Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জুলাই ৭, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৩৩

ফরাক্কায় ব্রিজটা তাড়তাড়ি শেষ হলে বাঁচি। স্টিমারের ঝামেলা থেকে রেহাই পাই। আপনি রেস্ট নিন। সকড়িকলিতে ডেকে দেবো।ডাঃ আচার্যে বললেন সহযাত্রী ...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৩৩

।। ফলকান্ড ।। 

আত্মপরকলা

 
মায়াময় অন্ধকার তখন। ডাক্তার আচার্য নির্মোক হলেন, খসে গেল সব পরিচয়, জেগে উঠলো নীলু। ঘুম আসছে না কিছুতেই।
 
ট্রেনটা ছুটছে নিজের উল্লাসে। কু..ঝিকঝিক…কু…। এখনো কয়লার ইঞ্জিন, শিগগিরি আর থাকবে না, ডিজেল এলো বলে, ইলেকট্রিকের ইঞ্জিন আসবে। স্টিমের পুরুষালি দাপট তখন রূপান্তরে কেমন হবে আগাম কি বলা যায় ! রূপান্তর ! ভাবনাটা অস্পষ্ট, কিন্তু শব্দটা বোধহয় মুখে বেজেছিল খচ করে বিঁধে গেল মাথায়, এফোঁড় ওফোঁড় চোরপুলিশ খেলছে।
 
ভোর চারটেয় ফার্স্ট স্টিমার। ট্রেন লেট করলেও সময় বেশরম হয় না। মালদা পৌঁছোতে অন্তত বেলা দশটা। স্টেশন থেকে রিক্সা। আট দশ মিনিট, ব্যস, শান্তি। বাড়িতে স্নেহলতা একা। একটা সর্বক্ষণের দাসী অবশ্য আছে। তবে ঝি-চাকরকে কি ঘরের লোক ভাবা যায়! নাকি ভাবা উচিত ! দেশবাড়িতে যারা ছিল, যেমন সাধন, তারা পরিবারভুক্ত ছিল। কেউ বলেনি তাদের, আপনাআপনি হয়ে যেত। অভ্যেস ছিল। সে অভ্যেসের রূপান্তরও আপনাআপনি ঘটে গেছে, সবার অলক্ষ্যে। এখন নীলু বাড়ি গিয়েই ঝি কে দেড়দিনের ছুটি দেয়, কলকারখানার মজুরদের মতো, শনিবার আধবেলা, রবিবার পুরোটাই।
 
পৌঁছলে রেস্ট। দুপুরে জার্নির ধকল মেরামতে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা। সন্ধে হলে মাতৃ হোমিও ঔষধালয়ের চেনা চেম্বারে আড়াই তিন ঘন্টা। দোকানটার আদল আরও বদলে গেছে। কাউন্টারে ওষুধের দাম চড়া, জার্মানির ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত, এখানে আমদানি করা। পরামর্শটা নীলুই রবীনকে দিয়েছিল। রবীনের তখন সংশয়, পেশেন্টরা মাগগি ওষুধ কিনবে তো ! তখন নীলু বলেছিল — কিনবে। দেখছেন না, পেশেন্টদের মনের রঙ বদলাচ্ছে। অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের দাম হু হু করে বাড়ছে। কম দামের ওষুধে রোগীর নাকি তেমন উপকার হয় না। আমাদেরও এই মোডটা নিতে হবে। প্রথমে দেশি বিদেশি দুটোই রাখবেন। ওরা বেছে নেবে। দেখবেন, ধাঁধায় পড়ে আপনাকেই জিগ্যেস করবে। তখন ওদের বুঝিয়ে বলবেন, দেশি মেডিসিনে ফরেন মেড-এর তুলনায় এফিক্যাসি কম। যত গুড়, তত মধু। দেখবেন, আর ওদের দোনামোনা নেই। অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে যুঝতে গেলে এটা আমাদের দরকার, ডঃ মজুমদার। — এখন মাতৃতে কেবল বিদেশি ওষুধই পাওয়া যায়। একেবারে টপ বিজনেস সিক্রেট— কলকাতার কোন এজেন্ট ওষুধের জোগান দেয়, মালদার কোনও হোমিওপ্যাথ জানেন না।
 
সে চেম্বারে নীলুর নিজের রোগী নেই, রাখা হয় না। সে এখন কনসালট্যান্ট। রবীন বেছে বেছে ক্রনিক রোগীদের তার কাছে পাঠায়। ভিজিটের ফি চড়া নেয় নীলু। রবিবারে সকালটা বাড়িতেই। সন্ধে আবার মাতৃতে, চেম্বার নয়, কনফারেন্স, ডাক্তারেরা আসেন, চিকিৎসা নিয়ে কথা হয়। কখনো কখনো বৈদ্যনাথবাবু, কি সনাতনবাবুও আসেন। প্রবীণ বয়স, প্রাকটিস কমিয়েছেন, তবু নীলুর কাছ থেকে আধুনিক মন্ত্র ও প্রয়োগবিদ্যা আহরণ করলে অপরাধ কী।
 
স্নেহলতাকেই সময় দেওয়া হয় না কাজের চাপে। কথাও গোনাগুনতি। এমনিতেই স্নেহ মুখচাপা ছিল, তাই বলে মূক ছিল না, যে কথাটি বলার জন্য মুখিয়ে থাকতো, সেটিতে সরব হতে বাধা ছিল না কোনও, জোরও ছিল। ভাবতে ভাবতে নীলু জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, অন্ধকারের মধ্যেও বাহিরটাকে পিছনে ছুটে যেতে দেখে সে — মাটি, গাছ, তারা, চাঁদও গুমগুমিয়ে ছুটছে। স্নেহলতার তাপ, উত্তাপের মুহুর্তগুলি যেন ট্রেনের চাকার চলনছন্দে তালে তালে নীলুর কানে ফিরে ফিরে বাজতে থাকলো।
 
স্নেহলতার দোষ নেই। পরিবেশ পরিস্থিতিটা এমন ঝোড়ো হাওয়ায় বদলে গেল। ওর বাবা মা দুজনেই গত হয়েছেন। চারুশীলা প্রথমে। ভুগছিলেন দিনকুড়ি, নিউমোনিয়া ধরেছিল। শেষ পর্যন্ত শহরের হাসপাতালের মেডিসিনের বড়ো ডাক্তার এনেও দেখানো হয়েছিল। তবু শেষরক্ষা হলো না। ডাক্তার বাবু বলেছিলেন — ওনার অসুখটা পুরোনো। চিকিৎসা করেননি কেন আপনারা ? — শুনে যাদবচন্দ্র, স্নেহলতাও থম ধরে ছিলেন। রোগের খবর তারা কেউই কখনও শোনেননি। অপরাধবোধের তাড়নাতেই সম্ভবত যাদবচন্দ্রও চলে গেলেন। স্ত্রীর শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাওয়ার পর একমাসও ফুরোলো না। বিকেলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, প্রত্যহই এমন সময় কাটান, পড়ে গেলেন। উঠলেন না।
 

খুলনা শহরের জন্মবাড়ি ছেড়ে যশোরের মুক্তোকান্দি গ্রামে এক অচেনা পুরুষের হাত ধরে এসেছিল যে কিশোরীটি, বাপমায়ের ভিটে থাকলেও খুলনার মাটিতে তার মূল ছড়ায়নি। মেয়েদের সে মূল থাকেও না। জন্ম থেকেই যেন সে জেনে যায় যে সে পরধন। তারপর একদিন সত্যিকারের ঘরণী হয়ে ওঠে, তার রসধারা মাটিকে সিক্ত করে, আবার রসস্রোত উর্ধচারী হয়ে তার দেহের ডালপালায় ছড়িয়ে যায়। নারী সে, বৃক্ষ সে। স্নেহলতা এখন তাই

 
ওই বাড়িটায় এখন হরীষেরা থাকে। স্নেহলতা আর যায় না। নীলুও চায়নি, ওদের সংসারে বউয়ের সম্পর্ক থাক। সম্বন্ধির আয় আহামরি নয়। বোনের কাছে স্নেহের প্রেরণায় কিছু সাহায্য চেয়ে বসলে স্নেহলতার পক্ষে সে দাবি হয়তো ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই…। তাছাড়া মালদা টাউনে ডাক্তার স্বামীর সামাজিক মর্যাদাটাও ওর মনে রাখা দরকার।
 
ছেলে টোটন, পছন্দের নাম চন্দ্রমৌলিকে স্কুলে ভর্তি নিয়েই শেষ মতান্তরটি ঘটেছিল। স্নেহ চায়নি ছেলে দূরে কোথাও যাক।
 
ছোটো খাটো হার ঘটছিল অনেকদিন ধরেই, এবার চরমতম পরাজয় ঘটলো। প্রথম প্রথম স্বামী-স্ত্রী যেত ছেলের হস্টেলে, বাবা মাকে জড়িয়ে টোটন কাঁদতো। স্নেহলতাও। ভ্যাকেশনে ছেলে বাড়ি এলে ফিরতে চাইতো না। তার মা তখন সত্যিই দশভূজা। টোটনের কী ভালো লাগে ভেবেই ব্যস্ত।
তারপর ইস্পাতধার হল ছেলে। মা বাবার জন্য ব্যাকুল হয় না। ছুটিতে ঘরে এলে নিজের কামরায় চুপচাপ বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মায়ের ডাকের জন্য উচাটন ভাব উবে গেছে। স্নেহলতা ভয় পেয়েছে, ছেলে অচেনা হয়ে যাচ্ছে, কথাবার্তার রকমও আলাদা। বিগড়ে যাচ্ছে নাকি ! নীলুকে বলেছে। নীলু হেসে উঠেছে — তুমি গিরামেই থাকি গেলা। ভুলি যাচ্ছো তুমি ডাঃ এন আচাজ্জির বউ। আমাগের টোটন মডারন সিসটেমে হেবিচুয়েটেড হতিছে।
 
স্নেহলতার এখন একা। বড়ই একা। গাড়ির চলন্ত চাকার আওয়াজ যেন নীলুকে বলছে — যাও এবার গিন্নিকে নিয়ে এসো। — নীলু মাথা নাড়ে। আনবে সে। মালদার ক্ষণস্থায়ী শিকড়টিকে উপড়ে ফেলবে। কষ্ট হবে স্নেহর। নিজের হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার তিলোত্তমা। তার বিশ্বভুবন। একলহমায় সে ঠাঁই ভেঙে চলে আসা কি সহজ ? কষ্ট কি নীলু নিজেও পাবে না ! মাটিতে গাছের মূল চারিয়ে যেতে সময় লাগে । খুলনা শহরের জন্মবাড়ি ছেড়ে যশোরের মুক্তোকান্দি গ্রামে এক অচেনা পুরুষের হাত ধরে এসেছিল যে কিশোরীটি, বাপমায়ের ভিটে থাকলেও খুলনার মাটিতে তার মূল ছড়ায়নি। মেয়েদের সে মূল থাকেও না। জন্ম থেকেই যেন সে জেনে যায় যে সে পরধন। তারপর একদিন সত্যিকারের ঘরণী হয়ে ওঠে, তার রসধারা মাটিকে সিক্ত করে, আবার রসস্রোত উর্ধচারী হয়ে তার দেহের ডালপালায় ছড়িয়ে যায়। নারী সে, বৃক্ষ সে। স্নেহলতা এখন তাই। মুক্তোকান্দিতেও কি তার শিকড় ছিল ? অনিকেতী বেদনাটা বয়স তাকে দিল কোথায় ! নীলাম্বরের কি ছিল ? আত্মপ্রশ্নের শরাঘাতে নীলুর দম বন্ধ হয়ে আসে। জামার বোতাম ঢিলে করে দিল, বন্ধ কাচের জানলাটা একচাবি তুলে দিল, বাতাস আসুক, হিমবাতাস। আরাম পায় নীলু, মনে মনে বললো — স্নেহ, কলকিতায় নেয়ি আসবো তোমারে। তোমার ভালো লাগবে। — ভাবে নীলু, আপাতত বাসা ফ্ল্যাটেই দুজনে থাকবে। আস্তনাটা বড়োই। আরামের। তারপর নয় কলকাতার গায়ে গায়ে অনেক নতুন বসতশহর গড়ে উঠছে, জমি বিক্রি হবে, খুব দাম নিশ্চয়ই হবে না। স্নেহের ডাক্তারবাবুর এখন টাকার অভাব নেই। আবার স্নেহ সাজিয়ে তুলবে নিজের ভবন। পারবে স্নেহ, পারবেই। এখানে এলে দেখতে পাবে কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কত মায়াময়ী লীলা। কলকাতার জীবন উড়োজাহাজের চেয়েও জোরে ছুটছে। মানুষেরা কত উদার। আবার বিড়বিড় করে নীলু — তোমারে আসতিই হবে। তুমি বিনে তোমার ডাক্তার যে একা গো। — এতক্ষণ পর ট্রেনের ঝাঁকুনিটা বড়ো স্পষ্ট কানে বাজে। হাওয়ায় ঝিম ধরে, ঘুম আসছে নীলুর। জানলা তেমন খোলা রেখেই হাওয়া বালিশটা মাথার তলায় দিয়ে নড়িয়ে শুলো নিলো।
 
তখন চোখে স্বপ্ন এলো।
 
স্নেহলতা বলছে — বাবারে মায়েরে খুঁজিছো ?
 
— কুথায় খোঁজবো।
 
— কেন, কলকিতায়।
 
— না, স্নেহ, কলকিতায় কাওরে খুঁজি পাওয়া যায় না। ইটা হারানের মহানগর। বাবা মা বুধায় বাঁচ্যে নাই। তোমার বাপমায়ে চলি গেলেন তাগের চেয়ি বয়সিতে বড়ো বাবা কি জীবিত থাকবেন ! মা-ও…।
 
— না খুঁজিই হাঁকি দিলা তারা নাই ! তুমি কি তাগের ছাবাল ? না অচিনা ?
 
— স্নেহ…। — কিছু বলতে চাইছিলো নীলু। স্নেহলতা তখন চোখ থেকে মিলিয়ে গেছে। সামনে ভেসে উঠলো কলকাতার ধর্মতলা। সে ব্যস্ত মোড় পার হবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। ফুটপাতে বসে ভিক্ষা চাইছে এক বুড়ো। বিরক্তির সঙ্গে মায়া জাগলো তার। একটা দশপয়সার মুদ্রা পকেট থেকে বের করে ঝুঁকলো, তখন বৃদ্ধের মুখটা সামনে। একী ! ভিক্ষা দেওয়া হলো না, প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে একেবারে হরলালকা বিলডিংয়ের নীচে এসে দাঁড়ালো। এখানে শান্তি। দেখেনি, পিছনেই এক বৃদ্ধা তার জামা ধরে টান দিয়ে হাত বাড়িয়েছে। এবার সে তাড়া খাওয়া পকেটমারের মতো ছুটছে। চিৎকার করে উঠলো — কেন তোমরা আমারে এমনি করি কষ্ট দিতি আলে! চলি যাও, চলি যাও, কচ্ছি । আমার সব্বোনাশ করো না তোমরা।
 
প্রবল শ্বাসকষ্ট বুক জাপটে ধরেছে তখন। নীলু উঠে বসলো,চোখ কচলায়।
 
বিপরীত আসনের যাত্রীটি চা খাচ্ছিল, বললো — কী হলো, স্যার, এনি প্রবলেম ?
 
— না, গরম লাগছে।
 
— উইনডোটা হাফ খুলে দিন। আমিই দিতাম। ভাবলাম, আপনার যদি আপত্তি থাকে। চা খাবেন ? ফ্লাস্কে আছে। নিয়ে এসেছি। রাস্তায় এ অমৃত না পেলে আমি কানা।
 
— কোন স্টেশন গেলো ?
 
— বারহাড়োয়া। দেখছেন না, ওই যে রেলের গোডাউন। লাইট জ্বলছে।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৩২

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৩২


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!