- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- আগস্ট ৭, ২০২২
দশইঞ্চি প্রজাপতি
পর্ব ১২

অলঙ্করণ: দেব সরকার
উ।প। ন্যা।স
সুরজিৎ কাঞ্জিলালের বড় শ্যালক শ্রীকুমার মুখোশের মেধাবু ছাত্রর ছিল । শেরপুর স্কুলেরই পুরনো ব্যাচ । বয়সে কাঞ্জিলালের চাইতে খানিক ছোট হলেও, বন্ধুতারই সম্পর্ক । সে এখন ন্যাশেনাল অ্যাটলাস বা দেশের ম্যাপ ইত্যাদির প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান । সুরজিৎ পেজ টুতে থাকে আর শ্রীকুমার সি.আই.জি.তে । প্রথমযুগে, এম.আই.জি.র ফ্ল্যাটগুলোর বর্ধিত পরিকাঠামো বানানোর আইন ছিল না । পরবর্তীতে কোর্টকাছাড়ির পর, সরকার নিয়ম পার্লার । শ্রীকুমার শুধু শৌখিন একটি দোতলা বানিয়ে নিয়েছে ।
শালা-জামাইবাবুর সম্পর্কটিও মধুর । রুচিতেও মিলে যায় । শ্রীকুমারের কাছে আশা সে উদ্দেশ্য ।
পাশের শহরের ডেন্টাল কলেজটির তিন বন্ধুর তুমুল বিতর্ক চলছিল । সম্ভবত, কথার টানে বোঝা যাচ্ছিল, মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে ডাক্তার হবার আশায় ভর্তি হয়েছে । মেধাতালিকায় সম্ভবত খুব পেছনের দিকে নাম । নইলে, শেরপুরের এই প্রাইভেট কলেজটায় গাদাগুচ্ছের টাকা দিয়ে ঢুকতে আসবে কেন? কংগোর প্রজাপতি ।…একটা জার্নালে দেখলাম । প্রথম জন ।
কংগো কী ? দ্বিতীয় ।
দেশটেশ হবে ! কিংবা পাহাড় । অথবা নদী…তৃতীয় বলে উঠেছিল । এরপর তিনজনের মধ্যে চটকানো নানা কথাবার্তা । কে কি বলছে, খেই ধরা যাচ্ছিল না ।
দেশ ? সেটা কোথায় ?
বঙ্গ দেশের কাছাকাছি ।
অনুপ্রাস সাজানোর নেশায়, তৃতীয় কন্ঠ বলে, রংগটা থামাবি ? চেপে যা । কংগো একটা দেশ । দেশ ? তবে ভালোই হল মায়া । …দেশ হলেই বাঘ-হরিণ-সিংহ থাকবে…কংগো তে না হয় প্রজাপতি রইল । … উড়ে উড়ে আসে ।
কংগোটা কোথায় ?
বললাম তো দেশ । রংগে ভরাতে সাঁড়া । … প্রজাপতি, বলেই সে আঙুল দিয়ে অশ্লীল একটি আকার তৈরি করেছিল । তিনজনই সঙ্গে সঙ্গে ভূগোল বিতর্ক থেকে সরে গিয়ে দামি মোবাইলে কিছু নিষিদ্ধ দেখতে মাথা ঝুঁকিয়ে ঘন হয়েছিল ।
কাঞ্জিলাল তখন একটা কলাওয়ালার মুখে দুই হকারের ক্যালাকেলির সরেজমিনে সাক্ষি নিচ্ছিল । এখন প্ল্যাটফর্মের তোলাবাজির টাকা গোপালশঙ্করের ইউনিয়নে একচেটিয়া যায় না, তপেশ আশি ভাগই দখল করে নিয়েছে ।
কাঞ্জিলাল কলাওয়ালার সাক্ষ্য শুনবে কি, ছেলে তিনটির কথাবার্তায় চোরা উৎসাহ বোধ করছিল । কিন্তু একাগ্রতার খণ্ডন ঘটলে পুরোটাই ঘেঁটে রায়। কোনটাই মস্তিস্কে পুরো হয়ে ওঠে না ।
কংগো তালে একটা দেশ বঙ্গের পাশে? ধ্যাৎ! বাংলার পাশে উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, বিহার—।
কটাই এখন তপেশের দলে? সে কি? গতবছরই প্ল্যাটফর্মে তপেশের ছেলেরা গুলি চালিয়েছিল না?
কলাওয়ালাটা হেসে বলেছিল, কেন পাল্টা গালি খাবে না? মস্তানরা কি একবারের ময়দা হয়?
শ্যালকের সঙ্গে চায়ের টেবিলে হঠাৎ কাঞ্জিলাল, কুমার?
বলুন । সন্ধ্যার ব্যাচ বসাননি আজ ?
ছাড়ো ও সব । কংগো বলে কোন দেশ তোমাদের ভূগোলে আছে ?
শ্রীকুমারের মজা লাগে ।
ভূগোল শুধু আমাদের হবে কেন ?
এটি কাঞ্জিলালের মুদ্রাদোষ । কোন কিছুর প্রতি বাড়তি জোড় দিতে, তোমাদের শব্দটা লব্ধদোষ হয়ে গেছে । তোমাদের ক্রিকেট আর খেলা নেই, বলার কামানোর অজুহাত” ‘ তোমাদের প্রধানমন্ত্রী কদিন বা ইন্ডিয়ার গ্রাম দেখতে যান ? তোমাদের রাস্তা ভাই ফুট ব্যবসায়ীরা দখল করে না, তোমাদের চাহিদা দখল করায় ।
প্রসঙ্গত জামাইদার কৌতূহলে, শ্রীকুমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসে ।
দিদি ভালো আছে ?
আছে স্বপ্না ।…ভালো না থেকে যাবে কোথায় ?
শ্রীকুমার হেসে চলে, এখন আর কংগো বলে তো কোন দেশ নেই ।
নেই? কাঞ্জিলাল বলে, ও নামের কোনো নদী বা পাহাড় ।
একদিন দেশ ছিল । … এখন দুটুকরো…নামও বদলে গেছে ।
কী মনে হয়? সুরজিৎ বিজ্ঞের মতো ভঙ্গিতে জানতে চাইল, ভারতবর্ষ কি ফিউচারের দু-টুকরো হবে ? গুরুত্ব না দিয়েই শ্রীকুমার মন্তব্য করে, হলে দুই নয়, চার-পাঁচ টুকরো হবে । কেন জানতে চাইছেন এসব ?
কিছু করার নেইরে পাগলা ।
এত দেশ থাকতে, কংগোর খোঁজ করছেন ?
কোন মহাদেশের আন্ডারে পড়ে ?
আফ্রিকায় !
রাষ্ট্রপ্রধানকে উইয়ে পুরো খেয়ে ফেললো একদিন । …দেশ দু টুকরো…দুই নাম…কংগো আর রইল না ।
…জ্যান্ত মানুষকে উই পোকা খেতে পারে? আমাদের বাল্মীকিকে খেয়েছিল না ?খেলে কোথায় ? উনিতো উঁই ঢিবি হয়ে গেছলেন ।লুমুম্বা বেচারা আমাদের ভারতীয় টেকনিকটা জানতেন না।
বোকার মতো প্রশ্ন করেছি বলে, মুরগি করো না যেন ।
শ্রীকুমার লজ্জা পেয়ে বলে, মহাদেশের প্রশ্নটা বোকার মতো নয়! … জর্জিয়া দেশটা ইউরোপের মধ্যে নাকি এশিয়ায়…জিজ্ঞেস করে দেখুন, বুদোর বুদো পন্ডিত গোল খাবে !
স্বপ্না উঠে পড়ে । খেয়ে যাবেন সুরজিৎ দা!… চিকেন চাপাচ্ছি !
না, না !…তোমার দিদির উপোস গেছে মঙ্গলচণ্ডীর ! … রাতে একসঙ্গে না বসলে আছে যাবে… খানিক পর..
আর এক কাপ চা দিও ।
শ্রীকুমার এবার খানিক জ্ঞান দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, দেশটা দু-টুকরো হয়েছিল মাটির নীচে প্রচুর মূল্যবান খনিজ ছিল বলে। দাদা, আমেরিকার ডিমান্ড । ….পুরনো ওদের এক রাষ্ট্রপ্রধান… লুম্বা ।
লু-মু-ম্-বা ?
যেন শব্দ ছকের ছন্দে কাঞ্জিলাল কৌতূকবোধ করছে ।
পুনরায় সুরজিৎ, দুনিয়ায় বাঙালিদের নামই সুন্দর হয় ।…একটা অর্থ থাকে ।
নামের মানে সব দেশেই থাকে দাদা…দেখুন গিয়ে লুমুম্ব্যা বলতে দেশের মানুষ কিছু বুঝত ।
হতে পারে ।
সুরজিৎ মনে মনে শব্দটি আওড়াতে থাকে ।
পুনরায় শ্রীকুমার, বলেছিলাম ওই রাষ্ট্রপ্রধানকে উইয়ে পুরো খেয়ে ফেললো একদিন । …দেশ দু টুকরো…দুই নাম…কংগো আর রইল না ।
উই ? মানে আমাদের উই পোকা ? টারম্যাক ? …জ্যান্ত মানুষকে উই পোকা খেতে পারে?
কেন পারবে না ? শ্রীকুমার ঝটপট জবাব দিল, আমাদের বাল্মীকিকে খেয়েছিল না ?
খেলে কোথায় ? উনিতো উঁই ঢিবি হয়ে গেছলেন ।
শ্রীকুমার হেসে, লুমুম্বা বেচারা আমাদের ভারতীয় টেকনিকটা জানতেন না।
মোবাইলটা বেজে উঠলো যদুনাথের। ঘর খালি হয়ে গেছে একে একে। চোখের ইঙ্গিতের জন্য পরিমল শুধু রয়ে গেল।
হ্যাঁ, বলে ফেল পেতন…আসতে চাস? আয়। …বেশিক্ষণ কিন্তু বসব না।
সুইচটা বন্ধ করতে করতে যদুনাথ দৃষ্টিতে হাসে।
কে? পচু? পরিমলের প্রশ্নে যদুনাথ মাথা দোলায়।
কেন? এখানে ওর কাজটা কী? আজ তো ওদের নাচা গানা।
নাচা গানা? কেন ? কোথায়?
শোনেন নি?সোহিনীর ট্রুপ আসছে। স্নেক ড্যান্স… ব্রেক ড্যান্স…শখেরপুর আজ হট!
ইয়ংদের মধ্যে গিয়ে দেখুন…টিকিটের কি ডিম্যান্ড!
উপলক্ষ্য?
যুব সংগঠনের দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যে।
যদুনাথ হেসে ফেলে। ভূঁড়িটা কাঁপে।
সাপ নাচটা কিগো পরিমল?
পরিমল হাসে। দেখবার শখ চেপেছে?
সাপ কি নাচে? …মনসাপূজা আমাদের বংশের ছিল দেশের বাড়িতে!
দেশের বাড়িতে বাঙালদের অনেক কিছুই ছিল, বলেই পরিমল, সাপ নাচতে যাবে কেন?
সেতো নাচাবে!
কি নাচাইতো আমরা?
পরিমল আর নিজেকে সামলাতে পারে না। যদুনাথের আত্মশ্লাঘার বাঁধ ভেঙে, অশ্লীল লন্বা একটা জ্যামেতিক আকার দেখিয়ে বলে, এটা নাচবে আপনার।
যদুনাথের কোনো বিষয়েই কোনো সংস্কার নেই। সব কিছু সহজ ভাবে, সবার সঙ্গেই ভাগ করে নিতে জানে। মা তারা। বলে সামান্য বাসন। পরিমল উল্টে জানতে চাইল না, পকু অর্থাৎ তপেশের পাশের বাড়ির পতেন সান্ডিল্য এখানে হাজির হবে কেন, যদুনাথ ব্যাপারটা ভাঙতে চাইল না। পরিমলও ছুতো দেখিয়ে সরে পড়ে। আর এ সুযোগে যদুনাথই পতেনকে ফোন করে। পতেন এম.এফ.এ তাফালের ঘনিষ্ঠ, ব্যক্তিগত সচিবই বলা চলে। ছোটবেলার বন্ধু। যৌবনের গোড়ায় সাইডিংসে যখন তপেশ হাতা পাকায় — পতেন ছিল শহচর। গোঁয়াড় ও দুঃসহসী। বরাবরই তপেশ ওকে কাজে লাগিয়েছে। তপেশের জীবনে এ রকম অনেক এসেছে গেছে– পতেন থেকে গেছে। তপেশ এর স্ত্রী বিয়োগের পর, পতেনই একমাত্র শহচর হয়ে উঠেছিল। পুলিশের হানা, মামলা, যুব সংগঠনে ঢোকা, ভাবমূর্তি বদলানো— পতেন ছায়ার মতো ছিল। তপেশ ক্ষমতা পেয়ে অনেককেই ল্যাং দিয়েছে, পতেনকে ছাড়েনি।
শিলিগুড়ি চলে গিয়ে ফোনে পতেনকে অনেক কিছুর দায়িত্বভার দিয়েছে। দলের অনেকেই মাতব্বর বিশ্বাস করে না। তপেশের নির্দেশ, ফুটে দোকান ভাঙার চূড়ান্ত সীমা যখন শেষ হয়, ভাঙচুরের সুযোগে কোনোন বিরোধীদল বা নিজেদের গোষ্ঠী যেন আপারহ্যান্ড না নিতে পারে। মানবাধিকার সংস্থার ছদ্মবেশে কেউ কেউ সুযোগ নিতে পারে– নজরে রাখা দরকার, থানাতেও যেন ইনফরমেশন যায়। কয়েকদিন ধরেই শখেরপুরে যেভাবে পরিস্থিতি পেকে উঠেছএ, ঘোলা জলে মাছ ধরার বহু চোরাগোপ্তা শক্তি দানা পাকাতে চেষ্টা করবে। হয়তো স্টেশনের ধারে কাছে টায়ার জালিয়ে দিতে পারে, বোমাবাজি ঘটিয়েও আয়োজন হেত পারে পুলিশের গুলি চালনার। এক আধজন ফুট ব্যবসায়ী শহীদ হলে তো কথাই নেই।
এযাত্রা কোনো কিছুর বাধার মুখেই উন্নয়নকে আটকানো যাবে না । খুব উচুঁ মহলের এই প্ল্যান । দু পাশে চল্লিশফুট রাস্তা, পাশাপাশি আর একটা উড়াল। খেয়াল রাখবি, কোনো প্রতিবাদের মুখেই কিন্তু রাস্তা ক্লিয়ার বন্ধ থাকবে না… তাতে যা ঘটার ঘটুক… কিন্তু ফুটের হয়এই তুই মাইকিং করবি। আর হ্যাঁ, গোপালশংকরদাকে যা বলার, বলে দিয়েছি । তুই একবার যদুদাকে সব ইনফর্ম করে রাখবি ।
কিন্তু তপু…?
কিন্তু কী ?
সব শুনে তপেশ যৌবনের খিস্তি দিয়ে বলেছিল, আস্ত বোকাচোদা একটা ।
পতেনকে ঝাঁঝিয়ে বলে, গান্ডু, আজকের প্রোগ্রাম এটা ?… সোনিয়ার ডেট একমাস আগে বুক হয়েছে!…
কলেজের নবীনবরণ বন্ধ থাকবে?
কাজ করিস ।… ভুল আইচ, খোকা সাহাদের– ওদের সমিতিটাকে জানিয়ে রাখিস ।
ক্রমশ..
চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us