, জলভরা ঘটি তাঁর পেটের উপর বসিয়ে যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে হয়।রাতের জন্য কেরোসিনের বরাত এতটাই কম যে হেমশশী বাধ্য না হলে আলো জ্বালান না। রুটি গড়া এ আস্তানায় বন্ধ। আটা দিয়ে দেন পাশের ঘরে, সেখানে জোয়ানমদ্দ আছে দু তিনজন, হেমশশীর আটা ওদের পেট ভরায়। 

এখন হেমশশী হাতা দিয়ে হাঁড়ির জাউ একটু নাড়লেন। তিনজনের আহার তৈরি করছেন ,সাধন তার এখানেই খায়। হিসেবের ডোল সে খুড়িমার জিম্মায় জমা রাখে। সাধনের ঘর কয়েকঘর উজিয়ে দক্ষিণে, ক্যাম্পের কাগজে ব্যারাকরুম, টানা লম্বাটে গঠন। এরকম কামরা আরও আছে। সাধনের মত একা পুরুষদের থাকবার ব্যবস্থা। একা মেয়েদের জন্যও ছোটমাপের ব্যারাকরুম আছে। এইসব ঘরের লোকগুলোর মধ্যে খারাপ খারাপ ব্যাপার ঘটে, ঘটে যায়। সাধন খুড়িমার পাশে বসে সেই গল্প শোনায়, যথেষ্ট ঢেকেঢুকেই বলে। শুনে আঁতকে ওঠেন হেমশশী, — সাধনে রে, বাপ আমার, অখানে থাকতি হবে না, তুই চলি আয়, ইখানে। এ ঘরে তেনজনের বেছান হয়ি যাবে।

এরকম হলে সাধনকে হাসতেই হয়, — তুমি মেছোমিছি ভয় পাতিছো, খুড়েমা। উরা আমারে নষ্ট করতি পারবেনে না। আমি চাঁড়ালের পো। আমার মাথার উপুরে খুড়েমশাই আর তুমার আশেব্বাদ রইছে।

— তাও , তুই সজেগ থাকিস। আমার তরাসে বুক কাঁপতিছে। কী নরকের দেশিতে আলেম ক ! 

এমনি করে কথায় কথায় সলতে পাকানো চলতে থাকে।

খাওয়ার পরেও সাধন উঠছে না দেখে হেমশশী তাড়া মারলেন, – কীরে, আজ যাওয়ার মতি নাই বুঝি? উয়েরা দোরে আগল দে দেবানে না? 

— আগল নাই। কাঠির আড়াখান বেচি দম হই গিছে উয়েগেরে। একগাছি কাতার রশি বান্ধে রাখে দুয়োরে। সে উয়েরা দিলে দেক। তুমার ইখানে থাকি যাবো আজ। তুমার কষ্ট হবে। 

— আমার কষ্ট কীরে! আমি তো কবেই কয়েছি তোরে। তুই থাকলি পরে আমার বলভরসা বাড়ে। এ কষ্ট বুধায় আমার এ জেবনে নেত্যসাথী হল। কুথায় দেশির বাড়ির দশদশান্ত, আর কুথায় কেম্পের বাসা ! তোর খুড়েমশায়েরে দেশি নিতি পারলি অনার মাথার ব্যায়রাম খান সারি য্যাত, বুঝলি। তার তো উপেয় নাই। 

—আর কয়টা দিন দাঁতে দাঁত কামড়ি সওন করো, খুড়িমা। এট্টা বেবুস্থা করি ফেলাবোনে।

এমন সাহসের সঙ্গে কথা বললো সাধন যে হেমশশী চমকে উঠেছেন, তড়িঘড়ি সুধালেন, – কী বেবুস্থা করবি তুই? অচিনা অজেনায়?

সাধন হাসলো একমুখ ছড়িয়ে, — তোমারে কই নাই। দশ বারো দিন হইছে ইষ্টিশানে গেয়িলাম। রাণাঘাট। বড়ো জংশন। রেলগাড়ি আলি পরে পিলাটফরম লোকে জংলা। ইষ্টিশানের বাইরে,রাস্তায়,সার দে রেস্কা খাড়য়ে থাকে। পেসিনজার তুলি নে যায়। ভাবেলাম, রেস্কার কামটা ধরা যায় কিনা। — সাধনের গল্পের সুতো তকলি ছেড়ে যাচ্ছে।

আসলে কাচুমাচু হয়ে সাধন এক রিক্সাওয়ালার সঙ্গে কথা বলেছিল। লোকটা উড়িষ্যা দেশ থেকে এসেছে। সাধনকে দেখে তার বোধহয় করুণা জেগেছিল। হয়তো নিজের পূর্বভাগ্যের কথা স্মরণে এসে থাকতে পারে ফলে এক মালিকবাবুর ঠিকানা দিয়েছিল সাধনকে। যদি সে গাড়ি দেয়। পুরোনো গাড়িই দেবে। নিজের কপালে এখনও নতুন জোটেনি। সাধন মালিকের সঙ্গে সাক্ষাত করতে দেরি করেনি। চেটাজ্জি বাবু। লোকটা সাফসুতরো। গাড়ি পাওয়া যাবে,তবে তার গাড়ি টানে এমন একজনকে আনতে হবে। গেরান্টার। জামিনদের। মালিকের কাছে জমা রাখতে হবে তিরিশ টাকা। রাত্রি সাড়ে দশটার মধ্যে গাড়ি জমা দিতে হবে আর দশটা টাকা, রোজগারের ভাগ। রাতে এসময়ের পরে রাস্তায় যে রিক্সা দেখা যায় ,সেগুলো যারা চালায় তাদের কেনা গাড়ি।

— মালিকের গাড়ি পুরান হলি তারা ছেকেনহেন বেচি দেয়।— বলেছিল সাধন 

টুকিটাকি মেরামতি ডেরাইভারের খরচ, বড়োমাপের ভাঙচুর হলে মালিক বইবে।গাড়ি সারাই না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ। সাধন বুঝেছে এটাও একজাতের জরিমানা।

—কী করবো তখন! – সাধন কথা থামায় না।

ওর কাছে তিরিশ টাকা কোথায়! ফিরে এসেছিল স্টেশনে, রিক্সা ডিপোয় সেই দয়ালু রিক্সাওয়ালার খোঁজে। লোকটা ডিপোয় নেই।সাধন বসে রইলো। অপেক্ষায়। অপেক্ষায়। অবশেষে সে আসে।আবার তার দয়া হল,বললো, — দেখো, ভাই, একটা কম্ম, তুমি ,করিবো?

লোকটা দুপুরে বাড়ি যায়, কুলদেবতার পুজো করে, সে উৎকলীয় ব্রাহ্মণ, খায়, একটু আয়েশী, বিছানায় গড়ায় ঘন্টাদুয়েক। এই অবসরটুকু সাধন তার রিক্সা নিয়ে সওয়ারি টহল দিতে পারবে রোজগারের ছ আনা ভাগ তার প্রাপ্য। সাধনের দশআনা। এইভাবে যতদিন না চ্যাটার্জিবাবুর তিরিশ টাকার তহবিল হচ্ছে।

সেদিন থেকে এরকম করে চলছিল সাধন। দুপুরে সওয়ার মেলে কম। স্টেশন ডিপোয় দাঁড়াতে পারে না। ধরা পড়ে যাবে। এতদিন যা আয় করেছে হেমশশীকে রাখতে দিয়েছে, কী কাজে রোজগার সেটাই গোপনে রেখে দিয়েছে। ব্যারাকঘরের বদমায়েশগুলো কেড়েকুড়ে নেবে। গাঁজার ধোঁয়ায় তেনেত্তর হয়ে ওরা এই বিশ্বজগত থেকে মুক্তি পায়।

— তয় , খুড়িমা, রেস্কা আমি টানতি পারবোনে না।খালি ডানি টাল খায়। দোমাস তেনমাস লাগি যাবে টাল সামলানি শিখতি। 

— তয় ?

— কয়েকটা দিন সবোর করো। একখান কুদাল কেনবানে। ইস্টিশান রুডের হাডুয়ার দুকানে পাওয়া যায়। দেখি আসিছি। টাটা কুম্পানির মাল । দর কলো দুইটেকা। 

টাটা কোম্পানি ! সাধনের মনে পড়ে যায়। চন্দ্রমোহন সে কোম্পানির গুণ শুনিয়েছিলেন। টাটারা লোহার লাইন বানিয়ে দিয়েছে রেল কোম্পানি গুলোকে।

— অন্য কুম্পানির মালও আছে। সস্তা। দেড়টেকা , পাঁচসেকি। কিনলি টাটাই কেনবো। একখান প্যায়রাকাঠির আছেড়ি। ছয় আনা। উয়েরাই লাগোয়ে দেবে।

— কী কাম করবি? পাবিই বা কনে? 

— খুড়িমা, কত বড়ো রানাঘাট টাউন! রেলের গাড়ি যাতিছে আসতিছে। নইয়িটি, শ্যালদা, লালগুলা, মোরশিদাবাদ,বানপোর, শান্তিপোর, বোনগিরাম । কুথাও কাম মেলবে।বাগানের কাম, মাটি কুপানির কাম, রাজমেস্তরির জুগালির কাম।খবর পাইছি। মুজুরি দুইটেকা। মুড়িটুড়ি খাতি দেবে। রেস্কা টানি টেকাটা জুগাড় করি নেই। তাপরে জাহান্নম থেকি তুমাগেরে নেয়ি চলি যাব।

এতক্ষণ পরে হেমশশীর হাসি পেল , ভাবলেন, – ছাবাল আমার লায়েক হইছে, – ভয়ও লাগছে,বললেন, — কাল আমার থে যা লাগে নেই যাস। আর রেস্কা টানতি হবেনা।

হেমশশী রাঁধেন একবেলা।পেট ভারী হয়ে থাকে এক আহারেই। ইচ্ছে হলে দুমুঠো মুড়ি আর গুড়দলা খেয়ে রাতে শুয়ে পড়েন। সাধন ফেরে সন্ধ্যের পরে। একেকদিন রাতও হয়ে যায়, সেদিন দূরে যেতে হয়েছিল কাজে।হেমশশী দুপুরের ভাত কী জাউ বেড়ে দেন ওকে।সাধন এমনভাবে খায় যেন অমৃত স্বাদে পাচ্ছে সে। হেমশশীর চোখফেটে জল নামে।

— কী হইছে,খুড়িমা? কান্দো কেন ? ও ! নীলুদাদারে মনি পড়লো বুঝি।

হেমশশী দ্রুত সাধনের এঁটোমুখ হাতে চাপা দেন, ইশারা করলেন ভিতর ঘরের দিকে।ওখানে চন্দ্রমোহন আছেন।

 

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৯

মাটি ব্রতের আখ্যান । নবম পর্ব


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!