Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • নভেম্বর ১৯, ২০২৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : মাটি ব্রতের আখ্যান । প্রথম পর্ব

সুধীরকুমার শর্মা
ধারাবাহিক উপন্যাস : মাটি ব্রতের আখ্যান । প্রথম পর্ব

অলঙ্করণ: দেব সরকার

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স

 

 

১ নভেম্বর, ১৯৫২। রেল শহর কাঁচরা পাড়ায় সুধীরকুমার শর্মার জন্ম। বাবা চুনিলাল শর্মা, মা তারুলতা দেবী। সুধীর পাঠ নিয়েছেন সতীশ নন্দী বিদ্যালয়ে, ‍‍ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে, অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা। শিক্ষা স্নাতকোত্তর। কবিতা দিয়েই লেখার শুরু। একদিন দুচ্ছাই করে প্রবন্ধে। সেটাও ত্যাগ করে আপাতত গল্পে থিতু। প্রথম প্রকাশিত গল্প জোছনা বাদ। ছাপা হয়েছিল বর্ধমান থেকে মুদ্রিত ক্ষীণতনু ক্ষণজীবী পত্রিকা ‘ প্রথম স্বরে ( ১৯৭৮)। মাটিব্রতের আখ্যান তার প্রথম উপন্যাস। সাতটি কান্ডে আখ্যানটি পরিকল্পিত। দীর্ঘ আয়তনের উপন্যাসটির বিষয়, ভাষা আর পটভূমি অন্যরকম। তাঁর গ্রাম দেখা, গ্রাম নিয়ে ভাবনা চিন্তা, তথাকথিত নাগরিকদের তাৎক্ষণিকতা থেকে দূরে, অনেক দূরে । আবহমানের চালচিত্র ছড়িয়ে আছে প্রতিটি পর্বে, নির্মান ও সৃষ্টির বিস্ময়কর বৈচিত্রে।

 

ভুঁই কান্ড

॥ জিব্রাইলের পাখসাট ॥

ঘোর ডামাডোলের আবহাওয়া, তবু বুকে তাকত ভূঁইমালী ঘবের কনিষ্ঠ পুত্রসন্তান ছাড়াভিটের এক তরফের কাছ থেকে একটুকরো বসতজমি কিনে ফেলেছিলো সস্তায়। অবশ্য এজন্য বেশ কিছু টাকা হাওলাত করতে হয়েছিলো ওকে। সেদিন সদানন্দের ভূমি পুজো ভিত খোঁড়া হারে কদিন পর। সকাল থেকেই গাঁয়ের নিকট পাঁচজনে সে জমিতে তত্ত্বতালাসে আসা যাওয়া করছিলো ভয় মেশানো খুশিতে। তখনই রেডিওতে বিশেষ খবরটা বেজে উঠেছিলো। তারপরই নিথর হয়ে উঠেছিলো খন্ড আকাশ। 

রেডিয়ু বাত্তাটা চন্দ্রমোহনের কানে পৌঁছেছিলোই। 

তিনি চন্দ্ৰমোহন আচার্য, বিএ, কাব্যবিশারদ, নলিনারহারী উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ের রিটায়ার্ড পন্ডিত ও হেডমাস্টর। বার্তাটি তাঁকে মুচড়ে দেয়নি। সেটা ঘটলো সন্ধে নামার বেশ পরে। আঁধার নামের জিব্রাইল ডানা বিছিয়ে যখন শীত বিছিয়ে দিচ্ছিলো চরাচর তখনই যেন গর্ভের গর্ভ থেকে গরম গোঙানির নিঃশ্বাসটা মাটি ফুঁড়ে গাছের ডালপালা পাতার বাঁধুনি ছিঁড়ে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকলো।

— উঁ…উঁ…উঁ…গান্ধিবুড়েরে.. উঁ…উঁ…উঁ… গোলি করি মারিচে গো… উঁ…উঁ…উঁ…

এই প্রথম চন্দ্রমাস্টার মুষড়ে পড়লেন, থ হলেন, কথা হারালেন। 

গোঙানিটা বেজেই চললো। 

দু বছর হয়ে গেলো, গোঙানিটা কেঁদে যাচ্ছে, কখনো মাঝরাতে, কখনো রোদ সেঁকা দুপুরের নিঃসঙ্গতায়, কখনো নৈঃশব্দ্যের কোলাহলের ভিড়ে। চন্দ্ৰমোহনকে তাড়া করে ফিরছে। বুক হালকা করতে দু একজনকে মুখ ফুটে বলেছিলেন। তারা আধেক ‘পেত্যয়’ চোখে মেখে চন্দ্রমোহনকে দেখেছিলো।

যেমন রাখাল কামার। হাপর আগুনে পেল্লাই রামদা শানাত শানাতে থেকে গেছিলো আঙুল সুতো বাঁধা দড়িটান। বুকে দম ভরে, আবার ছেড়ে, কেমন মিয়োনো গলায় বলেছিলো – মাসটের বাবু, আপনে পোন্যিবান, পাপ যে আপনেরে ছোতে পারে না, তাই ওইসব ব্যাদনাব্যাতা শোনতে পান। সামাল দেন নিজিরি। আর ভাই বা কতি পারি! মোখ্যসোখ্য মানুষ।

কিংবা জয়েনউদ্দিন নস্কর। তাঁরই ইসকুলের সেকেন্ড মাসটার। রোজ সন্ধেবেলা একবার চন্দ্রমোহনের বৈঠকখানায় পা দেবেনই। সব শুনে বলেছিলেন— আল্লা সকলেরে তুমার মতো কান দেন নাই, আচাজ্জি! সকলে যদি শুনতে পা তো, তালি দুনিয়াডা দোজেখ হতি পাত্তো না। সাওম হারায়ো না, ভাই, রসুলের উপর ভরসা রাখো।

লোকজন ফিসফিস করে— পুন্ডিতের মাতাটা গেচে।  খুনখারাধটে যিখানে গটলো, তাগোরি কুনু আপিত্যেশ নাই, কেবল তেনার চোখে জল! কুনু মানি আচে? 

গোঙানিটা এ অঘ্রানী জাড়ে আবার বাড়লো।

চৌকিতে উঠে বসেছেন চন্দ্রমোহন।

হেমশশী মেঝেতে আসনপিঁড়ি, পিতলে থেতানিতে পান ছেঁচছেন।

দিনে দুটি নেশা চন্দ্ৰমোহনকে করতেই হয়— দুপুরে ও রাতে খাওয়ার পর প্রথমে গুরুক গুরুক তামাক টানা ইজিচেয়ারে বসে। ইদানীং অনেক সময় ব্যয় করেন। ধোঁয়ার মেঘগুলো জলভারী হয়ে বড়ো থেকে আরো বড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়ানো চোখে সেই আয়োজন চোয় চেয়ে দেখেন। মেঘ ঘরের সমস্ত আকাশটা ছেয়ে দিচ্ছে, আর বোধহয় রোদ ফুটবে না। ভেবে শ্বাস পড়ে, চেষ্টা করেও দমন করতে পারেন না। দু নম্বর নেশাটি ছেঁচা পান খাওয়া। চৌকিতে ওঠার পর। যখন স্কুল ছিলো মুখে পরে বেরিয়ে যেতেন। তখন দাঁত সবকঠাই ছিলো। তবুও। 

হেমশশী হাত চালাছেন তিতাং তিতাং, আর বারবার স্বামীর মুখে চোখ রাখছিলেন। 

—হেম, কিছু বলতি চাও?

হেমশশী কেঁপে উঠলেন হঠাৎ। কত কতদিন পর নাম ধরে ডাক শুনলেন। একদিন ওডাকে তার সমস্ত শরীর উদনমুদল হতো, গলার ভিতরে লালা শুকিয়ে উঠতে, সুখে কী বিলাসে। আজ ততটা না হলেও অনেকটা। চোখের চামড়ায় টান পড়েছে, তবু রূপসার মতো ভাসা দুটি চোখ চন্দ্রমোহনের চোখে মেলেই নামিয়ে নিলেন হামানের মাথায়। লম্বা এলো বহু ক্ষয়া বসন্তের চাদর সরিয়ে।

তার তো এ ঘরে আসার কথা নয়। ঢাকা দেশের মেয়ে। যশুরিয়ারা জানে ঢাকাই মেয়েরা দজ্জাল হয়, শ্বশুর ভাসুরের মান রাখে না, শুটকি প্যাজ খায়।

চক্রমোহনের কত্তামা ছিলেন তেজালি জিদী। কোনো ওজর শুনতে রাজি হননি। হেমশশীকে দেখেছিলেন ভাদুড়িবাড়ির মোচ্ছবে, মেয়েমহলে, সুনার বনু, আপাছ গোছ চুল, ডলো ডলে বদনখান, আর চিনায়িনীর নাহান দুই চক্ষু- কাজল দিয়ি কথালে একখান আঁচি দিলিই মন্ডুপে বসান যায়। তার জলপানি পাওয়া নাতিটির জন্য আর কে আসতে পারে! সেই হেমশশী। এখন শুধু নীলুর মা। আরও একজনের মা হতে পারতেন। সুনয়নীর মা। তিন বছর বয়সে সে আবাগী কালাজ্বরকে বিয়ে করে চলে গেছে। হেম ডাক শোনেন না বছর তিরিশ। কাঁপুনি তো আসবেই। হেমশশী পান দিতে উঠলেন।

চন্দ্ৰমোহন চেপে ধরলেন তার হাত। বললেন, – তুমি তো কুরান পড়ো নাই। হজরত বলিচেন, ইবলিশ জেবরাইনোর সুযুগ পালিই পাঠায়ে দয়। শয়তান শকুনডে ডানা ছড়ায়ে আন্ধার করি ফেলায় দুনিয়ে ডারে। জেয়ন্ত মানষীর মজ্জা শুষি খায়, হাড় মাস চিড়ি চিড়ি খাতি থাকে। যতক্ষণ না আল্লা ভগবান তাঁর তলবার দিয়ি উয়ের ডানা না ছাটতিচেন। 

হেমশশী কেমন যেন চেয়ে থাকেন তাঁর দিকে। তবে কি ওই লোকের কথা সত্যি! মাথাটা কি…

— হেম, আমারে ছাড়ি যাবা না তো? কতা দেও।

— হেমশশীর তালু ছেঁচা পানের রসে আলতারঙিন হয়ে যায়, তার চোখ ছিঁড়ে ভাদুড়ে রূপসা দুই শাখায় আবছা রেখময় গালের আল, খেত, সিঁড়ি, বাগান, বনবাদাড় ছুঁয়ে, বইতে থাকে।

 

॥ আঁধি ॥

আবু জয়নাল সরকার জরুরি এনছাপি মজলিস তকাজা করেছেন নিজের দলিজে। তিনি, এই মুহূর্তে, মুক্তোকান্দির শাহেনশা। মোচলে লিগের লিডর, উনিয়েন বুডের চ্যারমেন। নেওটা কালোটুপি ভলান্টিয়ার ছোকরার দল তার নামে অজ্ঞান।

সভায় মোটামুটি ভিড়। মেহমান বক্তা জিলা ছিকরেটারি মৌলানা আতাউর খান এসেছেন জয়নালের ডাকে। দেশের পক্ষে সময়টা ভালো যাচ্ছে না, হঠাৎ গরমি হাওয়া। ছোটাছুটিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন। তার কাজের জন্য সদরের মাড়োরি বেনে বিনারসীদাস আগরিবাল নিজের ফেটন না কী গাড়িটা দিয়েছে ড্রাইভার করিমকেও। এমনকী পেটরুলের খরচটা। না, না, ছি ছি! সীয়ারাম সীয়ারাম।

মৌলানা ছাড়া আছেন মুক্তোকান্দিতে দলের সব মাথামিম্বর, বুডের মিম্বররা। শুধু খুলিলুর রহমানকে দেখা যাচ্ছে না। আদাবি তলবে হাজিরার বাধ্য হয়েছেন জয়েন উদ্দিন নস্কর সাহেব। 

খলিলের গরহাজিরা জয়নালের বুকে খিঁচ খিঁচ হুল ফোটায়। খলিল তার ডান হাত, নিজে তিন পা এগোবার কথা ভাবলে খলিল সঙ্গে সঙ্গে একুশ পা চলে যায়। কাজ দেখতে না দেখতে হাসিল। ঘটনাটায় এখন জয়নালের বিরক্তি লাগে, আজকের মিটিংটার ইমপোর টেনসি ও বুঝলো না। ক্ষোভও জাগে, পরশু বোর্ডে যখন এ নিয়ে কথা উঠেছিলো, খলিলেরই জোশ ছিলো সবচেয়ে বেশি। দুঃশিন্ডাও জাগলো একটু, হঠাৎ ঠান্ডার জাড়টা বলক দিয়েছে, জ্বরজারি হচ্ছে ঘরে ঘরে। ফুলু! মেলিরিয়া! নাঃ, সভাশেষে ভলিন্টের কাউকে পাঠাবেন ওর তবেও তালাশ নিতে। ঠিক হবে কি! নিজেই যাবেন। যাওয়া উচিত। 

মাথার উপরে যেন জাতীয় পতাকায় আঁকা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলো ফুটছে দেরিতে। জয়নাল প্রবোধ পেলেন। নিকট দূরে খলিলের ইমারতের খিড়কির দিকটা দেখা যাচ্ছে। এই রাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে! হঠাৎ তার নজরে পড়ে নাছ দুয়ারের দিকে কয়েকটা আলোয়ান মোড়া ছায়া দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে

মিটিং চলছে।

খান সাহেরের কথা অল্প, ব্যস্ততার কারণেই সম্ভবত। শ্রোতাদলে দাগ কাটছে না তেমন। মৌলানা কথার তাঁত, মনে হয়, ভানো বুনতে জানেন না, টানাপোড়েন বেদস্তুর। তবু তারা শোনে, সায় দেয়।

—ইবার আপনাগেরে ছ্যারমেন ছায়ের বুঝায়ে করেন। 

খানসাহেব কুর্নিশ করে পা বাড়ান। করিস গাড়ির দরজা খুলে ছ্যালট সেজে তৈরিই ছিলো। 

শ্রোতারা এরার নড়ে চড়ে বসে। 

জয়নাল কথা বলেন দিলের তল থেকে। গলায় মিঠা ঝরে। শোনে যারা, যেন মাতন লাগে। তার গুণের কদর বোঝে জিলা কুমিটি, প্রোভিনজ্যাল কোমিটি সদরে লাখো আদমির মজলিসে তার ডাক পড়ে। এমনকী কালেভদ্রে ঢাকাতেও কথার জন্যই যেতে হয়। 

—খঃ খখঃ খখখখ…

খাঁকারি দিতে গিয়ে গলাটা কি কেঁপে উঠলো! ডান পা যেন অসসাড়দশা। টেবিলে ঢাকা গেলাসে জল, জিভ ভেজালেন। 

— মোচলমান ভ্রাতাগণ…

এখন শব্দ কনটুলে, কথার ঝর্ণাস্রোত বেরিয়ে যাবে।

জয়নাল অজাতশত্রু। বাতাসে ভাসছে— সামনে দেশের প্রথম অ্যালেকশন, তাকে কেন্ডিডেট করে করাচি পাঠাবে, তার এগিনেস্টে দাঁড়াবে এমন তাকত কার হবে ? তবু নিন্দুক কি আর নেই ! জয়নাল নাকি কলকিতায় লিখাপড়া করতে গেছিলেন, থাকতেন মুসলিম মেসবাড়ি বা হোস্টেলে, তখন নাকি ভকনী স্যানের চেলা বনিচেলেন, একমাস দোমাস জেল হিফাজতে খাটিছে। এসব অবশ্য কানাঘুষো। দেশে ফিরেই দুটো ঘটনা একসঙ্গে ঘটিয়েছিলেন জয়নাল, আদালতী চাপকান গায়ে চড়লেন, আর লিগের সবুজ নিশান কাঁধে তুললেন।

— বেরাদর মোচলমানগণ…আমরা সোমায়ের এক সন্ধিক্ষণে আসি দোন্ডায়োমান হইচি।

কলকাতাই বকতিতের আদবখান তার ভালো রপ্ত। কন্ঠসর নানা পর্দায় ওঠান নামান, জানেন এতে ফল ভালো ফলে। 

সুদীর্ঘ লড়ায়ের পর আমরা আমাগেরি দেশ উসুল করি ছাড়িচি, ইনছাল্লা।

শেষ আরবি শব্দের জোর, ঢেউ হয়ে, বসে থাকা লোকজনের গায়েই যেন আছড়ায়।

— এখন আমাগের শিশু দেশের বড়ে বেপদ। নাজায়েল কাম, বেপাক কাম বেবাক আরম্ভ হইচে।- জয়নাল দম নেন খানিক, সকলের চোখে পরখ করে নিতে চান। এবার শুরু করলেন, – ভাইগণ, মরশুম কায়ীদি আজম গভন্নর জিনারেল হয়ি পেথম লিকচারে কী কয়েচেলেন আপনেরা একবার ইয়াদ করেন তো। কতি পারেন সিটা? কে করেন? আপনে?… আপনে…

সকলের মাথা নিচু হয়। লজ্জা ঢাকার অক্ষম চেষ্টা।

জয়েন উদ্দিন যুসুর হাসলেন।

— ছিঃ! ছিঃ! ফাদারফ নিশনের কুনো কথাই বলতি পারলেন না! হায় আল্লা! …কয়েচেলেন, …ইয়াদ রাখেন, …দুই জাতি থিউরিতি দেশ হাসিলের পর আর দুই জাতি নাই ।… বলিচেলেন- সনাতনধম্মীরা আমাগেরি পাক আমানত। সব্বতোভাবে উয়েগের জিম্মেদারি করা আমাগের ফরজ। টাউনগুলার যা হতি আরম্ভ করিচে জয় যেন আমাগের ইখানে কখনো না পেবেশ করে। খোদা কছম! এজন হেন্দোরেও জমিজিরিত বসতপাট উঠোরে দেশান্তরী হতি না লাগে। জিহাদ জারি রাখেন। ইনছাল্লাহ! ভলেন্টের ভাইরা, সুজাগ থাকো। কুনো ওসকানি কানে যাতি না ঢোকে…

 

— ছারমেন ছবি ! – এক মাথাগোছ আমতা আমতা করে, – গমতাকি লবেন না। ইসব তো হেন্দোস্থানের জন্যই হতিচে। বাঁটেয়ারার গোলমেলটা ছাড়ি দেন। তখন ডাইরিক একশনের লড়াই ছেলো। তারপর তো ঠান্ডা সারি গেলো। তয় উয়েগের বল্লব পাতিল মোচলমানের দেশ হাইদেরাবাদেরে দকল নেলো কেন! নেদামেরে জোর জবরদস্তি বরখাস্ত করি তক্তে এক হেন্দোরে বসায়ে দেলো।

এই সুযোগে আর একজন বুকে বল পায়, বলে, – রাজায় রাজায় জঙ্গ হলি কথা বাদ দিয়া যায়। কাগছে পড়লাম, সিখানে কাফের গুন্ডেরা শামিন মোচলমানের ঘরগেরস্তি জান পয়মাল করতেচে। আওয়তাগনের বেইজ্জতি চলতেছে। হেন্দো গরমেন কিছু কচ্ছে না।

—থামেন ! – চিৎকার করে উঠলেন জয়নাল। ভয় হচ্ছে লাটাইটা হাত ফসকে গড়িয়ে যাবে এইবার, সামলাতে হবে যে করেই হোক,- দুনিয়ার মোচলমান আমাদের বেরাদর, কিন্তুক ওই খব্রে সাচা আছে মিছাও আছে। কুরান ইনকার করবেন না। ভাইসব। লা-ইল-ল-লা-হ কুদরত… । ল তার জিভের ডগায় চেরাগের আগের মতো কাঁপে। আরবি ধ্বনির এমন দোল সক্তব মাদ্রাসার তলিবেরাও পান না।

 

—আমি একখান কথা কব। –  বিনীত জায়নউদ্দিন উঠে দাঁড়ান। 

—জি, মাস্টার ছায়েব, করেন না কেন? আপনের মোল্যোবান… 

—বলি কী, দুই জাতের একসাথে কথা কওন দরকার। হেন্দোরা হয় পাতিচেন। মেজুরিটির ওচিত মাইনুরিটির স্বাথথো দেখা। দুয়ে মিলি ঘরে ঘরে চলেন। আরো কই, আচাজ্জি মশায়ের সাথে নেন। তিনি তো গিরামের সবচেয়া মানী। আর তাঁর মতুন খাঁটি মোচলমান আমরাও যে না।

ঠিক ঠিক ঠিক, সকলের মাথা নড়ে। 

স্থির হলো আগামিকাল সকালেই সবাই মিলে আচার্যবাড়ি যাওয়া হবে।

জয়নাল তার পেয়ারের ভলান্টিয়ারদের নিয়ে হাটছিলেন। মাথায় একরাশ চপি। দুঃশ্চিন্তা। মাথার উপরে যেন জাতীয় পতাকায় আঁকা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলো ফুটছে দেরিতে। জয়নাল প্রবোধ পেলেন। নিকট দূরে খলিলের ইমারতের খিড়কির দিকটা দেখা যাচ্ছে। এই রাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে! হঠাৎ তার নজরে পড়ে নাছ দুয়ারের দিকে কয়েকটা আলোয়ান মোড়া ছায়া দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। ছ্যাঁত করে উঠলো বুক। জয়নাল হাঁকলেন,- কে! কিডা অখানে। – এই তোরা দেখতো!

কয়েকজন অনুচর সেদিকে দৌড়ায়। 

ছায়ামূর্তিগুলি বাঁশবনে মিলিয়ে গেছে।

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 

॥ কুরুকখেতরির বেষাদযোগ ॥

মিটিং বসতে চলেছে চিন্তেহরণ গুসঁইয়ের ঘরেও, অন্তত উপক্রমণিকা। 

উপস্থিত জনা সতেরোর। নকুল মন্ডল, সুদাম দাস, ঘনা ঘোষ, বনমালী ভূঁইমালী, পেল্লাদ ছুতুর-এই কয়জন দঙ্গলে ভারীগোছের, বাকিরা কায়াহীন, ওজনহারা, ছায়ামাত্র। মানুষের রাজত্বে এমনটাই বিধিব্যবস্থা। সকলের চোখেই একরাশ ভয়, উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা মাখামাখি।

চিন্তাহরণের চারমওলা বাড়ি, দোতলা দালান, উপরতলায় ঠাকুরঘর, সিংহাসনে কষ্ঠিপাথরের বাসুদেব। গোস্বামী ঠাকুর সেখানে আছেন। প্রভাত আহ্নিকের কাল। মুক্তোকান্দিতে তিনি সাধুজন, সজ্জন, তাঁর মহিমে আছে। 

প্রহলাদেরা কেউ বৈঠকখানার সামনে বারান্দায়, কেউ নিচে উঠোন— সেখানে রোদ্দুর। ওরা শুনতে পাচ্ছিলো ঠাকুরের সপ্তমে চড়নো মন্ত্রকণ্ঠ। তিনি শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা পাঠ করছেন। এরপর অষ্টোত্তর শতনাম পড়বেন, অখন্ত মন্ডলাকারং… শেষ হলে তিনি নিচে নেমে আসবেন। একতলায় সিঁড়িব শেষধাপের বাঁকে একখানি পিতলের রেকাবি, রাখা আছে পাঁচকণা আতপ চাল, পাশে একঘটি জল। পানশেষে উপবাস ভঙ্গ। অথশেষে বৈঠকখানায় সখড়ম তাঁর চরণধূলি পড়বে। 

এখন চিন্তাহরণের ঝাড়া হাত পা। এত বড়ো বাড়িতে তিনি, ব্রাহ্মনী, আর গোটাতিনেক দাসদাসী। জ্যেষ্ঠপুত্র পরেশকে হিন্দুস্তান পাকিস্তান হওয়ার অনেক আগেই কলকাতার পটলডাঙায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে তার পরিবার পরিজন নিয়ে গেছে। কিছুদিন পরে কনিষ্ঠ জীবেশকেও অগ্রজের আশ্রয়ে প্রেরণ করলেন। দাদার গারজেনিতে ভালো করে ব্যবসার দড়ির পাক, গিঁট, ফসফা ইত্যাদি শিখছে সে। পরেশ পটলডাঙায় খুলেছে বই বিক্রির পেল্লায় কারবার। ইচ্ছে আছে শিগগিরি বই ছাপিয়ে বিক্রির ব্যাবসাটাও খুলবে। ভাই যখন আছে, চিন্তা নেই। পরেশ অভিভাবকের কর্তব্য পালনে ভুল করেনি, কলকাতার কাছেই এক সচ্ছল ঘরের কন্যা এনে অনুজকে দান করেছে। যৌতুকের সামান্য অর্থটা নতুন উদ্যোগের মূলধন। গোস্বামী মহারাজের তিন কন্যা, সকলেই গোত্রান্তরিত, এবং প্রবাসী, তারা আছে রানাঘাটে, বারাসতে আর সি কে সেনের আগরপাড়ায়।

তবু ঠাকুর মশাই রাজ্যপাট ছেড়ে বেরোতে পারছেন না। অনেক গুহ্য কারণ আছে তার পিছনে। ঘরে বিগ্রহের নিত্য পুজো, তিনি না থাকলে ছত্তিশ জাতের ছোঁয়াছুঁয়িতে ধম্ম নষ্ট। একসময়ে জমিদার সিঙ্গিদের কাছারিতে গোমস্তাগিরির কল্যাণে – যে উপায় করেছেন তিনি, যার আশীর্বাদে ধনভান্ডার, এই ভদ্রাসন, তা বেচতে গেলে কিনবে কে? বেবাকে যে ওদাও হতি লাগিচে। অবশ্য এই হুটোপাল্লার বাজারে কিছু মুসলমানের কপাল ফুলে গেছে। তারা সে সংবাদ সবিস্তারে জানাতে দ্বিধা করছে না। খলিলুক রহমান পেরেস্তাব দিয়েই রেখেছে,– গুসাই ছাব! শোনতে পাতিচি চলি যাবার তাল কত্তিচেন! তা এই সাধের এমারতটারে কী করবেন? বেচতি চালি আমারে করেন, পাকিস্তানের রাজত্ব বলি হেন্দোর সাথে ঠকবাজি নাই, ভালো দর দেবানে। – চিন্তাহরণ মনে মনে পেন্নাম ঠুকলেন, শ্রীহরির শ্রীপাদপদ্মেরে বেধম্মীর হাতে! ছিঃ। আরো গুহ্য – তার বিপুলায়তন শিষ্যভান্ডার। বামুন কায়েত আর কয়জনা। ছুতের, চাষা, কামার, ফুমের সদগোপ, চাঁড়ালরাই উজের হয়ে আছে। এদের আতান্তরে ফেলে যাওয়া কী পাতককম্ম নয়? যোগেন মণ্ডল অবশ্য মাঝে কয়েকবার বরিশাল থেকে এসে নমশূদ্রদের কানে ফুসমন্তর ঢেলে গন্ডগোল করে দিয়ে গেছে। তবু শিষ্যদের ভবনা যে তাকেই… ।

উপরের ঘরে বেশে উঠলো, – তদ্বৎ শ্রীগুরুবে…। 

— গুরুদেব ! আমরায় কী করবো, কয়ে দেন। সবই যে আপনে জানেন। – সমস্বরে কথা ওঠে, প্রার্থণায়, আর্তিতে। 

চিন্তাহরণের চোখে জল এল হয়তো, কেননা এখন তিনি সাবধানে কোঁচার খুট তুলে চোখ মুছলেন। ভ্রুমধ্যস্থলে যত্নে আঁকা রসকলিটি অক্ষত রাখতে হয়। বললেন, – সবই তো জানি। কী কর! কথা তো কচ্ছে যুগনি মন্ডল। তরে পাবিই বা কনে? সে নচ্ছার করাচিতি গিয়ি ঠ্যাঙে ঠ্যাঙ তুলি পাকিস্থানের সেঙাত হইচে। যবনের অন্ন খতিচে মহাপাপী!

—তানের কথা ছাড়ান দেন। আপনে কন। আমাগেরে কেও নাই।

—ঘোর কলিকাল। কইলকে অবতার আবিরভূত হলি তবে কল্পান্ত। ততদিন একমনে তারে পাথথোনা কর। তিনি কয়েচেন, মামেকং শরণং ব্রজ। পাপ শেষ হলি আলো ফোটবে। নেষ্কাম কম্ম করি যা, মা ফলেষু কদাচন।

—জপ তো সব্বখনই কত্তিচি, কিন্তুক…।

—আবারও কচ্ছি, থাকতে পারবি নে। এচলামিয়া বেবাক ক্যাড়েকুড়ে ভাগায়ে দেবে। কচ্ছি, তোরা আগেই চলি যা। তুয়েগের নেবাপদে পাঠায়ে তবে আমার নিস্তার। আমার এজন সন্তানেরেও বাঘির মুখি ফেলায়ে আমি তুয়েগের বাপ, তুয়েগের গুরু বাচপার পারি? মহাপাতক! মহানরক! 

একটু আশ্বাস জোটে ক্ষণিক আশ্রয়, তবু ভয়ের বাসা যে হাড়ে। নকুল, সুদামরা অকিঞ্চন নয়, আঠেরো বিঘে কুড়ি বিঘের জোত, মাটি টিনের কোটাবাড়ি, উঠোন মরাই, তাদের পিছুটান খোঁচা মারতে থাকে অনর্গল। 

—জমি বেচার মতলব ভাজিস নে। জয়নালির চামুল্ডেগুলানের বেত্তান্ত বেস্মরণ হইচিস? হেন্দো জমি বেচতেচে, ফিসফিসি হলিই উয়েরা আসি তেনারে পিটোয়ে মারি ফেলাছে। 

শুনে আঁতকে উঠতে হয়। ভলান্টিয়ারদের কথা জানাজানি ছিলো, কিছু খুন করার খবর অজানাই। তবু গুরটাকুর কি মিথ্যা বলবেন, জ্ঞানী মানুষ! 

গোসাঁই তখন পোদ্দার বাড়ির আখ্যিনটা ফাঁদলেন। পোদ্দারেরা বড়ো ঘর, সাতমহলা প্রাসাদ। সংকটকালে বেচেবুচে চলে যাবেন এই ইচ্ছা। বাদ সাধছে অনেককিছু। খদ্দের মিলছে না। তখন উদ্ধার করলেন স্বয়ং গোসাঁইজি। বাড়ি জমি বেচাকেনা সইসাবুদ বিঘ্ন এড়িয়ে সারা হলো, সব কানুনমাফিক। এবার আবার বিপদ। অত নগদ টাকা হাতে নিয়ে পথে নামা ! লিগের গুন্ডারা ওত পেতে আছে। অতএব, আবারও গোসাঁই ঠাকুর। টাকাটা তাঁর কাছেই গচ্ছিত রাখলেন। পোদ্দারকে ধরিয়ে দিলেন পরেশকে লেখা লম্বা হাতচিঠি। পোদ্দার নির্ভয়ে চলে গেলেন, বিঘ্নহীন তার যাত্রাপথ। পটলডাঙায় গিয়ে টাকাটা তুলেও নিলেন।

—এসে কয় হোন্ডি। তোরা বুঝবি নে। 

নকুলেরা এখন হায় হায় করছে। কাঁদছে। রোল আফুট থেকে ভিজে হয়ে ফুটে উঠতে ব্যাকুল ওষ্ঠকম্পন সৃষ্টি করছে। ঠাকুর মশাইও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন, সামলে কোনোরকমে বললেন, – ভয় পাসনে। মাভৈঃ। তোরা গেলি আমারে পাওয়ারফ এটন্নি লিখি দে যাবি। দেখি, গোখেগোগুলানের কতখান দোঃসাহস যে হেন্দোর জমি খায়। তোরা ঘরে যা। ভাব। স্থির কত্তি পারলি আসিস। কাগজপত্তর লিখাপড়া করি দেবানে।- চিন্তাহরণ গাত্রোত্থান করলেন। উপরে ওঠার সিঁড়ির ধাপ থেকে গমগামিয় বাদলো,-তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি।

ক্রমশ…


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!