- গল্প
- মে ৩, ২০২২
আমরা চার বন্ধু, আমরা আমাদের শরীরটাকে হারিয়ে ফেলেছি
চিৎকার করেছিলাম শরীরগুলো ফিরিয়ে দেবার জন্য। কেউ কথা শোনেনি। গাড়ি এক ধাক্কায় একশ গতি তুলে মিলিয়ে গিয়েছে

চিত্র: দেব সরকার
আমরা চার বন্ধু, আমাদের চারটে শরীরটাকে হারিয়ে ফেলেছি। পুলিশ ওগুলোকে তুলে থানায় নিয়ে গেছে। আমাদের কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। আমরাও কাউকে আমদের কথা শোনাতে পারছি না। এখন রাস্তার ধারে গাছের তলায় হত্যে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, পরের বাসের অপেক্ষায়। বাস না-পেলে হাঁটা লাগাব। কলকাতা এখান থেকে অনেক দূরে। আরো অনেক দূর হাইকোর্ট। ওখানে বিচার দেব, কেন আমরা আমাদের শরীর আমাদের ঢুকতে দেবে না?
শহর থেকে যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে চলে এসেছে, তার মাঝামাঝি, না মাঝামাঝি বললে একটু ভুল হবে, ঠিক কিছুটা পরেই ডান দিকে বাঁক নিলেই পড়বে পুকুরটা, যে পুকুরপাড়ে আমরা চার বন্ধু বসতাম। ঠিক এমন ভাবে বসতাম, যেমন ভাবে পুকুরে জলের উপরে অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঞ্চির পালার ঢগার উপর হেলেসাপ চাঁদের দিকে ছুঁচালো লেজ তাক করে মুখটা জলের দিকে ওত পেতে বসে থাকে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, আমাদের বসার পালাবাদ যেত না। কিন্তু মাঝে মধ্যে কঞ্চির পালার উপর হেলেসাপের বদলে সাপব্যাঙ চাঁদকে ল্যাং মেরে মুখটা জলের উপরে জলফড়িং ধরার জন্য ওত পেতে থাকত।
শহরের দিক থেকে রাতের শেষ বাসটা যখনই এসে থামুক না কেন, আমি, মানে ভোলা, রংমিস্ত্রি রাধুদা, কাঠ-মিস্ত্রি গিয়াসদা আর মদের দোকানের চিল্লু, সবাই পুকুর পাড়ে বসে, দুএকটা বিড়ি খেয়ে, দু-চারটে গল্প-টল্প করে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। পুকুরের পাড় বরাবর এগোলে একফালি খেলার মাঠ, তারপরেই আমাদের কলোনি। যেভাবে পায়রার খোপে আদার দিয়ে খোপের ঢালা বন্ধ করে দেওয়া হয়, আমরা বাড়ি ঢুকলে, বাড়ির লোকজন সেই ভাবে দরজা বন্ধ করে দিত।
এদের মধ্যে কেবলমাত্র আমি চাকরি করি, বাকি তিন জন বন্ধু দিনমজুর। আমার চাকরিটাও অদ্ভুত, কাস্টমার কেয়ারের চাকরি। ফোন ধরা কাজ। সবার কথা শোনা আমার কাজ। আমাকে কথা বলতে হয় কম, শুনতে বেশি হয়। বস প্রথম দিন বলেছিল, ‘এ জবে বেশি দিন টিকতে হলে খারাপ কথা শুনেও হাসতে হবে, ভালো কথা শুনেও হাসতে হবে’। প্রথম প্রথম অসুবিধে হতো। এখন বেশ রপ্ত হয়ে গেছে।
প্রথম থেকেই যে সবাইকে চিনতুম, এমনটা নয়। আমাদের মফস্সলের একটা খাস বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এখানে সবাই সবাইকে চেনে, কিন্তু আসলি শহুরে হবার জন্য সবাই সবাইকে না-চেনার ভান করে। আমি ব্যাপারটার মধ্যে এক ধরনের মজা খুঁজে পাই। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত মনোহর কাকা। আমরা চিনতাম, কথা-টতা বলতাম, কিন্তু মনোহরকাকার মেয়ে সেই যে কলেজে পড়তে গেল শহরে, তখন থেকে রাস্তাঘাটে দেখলে এমন ভাবে তাকিয়ে কথার উত্তর দিত যেন, সাত জন্মে আমাকে দেখেনি। অথচ ওকে আমি ল্যাংটা-গা থেকে দেখে আসছি। ওই তো সেবার সকালবেলা বাসে করে অফিসে যাচ্ছিলাম। সেদিন আমার অফিসটাইমের বাসটা মিস হয়ে গেছিল। দেখি মনোহর কাকার মেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমি বলেছিলাম, কীরে বুলটি কোথায় যাচ্ছিস! ও আমার কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করেনি। এমন ভাবে তাকালে যেন আমাকে সাত জন্মেও দেখেনি, চেনেও না। আসল কথাটা অন্য জায়গাতে। বুলটির ইগো হার্ট হচ্ছে, আমার মতো এরকম একটা মিশকালো ছেলের সঙ্গে ওর কথা বলতে প্রেসটিজে বাধছে। আমি খুব একটা বুঝি না, কিন্তু এটা বুঝি যে, আমাদের মতো কালোছেলেদের কপালে এই অপমান লেগেই আছে। এটাকে অপমান ভাবলে অপমান, না ভাবলে আপমান নয়। আমি দ্বিতীয়টির পক্ষে সব সময়। কারণ এখানে আর যা হোক নিজের একটা ইজ্জত থাকে।
আমাদের মধ্যে সব থাকে বেশি ইজ্জত চিল্লুর। প্রথম কারণটা আর কিছু নয়, ওর মদের দোকানে কাজ করা। চিল্লুর ভাষায়, এখানে আর যা হোক লোকের দোরে দোরে হত্যে দিতে হয় না।
চিল্লুর কথা ঠিক। আমাকে হত্যে দিতে হয়, তবে দোরে দোরে নয়, ফোনে ফোনে। মজার বিষয় হলো আমাদের কোনো ঘ্যাম থাকতে নেই। কিন্তু চিল্লুর বিশাল ঘ্যাম আছে। তবে চিল্লু সৎ। এমন নয় যে দোকান থেকে রোজ রোজ মাল চুরি করে আমাদের খাওয়ায়। একদিন বাংলা খাইয়েছিল, তাও নিজের টাকায়। গিয়াস বলেছিল, করিস কাজ বিলাইতি মদের দোকানে, আর খাওয়াস বাংলা! চিল্লুর সাদা মনে কোনো কাদা নেই। বরং রাধুদাই ওকে খুব চড়াতো। চিল্লু এই, চিল্লু সেই। আসলে আমাদের ধারণা মদের দোকানে কাজ করা মানেই মাল-টাল খেয়ে টাল হতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত আমরা আকছার কারো-না-কারো সম্পর্কে করে থাকি। বছরে আমাদের একদিনই পিকনিক হয়, রান্নাপুজোর খাওয়া খেয়ে, বিশ্বকর্মা পুজোর ভাসানের রাত্রে। আমাদের অপিস ছুটি থাকে, গিয়াসদার কাঠের দোকান বন্ধ থাকে, রাধু সেদিন রঙের কাজে যায় না। চিল্লুর সেদিন ড্রাইডে আরকি।
আমরা সবাই চাঁদা তুলে গতকাল রাতের বেলা বোতল খুলে বসেছিলাম ফি-বছরের মতো। খুব হাল্কা করে নয়, ভারিই হয়ে গেছিল সেদিন আমাদের পেট থেকে মাথা। মাথা আর পেট ভারি হলে কী হবে, শরীর হাল্কা হয়ে হাওয়ার সাথে উড়ে যেতে চায়। পুকুর উপর দিয়ে হাঁস পোকার মতো করে আমরা চড়ে বেড়াই। গতকালও তাই করেছিলাম।
আমরা বেশি কিছু করিনি। পিকনিক-টিকনিক করে, গলা পর্যন্ত মাল ঢেলে আকাশে উড়ছিলাম শুধুমাত্র। যদিও আমাদের ওড়ার কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু চিল্লুর দেওয়া মদ খেয়ে আমাদের জান খুব হাল্কা হয়ে গেছিল। এত পল্কা হয়েছিল যে, আমরা সেদিন মৃদু-মন্দ বাতাসেও বসে থাকতে পরছিলাম না। ল্যাজকাটা চিলঘুড়ি যেমন একটু হাওয়ার ছোঁয়া পেলেই শোলমাছের মতো তড়পায়, আমাদের অবস্থাও তেমন হয়েছিল। পেটে তো পড়েই ছিল, সেই সঙ্গে ছিল মৃদু-মন্দ বাতাস, তাও আমাদের পক্ষে। ফলত আমরা আর বসে থাকতে পারেনি। ভারটানায় ভর দিয়ে, লাটাইয়ের সুতোয় জড়িয়ে আমরা উড়ছিলাম। আমাদের মধ্যে চিল্লুই প্রথম বলেছিল, কী লাভ এভাবে জোর করে বসে থেকে। তার থেকে বরং খুঁটি থেকে নোঙর তুলে চল আকাশে উড়ি। একটু বেড়িয়ে আসি। যেভাবে চলুন বেড়িয়ে আসি বলে পাড়ার মোড়ে মোড়ে পোস্টার দেখে সবাই বেড়িয়ে আসে উৎসাহ নিয়ে, আমরাও তাই করেছিলাম।
শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই দেখি আমরা আমাদের শরীরে খাপ খাচ্ছি না। সেই আগেকার মতো গলে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি না। অনেক বার চেষ্টা করেছিলাম, যতক্ষণ না পর্যন্ত পুলিশ আমাদের শরীরটাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। আমরা কষ্টে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে যাচ্ছিলাম
কিন্তু উড়লে কী হবে! আমরা দলে ছিলাম চারজন। চিল্লু বাদে বাকি সবাই মাল খেয়ে গুম হয়ে বসেছিল। একপ্রকার জোর করে রাধুদা আর গিয়াসদাকে নিয়ে উড়ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের গণতন্ত্রে, না চলতে চাইলে, বাধ্য করবে চলতে। রাধুদা আর গিয়াসদা এ ব্যাপারে অভ্যস্ত। সুতারং কোনো প্রতিবাদ করেনি, যেমন কেউ প্রতিবাদ করে না।
আমি উড়তে উড়তে চিল্লুকে বলেছিলাম, দ্যাখ, সব কিছুই বেঠিক চলছে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না।
চিল্লু বলেছিল, রাজনীতি আমি বুঝি না ভোলা। মদের দাম বুঝি। কে কতটা কিনতে পারবে, আর কে কতটা খেতে পারে, সে আমি কাউন্টারে মুখ দেখেই বলে দিতে পারি।
আমি বলেছিলাম, তাই যদি পার, তাহলে এটাও পারবে না কেন! বলে, রাধুদা আর গিয়াসদার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম সম্মতি আদায়ের অছিলায়। দুজনেই অদ্ভুত, বাটাং পাখির চোখ নিয়ে প্লাসটিকের গ্লাসের তলানিতে যে কয়েক ফোঁটা মদ অবশিষ্ট পড়েছিল, সেটাকে শায়েস্তা করতে চাইছিল উড়তে উড়তে। কিন্তু মদের ফোঁটাও খুব চালাক। কিশোরী নারীর অবুঝ ছলানার মতো, বুঝবে কিন্তু ধরা দেবে না। তার উপর দুজনেই কম কথার মানুষ। সুতারং আমার কথার উত্তর দেবার বাধ্যবাধকতা ওদের নেই।
পরিবর্তে গিয়াসদা বলেছিল, রাতের দিকে বিলের ধারে আতসবাজি পোড়ানো হবে। যাবে?
আমরা কেউ না করিনি। লাটাই থেকে ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার পর যেভাবে খুব সহজ গতিতে, আবার কখনো এলোমেলো ভাবে দোলে, আমরা তেমন ভাবেই এগোচ্ছিলাম। রাতের আঁধার হলে কী হবে, আকাশটা বেশ উজ্জ্বল। আমরা উপরের দিকে তাকালে মিটিমিটি নক্ষত্রের আবছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম।
গিয়াসদা অনেকক্ষণ বাদেই মুখ খুলেছিল। বলেছিল, এই বাজি পোড়ানো দেখলে আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে রোজার সময়ের কথা। তখন এত বেশি মাইক ছিল না। এত বেশি মসজিদও ছিল না। বাড়ি বাড়ি ঘড়ি ছিল না। মসজিদ বলতে তখন ওপাড়ার জামেমসজিদ। আর মসজিদের হেতনেতে ঝোলানো থাকত বড়ো কাঠের পাদানি-সহ ঘড়ি। প্রত্যেক ওয়াক্তে ঢং ঢং বাজ। আম্মাকে দেখতুম চিনির পানিতে চাল আর ছোলা ভিজিয়ে রাখতে। ও দিয়েই ইফতারি সারবে। কিন্তু কখন ইফতারির সময় হবে জানতুম না। ওপাড়ায় ঘড়িতে ঢং করলেই একটা বোমা ফাটত। আর আমরা সেই বোমার শব্দ শুনে পাড়ায় বুড়িমার চকলেট ফাটাতুম। সেই শব্দ শুনে মা রোজা ভাঙত।
আমি কিছু বলিনি। বলিনি, কারণ মুখের ভাষা খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। রাধুদা আর চিল্লু কেমন জানি সেণ্টি সেন্টি হয়ে গেছিল। আমি জানি আমাদের জেনারেশনের মধ্যে এইসব আবেগ-টাবেগ একটু কম। সে কারণে সেন্টিমেন্ট আমাদের কাছে সেন্টিতে পরিণত হয়েছে।
চিল্লু বলেছিল, আমাদের বকরি ইদে বাঁধা থাকত রাতের বেলার নেমতন্ন। এখন আর কেউ দেয় না। ছেলেবেলায়, রাধুদা তুই বল না, আমরা কতবার ইলিয়াসদের বাড়িতে গেছি মাংস খেতে। আমরা গোরুর মাংস খেতাম না বলে ওর মা কোথা থেকে ছাগলের মাংস জোগাড় করে রেঁধে খাওয়াতো। এখন আর কেউ ডাকে না।
কেন যে ডাকে না, সেটা আমি ওদের কী করে বোঝাই। ওরা নিশ্চয় বোঝে। আগে রাধুদা বুঝেছিল, এখন চিল্লু। গেলাসের তলানির শেষ ফোঁটা অব্দি যারা ছাড়ে না তারা বুঝবে না, এমনটা হয় না।
রাধুদা আমার মনের কথা বুঝে গেছিল কীভাবে আমি জানি না। তবে রাধুদা বেশ জোর দিয়েই বলেছিল, সবাই বোঝে না। রাধুদাকে এরকম জোর দিয়ে কথা এর আগে কখনো বলতে শুনিনি বোধহয়।
আমি বলেছিলাম, ঠিকই বলেছো রাধুদা, বোঝে না, সবাই বোঝে না। কিন্তু যারা বোঝে প্রয়োজনের সময় তারা এতদূরে সরে যায় যে, তখন আর বোঝা না-বোঝার অপশন থাকে না।
চিল্লু কীভাবছিল তা আমি আবছা আবছা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেমন জানি উদাস উদাস ভাবে, মুখটা আরো বেশি করে উপরের দিকে তুলে, যেমন করে মাছ শিকার করার পর বকের গলা সোজা করে উপরে ওঠে, ঠিক সেইভাবে বলেছিল, প্রয়োজন কিনা জানি না, তবে মানুষ খুব যে ভালো নেই তা বুঝি। আমার দোকানের কাউন্টারে যে লম্বা লাইন দেখি, তা যে এমনি এমনি বা শখের নয়। ভাবো, যে লোকটা সারা দিন হাড়ভাঙা খেটে যে দুশো ইনকাম করে, একশো সে বাংলাতেই উড়িয়ে দেয়। আমরা ভাবি বোকা, লোকটা বেহিসেবি। যদি তাইও হতো, তাহলে লোকটার পরিবার থাকত না, লোকটা খাটত না, লোকটা প্রত্যেকদিনের লড়াইয়ে নামত না।
আমি একটু অবাকই হয়ে যাচ্ছিলাম, চিল্লু কীভাবে এত সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলছে! পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, সাজিয়ে কথাগুলো কী আমরাই বলতে পারি! চিল্লু পারে না।
গিয়াসদা, রাধুদা একসাথেই বলেছিল, এটা তোমার ভুল ভাবনা ভোলা। কথাগুলো ছিল অস্পষ্ট, গোঙানোর মতো কিছুটা। আমার মনের কথা ওরা কীভাবে বুঝতে পাচ্ছিল, বা আমিও কীভাবে ওদের মনের কথা টেরপাচ্ছিলাম, সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনজনই হাসছিল। আর মনে মনে বলছিল, আমরাও বুঝি।
রাধুদা রাখঢাক না রেখেই বলেছিল, দ্যাখ এভাবে সবাই সবার মনের কথা পড়ে ফেললে, খুব বাজে একটা কিছু হয়ে যাবে। আমরা সবার সব কিছু জেনে যাব। তার থেকে বরং চল, আমরা বাজি পোড়ানো দেখার পর ঝিলপুকুরে ঢুব দিই। সবার সবটা জানা ঠিক না। ভগবানকে জেনে গেলে আর কী কিছু থাকে!
রং লাগানোর কাজ করে এ য়াধু এত কথা কীভাবে শিখল, আমি জানি না। আমার নিজেকে কেমন একটা অপরাধী অপরাধী লাগছিল। গত হপ্তাতে গিয়াসদার মেয়ের শরীর খারাপ ছিল। ফেরার পথে আমরা যখন বিড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের কথা বলছিলাম, তখন গিয়াসদা কিছু টাকা আমাদের কাছ থেকে ধার চেয়েছিল। চিল্লু একশ, রাধু ষাট টাকা ধার দিয়েছিল। আমার কাছে সেদিন মাইনের পুরো টাকাটাই তোলা ছিল, আমি কিন্তু কোনো টাকা দেয়নি।
গিয়াসদা সেদিন কিছু বলেনি। আমার দিকে চেয়ে বলেছিল, ও সব মনে করে মন ছোটো করিসনে ভোলা। বাচ্চা ছেলে তুই। তোর এখন টাকা পয়সার দরকার খুব।
আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম গিয়াসদার কথায়। কিন্তু মাসের পনেরো তারিখের পর আমার হাত টানাটানি যেত। আমি ধার চাইলে কেউ না-করত না। শখানেক জোগাড় হয়েই যেত।
গিয়াসদা আমার পাশেই উড়ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় এমন একটা হাসি হেসেছিল যে, আমার আর কোনো আপরাধবোধ ছিল না।
আমরা এরকম করে অনেকক্ষণ ধরে আকাশে উড়েছিলাম। একে অপরের মনের সমস্ত কথাগুলো পড়ে ফেলছিলাম। মনের কথাগুলো পড়তে পড়তে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসি ছাড়া আর কোনো কথা বলছিলাম না। এই খেলার মধ্যে আমরা একটা অদ্ভুত তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। একবার মনে হচ্ছিল আমরা সবাই আলাদা। পরক্ষণেই ভাবছিলাম, আমরা সবাই একাত্মা।
কতক্ষণ আমরা উড়েছিলাম, জানি না। কিন্তু এটা বুঝছিলাম, অন্ধকার ক্রমশ কমে আসছে। উড়তে উড়তে আমাদের আবার তেষ্টা পাচ্ছিল আরো কয়েক পেগের। শেষের দিকে আমরা আর কোনো কথা বলছিলাম না। আমরা সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিয়েছিলাম যে, সবারই তেষ্টা পেয়েছে।
এবার আমাদের ফিরতে হবে সেখানে, যেখানে লাটাই থেকে ঘুড়ি ছিঁড়ে উড়েছিল, সেই পুকুর ধারে। আমরা যখন উড়তে বের হয়েছিলাম, তখন হাওয়া আমাদের পক্ষে ছিল। সে কারণে আমরা তরতর করে উড়ে অনেক দূর চলে গেছিলাম। কিন্তু ফেরার সময় আমাদের গতি একেবারে কম, পাঁচের বেশি হবে না। একে বাতাস আমাদের বিপক্ষে, তার উপর সারা রাতের পিকনিকের ধকল।
আমারা যখন ফিরি, তখন ঝুক্কো ভোরের আলোতে সব কিছু শলক হয়ে গেছে। আমরা দূর থেকেই দেখছিলাম পুকুর পাড়ে হাজার খানেক মানুষের ভিড়। আমাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন ভিড় করেছিল। আমাদের মনের কথা রাধুদাই বলেছিল, হ্যাঁরে গিয়াস কী হলো রে?
গিয়াসদা বলেছিল, আমি কী জানি! তুমি আর আমি এক জায়গাতেই ছিলাম তো।
চিল্লু বলেছিল, কী আর হবে, দ্যাখো পুকুরে মাছ ভাসছে বোধ হয়। বিনি পয়সাতে মাছ পাওয়ার লোভে সবাই ভিড় করছে।
কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছিল অন্য কিছু নিয়ে। আমদের পিকনিকের মাল-সামান সব ওখানে পড়ে। সেগুলো কী আর আস্ত থাকবে।
আমরা খুব দ্রুত নেমে ছিলাম। পিছন থেকে সবাইকে সর সর বলে ভিড়ের ভেতরে ঢুকতে চাইছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছিল না। কেউ আমাদের যাওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছিল না। অথচ অদ্ভুত ভাবে আমরা কোনো বাধা পাচ্ছিলাম না। মানুষের শরীরের ব্যারিকেড ভেদ করে আমরা ভিড়ের ভেতরে প্রবেশ করছিলাম। আমরা সবাই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম শুধু। অবাক হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। খুব সহজেই সেখানে প্রবেশ করা যায়, যেখানে কোনো বাধা থাকে না, তার দিকে আমাদের যে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক থাকবে, সে আর এমন কী।
আমাদের মধ্যে চিল্লুই সব থেকে আগে, সব বাধা কাটিয়ে ভিড়ের ভেতরে প্রবেশ করেছিল, আমরা তার পেছনে পেছনে। আমি প্রথমে চিল্লুর অতোবড়ো হা করা দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপর হা থেকে মুখ সরিয়ে যখন নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের মতো দেখতে চারটে বডি শুয়ে আছে। শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ভোরের সকালের রোদের মতো শান্তিতে। মুখে মায়ের কোলে বসে থাকা নিরাপদ শিশুর মুখের শান্তি। কোনো অভাব অভিযোগ নেই।
রাধুদা বলেছিল, এরা আবার কে?
আমি রাধুদার কথার উত্তর দেবার আগে চারিদিকে আরো একবার ভালো দেখে নিয়েছিলাম। দেখি আমার মতো দেখতে যে দেহটা শুয়ে আছে, তার মাথাটা আমার মায়ের কোলে। মা কোনো কথা বলছে না, মুখ শুকনো। একটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে শরীরটার দিকে। গিয়াসদার মেয়ে ওর মতো দেখতে শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে কী সব যেন বলছে। চিল্লুর বৌ চিল্লুর মতো দেখতে শরীরটার পা জড়িয়ে বসে আছে। রাধুদার মতো দেখতে শরীরটার আশেপাশে কেউ নেই। যেন বেওয়ারিশ একখানা লাশ। রাধুদা ভাবছিল, যার তিন কুলে কেউ নেই, তার কে আসবে?

চিত্র: দেব সরকার
চিল্লু এখন ফুল ফর্মে। আরে এরা কারা রে? বলে, বউকে তুলতে যায়। বলে, এই দ্যাখ আমি, আমি এখানে। কিন্তু বউকে ধরতে পারে না। হাতে হাত রাখলে চিল্লুর হাতটা অর বউয়ের হাতের মধ্যে গলে যায়। গিয়াসদার কথাও গিয়াসদার মেয়ে শুনতে পায় না। আমি আমার মায়ের কানের কাছে চিৎকার করি গলা ফাটিয়ে। মা আমি এখানে, তোমার সামনে। মা আমার মুখ গুম করে আমার মতো দেখতে শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা তিন জন অনেকভাবে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু না-কেউ আমাদের কথা শুনছিল বা আমরা কারো কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের কষ্ট কাউকে বোঝাতে পাচ্ছিলাম না। নিজেরা থেকেও না থাকার অবহেলা যে কত কষ্টের, তা আমরা ছাড়া বাকিরা বুঝছিলাম না। আমরা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, রোদ ফুটে ওঠা অব্দি, পুলিশ না আসা অব্দি।
আমাদের মধ্যে রাধুদাই প্রথমে বলেছিল, এভাবে হবে না। এগুলো মনে হয় আমাদেরই শরীর। চল একবার যে যার মতো দেখতে শরীরটাতে ঢুকে পড়ি। দেখবি ঠিক জেগে উঠবে। অনেক সময় হয় না এমন!
আমারা আর দেরি করিনি। কিন্তু যেযার শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই দেখি আমরা আমাদের শরীরে খাপ খাচ্ছি না। সেই আগেকার মতো গলে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি না। অনেক বার চেষ্টা করেছিলাম, যতক্ষণ না পর্যন্ত পুলিশ আমাদের শরীরটাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। আমরা কষ্টে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে যাচ্ছিলাম। আমরা পুকুরের আল থেকে বড়ো রাস্তা অব্দি গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটেছিলাম। চিৎকার করেছিলাম, আমাদের শরীরগুলো ফিরিয়ে দেবার জন্য। আমাদের কথা কেউ শোনেনি। বড়ো রাস্তায় উঠে দেখি গাড়ি এক ধাক্কায় একশ গতি তুলে মিলিয়ে গিয়েছে। পুকুর ধারের ভিড় ক্রমশ খালি হচ্ছিল। আমার মাকে, গিয়াসদার মেয়েকে, চিল্লুর বউকে সবাই হাত ধরাধরি করে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বিকল্প একটা রাস্তা খুঁজছিলাম। সে কারণে এখনো রাস্তায় হত্যে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
♦–♦♦–♦♦–♦
গল্পকারের পরিচিতি: জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে নওয়াপাড়া গ্রামে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গবেষণায় রত। পেশা শিক্ষকতা। বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। মানবজীবনের বিবিধ রূপ, মাত্রা, কৃৎ ও কৌশল নিয়ে ভাবেন। পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক আবহ বিপন্ন করে। প্রকাশিত বই : কাল ছিল ডাল খালি (নভেলা), রামচন্দ্র এবার পুজোয় বাজার করতে যাচ্ছে (গল্পগ্রন্থ), আমাকে খুন করলে কেন? (উপন্যাস)।
চিত্রি পরিচিতি: আলোকচিত্রি, কলমবাজ চিত্রকর দেব সরকার আরম্ভ প্রকাশনার একনিষ্ঠ সহযোগী। বারুইপুরের বাসিন্দা।
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us