- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ১৬, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৩০
যান্ত্রিক গোলযোগে ৯ জুন এই ধারাবাহিকটি প্রকাশ করা যায়নি। এজন্য পাঠকদের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।এবার থেকে আবার প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে ...
।। ফলকান্ড ।।
শাস্ত্রের বচন
যে কথা কেউ জানে না, অথচ তা শাস্ত্র জানে। লিখে রেখে গেছে অলৌকিক কাগজে, খোদাই করে গেছে পর্বতগাত্রে, বৃক্ষকান্ডে, এমনকি ধ্বংসস্তুপের ধুলোয়। শাস্ত্র কথা বলে। কি বলে? হয়তো সেই কথা, যা মানুষ এখন বলছে, অথচ বলছে না। মানে মানুষের মনের মধ্যে সেইসব কথা মালা গেঁথে চলেছে। শুধু মুখে শব্দ নেই, ভয় পাচ্ছে হয়তো, উচিত অনুচিত দোলায় দুলছে, অপেক্ষা করছে আরও এক মানুষের আরও অনেক মানুষের মুখের, জিভের, আলজিভের সংস্পর্শ পেতে, তবে বলবে।
জনমেজয় বললেন — মহাত্মন, আপনি সেদিন বস্তুর ব্যাখ্যাক্রমে কালের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন, যদিও তা বিশ্লেষণ করেননি। সে অবধি আমি কাল বিষয়ে জ্ঞাত হওয়ার জন্য যার পর নাই আগ্রহান্বিত হয়ে আছি। আপনি অনুগ্রহ করে এই প্রসঙ্গে যাবতীয় ব্যাখ্যা করে আমার কৌতুহল নিবৃত্ত করুন।
বৈশম্পায়ণ তখন বললেন — বেশ, মহারাজ। আপনি তবে শ্রবণ করুন। আমি যথাসাধ্য আয়াস করছি, কারণ এ পর্যন্ত আপনার নিকটে আমি যা যা বলেছি, কালবিষয়ক বচন তার মধ্যে কিন্তু বিষয়বস্তু। ইতিহাস, পুরান, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাকার কোনও শাস্ত্রই কাল বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি। যদিও এতদ জ্ঞানভান্ডারগুলি কালের স্মারক নিজদেহে বচন করছে।
— কাল তাহলে কী, মহাত্মা?
— কালের সংজ্ঞা হয় না মহারাজ। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ সম্যক জ্ঞান। যার সম্বন্ধে কেউ জানে না, তদ্বিষয়ে সংজ্ঞানিরুপণ কীভাবে সম্ভব? মহারাজ,কাল একটি ধ্রুবক, পূর্বাকাশে সূর্য যেমন দিবালোকের ধ্রুবক, চন্দ্রমা যেমন নিশালোকের, রজনীর উত্তরাকাশে চিরস্থির নক্ষত্র যেমন দিকনির্দেশের। এগুলির বিনাশ নেই। কালও এইরূপ অক্ষয়।
—তবে কাল কি পদার্থ ?
— হ্যাঁ, মহারাজ, পদার্থ, কারন সে প্রাণবিশিষ্ট নয়। আবার তাকে পদার্থ বলাও যায় না, কারণ পদার্থের চিহ্নস্বরূপ যে মাত্রাগুলি বিদ্বতেরা ইঙ্গিত করেন, অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ,আকৃতি, ভর, ভার ইত্যাদি কোনটিই কালের নেই। বায়বীয় পদার্থ নয়, কারণ ধূমপুঞ্জ দ্বারা এটি নির্মিত হয়নি। তরলও নয়। মহারাজ, কাল এক বিস্ময়কর সৃজন, যা একই সঙ্গে পদার্থ ও অন-পদার্থ। অপেক্ষতা এর ধর্ম।
— তবে আমরা কাল অনুভব করবো কীভাবে?
— কালের স্ব-আত্মা পুঙ্খানুপুঙ্খ ধ্যানের সাহায্যে।
— সে যে মহাতপস্বীদের কাজ। আমাদের মতো অজ্ঞান অভাজনের কালোপলব্ধির কি কোনও সরল পথ নেই?
প্রকৃতে একটি স্থির কাল, আরেকটি স্থির কাল, এমনই করে অনেকগুলি স্থির কালবিন্দুকে যুক্ত করলে আমরা যে রেখাটি পাই, তারই নাম কালস্রোত। মহারাজ, কালচক্র এই রেখাপথে ভাসমান। সামান্য জনেরা বলে থাকেন— কালের প্রবাহপথটি সর্পিল। তাদের প্রমাদ ঘটে। বাস্তবে, সে পথের স্পর্শলগ্ন মেদিনি নানা ভঙ্গিমায় বঙ্কিম পায়
— মহারাজ, পথ সরল হয় না, জটিলও হয় না। তার জটিলতা সরলতা নির্ভর করে যে পথিক–তার উপর। পথচারীর নিজ বস্তুজগত ও ভাবজগতের দ্বন্দ্বে পথ সরল অথবা জটিল হয়ে থাকে। মহারাজ, আপনি কাল সম্বন্ধে অবগত হতে চাইছিলেন। কাল দৃষ্টি-অতীত, শ্রুতি-অতীত, গন্ধাতীত, স্বাদ, স্পর্শ সকলের অতীত। জ্ঞানেন্দ্রিয়ও তাকে অনুভব করতে অসমর্থ। কাল যেমন রূপাতীত, আকারাতীত– তেমনই গুণাতীতও বটে। তার হ্রাসবৃদ্ধি নেই, আদি-অন্ত নেই। তাই নতুন কোনও কাল কদাচ সৃষ্টি হয় না। রাজাধিরাজ, কাল একটি চক্র, এবং সে চক্র স্থির, যদি না কোন শক্তি তাকে চালিত করে। রথচক্রকে চালায় বেগবান অশ্বের টান। অশ্ব অকস্মাৎ স্থানু হলে রথচক্রটি থেমে যাবে। কালচক্রকে কোন শক্তি চালাচ্ছে, কেউ জানে না।
— যদি তাই-ই হয়, মহাত্মন, চক্রটি কি ভূমিসাৎ হয়ে যাবে না?
— সেটিই হওয়ার কথা, কিন্তু হয় না। কারণ, কালের চক্রটি চলতেই থাকে।নির্দিষ্ট নিয়তিতে। সূর্যাবর্তনে, চন্দ্রভ্রমণে সে ঘূর্ণনের রীতি স্থিরিকৃত। সুতরাং কাল অস্থির। একই সঙ্গে স্থিরতা ও অস্থিরতা কালের স্বরূপ চিহ্ন। হে রাজর্ষি, কাল অরূপ। আবার সে অন-রূপান্তর। আমরা যারা বলি আপনার পূর্বপুরুষ মহারাজ নহুঁষের রাজত্বকালের কাল অমনতরো রূপে ছিল, এ কালে আপনার সুশাষনাধীনে তা অন্যরূপ ধারন করেছে, কিম্বা তদ্রুপই আছে, তখন আমরা ভুল বলে থাকি। মহারাজ, গতকাল সূর্যকরে ঝলমল দিন গেছে, আজ মেঘে আবৃত, ছায়াময়। কাল কিন্তু বদল হয়নি, কারন সে অবিকার। অবস্থার ভেদ ঘটে। গতকাল তপ্তাবস্থা ছিল আজ সিক্তাবস্থা।
—ঋষিবর, কাল যদি স্থিরই হল, তবে আপনারা যে কালস্রোতের উল্লেখ করেন, এ ধন্দের উৎস কী?
— এরও উৎস অপেক্ষতা। কালের প্রবাহ আছে বলি। প্রকৃতে একটি স্থির কাল, আরেকটি স্থির কাল, এমনই করে অনেকগুলি স্থির কালবিন্দুকে যুক্ত করলে আমরা যে রেখাটি পাই, তারই নাম কালস্রোত। মহারাজ, কালচক্র এই রেখাপথে ভাসমান। সামান্য জনেরা বলে থাকেন— কালের প্রবাহপথটি সর্পিল। তাদের প্রমাদ ঘটে। বাস্তবে, সে পথের স্পর্শলগ্ন মেদিনি নানা ভঙ্গিমায় বঙ্কিম পায়। পূর্বেই বলেছি, কাল বদলায় না, বদলে যাচ্ছে তার পারিপার্শ্বিকতা। কেন এরকম হয়, অন্য একদিন তা সবিস্তারে আপনার কর্ণগোচর করবো, যদি অনুমতি দেন। আজ আমার গাত্রোত্থানের আদেশ হোক।
— হে মহাঋষি, একটিই প্রশ্ন। শেষ প্রশ্ন। কাল তাহলে কী?
— মহারাজ, এই জিজ্ঞাসাই কালতত্বের চরমতম অধ্যায়। আপনি কালের সমস্ত স্বরূপলক্ষণ জেনেছেন। বলে রাখি, কাল জ্ঞেয় এবং অজ্ঞেয়। মহারাজ, তপস্বীগণ ঈশ্বরের তত্ত্বালোচনায় অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। সহমত হয়েছেন কি? বলেছেন— তিনি নিরাকার, নিরঞ্জন, ব্রহ্মান্ড স্বরূপ। মহারাজ, তিনমত। আরও মত আছে। সিদ্ধান্ত এখনও গৃহীত হয়নি। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এই কথাটি বলতে চাই, মহারাজ, কালই প্রকৃত প্রস্তাবে ঈশ্বর, তাই তাকে বলা হয়েছে মহাকাল। তিনিই স্রষ্টা, সৃষ্টিকে তাঁরই প্রবাহমধ্যে ধারণ করেন, তিনিই তাঁর বিনাশ করেন। কালই স্নেহ,দয়া,মমতা ও দন্ডবিধানের সর্বময় কর্তা। তিনিই জন্ম জীবন ও মৃত্যু। সৃজন বর্ধক ও গ্রাসক। আসুন, মহারাজ, আমরা এই মহাকালের প্রণাম করি, বলুন, — আমাদের মূঢ়তা দূর করো, হে মহাকাল।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২৯
❤ Support Us