Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ২, ২০২৫

ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৭

নলিনী বেরা
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৭

১৯ 

 
আগেও বলেছি,  এরকম মাথামুণ্ডহীন একটা ছবি দেখেছি থ্রি-ফোরের ইতিহাস বইয়েগলাসুদ্ধ মাথাটাই নেই 
 
শুধু কী ঘাড়-মাথা ? হাতও তো ছিল না বোধকরিঅবশিষ্ট অবয়ব জুড়ে বোতাম-লাগানো সেই একটা মোটা ও মস্ত আলখাল্লাতাঁর বিষয়ে কত প্রশ্নোত্তর মুখস্ত করেছি :
 
              প্র:.  কুষাণ কারা ? 

                উ:.  মধ্য এশিয়ার এক পরাক্রমশালী যাযাবর জাতি ‘ইউচি’তাঁরাই কুষাণ। 
 
                প্র:. কুষাণদের মধ্যে খ্যাতিমান সম্রাট কে ছিলেন? 

                উ:.  কণিষ্ক । 
 
                প্র:.  তিনি কখন রাজা হন? তাঁর রাজধানী কোথায় ছিল?

                উ:.  কণিষ্ক ৭৮ খ্র্রিস্টাব্দে রাজা হনতাঁর রাজধানী ছিল পুরুষপুর 
 
                প্র:.  কণিষ্কের ধর্মমত কি ছিল?

                উ:.  কণিষ্ক ছিলেন বৌদ্ধ 
 
                প্র:.  তাঁর সভাকবির নাম কি? 

                উ:.  অশ্বঘোষ 
 
                প্র:.  তিনি কোন গ্রন্থ রচনা করেন ? 

                উ:.  বুদ্ধচরিত ।”
 
মথুরার নিকট তাঁর একটি কবন্ধ মূর্তি পাওয়া যায় ‘কবন্ধ >কন্ধ > কন্ধ +কাটা’ অর্থাৎ মাথাকাটা, মস্তকবিহীনহয়তো কোনও কারণবশত সম্রাট কণিষ্কের আস্ত মূর্তিটার মাথাটাই খোয়া গিয়েছিল এই সংঘারাম বা ভগ্নগৃহে রক্ষিত যতসব মাথা-ভাঙা, মাথামুণ্ডহীন মৃর্তিদের মতো !
 
তাও ভালোস্কন্ধকাটা বা কন্ধকাটা ‘কবন্ধ ভূত’ হলে তো মুস্কিলনাকি  সপ্তকাণ্ড রামায়ণে উল্লেখ আছে – যুদ্ধক্ষেত্রে এক অযুত গজ, এক নিযুত অশ্ব, একশত পঞ্চাশ রথী আর দশকোটি পদাতিক সৈন্য হতাহত হলে একটা ‘কবন্ধ’ তৈরি হয়। 
 
 ‘কবন্ধ’ – মাথামুণ্ডহীন, কেবলমাত্র ধড়বিশিষ্ট এক ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা“ চলেন চলেন ” বলে এরা সামনে এসে ডাকে না পথিককে পিছন থেকে আবাহন করে, “আয়েন আয়েন !” 
 
সাড়া দিয়ে পথচারী যদি বেভুলে পিছন ফিরে তাকায়, মুহূর্তেই সে কবন্ধ তার ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করেআর, তা দেখে পথচারী মূর্ছিত হয়ে পড়লে তবে তো কেল্লা ফতে !
 
অজ্ঞান পথচারীর বুকের উপর উঠে রক্ত শোষণ করে নেয় কবন্ধ‘হেলমেট’- খোলা কবন্ধরূপী আমার সমুখে দণ্ডায়মান এই আগন্তুকও কী সেই গোত্রের ? সেই তন্ত্রের ? 
 
– কই, লোকটাকে দেখে তেমনটা তো বোধ হচ্ছে না !  গৃহকর্তার মেজাজ দেখালেও উল্টে কেমন যেন চেনা চেনা, নিরীহ,  গোবেচারীই  লাগছে তাকেউপরন্তু বিছানায় ফেলে রাখা ‘হেলমেট’-টা যথাস্থানে জুড়ে নিলে ফের যে-কে-সেই 
 
মানুষ, মানুষ 
 
ভেল্কি নাকি ? মাদারির খেল ?  “ কী মুস্কিল ! ছিল রুমাল,  হয়ে গেল একটা বেড়াল ।” এমনটাও শুনেছি বটে আমাদের গ্রামের গুণিনের গুণিন রাজা গুণিন বালকা সাঁওতালের মুখে !
 
বড়ই শ্রদ্ধাস্পদ সাঁওতালী-পুরাণ-বিশারদ আমাদের গ্রামের এই বালক তথা বাল্কা সাঁওতালএকদিন সকাল সকাল আমি দোয়াতে কালির বড়ি গুলে বাঁশের কলম দিয়ে হাতের লেখা অর্থাৎ হস্তাক্ষর চর্চা করছি  ‘শিশুবোধ’ থেকে—
 
           “ সন্দীপনী  মুনির  পাঠশালা। 

                  তবে হলধর হরি,       মনে মহা খেদ করি 

                   গেলা  যথা  জনক জননী 

           প্রণমিয়া করপুটে,       দাণ্ডাইয়া সন্নিকটে, 

                   কহিতে লাগিলা যদুমণি ।। 

           পণ্ডিত সভার মাঝ,      পাইলাম বড় লাজ 

                     বিদ্যাহীন জন কেন বাঁচে 

           সন্দীপনী মুনিবর,        অবন্তীনগরে ঘর,

                     বিদ্যা শিক্ষা করি তাঁর কাছে ।। …”
 
আর আমার মা আমারই কাছে বসে বোধকরি আড়চোখে মুক্তার মতো হস্তাক্ষর সন্দর্শনে যার পর নেই প্রীত হয়ে কাটারি দিয়ে বাঁশের কঞ্চি চাঁচছে একমনেসরু সরু বাঁশের খুঁচি, যা দিয়ে বালির খলায় চাল বা মুড়ি ভাজা যায় 

আচমকা সেখানে কী কাজে যেন বালকা সাঁওতাল উপস্থিতপরনে একটা কৌপীনমাত্রমাথায় ঘোমটা টেনে শশব্যস্ত হয়ে মা বসার জন্য বাবুইদড়ির ‘মাচিয়া’-টা এগিয়ে দিল 
 

বলেই বালকা দুহাত দিয়ে মোচড়াতে লাগলেন আপনার মাথার খুলিটা ।  মা আর আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে । গুণিনের গুণিন রাজা গুণিন বলে কথা – খুলেও ফেলতে পারেন মাথার খুপরিটা

 
মাচিয়াটা টেনে বসতে বসতে বালকা বললেন –
 
“-হেঁ গড়ম, তা’লে –”
 
“-কী ?”
 
“-মাথার খুলিটা খুলি ইবার ?”
 
বলে কী লোকটা !! খুলি আবার খোলা যায় ?
 
“-নাট-বল্টু দিয়ে আঁটা বুঝি ? বাইকবালার হেলমেট নাকি?”
 
“-এই ত ! বল্লে তুঁই বিশাস করবি নাই – ওঃ হোঃ –”
 
বলেই বালকা দুহাত দিয়ে মোচড়াতে লাগলেন আপনার মাথার খুলিটা মা আর আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকেগুণিনের গুণিন রাজা গুণিন বলে কথা – খুলেও ফেলতে পারেন মাথার খুপরিটা !! 
 
না, খুললেন নাতবে সখেদে বললেন —
 
“-খুলত গড়ম, আগের যুগ হৈলে আলবাৎ খুলে যেত পটাং করে এই যুগে ত্যামন আর সুবিস্তা কই? কোথায়? নাই, নাই সবটাই আমাদের কপালের দোষ বাবু, জাতের বজ্জাতি ।”
 
“ কী রকম ? ”
 
বাঁশের খুঁচি-ছাড়ানো পড়ে থাকল একধারে, মা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলতার উত্তরে বালকা গুণিন সৃষ্টিকর্তা ‘ঠাকুরবাবা’-র জরপ শুরু করলেনবিমানবিহারী সূর্যদেবই সাঁওতালদের ‘ঠাকুরবাবা’ —
 
                      “ সিন চান্দো সেওয়া কাতে 

                       বাহা মান্দার মূলিং রহয়লেদা–”
 
মান্দারমূলী ফুলের গাছ লাগিয়েছিলাম ‘সিন চান্দো’ বা সূর্যদেবের পূজার জন্য –
 
সাঁওতালদের আদি বাসস্থান নাকি ছিল ‘হি হি ড়ি-পি পি ড়ি’ ও ‘চায়-চম্পা’ পিপিড়ি, তারমানে প্রজাপতি আর চায়-চম্পা  তো ফুলের গাছহিহিড়ি পিপিড়ি আর চায়-চম্পা রাজ্যে সাঁওতালরা কিস্কু রাজাদের রাজত্বে নাকি বেশ সুখেই বসবাস করছিল 
 
-“সুখ বলতে সুখ ! সুখের অধিপতি, সীমা-চৌহদ্দি ছিল না বা-ঙা –”
 
দুহাত মেলে ধরে বালকাগুণিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন –
 
“-এই যে তুঁই বাঁশ না খাগের কলম দিঞে আজ লেখালিখি কচ্ছিস, সেকাল হৈলে কষ্ট করে তোকে আর লিখতেই হত নাই ঠাকুরবাবার কিরপায় কাগজে দাগা বুলানো মাত্রেই চড় চড় করে লেখা হঞে যেত 
 
ধানগাছে ধান ফলত নাই, ফলত ঢেঁকি-ছাঁটা-চালের ল্যাখেন চালতুলা- গাছে তুলা হত নাই, সরাসরি কাপড় ফলত নানা রঙের শাড়ি-ধুতি- লুগা –
 
ঠাকূরবাবার দয়ায় বলতে গেলে মানুষকে খাটতে খুটতেও হত নাইমাগলেই হাতের কাছে -অমুক-ঢেঁক্-ফালনা-তুসকা -খাবারদাবার  -সবকিছুই এসে যেত ।”
 
দুচোখ বড় বড় করে মা বলল —
 
“-বলেন কী ?”
 
“ তা’লে আর বলছি কি !”  বলেই মাথার উকুন বাছার গল্প তুললেন বালকাএমনিতেই কারোর মাথার উকুন বাছতে হলে আজকাল আরেকজন লোকের দরকারএকা একা তো আর নিজের মাথার উকুন বাছা যায় না !
 
মাথার চুলে বিলি কেটে কেটে চুলের গোড়ায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা উকুনটাকে ধরে দুহাতের বুড়ো আঙুলের নখে টিপে পুটুস করে মারাঝঞ্জাটের কাজ – সে তো আর একার দ্বারা হয় না 
 
কিন্তু ‘ঠাকুরবাবা’-র কৃপায় এককালে নাকি একা একাই উকুন-বাছা হত কী করে? কেন মাথার খুলিটা টুক করে খুলে হাতে নিয়ে ইচ্ছামতো উকুন বেছে ফের ‘হেলমেট’-এর কায়দায় মাথায় বসিয়ে নেওয়া–
 
“ কী গড়ম, বহুৎ সুবিস্তা না ? আরও শুনবি, ‘মেঘপাতাল’-টাও ছিল হাতের নাগালের মধ্যে, বলতে কি হাত দিয়ে ছোঁয়াও যেত ”
 
মেঘপাতাল ! তারমানে তো আকাশআকাশ, আকাশদূর, বহুদূরতাও কী না ছোঁয়া যেত হাত বাড়িয়ে ?
 
“-হঁ হঁ সেই আছে না,  -“তুলব ফুল গাঁথব মালা আমরা দুজনে” –  মেঘ- পাতালের তারাফুল হাত দিয়ে খুশিমতো ছেঁড়ো, মালা গাঁথো, গলায় পরো আর নাচো – “ তাঁহা রেতা না না তারনা  -তাঁহা রেতা না না তারনা –”
 
মা অতঃপর জিজ্ঞাসা করল –
 
“-তা এমনটা কেন বন্ধ হয়ে গেল, বাবা ?”
 
বালকা বললেন –
 
“-অই যে বললম -আমাদের কপালের দোষ ! আমাদের জাতের বজ্জাতি !! এক সান্তাল মেয়েমানুষ মাঠে ‘জলঘাট’ করতে বসে গাছ থেকে চাল তুলে মুখে পুরে আক্কুটির মতো গসা গসা খাচ্ছিল – তাই দেখে রাগ হয়ে গেল ঠাকুরবাবার – রাগ তো হওয়ারই কথা !
 
পূর্বপুরুষরা, ঠাকুর্দার বাপ-ঠাকুর্দারা, পই পই করে বলত  -ঘরদুয়ার সাফ-সুতরো রাখিস, খাবার দাবারের ‘আঁইঠা-পাতা’ ঘরের ছামুতে ফেলিস  নাই ! ফেলিস নাই !! ঠাকুরবাবা মেঘপাতাল থেকে নেমে এসে  রোজ রাতের বেলা সান্তালদের ঘরসংসার দেখতে আসেন স্বচক্ষে
 
দেখতে এসে যদি –
 
আর সত্যি সত্যিই, পড়বি ত পড়, উড়বি ত উড় – খাবারদাবারের ‘আঁইঠা- শালপাতা’ বাতাসে পত্ পত্ করে উড়তে উড়তে – লাগবি ত লাগ – একেবারে স্বয়ং ঠাকুরবাবার  চোখে-মুখে !!
 
— রাগ হবেক নাই ঠাকুরবাবার ? 
 
— হৈলও তাই ! তাই !! ভয়ঙ্কর রাগে ঠাকুরবাবা ধরতি থেকে এক হ্যাঁচকায় মেঘপাতালটাকে তুলে নিয়ে গেল উপরে ধানগাছেও আর চাল ফলল নাই কাপাসগাছেও আর কাপড় ধরল নাই সেই থেকে মাথার খুলিটাও আর খুলল নাই -ইসক্রুটাও টাইট হঞে গেল বরাবরের তরে তোকে আর কী বলব, গড়ম ”- 
 
কবেকার কথাআতান্তরে পড়ে আজ যাদের এখন সমুখে দেখছি –তাদেরও  মাথার খুলির স্ক্রুর ঢিলা-টাইটের ব্যাপার আছে নাকি ?
 

২০ 

 
‘মাথামুণ্ডহীন’ লোকটা কী যেন হাঁতড়ে বেড়াচ্ছে ! তার জিনিস সে খুঁজতেই পারে তাতে আমারই বা কী বলার আছে !
 
কিন্তু আমার মাথার মধ্যে সহসা একটা চিন্তার উদ্রেক হল– লোকটা কী রাতে আমার সঙ্গে এই একবিছানায় রাত কাটাবে ?  নাকি যা খুঁজতে এসেছে, তা পেয়ে গেলে অন্যত্র চলে যাবে ? 
 
কে জানে সে কী করবে ! আপাতত সে হাণ্ডুলমাণ্ডুল হয়ে জিনিসটা ঢুঁড়ে চলেছেখুলিটা  তো খোলা অবস্থায় বিছানাতেই রাখা আছেতাহলে এতকিছু সে দেখতে পাচ্ছে কী করে ? 
 
না নাচোখ-মুখ তার সঙ্গে সঙ্গেই আছেশুধুমাত্র খাপে-খাপ খুলিটাই যা খোলাঅবিকল আমাদের গ্রামের বালকা সাঁওতালের বলা  ‘বিনতী-কাহনি’-টার মতোই 
 
লোকটার পরনে লুঙ্গির মতো  ‘চীবর’-ই  হবেগেরুয়া গেরুয়া দেখতে, ‘কাষায়’ কী ? গায়েও একই রঙের ফতুয়া,  ‘চৌবন্দি’ কী? দীপাধারের আলোয় তো ‘ভিক্ষু-ভিক্ষু’ লাগছে 
 
বয়ঃক্রম ন্যূনাধিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবেহয়তো ভিক্ষু, তবে এখনও শিক্ষার্থীতাহলে এই গৃহ, গৃহবাসী সম্পর্কে এতক্ষণ ধরে যা ভাবছি  -তা বোধকরি ঠিক 
 
তবে তারসঙ্গে আমার এখনও কোনও কথা হল না সে তো আসাইস্তক ব্যস্ত, কী যেন ঢুঁড়ে চলেছে ! তাছাড়া ‘মাথামুণ্ডহীন’ একটা লোকের সঙ্গে আগ-বাড়িয়ে কী কথাই বা বলা যায় !
 
উপরন্তু ওই যে বললামএকটা চিন্তা,  কথায় আছে- ‘খেতে পেলে শুতে চায়’ -আলাপ জমে গেলে সে যদি আর উঠতেই না চায়? এখানেই শুতে চায় ? 
 
তারবেলা ? 
 
অতএব যা বলবার – ওই আগে বলুক আমি বরঞ্চ ততক্ষণ তার কার্য-কলাপ ও গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকিঅন্যথায় কক্ষের গবাক্ষ পথে চোখ রেখে রাতের পুষ্করিণী দেখি – “ গগন গবাক্ষ যেন চকিতে খুলিয়া –”
 

নদীধারের গ্রাম লাউদহ নৈহাট কাঁটাপাল কুলবনী থুরিয়া মলম নাহোক, তখনকার করঞ্জ ঘাঘরকাট্টি তালবাটী বটগোহালী গোবিন্দকেলি বলিকন্দর দণ্ডভুক্তি কি শ্বেতবালিকা নামের কোনও না কোনও গ্রামের কেউ না কেউ কী এহেন সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে যেতে যেতে পথিমধ্যে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে এদৃশ্য অবশ্য অবশ্য দেখছেই

 
সত্যি সত্যিই রাতের পুষ্করিণী অপরূপা হয়ে উঠেছে ! তারাদল নিয়ে নভোমণ্ডল জলে নেমে পড়েছেতারাগুলি জলে পড়ে গুলিয়ে না গিয়ে ড্যাবা ড্যাবা অজস্র চোখে যেন তাকিয়ে রয়েছে 
 
তাকিয়ে আছে এই পোড়োবাড়িটার দিকেইবাড়ির প্রতিটা কক্ষের গবাক্ষ দিয়ে দীপাধারের আলোও যেন ক্রমে ক্রমে নেমে পড়েছে জলে !
 
আর, এখনকার নদীধারের গ্রাম লাউদহ নৈহাট কাঁটাপাল কুলবনী থুরিয়া মলম নাহোক, তখনকার করঞ্জ ঘাঘরকাট্টি তালবাটী বটগোহালী গোবিন্দকেলি বলিকন্দর দণ্ডভুক্তি কি শ্বেতবালিকা নামের কোনও না কোনও গ্রামের কেউ না কেউ কী এহেন সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে যেতে যেতে পথিমধ্যে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে এদৃশ্য অবশ্য অবশ্য দেখছেই 
 
যেমনটা আমাদের নদী-সেপারের বড়-ইস্কুলের ডুলুঙনদীতটস্থ হোস্টেলে সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে প্রায় তিনশতাধিক ‘বোর্ডার’-এর হেরিকেন-প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে  সচরাচর ঘটে থাকে 
 
বিশেষ করে রগড়া-হরিপুরা গ্রামের সেদিক থেকে সায়ংকালে যখন কোনও হাটুরে, গৃহাভিমুখে প্রত্যাগমনকারী পদযাত্রী,  চলতে চলতে ডুলুঙনদীর তীরে সহসা উপস্থিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে – রোহিণী চৌধুরানী রুক্মিণীদেবী হাইস্কুল হোস্টেল- বাড়ির কম-সে-কম পঞ্চাশ-ষাটটা  ‘ঝুরকা’ দিয়ে নলাকারে আলোর শীষ এসে  লেগেছে ‘ডোলঙ্গ’ তথা  ডুলুঙনদীর জলে –
 
তখন, থমকে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে এদৃশ্য সে দেখবেই দেখবে !  উপরন্তু তার কোনও পুত্র কি নিকট আত্মীয়  হোস্টেলে থাকলে একফাঁকে তার কাছে সত্বর গিয়ে উপস্থিত হয়ে দেখাও করে আসবে এই বলে –
 
-বাবু রে !  এই যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে তাই আর কি !  সবদিক কুশল তো ? পয়সাকড়ি আছে তো ?
 
এতক্ষণে লেপ-তোষক  হাটকে-পাটকে লোকটাও যেন একটা কিছু খুঁজে পেয়েছে মাথামুণ্ডহীন লোকটা !!   যা খুঁজছিল  – তা কী সে পেয়ে গেছে? নাকি এখনও খোঁজাখুঁজি বাকি আছে তার ? 
 
হ্যাঁ, আমারই কেমন যেন  অস্থির অস্থির লাগছিল তবু যদি  বিছানায় ফেলে রাখা নিজের খুলিটা মাথায় চাপিয়ে খোঁজাখুঁজি করত লোকটা !
 
আস্ত একটা মানুষ তো নয় লোকটা, আদতে একজন, ‘ ই ন্ ক ম্ প্লি ট্ ম্যা ন’তবে বোর্ডিংয়ের সবকটা বোর্ডারেরই কী এই একই অবস্থা ? মাথামুণ্ডহীন দশা ?
 
না, নালোকটা আমার মনের কথা বোধকরি বুঝতে পেরেছিলতৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে খুলিটা হাতে নিয়ে খাপে খাপ স্ক্রু-টাইট করে মাথায় পরে নিল 
 
তাকে দেখেই অনেকটা মনে হল -বুঝি বা দেউলবাড় গ্রামের ফকিরমোহন চক্রবর্তী না না, বরঞ্চ মিল আছে রামচন্দ্রপুরের চারুচন্দ্র হাটুইয়েরউঁহু, উঁহুতাও নাকিছুটা হলেও এক দেখতে – নুয়াসাহি গ্রামের সুধীর সীট
 
যাহোক লোকটা তো বিছানার তলা থেকে হাঁতড়ে বের করে আনল লাল শালুতে মোড়া কী একটা হাতে-লেখা পুঁথিদীপাধারের আলোয় সেটা মেলে ধরল 
 
তাই দেখে ফের আমি যার পর নেই বিরক্ত হচ্ছি – এই রে ! লোকটা আর তাহলে এঘর ছেড়ে যাচ্ছে না? রাতটা তার সঙ্গেই কাটাতে হবে আমাকে ? 
 
এক্ষণে পুঁথি খুলে সে কী আর পাঠ করবে – এই বড়জোর ‘ত্রিশরণ মন্ত্র’  – “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি” “ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি” “সংঘং শরণং গচ্ছামি ” –
 
না, নাকান খাড়া করে শুনলাম – পালিও না, সংস্কৃতও না, পরিষ্কার বাংলাবাংলাই পড়ছে লোকটাআ মরি বাংলা ভাষা –
 
                 “ থলরেণু ঘুচাইয়া যুবতী রূপবতী 

                  সরস গোময় রসে স্থান কৈল শুদ্ধি ।। 

                             সুগন্ধি চন্দন রসে রচিল দেহালি 

                  আরোপিল শ্বেতধান্য হেমঘট বারি  ।। 

                             ঘটে চূতডাল দিল কন্ঠে ফুলমাল 

                  স্থাপিল কুঞ্জরমুখ দেবার কুমার ।। ”
 
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল – বুঝি বা কোনও পূজা-আরাধনার কথাই বর্ণনা করা হচ্ছে “ থলরেণু ঘুচাইয়া ” – ( চমৎকার প্রয়োগ !! ) তারমানে তো পূজাস্থলের ধূলাধুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে –
 
নাচদুয়ারতক আঙিনাময় গোবর লেপে, শুদ্ধ করে, তদুপরি জলভরা হেমঘট বসিয়ে, ধান-আমডাল-সপুষ্প-সচন্দন দিয়ে বেদীমঞ্চ সাজিয়ে, চাক-ঘাঘর-নুপূর-শঙ্খ-মাদল বাজিয়ে –
 
এ তবে কার পূজা? কার আরাধনা ?  এতক্ষণ, এতদিন ধরে জলেস্থলে যে বাদ্য-বাজনা কর্ণকুহরে ধ্বনিত হচ্ছিল – সে কী তবে এই? আরও কতকটা শুনে সন্দেহের মেঘ বুঝি কেটে গেল !
 
                    “ তুমি মাহেশ্বরী       বাশুলী খেচরী 

                                দানবদলনী ভীমা 

                      গদিনী খড়্গিনী       চাপিনী শূলিনী 

                                যার তনু নাহি সীমা  ।। 

                      সিন্ধু জলদেবী        লোক ভয়ঙ্করী 

                                নাসিকা দিঘল খর্ব্বা  । 

                      প্রচুর হাসিনী        দেবতা-জননী 

                                দুর্গতি নাশিনী দুর্গা  ।।     
 
বাশুলী ? বাশুলী খেচরী ? হ্যাঁ,  আমাদের ওদিকটায় বাশুলী দেবীর ‘থান’ আছে বটেলাউদহয় যেমন আছে  ‘ভুলাসনি’ দেবীর মাথা-কাটা মূর্তি তেমনি আছে কালরুইয়ে ‘বাশুলীর থান’ । 
 
কোথাও কোথাও মনসাদেবীই বাশুলীত্রিনয়নী, বড় বড় চোখসেহেতু ‘বিশাল লোচনী’  বা  ‘বিশালাক্ষী’-ও তিনি
 
কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও চতুর্ভুজাকখনও মা কালীর মতো গলায় নরমুণ্ড-মালাকখনও একহাতে অস্ত্র, অন্য হাতে বরাভয়আবার রঙ্কিনী, ডাকিনী-যোগিনীর সঙ্গেও তাঁর  যোগসাজশ আছে 
 
কিন্তু এদের সঙ্গে তাঁর কী ? কে এই লোকটা ? যদি আমার অনুমানই ঠিক হয় – তবে সে এই সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে দীপাধারের আলোয় “অর্হতে নমঃ ‘ বা “নাম-মিও-হো-রেঙ্গে-কিও”  অর্থাৎ “কার্য ও কারণের এই পদ্মসূত্রকে অভিবাদন ” এই বলে তথাগতকে ভরসন্ধ্যায় স্মরণ ও প্রণাম করবে—
 
তা নয়, পাঁচালির সুরে কী পড়ে চলেছে লোকটা ? কিছুক্ষণ আগে এই লোকটাই কী বিদ্যাপতির পদ আউড়াচ্ছিল,  “মাধব, বহুত মিনতি করি তোয় ” ?
 
এই লোকটাই কী সেই কীর্তনটাও গাইছিল,  “ ও শারী তুই দে গো সাড়া ” ? কীর্তন ছেড়ে মুখস্ত করছিল শুভঙ্করের আর্য্যা  —      “ তৈল লবণ ঘৃত চিনি যাহা কিনিতে যাবেতঙ্কা প্রতি মণ হইলে সের কত লবে ?” 
 
পাগল নাকি ‘কখনও মাথাওয়ালা কখনও মাথামুণ্ডহীন’ এই লোকটা ? এই পোড়ো বাড়িটায় একা একাই সে নানাবিধ উৎপাত করে  দাপিয়ে বেড়াচ্ছে? ধারেকাছে আর কেউ নেই বুঝি ? 
 
বাইরে বেরিয়ে এইরাতেই চারধারটা একবার সরেজমিনে দেখে আসা মনস্থ করলামকিন্তু দরজা তো বন্ধ ! কে জানে ঠেলাঠেলি করলে আবার খুলবে কীনা !
 
‘আলীবাবা ও চল্লিশজন দস্যু’ গল্পের  “সিসেম্, দরজা খোল ”, “ সিসেম্, দরজা বন্ধ কর ”-এর মতো “চিচিং ফাঁক” “চিচিং ফাঁক” বলে চিৎকার করতে হবে?  নাকি তার জন্য আলাদা কোনও ফুসমন্তর আছে ? 
 
তার আগে লোকটার সঙ্গে আলাপ করা দরকার একসঙ্গে রাত কাটাতে গেলে আলাপ-আলোচনা তো করতেই হবেকিন্তু লোকটা যে থামেই না, থামেই নাপুঁথি পাঠ করেই চলেছে, করেই চলেছে –
 
                           “ যে তোমার পদ সেবে   অভিমত কর্ম্ম লভে 

                                              ক্ষিতি তার জনম সফল 

                             চণ্ডীপদ  সরসিজে        শ্রীযুত মুকুন্দ দ্বিজে 

                                              বিরচয়ে   সরসমঙ্গল ।।” 
 
ভণিতা হল‘শ্রীযুত মুকুন্দ দ্বিজে বিরচিয়ে সরসমঙ্গল ’ – প্রশ্ন , কোন মুকুন্দ ? কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কী ? ‘সরসমঙ্গল’ তবে কী ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ?
 
যাই হোক, ভণিতা তো শেষ হলএইবার যদি লোকটা থামে ! থামলওলাল-শালুতে পুঁথিটা ফের বাঁধাছাঁদার উদ্যোগ নিলে সেই মুহূর্তে আমিও তাকে ‘দাদা’ বলেই সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করলাম –
 
– “এই যে দাদা, এতক্ষণ ধরে কী পুঁথি পড়লেন জানতে পারি কী ?”
 
ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখল আমাকেযেন ঘরে আরেকজন কেউ আছে -জানতেই পারেনি এতক্ষণ সে !
 
কার্যত কোনও উত্তরই দিল না সেযেমনকার তেমন পুঁথিটা বাঁধাছাঁদা করতেই থাকল 
 
আমি আবারও চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম –
 
—“ দাদা,  দাদা ! কী পুঁথি পাঠ করা হল -জানতে বড়ই কৌতূহল হয়দয়া করে যদি বলেন –”
 
বলল নানিষ্ঠা সহকারে বাঁধাছাঁদা সেরে পুঁথিটা বিছানার তলায় গুঁজে রেখে মাথার খুলিটা খুলে হাতে নিয়ে বেরিয়েও গেল 
 
দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল দড়াম করে 
 
এতকাল পরে তবু একটা লোক এসেছিল বটেমাথামুণ্ডহীনদেখাও হল বিলক্ষণকিন্তু কোনও কথা হল নাহয়তো এখনও আমার ‘গোত্রান্তর’ হয়নি বলেই
 

২১ 

 
লোকটা গেলআর আমিও “না না” করে বিছানার তলা থেকে লাল শালুর পোঁটলাটা খুঁজে টেনে বের করলাম 
 
তালপাতার পুঁথি তো নয় এটামোটা তুলট কাগজে কপি করা পুঁথিচাল-পোড়া কালিতে ঝরঝরে লেখা 
 
একটা নয়, দু-দুটো পুঁথি‘বাশুলীমঙ্গল গীত’ আর ‘ব্যবস্থাসর্বস্ব’‘বাশুলী-মঙ্গল গীত’-এর রচয়িতা ‘কবিচন্দ্র মুকুন্দ মিশ্র’ । 
 
‘ব্যবস্থাসর্বস্ব’-এর লেখকের নাম তো দেখতে পাচ্ছি নাবোধকরি পুঁথিটা অসম্পূর্ণতবে ‘প্রতিজ্ঞা’ নাম দিয়ে গোড়াতেই কিছু কথা উদ্ধৃত আছে –
 
                  “ বর্তমানকালে সদ্বিদ্য পণ্ডিতের প্রায়ই দিন 

                দিন বিরলতা হইয়া উঠিতেছে, কেহই স্বজাতীয় 

                শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতে ইচ্ছুক নহেনতন্নিমিত্ত বৈদিক 

                গৃহস্থদিগের ধর্ম্মকর্ম্মাদির নিরন্তর বিঘ্ন ঘটিতেছে 

                বিশেষতঃ প্রাচীন প্রাচীন পণ্ডিতেরা অর্থলোলুপ 

                হইয়া আপন আপন পুত্রপৌত্রদিগকে বিজাতীয় বিদ্যা 

                শিক্ষা করাইবার জন্য সম্পূর্ণ যত্নবান হইয়াছেন 

                    তন্মধ্যে যদিও কথঞ্চিৎ কোন কোন ব্যক্তির 

                স্বশাস্ত্রাধ্যয়নে যত্ন আছে বটে কিন্তু সে যত্নলতিকা 

                কোনক্রমে ফলবতী হয় না, যেহেতু সুচারু নিয়মে 

                বিদ্যাশিক্ষা করা হয় নাই, সম্প্রতি যে সকল সম্ভ্রান্ত 

                বিদ্যালয় প্রকাশ হইয়াছে তাহাতে যে প্রনালীতে

                শিক্ষা-দান হইতেছে, যে স্থলে ব্যাকরণের বিপন্নতা, সে স্থলে 

                ধর্মশাস্ত্রের যত আলোচনা হইবে তাহা কে না উপলব্ধি 

                করিতে পারিবে !…”
 
উপরোক্ত ‘বাশুলীমঙ্গলগীত’ ও ‘প্রতিজ্ঞা’ থেকে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লোকটা বাশুলীমন্দিরের ‘দেহুরি’ বা পুরোহিতই হবেন আর ধারেকাছে কেন, এই পোড়োগৃহেরই অভ্যন্তরে কোথাও হয়তো বাশুলীদেবীর মন্দিরও  আছে 
 
সুবর্ণরেখা নদীধারের গ্রাম কালরুইয়ে বন্ধুবর কালীপদ হাটুইয়ের বাড়ি গিয়ে তাদের গ্রামের বাশুলীর থান দেখে এসেছি বটে তাবলে মহিষাদল রাজবাড়ির অধীনস্থ নন্দীগ্রামে হলদি নদীর ধারে বাশুলীচকে কখনও যাইনি !
 
শুনেছি বাশুলীচকে শ্রীশ্রী৺বাশুলীদেবীর মস্ত মন্দির আছেআর সমুদ্রউপকূল- বর্তী মহিষাদল তো দস্তুরমতো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ! একদা সাগরসঙ্গমে গিয়ে ফিরতি-পথে বাশুলীর মন্দিরে পূজা দেওয়াও নাকি ছিল অবশ্য কর্তব্যসেখানে নরবলিও হত 
 
মহিষাকৃতি দ্বীপই মহিষাদলতাছাড়াও তৎকালীন সেখানকার বনেজঙ্গলে বুনোমোষের আধিক্যআবার কেউ বলেন, মাহিষ্যদের আদি বাসভূমিতাই মহিষাদল 
 

স্বপ্নাদিষ্ট হলেন এলাকারই জনৈক ব্রাহ্মণ । সমুদ্রে নেমে উদ্ধার করে আনলেন প্রস্তরীভূত দেবীকে । স্বপ্নমোতাবেক তাঁকে ‘থাপনা’ করলেন সেই জায়গায়, পরবর্তীকালে যে জায়গার নামই হবে ‘বাশুলীর চক’। 

 
বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মনুসংহিতা  বলছে – ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য- মাতাজাত সন্তানই কৈবর্তআবার কখনও তাদের পিতা নিষাদ, আর মাতা আয়োগব  
 
যাহোক, কৈবর্তদের আবার দুটি ভাগ – হালিক কৈবর্ত আর জালিক কৈবর্ত যাঁরা হাল বা চাষ করেন তাঁরা ‘দাস’ বা চাষী কৈবর্ততথা মাহিষ্যআর যাঁরা জাল ফেলে মাছ ধরেন, নৌকা চালান – তাঁরা ‘কেবট্ট’ বা আদি কৈবর্ত তথা ধীবর 
 
এতদ অঞ্চলে – তমলুক , বালিসীতা, তুর্কা, সুজামুঠা ও কুতুবপুর – একদা ছিল মাহিষ্যদের সর্বময় রাজ্যমহিষাদল-নন্দীগ্রাম-গুমগড়ও তারই অন্তর্গত 
 
এই গুমগড়েই ব্রাহ্মণদের মেয়ে সেজে একদা এক ধীবরের গৃহে বাস করছিলেন বিশাললোচনী বাশুলীধীবরকে তাঁর ‘বাবা’ আর ধীবরপত্নীকে ‘মা’ পাতিয়েছিলেন তিনি 
 
দেবীর কৃপায় লক্ষ্মীলাভ ও ধনে-মানে প্রতিপত্তি ক্রমেই বাড়ছিল ধীবরেরদরিদ্র ধীবর কোথায় বিলেঝিলে মাছ ধরে বেড়াবেন, তা নয় –
 
এহেন সংবাদ কানে পৌঁছাতে সময় লাগল না মহিষাদল রাজাধিরাজেরওতৎক্ষণাৎ আদেশ হল – কন্যাটিকে সাদরে রাজগৃহে নিয়ে আসার 
 
সত্বর ধীবরগৃহে পৌঁছাল রাজ-শিবিকাপাল্কী বা ডুলিকিন্তু কোথায় কী, ততক্ষণে বাশুলী তো  প্রস্তরীভূত শিলা !
 
কূপিত হলেন মহারাজাততোধিক কূপিত হয়ে প্রস্তরখণ্ডটিকে সমুদ্রবক্ষে ছুঁড়ে দিলেন ধীবরও 
 
অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হলেন এলাকারই জনৈক ব্রাহ্মণসমুদ্রে নেমে উদ্ধার করে আনলেন প্রস্তরীভূত দেবীকেস্বপ্নমোতাবেক তাঁকে ‘থাপনা’ করলেন সেই জায়গায়, পরবর্তীকালে যে জায়গার নামই হবে ‘বাশুলীর চক’। 
 
বাশুলীর চক, বাশুলীর চক। 
 
ধীবরের ধন হাতছাড়া হয়ে গেল কীনা ব্র্রাহ্মণের কাছে ! তদুপরি মহিষা- দল রাজরানি দেবীর নিত্য পূজার্চনা ও ভোগদ্রব্যাদির জন্য দান-খয়রাতও  করে দিলেন এক সুবিস্তৃত নিষ্করভূমি 
 
কালক্রমে সতের শো পঁয়ষট্টিতে দেওয়ানি সনদ পেল ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীআর রাতারাতি জায়গাটা হয়ে দাঁড়াল নুন তৈরি ও ব্যবসার পটভূমি 
 
দারোগা, হাবিলদার, চৌকিদার, জেলাদার, আদলদার, সেপাই-শান্ত্রী, দেশী বিদেশী কতরকম বেতনভূক কর্মচারীতাঁদের উপস্থিতিতে গম গম করতে লাগল ‘বাশুলীর চক’। 
 
তাঁদেরই কেউ কেউ তন্ত্রে মন্ত্রে বিশ্বাসী বজ্রযানী-সহজযানীরা মদ-মাংসে পূজা দিতে লাগলেন বাশুলীকেএ দেবী তো তাঁদেরই – ‘বাচ্ছলী’ বলে ‘চর্যাপদ’-এ এক দেবী ছিলেন না ?
 
উপরন্তু তাঁদের সঙ্গে এসে জুটলেন  সাগর-সঙ্গম-ফেরত তীর্থযাত্রীরানাঙা সন্ন্যাসী আর কাপালিকরাও‘বাচ্ছলী’-ই বাশুলী কোথাও কোথাও বা  তিনি  বিশালাক্ষী 
 
তাছাড়া পদাবলীর কবি  দ্বিজচণ্ডীদাস তো শালতোড়া গ্রামে এক জ্যান্ত ‘ডাকিনী’ বাশুলীকেও দেখেছিলেন !
 
আসলে এই ডাকিনীও এক যোগসিদ্ধা ব্রাহ্মণী, ব্রাহ্মণকন্যা তিনি ‘বাসুলী’ বা ‘নিত্যা’ নামের এক দেবীর সেবিকাভক্তরা তাঁকেও ‘বাসুলী’ বলত –
 
                     “ শালতোড়া গ্রাম   অতি পীঠস্থান 

                             নিত্যের আলয় যথা 

                       ডাকিনী বাসুলী   নিত্যা সহচরী 

                             বসতি করয়ে তথা ।।”
 
কথিত আছে যে, এই ‘ডাকিনী বাসুলী’-ই দ্বিজ চণ্ডীদাসকে বলেছিলেন – ‘বিশাললোচনী বাসুলী ওরফে বিশালাক্ষী প্রত্যেকদিন প্রত্যেক মুহূর্তে তন্ত্রমন্ত্র-সংস্কৃত শ্লোক শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন 
 
তাই দেবীর ইচ্ছা – তুমি তাঁকে প্রেমরসের গীত শোনাও’ –
 
                  “ চণ্ডীদাস কহে   সে এক বাসুলী 

                         প্রেম প্রচারের গুরু 

                   তাহার চাপড়ে  নিঁদ ভাঙ্গিল 

                         পীরিতি হইল শুরু ।। ”
 
আর বস্তুত  চণ্ডীদাস নিজেও তো তন্ত্রযানী এক সহজিয়া সাধক দেবী ‘বাসুলী’-র একান্ত সেবক 
 
তবে ওই যে – ধীবরের ধন হাতছাড়া হয়ে গেল কীনা ব্র্রাহ্মণের কাছেতবু তবু, মূলতঃ বনজঙ্গলজীবী ও সমুদ্র-উপকূলবর্তী মৎস্যজীবীদের হাতেই ‘বাশুলী’ বেশি বেশি পূজা পান 
 
কোথাও কোথাও তিনি ঘোড়ামুখীকোথাও মনুষ্যরূপীকোথাও বা শুধুই মুণ্ডুধারীআর কোথাও কেবলমাত্র পাথরের ঢেলা –
 
দু নম্বর পুঁথিটাও নেড়ে চেড়ে দেখছি‘প্রতিজ্ঞা’ আর কি – পুরোহিতের সন্তান কেন পুরোহিত হচ্ছে না তজ্জনিত আক্ষেপ ও সেহেতু ‘একরারনামা’ করা –
 
               “… বিশেষতঃ পল্লীগ্রামবাসীদিগের বিস্তর হিতসাধন,

               প্রতি গ্রামে ধর্ম্মশাস্ত্রাধ্যাপক স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য নাই, হঠাৎ 

               কোন ব্যবস্থার প্রয়োজন হইলে পণ্ডিতের অণ্বেষণ করিতে 

               গ্রামান্তরে যাইতে হয়, যদি নিকটস্থ গ্রামে পণ্ডিতের সাক্ষাৎ 

               না হয়, তবে সহসা তৎকর্ম্ম পণ্ড হইবার সম্ভাবনা এবং 

               এরূপ অনেক গ্রামে অনেক কর্ম্মও পণ্ড হইয়া গিয়াছে, 

               সুতরাং…

                  অনুভব করি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তানেরা এই পুঁথি-

               প্রসাদে অনেক তৈলবট দিয়া পুঁথিখানিকে আত্মসাৎ করিয়া 

               রাখিলে বিস্তর উপকার দর্শিবে…”
 
‘ব্যবস্থাসর্বস্ব’ -এর ব্যবস্থাই বা কি ?  – প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা, অশৌচ ব্যবস্থা, তিথিকৃত্য ব্যবস্থা, দায়ভাগ ব্যবস্থা –
 
        ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

     আর ‘তৈলবট’ ?
 
এক্ষণে ফের শ্রীশ্রীহরিচরণ শর্ম্মা বিরচিত  ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর শরণ নিতে হয়  “ তৈলবট  বি ব্যবস্থাপত্রের মূল্যস্বরূপ স্মার্ত্ত পণ্ডিতের প্রাপ্য অর্থ [ পূর্ব্বে ব্যবস্থার মূল্যস্বরূপ তৈল ও বট( কড়ি ) দেওয়ার নিময় ছিল; সেইহেতু ‘তৈলবট’]
 
তারমানে তেল-কড়ি ফেলো কড়ি মাখো তেল – সেই আর কি ! তদুপরি ‘ব্যবস্থাসর্বস্ব’-এর সূচিপত্রে কতকক্ষেত্রে  ‘ভেরি ভেরি ইমপ্যরটেন্ট-এর মতো দাগা বুলানো এই যেমন –
 
৴মুণ্ডন ব্যবস্থা ৴যজ্ঞোপবীতচ্ছেদন প্রায়শ্চিত্তং ৴৴৴ বিদ্যাপুস্তক চৌর্য্য জন্য মূকরোগ প্রায়শ্চিত্তং –
 
তিন-তিনবার দাগা-বুলানো  “বিদ্যাপুস্তক চৌর্য্য জন্য মূকরোগ প্রায়শ্চিত্তং” বিষয়টি পাতা খুলে দেখতে ভারি কৌতূহল হল কেননা – এর-তার বইয়ে কতই তো লেখা দেখি – “ এই বই যে করিবেক চুরি “-
 
খুলে দেখলাম –
 
               “ যথা  ।   বিদ্যাপুস্তকহারী চ কিল মূকঃ প্রজায়তে  ।      

                        ন্যায়েতিহাসং দদাৎ স ব্রাহ্মণ্যায় সদক্ষিণং  ।  । 

              অস্যার্থঃ  ।  জন্মান্তরে বিদ্যাপুস্তক চৌর ব্যক্তির তৎপাপ 

                       চিহ্নরূপ মূক অর্থাৎ অস্পষ্ট বাক্য হয় তাহার 

                       প্রায়শ্চিত্ত ন্যায় কিম্বা ইতিহাস পুস্তক লেখাইয়া 

                       দক্ষিণার সহিত ব্রাহ্মণকে দান করিবে “
 
ভারি তো কঠিন প্রায়শ্চিত্ত-ব্যবস্থাপনা !! বই-চুরির পাপহেতু মূক হলে বা কথা বলায় আড়ষ্টতা দেখা দিলে আস্ত একটা ‘ন্যায়’ কী ‘ইতিহাস’ লিখিয়ে দক্ষিণাসহ ব্রাহ্মণকে দান করতে হবে !
 
পাছে বইচুরির পাপে পড়ে যাই  তাই পুঁথিদুটি লালশালুতে বেঁধে তড়িঘড়ি ফের যেমনকার তেমন বিছানার তলায় ঢুকিয়ে রাখলাম 
 
এতক্ষণে দরজা খুলে লোকটাও পুনরায় ঘরে ঢুকলতবে এবার সে  একলা নয়, সঙ্গে আরও একজন
 

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৬

ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৬


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!