- খাস-কলম ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ১৭, ২০২৪
আমার বাবা । শেষ পর্ব
বাবা মেঘ দেখতে চাইতেন না বলে ছোটবেলায় খুব কষ্ট পেতাম ৷ তা দেখে বাবা বলতেন—মেঘকে এত দেখে দেখে বিরক্ত করতে নেই
• ১১ •
রাত দুপুরের থানাদার কুকুরের মতো বিশুদ্ধ আবেগের বাস নিতে নিতেই শতখান হতাম তখন ৷ কী বলব, অভিনীত চরিত্রের জন্য লাগসই কোনো আবেগে ঘূর্ণায়মান থাকা কিংবা নেহাতই এলোপাথাড়ি একটা দুটো আবেগ, যা কিনা তার নিজের বেগেই আসি আসি করছে, কোনোমতে তাকে এদিক সেদিক করে ঠেকিয়ে রাখা — দুটোই চলতো তখন আমার, স্রেফ আমার মর্জিতে ৷ এমন একটা সময় নাট্যকার মনোজ মিত্র মহাভারত নিয়ে একটা নাটক লিখলেন ৷ নাম যা নেই ভারতে ৷ আমাকে দিলেন এক বুনো মায়ের চরিত্র ৷ পেটভর্তি খিদে নিয়ে জ্বলতে জ্বলতে যে কিনা মহাসন্তুষ্টিতে পালপোষ করতে থাকে কৌরবদের হাড়হাবাতে জারজ বাচ্চাগুলোকে ৷
আমার গিন্নিবান্নি চেহারা দেখে দু চারজন শলা দিলেন — ঘুরে টুরে তো বেড়াও ! যাও না পুরুলিয়ার জঙ্গলে ৷ আদিবাসী বুড়িদের একটু নেড়েচেড়ে দেখোই না বাপু ৷ এরকম একটা কালজয়ী নাটকে অভিনয় করবে, একটু গা ঘামাবে না ? তোমাদের বামেদের তো হয়ে এলো হে ! এবারে জঙ্গলে জঙ্গলে নয়া বাম ! আর ভেবে দেখ পাতকিনীর (আমি যে চরিত্রে অভিনয় করছিলাম) ওই পালিত শিশুগুলো, তারা তো রাজবংশেরই সন্তান ৷ এখানেও দেখো তাই ৷ জঙ্গলের এরা তো বামদেরই অংশ ! এখন দেখো বামেরাই কেমন এদের উচ্ছেদ করছে ৷
অনর্গল এইসব বলেই চললেন আমার নাট্যবন্ধুরা ৷ সত্যি বলতে কী জীবন দেখার এই সব নিভাঁজ ছিরিছাদ বা চরিত্রনির্মাণের এসব গাছাড়া মন হারানো পন্থার কথা যত শুনতে লাগলাম অভিনয়ের যেন ধক চলে যেতে লাগল ৷ দোনামনা শুরু হল অভিনেতা ময়ূরীর ৷ যে দোনামোনায় অভিনেতার মনঃসংযোগ ও মনচক্ষু দুইই বিলীন হতে থাকে এক অনর্থক উত্তেজক সংশয়ে ৷ সেদিন অভিনয়ের অব্যর্থ সূত্র ধরিয়ে দিয়েছিলেন নির্দেশক মনোজ মিত্র ৷ পাতকিনীকে কেমন করে মঞ্চে আনতে হবে, তা বোঝতে বসে কথাগুলো ছিল তাঁর এইরকম —
যে মহাভারতের ওপর ভর দিয়ে আমার এই নাটক উচ্চবর্গ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেই মহাভারত তোমার কোনো কম্মে লাগবে না ৷ তোমার আশেপাশের কোনো চরিত্র বা আগেপিছের কোনো দৃশ্য থেকে বাড়তি আবেগ সংগ্রহে একদম ক্ষেপে উঠবে না ৷ দেশ কাল ডাইনে বাঁয়ে পাশ ফিরে আর দেখো না ৷ ওতে তোমার দৃষ্টিই থিতিয়ে পরবে ৷ তুমি কেবল তোমার দেখার লক্ষ্যটিকে অমোঘ করে নাও ৷ স্ফীত করো মনচোখের পরিসর ৷ কেবল দেখে যাও —মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই অনন্ত ক্ষুধায় খাক হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড ৷ আর সেই ক্ষুধায় ঘাস মাটি কীট পতঙ্গ কামড়ে বেড়াচ্ছে যারা তারা তোমারি বান্ধব, তোমার পরিজন ৷ এ দেখতে গিয়ে অভ্যন্তর যদি তোমার অগ্নিগর্ভ হয়, কদাকার হয়ে যায় সেও ঠিক৷ আর যদি স্থবির কি প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠ সেও বা ভুল কী !
সে দেখা আজও চলছে আমার ৷ অভিনয়টিও অসমাপ্ত থেকে গ্যাছে ৷ পাতকিনীর সে রাগে পুড়তে থাকার দৃশ্যে বেপরোয়া লাফ দি ৷ আবহের সাথে লাফনাচ মুহূর্মুহু বেতালা হয় ৷ বন্ধুরা বেজার হয়ে বললেন, আরে আরে অভিনয়ের অ আ জানে না মেয়েটা ! মঞ্চে নেচেকুদে কাদের হয়ে মাতব্বরি করে এ !
গোপনে মুচকি হাসি— এই যা ! আমার সে নিক্তি ধরে হাসিকান্না কখন খুইয়ে বসলাম রে !
এই নাটকের পর থেকে বাবার সঙ্গে প্রবল বিরোধ শুরু হল আমার ৷ নীতির বিরোধ নয় পুরো মেটে, নয় মোটে মেটে না ৷ একসময় আমাদের ঝগড়াটা পাকা হল ৷ ২০১৮ -এ বার্মিংহাম মঞ্চে ছিল মনোজ মিত্রের সঙ্গে আমার শেষ অভিনয় ৷ আর ফেরা হয়নি এক মঞ্চে এক সংগঠনে ৷ সম্পর্কটা থেকে গেল বাচ্চা মেয়ের ফিনফিনে চুলে ফিতে বাঁধার মতো ৷ কখনো ফিতে শেষ ৷ কখনো আবার চুলই ফুরিয়ে যায় ৷
• ১২ •
অনেকদিন পরে বর্ষার জন্য হঠাৎ ছুটি পেলাম আর অনেকদিন পরে বাবার ঘরে ঢুকলাম ৷ ঘরটি পশ্চিমের ৷ তিনদিকে বড়ো বড়ো জানলা দিয়ে মেঘ সূর্য দুটোই বেশি দেখা যায় ৷ মাঝখানে বাড়ির সবথেকে সস্তা খাট ৷ তবে ছত্রী আছে ৷ খাটের কিনারা ধরে বই পরপর সাজানো ৷ মাঝখানে হাত পা গুটিয়ে ছোটটি হয়ে বাবা ঘুমিয়ে ৷ মেঘের দিন তাঁকে বরাবর ঘুম পাড়ায় ৷ বাবা মেঘ দেখতে চাইতেন না বলে ছোটবেলায় খুব কষ্ট পেতাম ৷ তা দেখে বাবা বলতেন—মেঘকে এত দেখে দেখে বিরক্ত করতে নেই ৷ ওদের নিজের মতো থাকতে দে ৷ চ -ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুমই ৷ মানতে চাইতাম না ৷ বলতাম— মেঘের কি জীবন আছে ? বাবা বলতেন— তাই সে জল দেয় ৷
— আছছা বাবা মেঘ ছেলে না মেয়ে ? সে কারোর মা না বাবা ?
নীরব হাসিতেই শেষ হতো দার্শনিক বাবার উত্তর ৷
আজো দেখলাম জানলা দিয়ে অনেক মেঘ আসছে ৷ কিংবা তারা আসছে না ৷ আমি বাবাকে নিয়ে পৌঁছতে চাইছি তাদের কাছে ৷ বুঝতে চাইছি মেঘলিঙ্গ ! মানুষের কী সব অদ্ভুত ইচ্ছে ৷ বাবার গায়ে হাত রাখলাম ৷ অন্যদিন বসার ঘরে বাবার সঙ্গে সামান্য কথা বলে মায়ের কাছে চলে যাই ৷ আজ যখন এসেছি বইঘেরা খাটে, দেখে যাই চামড়া ছুঁয়ে ৷ নাহ : ঝোলেনি চামড়া ৷ তুলতুলে হয়ে গেছে ৷ ওঘর থেকে মা ডাকলে ৷ সাড়া দিলাম না ৷ বাবাও জাগলেন– চোখ বন্ধ ৷ টাস্ক দিলাম– সক্রেটিস প্লেটো আর এরিস্টটলকে কাল অনুযায়ী সাজাও । হাসতে হাসতে উত্তর এল — ওই তো একজন যদি একজনের ঠাকুরদা হন তো অন্যজন তার নাতি ৷ সক্রেটিস ঠাকুরদা আর এরিস্টটল নাতি ! আর মাঝেরটা ওই প্লেটো হল গিয়ে ছেলে ৷ তবে এই তিনমানব যে কালেই আসুন, সর্বদা শক্তিমানের বিরুদ্ধে ৷ বোঝার চেষ্টা করলাম–মেঘলা দুপুরে তুলতুলে হাতে আমার গলা সামান্য জড়িয়ে এইমাত্র যিনি বন্ধ চোখে নির্ভুল উত্তর দিলেন –তিনি আমার মা না বাবা !
বহুদিন আগে বসিরহাট অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে থিয়েটার করতে গেছি ৷ সেও এক বৃষ্টির দিন ৷ সন্ধেতে থিয়েটার ৷ দুপুর দুপুরই গেছি ৷ জোলো মাঠের একাংশে ছোট্ট মেলা– ৷ মাটি জলে মাখামাখি করে বসে আছেন মা ৷ দুটো বাচ্চাই মাই খাবে বলে চিল্লাছে ৷ মা ছোটটাকে দুধ দিচ্ছেন ৷ আরেকটাও ছোট ৷ সে ব্যাটাও চেঁচাচ্ছে ৷ ওদের বাবা মায়ের দ্বিতীয় মাইয়ের কাছে বাচ্চার মুখ ধরলেন ৷ দুধ পড়ল না ৷ দেখলাম, পরপর দু তিন ছেলের জন্ম দিয়ে মায়ের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ঘোর অপুষ্টি ৷ অসহায় বাবা বাচ্চাকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন ৷ ক্ষুধার্ত বাচ্চা বাবার পাঞ্জাবী সরিয়ে হাড় বের করা কণ্ঠায় মুখ গুঁজল ৷ একটা বাচ্চা মায়ের আরেকটা বাচ্চা বাবার বুকে ৷ দু ভাই আবার দুজনের আঙ্গুল ধরে খেলছে ৷ বোরখা সরল ৷ মায়ের চোখ খুব সুন্দর — এখন তা আরো সুন্দর বাবার চোখে মিলে ৷
এসব দেখে সেদিন মেঘকুম্ভ পূর্ণ হয়েছিল কিনা মনে করতে পারি না ৷
ঘটনা শুনে মুখে শেষ তুলির টানটি দিয়ে মনোজ মিত্র বললেন, মেঘ উভলিঙ্গ ! উভয়ের হৃদয়ে মেঘ আর মেঘ থাক রে আমার বাপ, তাই থাক !
অম্বার পুনঃ পুনঃ জন্ম হোক ৷
·•··•··•· ·•··•··•·
চতুর্থ পর্ব পড়ুন: আমার বাবা
❤ Support Us