Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ২১, ২০২৪

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৭

ফাল্গুনী দে
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৭


ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ 

♦ পর্ব ৭ ♦

 

‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে।’ দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় উঠে এলো ভয়াবহ খবর। বৃষ্টি প্লাবন এবং ভূমিধ্বসে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ সহ হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিধ্বস্ত নৈনিতাল। বিচ্ছিন্ন আলমোরা, রানিখেত। কোশী নদী বইছে বিপদসীমার উপরে। খুলে দেওয়া হয়েছে বাঁধের গেট। জলের তোড়ে ভেসে গেছে হিমালয়ের কোলে ছোট বড়ো পাহাড়ি জনপদ। ২০২১ সাল, শেষ সপ্তাহের ভরা অক্টোবর মাস। বাতাসের উষ্ণতা নামতে নামতে শূন্যকে টপকে যাবার জন্য লাগিয়েছে পড়ি কি মরি দৌড়। কোভিডের আতঙ্ক মানুষের মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। অথচ পুজোর ছুটিতে মানুষের দল দিকে দিকে বেরিয়ে পড়েছে ভ্রমণের নেশায় পাহাড়ের টানে। এমন ঘোর অসময়ে রাতের অন্ধকারে আচমকা নেমে এলো ‘মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি’। দোকান বাজার, রাস্তাঘাট, হোটেল রেস্তোরা, যানবাহন তলিয়ে গেছে জলের নিচে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে হাজার হাজার পর্যটক আটকে পড়েছে বিদ্যুৎহীন আতঙ্কের শৈলশহরে। সমগ্র দেশ থেকে হিমালয় কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ভয়াবহ দুর্যোগে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় একশো জনের কাছাকাছি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর যারা হারিয়ে গেলো, ভেসে গেলো ঠিকানাহীন অকূলে? তাদের কী হলো? জীবিত নাকি মৃত এই সংশয়ে ঝুলে রইল আত্মীয় পরিজনের বিনিদ্র রাতগুলি? অকস্মাৎ শোকের আয়ুরেখা মুছে দিয়ে টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো সরকারি ঘোষণা —প্রতিটি মৃত্যু পিছু চার লক্ষ টাকা! বুঝলাম, আত্মার আত্মীয় হলে তবেই মৃত্যু একটি ‘শোক’ আর না হলে মৃত্যু নেহাৎ একটি ‘সংখ্যা’ মাত্র! হাহাকারের মধ্যে চারদিকে শুধু খোঁজ খোঁজ রব। কাদামাটির নদী থেকে নেড়ে ঘেঁটে লাশ বের করছে সেনাবাহিনীর জওয়ান। সরকার জেলায় জেলায় বিপর্যয় মোকাবিলার দপ্তর খুলেছে সঙ্গে হেল্পলাইন নম্বর। কিন্তু প্রতিটি উদ্বিগ্ন ফোনের জবাবে বারবার সেই একই উত্তর — “ইস রুট কে সভী নম্বর অভী ভ্যয়স্ত হে !”

কিন্তু প্রিয়জনের মন যে কিছুতেই মানতে চায় না! শখের পর্যটকদের গাড়ি চলার পথ যেখানে শেষ হয় সেখানেই তো শুরু হয় ট্রেকারদের পায়ে হাঁটা পথ। ওই উপরে আরও উপরে যেখানে মেঘের দেশ, ওরা গেছে সেখানে— প্রকৃতির নিবিড় আশ্চর্যে, ব্রহ্মাণ্ডের অলীক মায়া বাস্তবতায়। বেয়াড়া ছন্নছাড়া হিসাবহীন পাগল লোকগুলো নিষেধ মানতে চায় না। বারণ করলেই গীতার বাণীর মতো ম্যালরি সাহেবের “Because it is there” এর কেতাদস্তুর বুলি আউড়ে সহাস্যে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আবার পাল্টা যুক্তি দেয়, “মানুষের এতো বৈভব আর স্বাচ্ছন্দ্যের অভ্যাস কোথা থেকে আসে? পর্বতারোহীদের দেখো, মাত্র একটা রুকস্যাকের ভিতরে অন্তত এক মাসের প্রয়োজনীয় জীবন ভরে নিয়ে কেমন বিবাগী হেঁটে যায় ! এই পৃথিবীর মানুষ এমনটি করে যদি ভাবতে পারতো প্রাকৃতিক পরিবেশটা অন্তত বেঁচে যেত!” অন্তহীন এই তর্কের মধ্যেই হাওড়া অথবা শিয়ালদা স্টেশনে হাত নেড়ে সবুজ ইশারায় ওরা চলে গেলো পাহাড়ে। এইতো কাল রাতেই ডিনারে কী কী খাওয়া হলো তার বিবরণ শুনিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শেষবার কথা হলো। তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই! টেলিভিশন, খবরের কাগজ বলছে হিমালয়ের বিভিন্ন পথে অন্তত জনা পঞ্চাশেক বাঙালি ট্রেকার এবং পর্বতারোহী আটকে পড়েছে অথচ তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। নিচের পরিস্থিতি মাথায় রাখলে পাহাড়ের আরও উপরে কি হচ্ছে তার ভয়াবহতা আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়। তাহলে ? লোকগুলো আদৌ প্রাণে বেঁচে আছে তো ?

এই ঘটনার মাসখানেক আগে, একদিন কলকাতায় যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে সিগারেটের শেষ টান ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিয়ে আমি, ব্রতীন সরকার এবং অঙ্কুর পোরালি ব্যস্ত পায়ে হাঁটা দিলাম। কাছেই একটি বাজারের ভিতর দোতলায় ছোট্ট এক কামরা ঘরের ভিতর এজেন্সির অফিস। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। মচমচে সরু অন্ধকার সিঁড়ি পথে অপরিচিত পায়ে উপরে উঠে দেখি একটি প্রশস্ত শোরুম। নানান পাহাড়ি সরঞ্জাম, যার কিছু শোকেসে সাজানো, কিছু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক। আমাদের বসতে বলে লোকটি ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নেপালি হিন্দি বাংলা মিশিয়ে একটি খিঁচুড়ি কথোপকথন চলছে ফোনে। পোর্টার, গাইড, মিউল, খাবারদাবার, পারমিশন সবকিছু নিয়ে একটা দর কষাকষি চলছে। আমরা ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্রের মাপ এবং দাম সম্পর্কে একটু পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছি। লোকটি মাথা নেড়ে একনাগাড়ে চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অক্লান্ত ফোন। মোটামুটি একটা আলোচনা শেষে প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে আড্ডা মেরে আমরা নিচে নেমে এলাম। তারপর, “আচ্ছা সেই কথাই রইলো” বলে হারিয়ে গেলাম যে যার ব্যক্তিগত ভিড়ে। আমাদের যাওয়া প্রায় ঠিক ছিল কালিন্দী পাস, বালি পাস, কুঁয়ারি পাস অথবা এমনই কোন এক উত্তরাখণ্ড বা হিমাচলের পাহাড়ি পথে। এমনই অতর্কিত বৃষ্টির হিংস্র ডেরায়, এমনই সর্বগ্রাসী প্লাবনের দেশে, এমনই ভয়াবহ পাহাড়ি ধ্বসের উচ্ছন্নে। কিন্তু সব পথেই ট্রেনের টিকিট অপ্রতুল। এখন কী উপায় ? তিনমাস আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের মতো ছাপোষা কর্মব্যস্ত শখের ট্রেকারদের পক্ষে সহজ ছিল না। যেখানে কিনা, বিভিন্ন পেশার বন্ধুদের একপ্রকার বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে এনে পুজোর ছুটিতে একমত হয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের দল।

এ বছর আমাদের গন্তব্য পূর্ব হিমালয়ের সিকিম রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেক রুট জংরী-গোচেলার পথে। জাহান্নাম ছাড়া অন্য যে পথেই যাই না কেন একটু আগাম পড়াশুনা করে না গেলে বিপদের ঝুঁকি বাড়ে বৈ কমে না। উপরন্তু আহাম্মকের মতো আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে নিজেকে একটু ছন্নছাড়া বলেই মনে হয়। পাহাড়ে শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক দৃঢ়তার প্রশ্নে যেটি একটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়। এই পথকে ভালোবেসে স্থানীয়রা নানান নামে ডাকে যেমন ‘গোচে লা’, ‘গোয়েচা লা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। পশ্চিম হিমালয়ের জনপ্রিয়তা, পথে উৎশৃঙ্খল যাত্রীদের ভিড়, অহেতুক ব্যস্ততা, খরচের বাহুল্য ইত্যাদি থেকে যারা একটু মুখ তুলে অন্য পথে হাঁটতে চায় তাদের জন্য এই পথ চিরকালই আকর্ষণীয়। পথের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং কাঠিন্যের নিরিখে গোচেলা ভারতবর্ষের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্রেক রুট। যথেষ্ট দূরূহ এই পথ নেহাৎ নবিশদের জন্য মোটেই নয়। মোট ১০ দিনের এই পথে চড়াই-উতরাই মিলিয়ে প্রায় ৯০ কিলোমিটার রাস্তা হাঁটতে হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১০ কিলোমিটার হাঁটবার বিশেষ শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা প্রয়োজন। অনুমতি সাপেক্ষ এই পথে সুস্থ থাকলে পাসের সর্বোচ্চ প্রায় ৪৯৪০মিটার বা ১৬২০৭ ফুট পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। বিপদসংকুল এই পথে বন্য জন্তু জানোয়ার, খামখেয়ালী আবহাওয়া এবং উচ্চতাজনিত শারীরিক অসুবিধাই সাফল্যের মূল অন্তরায়। অথচ এই পথের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হোল কাঞ্চনজঙ্ঘার এক্কেবারে পায়ের নিচে পৌঁছানোর বিরল কৃতিত্ব যা কিনা ভারতবর্ষের অন্য কোন ট্রেক রুটে পাওয়া অসম্ভব। সারা বছরের মধ্যে একমাত্র মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পথে হাঁটা সব থেকে সুবিধাজনক। শিলিগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত জনপ্রতি খরচ প্রায় কুড়ি হাজার টাকা। শীতের নরম দুধসাদা বরফ অথবা বসন্তের রোডোডেনড্রনকে সাক্ষী রেখে এই পথের প্রতিটি রহস্য বাঁকে উষ্ণ চায়ের কাপ হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে এমন নৈসর্গিক প্রেম একমাত্র সাহসীদের ভাগ্যেই জোটে। সান্দাকফু ফালুট শীর্ষ থেকে দেখা নিরেট সমান্তরাল ঘুমন্ত বুদ্ধের যে শান্ত অবয়ব, বুদ্ধের শ্রীচরণরূপী যে পান্ডিম পর্বত তারই পাদদেশে হিমবাহের উষ্ণতা ছড়িয়ে জেগে আছে গোচেলা পাস। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাহাড়ি ঘর সংসার, গিরিশিরার প্রতিটি উত্তল অবতল, হিমবাহের গায়ে ফাটল, শিখরের গায়ে ভোরের নরম সোনালী রোদ দেখতে দেখতে মনে হয় আরও প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এই বুঝি হাত বুলিয়ে স্পর্শ করা সম্ভব। পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ এবং পর্বতারোহণের জন্য অন্যতম কঠিন এই পাহাড়কে আমরা দূর থেকে তাকিয়ে অনুভব করেছি কী ভীষণ অবলীলায়!

অবশেষে পশ্চিমের নিবিড় মায়া কাটিয়ে শিয়ালদা থেকে এবার উত্তর অভিমুখে দার্জিলিং মেল ধরে ১৭ই অক্টোবর রাত দশটায় আমাদের দল রওনা দিল। দলের অন্যতম সদস্য ব্রতীন সরকার থাকেন কলকাতায়, পেশায় স্কুল শিক্ষক। রথীন্দ্রনাথ মিত্র থাকেন পুরুলিয়ায়, পেশায় স্কুল শিক্ষক। অতীন পান্ডা থাকেন কাকদ্বীপে, পেশায় ব্যবসায়ী। সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় থাকেন বোলপুরে, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অর্পণ সেন থাকেন জয়নগরে, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। এবং বর্তমান কাহিনীকার আমি ফাল্গুনী দে, থাকি কলকাতায়, পেশায় কলেজ শিক্ষক। শেষ মুহূর্তে দলে যোগদান করতে না পারলেও মানসিকভাবে প্রতি মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে ছায়ার মতো হেঁটেছেন অঙ্কুর উত্তম পোরালি, আশুতোষ সোরেন এবং রোহিত ঘরামী।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ঠিকঠাকই চলছিল। দলের সঙ্গে রাত ন’টায় শিয়ালদায় সাক্ষাৎ সময় প্রায় নিশ্চিত। ওরা সবাই জাতীয় পতাকা এবং অভিযানের ব্যানার নিয়ে স্টেশনে উপস্থিত। সঙ্গে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী স্বজন আত্মীয় এসেছেন বিদায় জানাতে। ট্রেন ছাড়লেই রাতের খাবার নিয়ে ওরা বসে পড়বে জমজমাট আড্ডায়। একে একে প্রয়োজনীয় সব মালপত্র তোলা হচ্ছে সাবধানে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সেদিন রাতে দলের সঙ্গে ঠিক সময়ে যোগদান করতে আমি একপ্রকার ব্যর্থই হলাম। ট্রেন রওনা দিল আবহমানের উদ্দেশ্যে।

 

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ৬


  • Tags:
❤ Support Us
আশ্রয় গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি। পর্ব ১২ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
হিরণবালা । পর্ব ১২ ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!