- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ৪১
।। শুকনাকান্ড ।।
নতুন বসত
ডা. এন আচার্য এখন পুরোদস্তুর অনঙ্গাপুরী, মালদার পাট চির উঠিয়ে চলে এসেছেন।
আসার আগে ভয় ছিল, স্নেহলতা বেঁকে বসবে। ওর বাবা-মায়ের স্মৃতি জড়ানো শহর। ওদের বাড়িটা, না- হয় এখন ওর দাদা বউদি থাকে, তেমনই আছে। নিজের বাড়ির ছাদে উঠলেই দেখতে পেত স্নেহ।
নিজের বাড়ির মায়াটা ! সেটাও যে নিজের রক্তপতনের সাক্ষী।
আশ্চর্য ! স্নেহলতা অনুগত থেকেছে। নীলাম্বরের খটকা লাগে। বউয়ের শান্তভাবটা স্বাভাবিক নয়। ছেলেটা যদি কাছে থাকতো ! কোনও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে না তো ! হোমিওপ্যাথিতে এ রোগের চিকিৎসা নেই। সাইকো স্পেশালিষ্টকে কি দেখাবে !
অনঙ্গপুর এখন একেবারেই খোলনলচে বদলে ফেলেছে। চাষের ক্ষেত রাতারাতি বাস্তুজমি হয়ে গেল। ল্যান্ড ডেভেলপারদের খেল! বিরাট পশ এলাকা, মাঝারি মধ্যবিত্তদেরও হিম্মত নেই ওখানে জমি কেনে। প্রাসাদের পর প্রাসাদ, নয়নমনোহর বর্ণসমারোহ, রাস্তা দিয়ে সময় দশকের চোখে মোহ মাখায়। যে কোনো দালানে ঢোকার মুখে ভিত্র থেকে তালাঝোলা গ্রিল দুয়ার, বাঁ-পাচিলে খোদিত মহা মানুষটির নামফলক। তারই নিচে চেতাবনি-ঘরে কুকুর আছে। অনুমতিপ্রাপ্ত ভগ্নপ্রাপ্ত সে লৌহদুয়ার ঠেলে ঢুকলেই বাহারি লন, পাম-ক্যাকটাস-সিজনফ্লাওয়ারের উদ্যানিকা, একপাশে চার চাকা, দুচাকার তো বটেই, গ্যারেজকক্ষ এবার চোখের সামনে চোখের সামনে ইমারত্টি, গ্রিক কিংবা ইতালিও স্থাপত্যদম্ভের ভগ্নাংশই যেন।
এ পাড়াতেই ডা. আচার্যের নব রাজগৃহ, নামফলকে তার অর্জিত বোঝাসমেত আস্ত আছেন তিনি, সে বোঝায় নবতম সংযোজন।
রাজ্য মেডিকেল (হোমিও) কাউন্সিলের সদস্য।
তিনি কৃ্তবিদ্য। ব্যস্ত মানুষ এ ভূমিতে। নিউ মাকের্টের একটি ফ্ল্যাটের নীচে দুটো সুইট ভাড়া করেছেন তিনি। তার চেম্বার। রোগীদের ও সঙ্গে আগতদের বসার জন্য বিলাসী আয়োজন, রোগী পরীক্ষার পর ওষুধ মেলে জার্মানিতে প্রস্তুত।
সমাজসেবাতেও মগ্ন হয়েছেন। কিছুদিন হল অনঙ্গাপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের আসনটি অলঙ্কৃত করছেন। সপ্তাহে তিনদিন সে দফতরে যেতে হয়, নিজের আম্বাসাডার মোটরে যান।
নানা জায়গায় স্বাস্থ্য শিবির লেগেই থাকে। ডাক্তার হিসেবে তিনি থাকবেনই। গরিব মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন, ভালো লাগে তার। সপ্তাহে একদিন ওদের জন্যই ফ্রি চেম্বার, বিনামূলে বিদেশি ওষুধ।
রাজ্য যারা শাসন করেন, তাদের দলের অত্যনত প্রিয় ডা. আচার্য। কানাকানি পরের সাধারন নির্বাচনে তিনি নাকি প্রার্থীপদ পেতে পারেন। যদি সত্যিই তা হয়, হবে ড্য্ং ড্য্ং করে জিতে যাবেন।
আগামি রবিবার, সন্ধে ছটায় পার্টি অফিসে মিটিং আছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। লাস্ট ইলেকশনে জনগণে আর্শীবাদে বিপুল মেজরিটি আমরা পেয়েছি। তাকে চোখেরমণির মত রক্ষা করতে হবে। এখনো দুবছর হাতে। তবু যুদ্ধ তো। দুর্গ এখন থেকেই নিশ্চিদ্র করতে হবে
ডা. আচার্যের চেম্বারে দেয়ালে টাঙানো বাঁধাই ফটো দুটি, চন্দ্রমোহনের কাজলঘষা পায়ের ছাপ অপরটি হেমশশীর আবক্ষ শরীর। দুটোই মাল্যশোভিত, প্রতিদিন টাটকা মালিকা।
সেদিন সতীন সেন এসেছিলেন। হেমশশীর ফটো নির্দেশ করে বলেছিলেন – ইনি কে ?
ডাক্তার বললেন – আমার মা। স্বর্গতা হেমশশী আচার্য।
–তার করজোড় কপালে প্রণামে ছিল, চোখ বন্ধ, দীর্ঘশ্বাস গোপনে থাকেনি।
– ওনাকে আমি দেখেছি চরগাঙপুরে। সাধন মণ্ডলের বাড়িতে। কথাও বলেছি ওনার সঙ্গে। বড়ো ভালোমানুষ ছিলেন। সাধনদা সে সময় পার্টির খুব ভালো ওয়ার্কার ছিল। জঙ্গীভাব বেশি ছিল। নেতৃত্ব দিতে পারতো। ওর স্ত্রী রমা বউদিও। কেন যে ওরা দলটা ছেড়ে দিল। পার্টির পক্ষে বড়ো ক্ষতি। বাই দ্য বাই, সাধনদার সঙ্গে আপনাদের কি কোনো রিলেশন আছে ?
নীলাম্বর ঘেমে ওঠেন। ভুল হয়ে গেছে। বড়ো ভুল। এখানে মায়ের ছবিটা রাখা ঠিক হয়নি। এখানকার অনেকেই যে তার মাকে দেখেছে– মানে। অন্যভাবে নেবেন না, সতীনবাবু আমাদের দেশ ছিল মুক্তোকান্দি। আনডিভাইডেড বাংলার যশোর ডিসট্রিকট। বাবা ছিলেন হেডমাস্টার। নলিনবিহারী এইচ ই স্কুল। আমাদের জমিজমাও ছিল। জমিদার ভেবে বসবেন না যেন আবার।
— না, না, জমি থাকলেই কি জমিদার হয় নাকি !
— সাধন ছিল আমাদের খাসচাকর। আমাদের বাড়িতেই থাকতো, খেতো। বাবা, বোধ হয়, কিছু হাত খরচাও দিতেন। ঠিক জানি না। গ্রামের ব্যাপার তো।
— আপনার মা তো সাধনের কাছেই মারা যান !
— আসলে, বাবার মৃত্যুর পর মা সন্ন্যাসিনী হয়ে যান। কখন যে কার কাছে থাকতেন, ঠিক ছিল না। শেষ সময়টায় হয়তো সাধনের কাছে ছিলেন।
— আপনার বাবার কী হয়েছিল ?
— উনি তো অ্যাকসিডেনেট মারা গেছেন।
সতীন ডাক্তারের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন, একবার চোখ সরালেন ফটোতে, হেমশশীর চোখে, আবার ফিরে এলেন ডাক্তারের মুখে – যাকগে, পারসোনাল ম্যাটারে ঢুকে পড়েছিলাম। সরি।
— না, না, কিছু না – ডাক্তারকে বলতেই হল।
— জানেন। নিশ্চয়ই, আগামি রবিবার, সন্ধে ছটায় পার্টি অফিসে মিটিং আছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। লাস্ট ইলেকশনে জনগণে আর্শীবাদে বিপুল মেজরিটি আমরা পেয়েছি। তাকে চোখেরমণির মত রক্ষা করতে হবে। এখনো দুবছর হাতে। তবু যুদ্ধ তো। দুর্গ এখন থেকেই নিশ্চিদ্র করতে হবে। প্রসারিত করতে হবে। কোন ঢিলেমি যেন না পেয়ে বসে।
— হুঁ।
— চলি, ডাক্তারবাবু। মিটিংয়ে দেখা হবে।
নীলাম্বর সতীনকে এগিয়ে দেন, হাসেন— অফ কোর্স। —সতীন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।
সাধনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না।তবে স্পর্শ একেবারে এড়ানো সম্ভব হ্য়নি। হেমশশীর ছবিটা, চন্দ্রমোহনের পায়ের ছাপ ওদের কাছে থেকেই আনতে হয়েছিল। অবশ্য সে কাজে লোক পাঠিয়েছিল। ওরা দ্বিধা করেনি। রমা নেগেটিভ দুটো দিয়েছিল। তা থেকেই দুটি দুটি প্রিণ্ট তৈরি করে বাঁধানো হয়েছে। বড়ো দুটি চেম্বারে, ছোটো দুটি স্নেহলতার শোয়ার ঘরের দেয়ালে, সে ছবিদুটোয় মালা নেই।
অবশ্য সাধনের সঙ্গে নীলাম্বরের প্রত্যক্ষ যোগ ঘটেছিল আরো একবার। তখন মিউনিসিপ্যালিটির ভোট আসছে। নিজেই এসেছিল নীলু। ওর নির্বাচনী ওয়ার্ড চরগাৎপুর নয়, তবু। সাধনকে আর্জি জানিয়েছিল। বিনীতভাবেই। তার নির্বাচনী ওয়ার্ডের অনেক ভোটার সাধনকে চেনে। পার্টির লোকাল লিডারশিপও বলেছিল যে নীলাম্বরের ওয়ার্ডের পিছন দিকটায় কলোনির মতো বসতি, গরিবগুর্বো লোকের বাস। ওখানে সাধনের পরিচিতি ভালোরকমের। প্রার্থী হিসাবে ডা. নীলাম্বর আচার্যকে নিয়ে একটু অপছন্দের উষ্মা আছে। সেখানে ভোট ক্যাচিংয়ে সাধন একটা বড়ো ফ্য্যাক্টর হতে পারে।
নীলু বলেছিল – সাধন, তুই তো আমার ভাই-ই হোস, তাই না ? বাবা মা তোকে তো তেমনই দেখতেন। এদেশে এসে তোর কাছেই ওঁরা ছিলেন। তোরাই যেমন পেরেছিস, তাঁদের আগলে রেখেছিস। সব তো শুনেছি, এখানে এসে। সেদিন কলকাতার রাস্তায় হঠাৎ কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল ! ক্ষমা করিস, ভাই।
— না, না, উসব আমি মানেতে রাখি নাই। তুমার মা, তারে আমি ভিক্ষি করাইছি। পাপ করিছি। অপ্রাধ করিছি। তুমি কবা না ! উকথা বাদ দেও। তিনি সগগে গেছেন। ভালো থাকেন য্যান।
— বিশ্বাস কর, আমি প্রানপণে ওঁদের খোঁজ করেছি। পাইনি। কিন্তু দেখ, ওঁরাও তো আমাদের খোঁজ করেননি। মালদার শ্বশুরমশাইয়ের ঠিকানা বাবা জানতেন, হয়তো মা-ও। একটা পোস্টকার্ড তো লিখতে পারতেন। বাবা স্বর্গে যাওয়ার পরে মা তো অনেকদিন বেঁচেই ছিলেন। বাবার পুরানো কাগজপত্র খুঁজলেই পেয়ে যেতেন। শুধু কি আমারই অপরাধ ? তুই-ই বল। — সাধনকেই বিচারকের আসনে বসিয়ে দিল নীলু।
— ওসব পুরেন কথা গুরেন দেশে চলি গেছে। ছাড়ান দেও। এই রেতির বিলা কি দরকারে আসিছ, কয়ি ফেলাও।
— ভাইরে, তোর দাদার জন্য ভোটের প্রচারে কয়েকদিন সময় দে না। সতীন বাবু বারবার করে তোর নাম বলছিলেন।
— সতীন দাদা আমার শেরোধায্য।
— ভাই রে, একটুখানি সময়।
সাধন অমায়িক হাসলো – আমি তুমার ভাই, কতি পারি নাকি। নখর মানুষ। শোনো, নীলু দাদা, আমি কচ্ছি, তুমার একটুও ভয় নাই। তুমার দলির সাথি জঙ্গ দেবে, এমুন তাকত অন্য পার্টির আর নাই। ড্যাং ড্যাং করি জেতি যাবা। রেকর্ড ভোটে। একখান কথা জিগোচ্ছি, জবাব খান জানলি দিও।
— বল
— কোঞ্জবাবুর খবর জানো ?
— কুঞ্জবাবু ! তোদের চরের দায়িত্বে ছিলেন এক সময়ে ! শুনেছি। নীলু মাথা নাড়ছিল — উনি আর পার্টিতে নেই। এখন নামজাদা উড অ্যাণ্ড টিম্বার মার্চেণ্ট। আসাম চেম্বার অফ কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তা, হঠাৎ কুঞ্জবাবুর কথা !
— এমুনি। বদলায়ই যায়। সব। নেতাইদা, তুমি তারে, দেখো নাই, নীলুদাদা, কতেন, সব বদলায়ে যাবে, সব সময়, তুমি চাও, না চাও। তখন সে কথার অথথো বোঝতেম না, এখন এত্তুআটু মালুম হচ্ছে। সাধন দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসে – নাকি ত্যাল মারি ঘুমাও। জাগি দেখবা, তুমি মিউনিসিপালুটির চিয়ারে অধিষ্ঠেন করতেছ।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪০
❤ Support Us