Advertisement
  • স | ফ | র | না | মা
  • জুলাই ৬, ২০১৯

টোয়েডো কভি, ধন্যবাদ তোমাকে

জ্যোতির্ময় বিশ্বাস
টোয়েডো কভি, ধন্যবাদ তোমাকে

ইন্টারন্যাশনাল ইউভিআইটিসের স্টাডি গ্রুপের অমত্রণ, ইজরায়েলের তেল আভিভে। কিন্তু কী করে যাব ইজরাইলে? তেল হাভিভ? ট্রাভেল এজেন্ট জানাল, অসুবিধা নেই। চেন্নাই থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে ইজরায়েল এয়ারলাইনসে সোজা তেল আভিভের বেনগুয়ান এয়ারপোর্টে। তবে উড়ান যদি কমাতে চাও, দিল্লি হয়ে যাও। এয়ার ইন্ডিয়ার ডিরেক্ট ফ্লাইট তেল আভিভে যায়। সাতঘণ্টার মতো লাগে। দিল্লি থেকেই যাব ঠিক করলাম।
দুমাস আগে ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ইজরায়েলি ভিসা পাওয়া মুশকিল! বলল ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে, গেলামও। এই প্রথম ভিসার জন্য চেন্নাই থেকে অন্য শহরে যেতে হˆল।
পঁচিশে নভেম্বরে সকাল দশটায় ফ্লাইট। রাত সাড়ে আটটায় পৌঁছেগেলাম বেনগুয়ান এযারপোর্টে। সুন্দর,আধুনিক বিমাদবন্দর । ইমিগ্রেশনে লোকেদের মুখে কোনো ইমোশন নেই। যন্ত্রের মতো সবাই কাজ করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, পাসপোর্টে কোনো স্ট্যাম্প লাগালো না, বদলে একটা কার্ড দিল। লাগেজ কালেক্ট করে ফরেন একচেঞ্জ নিলাম। একশো ডলার ভাঙালে ৩৩২ সেকেল পাওয়া যায়। এখানকার ট্যাক্সিতে মিটার নেই, বাধা রেট। হোটেলে পৌঁছে দেবে ২০০ সেকেলের বিনিময়ে।

হোটেলে পৌঁছে নতুন এক বিপত্তি, রিশেপশন ফাঁকা। কি মুশকিল।বাধ্য হয়েই রিশেপশেনের পাশে একটা রুমে নক করলাম। সে ম্যানেজার নয়।তবে ম্যানেজারের নম্বর দিল। হোয়াটস্ অ্যাপে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ হল। শেষˆমেষˆ একটা ঘরে ঢুকে জিনিসˆপত্র রাখলাম। আমার সঙ্গে ছিল ভুনেশ্বরের এক চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তার সৌমোভ্য। ঘর তো পাওয়া গেল। কিন্তু খাই কোথায়? রাত্তির দশটা বাজে। শেষˆমেষˆ সামনে একটা ছোটোখাটো বেকারি শপে পিৎজা খেয়ে এসে ঘুমোলাম। তেল আভিভ শহরের ড্যানি হোটেলে মিটিংটা হবে। ফাইভস্টার হোটেল। বেশ সুন্দর। ওখানেই আমাদের কনফারেন্স। প্রথম দিন চোখের টিউমারের ওপর আলোচনা। রাতে হোটেলে ফিরে দেখা হল কেয়ারটেকারের সঙ্গে। জানা গেল রাত্তিরে কোনো হোটেল স্টাফ থাকে না। কী বিদঘুটে ব্যাপার । সন্ধেবেলা একটা রেস্তোরায় সি ফিশ পেলাম।

কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনেই পুরনো বন্ধু জ্যাক পিয়ারের সঙ্গে দেখা হল । প্রায় কুড়ি বছর আগে চেন্নাইয়ে এসেছিল। ও থাকে জেরুজালেমে। ওখানকার হাডাসা হাসপাতালের প্রাক্তন ডিরেক্টর। মিটিং শেষ হতেই আমায় জেরুজালেম দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। পাশাপাশি তার কর্মক্ষেত্রেও নিয়ে যাবেন। ওর কর্মক্ষেত্র হাডাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর। হাসপাতালটার বয়স একশো বছর।

জ্যাকের ডাক নাম কভি। কভি বলেছিল, ছোটোবেলা সাইকেলে করে বাড়িতে বাড়িতে সে জিনিসˆপত্র পৌঁছে দিত। সংগ্রামী জীবন । ঠিক সকাল সাতটায় নিজেই ড্রাইভ করে হোটেলের সামনে থেকে আমাকে পিক আপ করˆল। তেল আভিভ থেকে জেরুজালেম একঘন্টার পথ। যে শহর নিয়ে আরবদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয়। ইজরায়েলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়।

জেরুজালেমের দুটো ভাগ। একটা নতুন জেরুজালেম, অন্যটা ওল্ড সিটি। ইজরায়েল বড়ো দেশ নয়। জনসংখ্যা মাত্র ৮.৫ মিলিয়ন। চেন্নাইয়ের থেকেও কম। কিন্তু চক্ষু বিশেষজ্ঞের সংখ্যা চমকপ্রদ, সাতশো। প্রথমেই গেলাম শতাব্দী প্রাচীন হাডাসা হাসপাতালে। জ্যাক অবসর নিয়েছে, কিন্তু এই হাসপাতালের সঙ্গে এখনো যুক্ত। আধুনিকাত, অভিজাত্য আর পরিচ্ছন্নতার নিপুণ দৃষ্টান্ত। একটা ফ্লোর থেকে আরেকটা ফ্লোরে যেতে সিকিউরিটি কি বা কোড ব্যাবহার করতে হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আক্রমণ থেকে হাসপাতালকে রক্ষা করতেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। সেদিন ওদের রিসার্চ মিটিং ছিˆল। হাডাসা ইউনিভার্সিটির রিসার্চ বিশ্বখ্যাত । মিটিং শেষে কভি আমাকে নতুন ইজরায়েল দেখাতে নিয়ে চলˆল। প্রথমে দেখাল ওদের পার্লামেন্ট হাউস। প্রেসিডেন্টের বাড়ি।

এখানকার সব বাড়ির রঙ গেরুয়া। একটা পাথরের দেওয়াল নতুন আর পুরনোকে ভাগ করেছে। প্রাচীরের ওপরে বেশ কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট আছে। সেখান থেকে পুরোনো শহর দেখা যায়। বেশ কিছু ছবি তুললাম। নতুন জেরুজালেম ঘোরার পর কভি তার বাড়িতে নিয়ে গেল। ছিমছাম, বাড়িতে সপ্তপদীপের মতো ঝকঝকে রয়েছে মেনোরা। দিন কয়েকের মধ্যেই জেরুজালেমে ইহুদিদের উত্সব শুরু হবে। সেইদিন এই সপ্তপ্রদীপ জ্বলে, অনেকটা আমাদের দেওয়ালি বা শ্যামা পুজোর মতো। কভির বাড়িতে স্যুপ আর স্থানীয় একটা বড়া খেলাম। খাওয়া দাওয়ার পর ইলেকট্রিক ট্রেনে রওনা দিলাম হলি সিটির উদ্দ্যেশে। শহরের মূল রাস্তার মাঝখান দিয়ে ট্রামের মতো ট্রেন। ট্রেনে টিকিট কাটা যায় না, স্টেশন থেকে টিকিট কেটে উঠতে হয়।

হলি সিটিটা পুরো গেরুযা রঙের দেওযালে ঘেরা। সব জায়গায় প্রাচীনতার স্পর্শ। হলি সিটিতে এসে পথমে একটা আর্মেমিয়াম চার্চে ঢুকলাম। খুব শান্ত ।
সেখান থেকে সরু গলি দিয়ে ঢুকতে হয় জেরুজালমের মূল অংশে। জেরুজালেমে রয়েছে ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলিমদের মূল তীর্থস্থান। কভি যেতে যেতে বলল, এই শহর কার দখলে থাকবে তা নিয়ে বিবাদ বহু পুরনো। ঝগড়াঝাঁটি মারদাঙ্গা লেগেই আছে। জেরুজালেম শহরটা অন্তত দুবার ধ্বংস করা হয়েছে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছে ৫২বার।

 

চার হাজার বছরের পুরোনো জেরুজালেম প্রথমে এসেছে জুডায়িজম। তারপর খ্রিস্টধর্ম, তারপর ইসলাম। পবিত্র জেরুজালেমে সকলেরই আলাদা আলাদা ধর্মস্থান আছে। এখান থেকেই মহম্মদ নাকি আকাশ সফরে গিয়েছিলেন। ইসলাম ধর্মাবিলম্বীরা তাই এই শহরকে পবিত্র তীর্থস্থান বলে মানেন। জুডিস্ট তীর্থস্থানে ঢুকতে মাথায় ছোট্ট সাদা টুপি পরতে হয়। ভেতরে নিরাপত্তার বেশ কড়াকড়ি। আসলে শান্তির পবিত্রতা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তাই এই ব্যাবস্থা। ভেতরে সবাই দেওয়ালে দুহাত ঠেকিয়ে প্রার্থণা করছে । আমিও ওদের প্রথা অনুযায়ী বাড়ির সবার জন্য প্রার্থণা করলাম। একটা সুভেনির শপ থেকে সপ্তপদীপের মতো দেখতে জেরুজালেম লেখা কয়েকটা ম্যাগনেট আর হাতের কাজ করা ব্যাগ কিনলাম স্বজন বন্ধুদের জন্য । হলি সিটি দেখে ফিরতে ফিরতে সাড়ে চারটে। প্রায় আড়াইঘন্টা লেগে যায় ভেতরটা ঘুরে দেখতে। হোক না উপাসনা স্থল, কিন্তু তার অন্তরে তো লুকিয়ে আছে সভ্যতার ইতিহাস। কভির বাড়িতে অরেঞ্জ জুস খেয়ে রওনা দিলাম তেল হাভিভের দিকে। ইডেল মল স্ট্রিটে হোটেলের গেটে পৌছে দিল ও।

কভির জন্যই তো পরিচয় হল পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে। ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলিমদের তীর্থস্থান দেখার সুযোগও ঘটল। এটা যে এত ঐতিহাসিক, তা জানা ছিˆল না, টোয়েডো কভি। টোয়েডো, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

আলোকচিত্র: লেখক

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!