- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ৯, ২০২৫
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৮

২২
কারামুক্তি হলো দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ন সুক ইয়লের । শনিবার সিওলের আদালত তাকে মুক্তি দিয়েছে । যদিও সেদেশে মার্শাল আইন লাগু করা নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা চলবে বলে জানিয়েছে সদেশের আদালত তাঁর বিরুদ্ধে ও দুজনেই ‘হেলমেট’ তথা মাথার খুলি খুলে প্রথমেই তো ছুঁড়ে ফেলল বিছানায় । আমার চোখের সামনে এখন দু-দুটো মাথা-মুণ্ডুহীন মানুষ !
দু-দুটোই বা বলি কেন, এতক্ষণে ধারণা বদ্ধমূল হল যে, এই ভগ্নপ্রায় গৃহটির সমস্ত আবাসিকেরই মাথার খুলি ছিপি-আঁটা । যখন খুশি খোলা-পরা যায় ।
দ্বিতীয় লোকটির পরনেও গেরুয়া ‘চীবর’ । তবে ঠিক ‘চীবর’ কীনা জানি না – অনেকটা আমাদের ‘উড়া’ বা গাজনের ‘ভক্তা’-দের গেরুয়া-ছোপানো পোশাকের মতো ।
যা তারা উৎসবের আগে প্রায় মাসাধিক কাল ‘হাঁকড়’-এর সময়ে ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে পরে থাকে । দু নম্বর লোকটা তুলনায় কিঞ্চিৎ ছোটই । বয়ঃক্রম বড়- জোর পঁচিশ-টচিশ । বোধকরি সহকারী পুরুত-টুরুত হবেন ।
আমি গবাক্ষে দাঁড়িয়ে ফের পুষ্করিণীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম । অন্ধকারে ওই শুধু আলোর ফোকাস ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু অগত্যা অনন্যোপায় হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
লোকদুটি আমার উপস্থিতিকে আদৌ গ্রাহ্য না করে নিজেদের ভিতর কথা- বার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল । কী কথা, ব্যাঙের মাথা – উৎকর্ণ হয়ে শুনছি –
কী বললি ? বাড়চুনফলি ?
আদি নিবাস ?
হঁ, আইজ্ঞা ।
কোন পরগণা ?
সুজামুঠা ।
জুনপুটের সন্নিকটে কী ?
বড়জোর তিন পোয়া-তিনক্রোশ, আইজ্ঞা ।
বৃত্তি ?
মৎস্যজীবি, আইঙা ।
জানি, জানি । বাঁশের খুঁটায় কুলজানের বেড় দিয়ে মাছধরা–
হঁ, আইজ্ঞা । হুড়মুড় করে মাছ নিয়ে জোয়ারের জল ঢুকে আসে । আর –
জানি, জানি । ভাঁটার জল সরলেই ‘কতুগ্গা’ ‘কতুগ্গা’ মাছ !
কী বললেন ? ‘কতুগ্গা’ মাছ ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ । কত কত মাছ ।
তারমানে আপনিও কী সুজামুঠা ?
না না । বালিসীতা-পাঁচখালি। নরঘাট থেকে আধাক্রোশ ।
নরঘাট !! বলেন কী আঁইজ্ঞা ?
হুঁ, সেই ‘নরের হাট’ । হলদি নদীর ধারে । এককালে যেখানে নর ও নারী ক্রয়-বিক্রয়ের হাট বসত ।
বলেন কী আইজ্ঞা ?
তবে আর বলছি কী ! মগ, মগের মুল্লূকের নাম শোনা আছে ?
হঁ, আইজ্ঞা ।
কাউখালি, হলদি, হুগলি, রূপনারায়ণ – ওই সমস্ত নদী দিয়েই ওই মগ জলদস্যুরা হানা দিত । সাধে কি আর নদীগুলোর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ডাকাতে নদী’ ।
আইজ্ঞা ।
সেই সময়টায় নদীধারে, নদীঘাটে গা ধুতে, মাছ ধরতে আসা মাইয়া- মাইপোদের দেখতে পেলেই ছেঁকে তুলত নৌকায় । চালান করে দিত মগরাজ- পুরে ।
বলেন কী আইজ্ঞা ?
শুধু কি মগ-হার্মাদরা , ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লবণ-কর্মচারীরাও মহিলা- দের জোরজবরদস্তি করে গোরাসন্তান ধারণে যেমনখুশি ব্যবহার করত । গোরা- বাচ্চা নিয়েই তো খেজুরীর ‘সাহেবনগর’।
কুনোরকম কেউ বাধা দিত না আইজ্ঞা ?
দিত বৈকি । জমিদারদের লেঠেলবাহিনী ছিল– ‘সরবোলা’।নদীধারে বড় বড় গাছে লুকিয়ে থাকত তারা । হার্মাদদের নৌকা আসতে দেখলেই শাঁখে ফুঁ দিত । শঙ্খধ্বনি শুনেই মাইয়া-মাইপোরা লুকিয়ে পড়ত।
হঁ, আইজ্ঞা ।
তার উপর গুমগড় কী চক্রবেড়িয়া গড়ের জমিদারদের ছিল ‘রণতরী’। ওড়িয়া পুঁথিতে লেখা আছে –
‘ময়ূরপঙ্খী জলযান, গড়ন কৈলে পঞ্চখান।
ভাসায়ে তাকু গঙ্গাজলে, দমন কলে মগদলে ।।’
তাছাড়াও মগ তাড়াতে মোগল বাদশারা হেথা-হোথা হুগলি কী হলদি নদীধারে গড়, দুর্গও বানিয়েছিল ।
আর ওই যে বললেন ‘নরের হাট’ আইজ্ঞা ?
হুঁ, ‘নরের হাট’ । মগ-ফিরিঙ্গিরা বেছে বেছে শুধু যে মাইয়া-মাইপোদের ধরে নিয়ে নৌকায় তুলত, এমনটাও নয় । খেত-খামারে কাজে লাগা মুনিশ-মাহিন্দর, রাস্তায় ঘাটে হেঁটে-চলে বেড়ানো তাগড়াই জোয়ানদেরও টেনে-হিঁচড়ে নৌকায় চাপাত।
কেউ কুনোরকম টেণ্ডাই-মেণ্ডাই করত না, আইজ্ঞা ?
টেণ্ডাই-মেণ্ডাই ? তবে আর মগের মুল্লুক কাকে বলে? তখন তো পুরোদমে চলছে ক্রীতদাস প্রথা । কেনো আর বেচো হাটে-বাজারে । চালান করে দাও গোয়া কী সিংহলে । পর্তুগিজ-ওলন্দাজ বাজারে ।
মাঝরাস্তায় কেউ কেটে পড়ত না, আইজ্ঞা ?
পালাবে কী ? একে তো বন্দুকের নল । তার উপর হাতের তালু ফুটো করে দড়ি গলিয়ে নৌকায় বাঁধা । আর পালাবেই বা কেন ? পেটের দায়ে তো বিক্রি হয়ে গেছে তারা !
বলেন কী আইজ্ঞা ?
হুঁ, নদী-সেপার থেকে যাত্রী নিয়ে নাউড়িয়া যেমন এপারে নৌকার ‘ভরা’ নিয়ে আসে, তেমনি আসত নৌকায় করে ‘চালানী’ মাইয়া-মাইপোদের ‘ভরা’ । হাঁস-মুরগিদের মতো গাদাগাদি করে চালান হয়ে যেত হাটে –
কোথায়-কুনমা হাট বসত, আইজ্ঞা ?
কোথায় না, চারুবিটিয়া । তমলুক, আর ‘নরের হাটরু’ ত নরঘাট ।
আইজ্ঞা ।
চণ্ডীপুর, ভগবানপুর, ময়না, মহিষাদল, ঈশ্বরদহ জালপাই, মৈসালি জাল- পাই, চুনাখালি, তেরপেখ্যা, বাঘডোবা জালপাই, টেংরাখালি, ২য় খণ্ড জালপাই, বাশুলীচক, শ্রীপতিগঞ্জ, হোড়খালি, খাগদা জালপাই – এসব গ্রামের নাম শোনা আছে ?
কিছি কিছি, আইজ্ঞা ।
গ্রাম-কে-গ্রাম – সে তাম্রলিপ্ত পরগণাই হোক আর বালিসীতাই হোক – প্রায় সব তো হালিক আর জালিক কৈবর্তদের বসবাস । হাল আর জাল নিয়েই কারবার ।
মশায়ের পূর্ব-পেশা, আইজ্ঞা ?
যথা পূর্বং তথা পরং । আগেও যা এখনও তাই । শ্রীশ্রী ৺বাশুলীদেবীর পূজাপাঠ ।
অনুমান হয় আইজ্ঞা, জাতি -?
কৈবর্ত ।
হঁ গ, বলুন না ! আমহর বি ‘জালি খাদাল’, কেঁওট আইজ্ঞা । ছোট মুখে বড় কথা – একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
বল না । কী কথা ?
আমাদের জাতটার নাকি কোনও পুরোহিত ছিল না । বাঙলার রাজা বল্লাল সেনই এক হাড়ির গলায় পৈতা দি করি তাকু আমারমেনকার পুরোহিত করথান ?
যতসব আফুয়া কথা । হাড়ি-মুচি-ডোম জানি না – তবে জানি বল্লাল সেনই যে আমাদের ‘জাত’-এ তুলেছিলেন – সেটা কতক কতক জানা আছে ।
আইজ্ঞা, বলুন না !
তবে শুন্ । জানিস তো বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেন। বিবাহের পরে পরেই রাজকার্যাদিহেতু তাঁকে থাকতে হত দূর বিদেশে। সূর্যদ্বীপের সূর্যনগরে । এদিকে বিরহকাতর পুত্রবধূ পত্র লিখলেন স্বামী লক্ষ্মণকে ।
হঁ, আইজ্ঞা ।
সে পত্রে বিরহের কথা লিখিতং ছিল –
‘পতত বিরতঃ বারি নৃত্যান্তি শিথিনো মুদা ।
অদ্যকান্তঃ কৃতাস্তোবা দুঃখ শান্তি করিষ্যতি ।।’
তা বাদে, আইজ্ঞা ?
পড়বি তো পড়, সে পত্র পড়ল গিয়ে বল্লাল সেনের হাতে । পত্র পড়ে শ্বশুর বল্লাল সেন বুঝতে পারলেন পুত্রবধূর অন্তরবেদনার কথা । তৎক্ষণাৎ রাজা ঘোষণা করলেন –
কী আইজ্ঞা ?
সূর্যাস্তের আগে যে বা যারা লক্ষ্মণকে সূর্যদ্বীপ থেকে সত্বর নিয়ে আসতে পারবে – তাকে বা তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন ।
কী পুরস্কার, আইজ্ঞা ? অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা ?
না না । শুন্ না ! ঘোষণা শোনামাত্রই জালিক কৈবর্তরা তো ‘পাটিয়া’ ‘ভাউলিয়া’ নিয়ে শুরু করে দিল ‘নাউ-দৌড়ানি’ ।
হঁ,আইজ্ঞা । বাইচ প্রতিযোগিতা । ‘ভাউলিয়া’ আর ‘পাটিয়া’ বাইতে বাইতে সৌউ ‘দেওয়ান-ভাবনা’ পালার গানটা গাইথিলান কী ? –
‘উড়িয়া যাও রে বনের পাংখী
খবর দিও তারে ।
তোমার সুনাই লইয়া যায়
দেওয়ান ভাবনার ঘরে ।।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ । গান তো হচ্ছিলই । উপরন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই ধীবর- জালুয়ারা মহা আনন্দে সূর্যদ্বীপ থেকে পাল তোলা ‘পাটিয়া’ কী ‘ভাউলিয়া’-য় ‘নাউ-দৌড়ানি’ খেলে লক্ষ্মণকে এনে দিল তাঁর বউয়ের কাছে, বল্লালের কাছে ।
তা’পরে আইজ্ঞা ?
রাজা বল্লাল সেন মহাখুশি । দিলেন তো দিলেন, তাবৎ সূর্যদ্বীপটাই দান করে দিলেন ধীবরদের । আর জাতটাকেও তুলে দিলেন উপরে–
শুধু কী সূর্যদ্বীপ, তমলুক-বালিসীতা-তুর্কা-সুজামুঠা-কুতুবপুরও তো আমাদেরই ছিল, আইজ্ঞা ?
ছিল মানে, এসব রাজ্যের রাজা ও রাজপুরোহিত তো আমরাই ! তাছাড়া কেন্দ্রভূমি তো আমাদের। কৈবর্ত বীর ‘দিব্বোক’ তস্য ভ্রাতা ‘রুদোক’ তস্য পুত্র ‘ভীম’ সবাই তো বরেন্দ্রভূমের রাজা । তমলুকের ময়ূরধ্বজ বংশ, ময়নাগড়ের বাহুবলীন্দ্র বংশ, তুর্কাগড়ের গজেন্দ্র মহাপাত্র বংশের বংশধররা তো এখনও আছেন ।
আপুন কুন দিয়ার পূজারি রহিথান ?
বাশুলীচকের নাম তো জানা আছে বললি – সেই চকের শ্রীশ্রী৺বাশুলীদেবী মন্দিরের ।
নাম আইজ্ঞা ?
শ্রীযুত বুদ্ধেশ্বর লায়া । ‘নম্বর দেবী ভগবতী নৃমুণ্ডমালিনী । কুমতিনাশিনী সুখসমৃদ্ধিদায়িনী ।’
নমঃ শ্রীশ্রী৺বাশুলীয়ৈ নমঃ ।
নমঃ আইজ্ঞা !
তোর নামটা তো বললি না ?
আইজ্ঞা, লম্বোদর দলাই । মোকাম বাড়চুনফলি ।
দলাই, এতক্ষণে কী বুঝলি?
আইজ্ঞা, যা বুঝার । আসলে কৈবর্ত জাতটা বীরের জাত ।
শুধু কী বীরের জাত ! নৌকা বানাতে ও চালাতেও ওস্তাদ । রামায়ণের এক জায়গায় আছে –
‘নাবাং শতানাং পঞ্চানাং কৈবর্তানাংশতংশতম্ ।
সন্নদ্ধানাং তথা য়ূনাং তিষ্ঠত্বিত্যভ্যচোদয়ৎ ।।’
হঁ, আইজ্ঞা ।
যন্ত্রের নৌকা বা কলের জাহাজ বানাবার কথা তো মহাভারতেও আছে –
‘সর্ববাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিনীম্ ।
শিবে ভাগীরথীতীরে নরৈবির্ব্বশ্রম্ভিভিঃ কৃতাম ।।’
ভারি খটোমটো, আইজ্ঞা।
আরে না । শুন না ! পাণ্ডবরা বারণাবত নগর থেকে বনে এলেন । মা- কুন্তীসহ গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়ে পারাপারের জন্য নদীর জল মাপছেন পাণ্ডবরা ।
হঁ, আইজ্ঞা।
তখনই নৌকাটা এল । মনোমারুতগামিনী যন্ত্রপতাকাশালিনী ( যন্ত্রচালিত ও পালযুক্ত ) বাতসহা নৌকা । হাতজোড় করে ধীবর লোকটি জানাল –
‘হে মহানুভব ! সর্ব্বার্থবেত্তা মহাত্মা বিদুর আপনাদিগকে কহিয়া দিয়াছেন যে, ‘তোমরা কর্ণ, ভ্রাতৃগণসমবেত দুর্য্যোধন ও শকুনিকে সংগ্রামে পরাজিত করিবে ।’
হে মহাত্মন্ ! এই তরঙ্গসহা সুখগামিনী তরণী উপস্থিত, ইহার দ্বারা আপনারা নিঃসন্দেহে এইসমস্ত দেশ অতিক্রম করিতে পারিবেন ।’
বলেন কী আইজ্ঞা ? মহাভারতের যুগেও যন্ত্রচালিত ট্রলার ভুটভুটি ?
ছিল বৈকি । এই তো শুনলি মহর্ষি বেদব্যাসের স্বহস্ত লিখিত শ্লোক- ‘ সর্ব-বাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং ।’ আরও কী যেন জানতে চাইছিলি, দলাই ?
কালকের পাঠকক্ষের পাঠক্রমটা, আইজ্ঞা।
ও হো, সোউ যে –
‘দী কনস্ট্রাকশন অব্ দী শিপ্ মাস্ট বী সাচ্ দ্যাট্ হার জেনরল্ স্ট্রাকচারাল স্ট্রেংথ উইল বি স্যাফিসিয়েন্ট ফর দী ফ্রী বোর্ডস্ টু বি অ্যাসাইন্ড। দী ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অব দী শিপ মাস্ট বী সাচ্ দ্যাট্ হার স্ট্যাবিলিটি ইন্ অল্ প্রোব্যাবল্ লোডিং কনডিশন ইজ স্যাফিসিয়েন্ট ফর দী ফ্রী বোর্ডস্ অ্যাসাইন্ড।’
কিছি কী বুঝা গেলা, দলাই ?
হঁ, আইজ্ঞা । যেমতি কলকাতার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের হাওড়া- শালিখার ‘ক্যালিডনিয়ন ডক-ইয়ার্ড’-এর ‘নক্সা জাহাজ’ । আমানকার পাটিয়া, ভড়, ভাউলিয়া, ট্রলারনু উঁচা…
২৩
লোকদুটি দরজা হাট করে খুলে রেখে কথা কইতে কইতেই স্থানান্তরে অন্তর্হিত হল । আর আমি অগাধ বিস্ময়ে তাদের যাত্রাপথের দিকে বেবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবছি –
এরা কারা ? কারা ? দেখতে তো বড়জোর আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম বড়োডাঙা কী চঁদরপুরের ‘হাটুয়া’ জনমানুষ নাউড়িয়া মনাবধুক নচেৎ আখের গুড় প্রস্তুতকারক গুড়িয়া সরো বেহারার মতো।
কিন্তু তুখোড় মুখে যে রোহিণী চৌধুরানী রুক্মিণীদেবী হাইস্কুলের দোর্দণ্ড প্রতাপ হেডমাস্টার শ্রীউমেশচন্দ্র দে, ট্রিপল্ এম. এ মহাশয়ের মতোই ‘বোম্বাস্টিক’ ইংরাজি বলে !
কখনও সংস্কৃত –
কখনও কবিচন্দ্র মুকুন্দ মিশ্র বিরচিত ‘বাশুলীমঙ্গল’ গীত আউড়ায় । আবার কখনও নেহাতই ‘হাটুয়া’ ভাষায় জাহাজ তৈরির ফর্মূলা শোনায়।
এবম্বিধ কাণ্ডকারখানা ও কেরামতি দেখাতে দেখাতে কখন যে হুট করে মাথার খুলিটাও খুলে ফেলল ! ফের ক মিনিট বাদে ইচ্ছামতো খাপে-খাপ লটকেও নিল ।
কোনও অসুবিধাই হল না ।
তা নাহয় হল । তাবলে এই পোড়োগৃহেই বা কেন ? আগামীকালের পাঠ-কক্ষের ‘পাঠ’-টাই বা কী ?
দেখে শুনে মনে তো হয় – জাহাজ তৈরি বা মেরামতির কোনও কার- খানা বা কামারশালা আছে এখানে । বিশেষ করে কলকাতার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের হাওড়া-শালিখার ‘ক্যালিডনিয়ন ডক-ইয়ার্ড’-এর ‘নক্সা জাহাজ’- এর কথা যখন তুলল ।
বলাই বাহুল্য, দেখতে এদের আদার বেপারী মনে হলেও আদতে বুঝি জাহাজের কারবারীই বটে।
তারউপর বল্লাল সেন-লক্ষ্মণ সেনের ইতিহাসও তাদের স্মরণে আছে দেখছি।
জাহাজ তৈরির ফর্মূলা কোন বই থেকে ‘কোট’ করছে -তা ধরতে না পারলেও, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘পদার্থ বিজ্ঞান’ পড়া থাকায় “ জাহাজ জলে ভাসে কেন’ – তার কলকব্জা আমারও যৎকিঞ্চিৎ জানা বৈকি।
সেই তো একই ব্যাপার –
একটুকরো লোহা জলে পড়লেই ডুবে যায় ।
অথচ লোহার তৈরি অতবড় জাহাজ ডোবে না কেন ?
এখানেও আর্কিমিডিসের সেই একই ভাসন-নীতি ।
‘কোনও বস্তুকে স্থির তরলে আংশিক অথবা পূর্ণ নিমজ্জিত
রাখিলে ঐ বস্তুর ওজনের আপাত হ্রাস হয় এবং এই হ্রাস
বস্তুটি যে আয়তনের তরল স্থানচ্যুত করে তাহার ওজনের
সমান ।’
জাহাজ জলে ভাসার কারণও তাই, তাই ।
জাহাজের তলদেশ কড়াইয়ের মতো চ্যাপ্টা । সে কারণে যথেষ্ট পরিমাণ জলও অপসারণ করতে পারে । সেই অপসারিত জলের পরিমাণ জাহাজের ওজনের সমান ।
জাহাজ তাই জলে ভাসে, ডোবে না ।
ধরা যাক, কোনও জাহাজ যদি ৮০,০০০ কিগ্রা জল অপসারণ করতে পারে, তবে নিজের ভর, মালপত্র ও প্যাসেঞ্জার সহ ৮০,০০০ কিগ্রা ওজনের জাহাজও জলে ভাসতে পারবে ।
প্রশ্ন আসে – [ ১ ] নদীজলে সাঁতার কাটার চাইতে
সমুদ্রজলে সাঁতার কাটা সহজ কেন? [ ২ ] সমুদ্রজল
হইতে নদীজলে আসিলে জাহাজ ডোবে কেন ?
সেটাও আবার নির্ভর করে জলের ঘনত্বের উপর । সমুদ্রের লবণাক্ত জলের ঘনত্বের চেয়ে নদীর পরিষ্কার জলের ঘনত্ব কম । তাই প্লবতাও কম ।
সেহেতু নদীজলে জাহাজের বেশি অংশটাই ডুবে যায় । তারউপর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নদী কি সমুদ্র হলে তো কথাই নেই । নদীর খাঁড়িতে ঢুকেও জাহাজডুবি ঘটে ।
যেমনটা ঘটেছিল আমাদেরই গ্রামের অনতিদূরে অবস্থিত থুরিয়ার মহিষাসুর ‘দঁক’-এ ।
ওই যে ‘তপোসা’ আর ‘পালেকাথ’ নামের দুই ওড়িয়া সওদাগরের জাহাজ ‘আদজেত্তা’ বন্দর থেকে ‘সুয়োমা’ অর্থাৎ ‘সুহ্ম’ দেশে যাবার পথে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রের জোয়ার ও বাত্যাতাড়িত হয়ে ঢুকে পড়েছিল সুবর্ণ- রেখার খাঁড়িতে । শুধু ঢুকে পড়াই নয়, আছড়ে ভেঙে পড়েছিল আমাদেরই গ্রামের মহিষাসুর ‘দঁক’-এ ।
সেই তো ডুবে গেল । অচেনা অজানা বীজদানা, নাকি আরও কীসব নিয়ে মাটি চাপা পড়ল । ‘বালিপোত’ হল ।
তারপর তো তার উপর নানাবিধ গাছ জন্মালো । অর্জুন, পাকুড়, শাল, মহুল, ডুমুর, শিমুল নয় – অজানা অচেনা সব বীরুৎ বৃক্ষ !
সেই থেকে ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে, ফিন-ফোটা-জ্যোৎস্নাধারায়, এমন কী নিকষকালো অন্ধকারেও দিন-ক্ষণ-মুহূর্ত দেখে ঝলসে উঠতে লাগল – উঠতে লাগল কী, এখনও ঝলসে ওঠে ভেঙে পড়া ডুবে যাওয়া সেই জাহাজের কানা !
সেই বলে না —
‘কে দেখেছে ? কে দেখেছে ?’
‘দাদা দেখেছে । দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে ।’
দাদা-দিদি কীনা জানি না -যেই দেখেছে সেই নাকি উন্মাদ ও বিবাগী হয়ে দেশান্তরী হয়েছে ।
তবে এখন আর স-সাগরা সে সুবর্ণরেখাও নেই, সুবর্ণরেখায় সে জোয়ারও আসে না, সে ভাটাও পড়ে না । জাহাজই বা কোথায় ?
আছে তো বড়জোর কটা ডোঙা-ডুঙি ভেলা-ভেউরি পাটিয়া-পানসী। তাও তো শীত পড়তে না পড়তেই নদীর জল একহাঁটু !
তখন নাউড়িয়া মনা বধুকের নৌকা, জালুয়া ঝাড়েশ্বর কী মাধব পানীর মাছ মারার পাটা, গুড়ের কারবারি সরো বেহারার পাটিয়া, পানসী, ভাউলিয়া, ডোঙাডুঙি, বাছাড়ি, জালিবোট – সব, সব তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে নদীর বালিতে । হয় মেরামতি কাজের জন্য নয় রং মাখাতে ।
কোথাও রুদ্ধ দ্বার, কোথাও বা অবারিত । দীপাধারে আলো জ্বলছে, কোথাও বা নির্বাপিত । কিন্তু বুদ্ধেশ্বর লায়া আর লম্বোদর দলাইয়ের মতো মাথামুণ্ডহীন লোকজন তো আর দুটি দেখি না ।
বুদ্ধেশ্বর লায়া, লম্বোদর দলাই – না জানি এরা কারা ? কোন দিয়া বা দিগরের ? বলল তো বাশুলীর চক, বাড়চুনফলির !
বোধকরি এদের ‘দ্বিজত্ব প্রাপ্তি’ বা শুদ্ধিকরণও ঘটে গিয়েছে, আমার এখনও সেসব ঘটেনি । তাই হয় তো এরা আমাকে চিনতে পারছে না, বা চিনেও না চেনার ভান করছে ।
কোনও রকম কথাই কেউ আমাকে বলছে না । অথচ নিজেদের ভিতর- খুলি থাকল কী থাকল না – কোনও কিছুতেই কথা তাদের আটকাচ্ছে না । অনর্গল তো বকেই চলেছে !
হালচাল, কথাবার্তা শুনে এতক্ষণে বোধগম্য হতে কিছু বাকি নেই আমার – নির্ঘাত কোনও জরুরি কাজে নিযুক্ত আছে তারা ।
কোনও ঠিকাদার তাদের ধরে এনে নিযুক্ত করেছে । আর কাজটাও কঠিনস্য কঠিন বটে । যার দরুন ‘পাঠ’ নিতে হচ্ছে নিয়মিত । বুঝতে অসুবিধা নেই – সে ‘পাঠ’ অবশ্যই জাহাজ তৈরি বা মেরামতি সংক্রান্ত ।
আগামীকাল সকালের পাঠকক্ষের পাঠ্যসূচির বহর দেখে তো ওইরকমই বোধ হচ্ছে । ‘The construction of the ship must be such that her general structural strength –’
কিন্তু কল-কারখানার কুলি-কামিনদের বস্তি, শিক্ষানবীশীদের ‘সেল’, শ্রমিকদের কোয়ার্টার ‘খিলান ধাওড়া’, হাজারীবাবু-লোডিংবাবু-তংখাবাবুদের হাতায় বা খাতায় তো আর এক-দুজন থাকে না, থাকে তো বুদ্ধদেব লায়া, লম্বোদর দলাইয়ের মতো আরও আরও একশো, দুশো –
হাট-খোলা দরজা দিয়ে বিনা বাধায় তো নিষ্ক্রান্ত হলাম – ঘুরে বেড়িয়ে দেখিই না এই পোড়োবাড়িটার আনাচে কানাচে বুদ্ধেশ্বর-লম্বোদরদের মতো আর কেউ কোথাও আছে কীনা ?
কুহররত পায়রা-পারাবত বাদুড়-চর্মচটিকার ভদভদানি তো শুনেছি একবার নয় একাধিকবার !
নিষ্ক্রান্ত হওয়া মাত্রই একরাশ খোলামেলা হাওয়া যেন আমাকে সমাদরে গ্রহণ করল । দরজাটাও খোলা থাকল । পায়েও অদৃশ্য ঝিঁজরির টান আর তেমন অনুভূত হল না ।
এই রে ! মুক্তি কী তবে এসে গেল? এপাশ ওপাশ পা ছোঁড়াছুঁড়ি করেও দেখলাম বারকতক -কই? কেউ তো অদৃশ্য ঝিঁজরি ধরেও টানছে না আর ?
মুক্তি ! মুক্তি ! মুক্তি ! খানকতক পায়রা ভদভদিয়ে উড়ে এসে মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরতে লাগল । মুক্তির স্বাদ যেন তারাও পেয়ে গেছে আমারই মতো ।
একদিকে পায়রার ভদকানি, আরেক দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধুলামন্দির’ কবিতাটা আমার মুখে ‘শতজল ঝর্নার মতো উৎসারিত’ ও উচ্চারিত হতে লাগল ।
কাকে যে চেঁচিয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছি –
’ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পড়ে
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে !
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন-মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ্ দেখি তুই চেয়ে – দেবতা নাই ঘরে ।।
… … … …
মুক্তি ? ওরে, মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে !’ …
কক্ষ থেকে কক্ষান্তরের পাশ দিয়ে, যেমনটা অদৃশ্য ঝিঁজরি আমাকে টেনে এনেছিল সকালের দিকে, তারও চেয়ে জোরে, আরও জোরে দৌড়াচ্ছি ।
কোথাও রুদ্ধ দ্বার, কোথাও বা অবারিত । দীপাধারে আলো জ্বলছে, কোথাও বা নির্বাপিত । কিন্তু বুদ্ধেশ্বর লায়া আর লম্বোদর দলাইয়ের মতো মাথামুণ্ডহীন লোকজন তো আর দুটি দেখি না ।
অথচ কতই না কোলাহল-কলরব শুনছি –
-টিকে গুড়াখু দিবু ?
-কেনে, তোর ডিবার কী হেলা ?
-কঁঠে যে রাখনু ! মনে পড়েটেনি রে !
-হায় দ্যাক্ ! মোর ত আকবর গুড়াখু । মাজি পারবু ত ?
-ম’লা ! ‘ন দবু ধন, কহিবু দিব্যবচন’ ।
-আচ্ছা, নে তাইনে –
‘ছাই ছাড়,
গুড় কাড় ।
ছাই মোর হাতে
গু তোর দাঁতে ।’
এই রে ! এরা আবার কারা ? জোড়ায় জোড়ায় যেন বসে গেছে গুড়াখু-হাতে দাঁত মাজতে ঝিলের ধারে । এমনটা দেখেছি বটে আমাদের ইস্কুলহোস্টেলে, ডুলুং নদীর ধারে ।
ইস্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ল কী পড়ল না, বইখাতা হাতে হোস্টেলের বোর্ডাররা যে যার ঘরে পৌঁছাল কী পৌঁছাল না, তামাকের গন্ধে তো ভরে উঠল ডুলুঙের পাড় !
উঁহু, তামাক-তম্বাকু-তামুক-তামাকু কী আর, গুড়াখু – গুড়াখু , গুড়াখু । নামটাতেই কেমন একটা ওড়িয়া মাদকতা আছে ।
নাহলে বোর্ডাররা, শুধু কী বোর্ডাররা আশপাশের গ্রামের লোকেরাও ডানহাতের তর্জনীর ডগায় আফিমের গুলিসদৃশ গুড়াখুর মাজন বা মাঞ্জন লটকে নিয়ে বেলাবেলি এসে যায় ডুলুঙের তীরে ।
“কালিন্দীসলিলকান্তিকলেবর কৃতকুসুমাবলী বেশ !” অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে মুখ করে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে যায় সব সার সার ।
তারপর ক্রমান্বয়ে ডাহিনে ও বামে চালিত হতে থাকে, হতেই থাকে হতেই থাকে তাদের গুড়াখুরঞ্জিত আঙুল ।
গুড়াখুর গুলি ক্ষয়িত হতে থাকে, হতেই থাকে হতেই থাকে, তবু ভুলেও বেমক্কা আলটপকা খসে পড়ে না আফিমনন্দিত তর্জনীধৃত গুড়াখুর গুলি !
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয় । ঝপ্ করে রাত্রি নেমে আসে । কেউ কেউ তখনও বসে থাকে, বসেই থাকে ।
ইস্কুলহোস্টেলের বোর্ডাররা তো রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে গুড়াখু আঙুলে লটকে আবারও একবার এসে যায় নদীধারে ।
ডুলুঙনদী-সেপারে আখুবিলে তখন ফিঙা ডাকে, রট্ রট্ করে শিয়াল আখু ভাঙে ।
কিন্তু এই পোড়োগৃহের পুষ্করিণীর পাড়ে এখন জোড়ায় জোড়ায় বসে গুড়াখু হাতে নিয়ে কারাই বা ‘রাতালাপ’ সারছে ? কারা ? কারা ?
পুষ্করিণীর রাত্রিজলে তাদের ছায়া পড়েছে কী ? ছায়া ?
২৪
প্রত্যুষে, জল থেকে নিষ্ক্রমণের পরে, ডাঙায় উঠে মহেঞ্জোদাড়ীয় গো-শকটে চড়ে বাস্তুভিটা, মাঝেমধ্যে খিলক্ষেত্র অর্থাৎ কৃষিভূমি সমন্বিত এক বৃহদাকার গঞ্জের ভিতর দিয়ে যখন এই পোড়োগৃহে আনীত হলাম, তখন বলা বাহুল্য –
না এই গৃহে, না গঞ্জে, না রাস্তায় ঘাটে তো একটাও লোক দেখি না । তবে জলভ্রমি ডাঙার মানুষ, ঘরের মানুষ যে এইমাত্র জোটিকা বা খালের ঘাটে ডোঙাডুঙি পাটিয়া বেঁধে ঘরে ফিরল, তার পায়ের চাপে সদ্য বাঁধা ডোঙা-ডুঙি পাটিয়া যে যৎসামান্য এখনও নড়ছে, টলমল করছে – তা অবশ্যই টের পেয়েছিলাম ।
আম্রতলে, কানঠাড়ী ছায়ায় দড়ির খাটিয়া পেতে কেউ না কেউ নিদ্রা যাচ্ছিল, তৎক্ষণাৎ উঠে যাওয়ায় তার পেটে পিঠে দড়ির ছাপ নির্ঘাত লেগে থাকবে, যেন হাঁক দিলেই সে বাইরে আসবে আর তার দেহে দড়ির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে ।
রৌদ্রে, দড়িতে কী তারে, মেলে দেওয়া শাড়ি-সায়া-সেমিজ গামছা-লুঙ্গি এতক্ষণ দিব্য শুকোচ্ছিল, কে যেন টান মেরে এক ঝটকায় কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে, হ্যাঁচকা-টানে কাপড় শুকোবার তার যে তরঙ্গ তুলে কেঁপে কেঁপে উঠছে ঝনঝন করে, তখনও কাঁপছে, নাচছে, ওঠানামা করছে– তাও তো স্ব- চক্ষে দেখেছিলাম বটে।
আর –পুষ্করিণীর জলের ধারে কলমি-শুশনি লহ লহ করছে, জলপিপি উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে, কাদাখোঁচা “ চিক্ চিক্ চিকা-চিকা-চিকা রবে মুহুর্মুহু ডাকছে– এই পোড়োগৃহ বা সংঘারাম থেকেই তো কত পায়রা-পারাবত বাদুড় চর্মচটিকা ভদভদিয়ে ডানা ফেটিয়ে উড়ে গেল, আবারও ফিরে এল- সেসবও তো একসময় দেখেছি! এবার তো কী ঘরে কী বাইরে সশরীরে মানুষ দেখছি। মানুষ, মানুষ।
তবে কীনা মাথামুণ্ডহীন মানুষ । এখন যারা পুষ্করিণীর পাড়ে জোড়ায় জোড়ায় বসে গুড়াখু মাজছে, মাজতে মাজতে দিব্য কথা বলে চলেছে, কথা বলতে বলতে হয়তো ফের হেলমেটের মতো মুণ্ডুটা গলিয়ে নিচ্ছে ।
এখন দেখতে হবে পুষ্করিণীর রাত্রিজলে তাদের ছায়া পড়েছে কী না ! আচ্ছা, ছায়া দেখার কথা উঠল কেন? তবে কী তারা অশরীরী ? প্রেতাত্মা ?
প্রেতাত্মাদের ছায়া পড়ে না । ছায়া পড়ে না ডাইনীদেরও । মা-কাকিমারাই তো এবম্বিধ বলত ।
আমাদের গ্রাম বাছুরখোয়াড়ে যে কজন স্ত্রীলোক ‘ডাইনী’ বলে এপর্যন্ত বিবেচিত হয়ে আসছে, যেমন ধরো ফাটাদার বুড়ি –
মুখের চেহারা, শরীরের চেহারা – কুঁচকে মুচকে ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাওয়া, চোখদুটিও মার্বেল গুলি, বিড়ালাক্ষী, লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটা ।
দৈবাৎ পথিমধ্যে কোথাও দেখা হয়ে গেলে খনখনে গলায় আগ-বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করা, নচেৎ ফটাস করে থুতনি ধরে চুমু খাওয়া – “কী গো স্যাঙাৎ, কুন বাটিয়া যাবা ? ”
আমি থতমত খেয়ে বলি – ‘এই তো, একটু এদিকে’
পরক্ষণেই তার শরীরের ছায়া খুঁজি – ছায়া, ছায়া – হয়তো অপরাহ্ণ, পড়ন্ত বেলায় দীর্ঘ ছায়া পড়েছে তার । ছায়া পড়েছে তার লম্বা লাঠিটারও ।
দশরথের বউ । কতই বা বয়স তার ! বড়জোর ছোটকাকির সমান সমান । সুঠাম ও সুন্দর দেহ । মাগুর মাছের মতোই গায়ের রং । তেমনি খলবলি ।
লোকে তো বলে – সে নাকি ডাইনী ! যে সে ডাইনী নয়, পাক্কা ডাইনী । রাতভিত দশরথের অজান্তে সে নাকি ঘরের ‘বাহির’ হয়ে যায় ।
নাকি আর আর ডাইনীদের সঙ্গে বনধারে কী বনের ভিতরে ‘চরতে’ যায় । চরতে চরতে গরুছাগলরা যেমন ঘাস, বনের লতাপাতা খায়, ডাইনীরা খায় গু ।
গু, গু ।
দেহ উল্টে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে জিভে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে তারা উলঙ্গ হয়ে চরে । সেসময় কারও সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয় যদি তো সে মরে ।
রাত না পোহাতেই তার মরণ ! ডাইনী বা ডাইনীরা চেটেপুটে খেয়ে নেয় তার কলজেটা । এমন এমন যে দশরথের বউ সেও সময় সময় বড় আদর করে আমাকে ডাকে –
-“আয় ! আয় না রে ললিন !! গাছের আমটা, কলাটা খেয়ে যা !”
রৌদ্রে, পরনে নীল খুরদা শাড়ি, মাথায় একহাত রেখে আরেক হাত দিয়ে সে-হাতের আঙুলগুলো ধরা, খলা-খামারে দাঁড়িয়ে মনোহরণ ভঙ্গিতে সে ডাকে । ভারি লোভাতুর সে-ডাক !
ডাক শোনামাত্রই আমি তার শরীরের ছায়া খুঁজি – ছায়া , ছায়া – ‘ছায়া ঈশ্বরীর মতো’ । কোথাও পাই না । মধ্যাহ্ন-সূর্য যে তখন মাথার উপর ! ছায়াও ছোট হতে হতে মিশে গিয়েছে দেহে ।
ঘোরের মাথায় লোকে তখন কত কী ভাবে ! কত কী অনর্গল বকে যায় ! উৎকর্ণ হয়ে শুনছি, কে কী বলছে । যেমনটা শুনছিলাম বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দালাইয়ের কথোপকথনের মধ্যে ।
রাত্রে, এই পোড়োগৃহ কী সংঘারামের পশ্চাতে পুষ্করিণীর জলে তামাকু-মাঞ্জনকারী এই সমস্ত মাথামুণ্ডহীন লোকেদের ছায়া পড়েছে কী না –
তা সরেজমিনে দেখার জন্য নিজে নিজেই একটা সবিশেষ উদ্যোগও নিলাম । এধার ওধার ইতস্তত ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করছি—উঁহু, দেখা কী যায় !
জলাশয়ের আবদ্ধ জলে জ্যোৎস্নাধারায় মৃদুমন্দ সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হতে হতে তা যেন ভেঙেচুরে একশা হয়ে যাচ্ছে । আর নয়ত মাথামুণ্ডুহীনদের ছায়া বা ছায়াহীনতা অতদূর জলাশয়ের জলের তল পাচ্ছে না ।
অথচ পোড়ো বাড়িটার শতাধিক গবাক্ষ বাহিত দীপাধারের আলো তো ঠিক জল ছুঁয়ে ফেলছে !
ছায়ার হদিস পাই বা না পাই, কান পাতলাম গুড়াখু-মাঞ্জনকারীদের কথালাপ শুনতে – কে কী বলছে, কীসব বলাবলি করছে !
তারা যে ডুলুঙ নদীতীরবর্তী রোহিণী চৌধুরানী রুক্মিণীদেবী হাইইস্কুল হোস্টেলে বসবাসকারী ছাত্রদের মতোই পুষ্করিণীর তটে বসে গুড়াখু মাজছে – তারই বা খোঁজ পেলাম কী করে ?
আরে বাবা, একে তো ‘আকবর গুড়াখু’-র নাম শুনলাম, তার উপর তার গন্ধ । গন্ধে যে পুষ্করিণীর সারা পাড় ম ম করছে ! রোহিণী হাইস্কুল হোস্টেলের বোর্ডার হিসাবে আমিও যে কম-বেশি ভুক্তভোগী, ওইরকমই নেশাখোর ।
গন্ধ শুঁকেই বোধ হচ্ছে তর্জনীর ডগা তামাকু রঞ্জিত করে তাদের সঙ্গে আমিও বসে যাই ! তাদের দলে ভিড়ে আমিও কথায় কথায় রাজা-উজির মারি । যেমনটা আফিঙ্গখোর কমলাকান্ত ।
ক্লাস নাইন-টেনেই তো পড়েছি –
আমি শয়নগৃহে চারপায়ীর উপর বসিয়া, হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছিলাম । একটু মিট্
মিট্ করিয়া ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে-দেয়ালের উপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে । আহার
প্রস্তুত হয় নাই – এইজন্য হুঁকাহাতে, নিমীলিত লোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমি যদি
নেপোলিয়ান হইতাম, তবে ওয়াটার্লু জিতিতে পারিতাম কি না । এমত সময়ে একটি ক্ষুদ্র শব্দ
হইল, ‘ মেও !’
চাহিয়া দেখিলাম – হঠাৎ কিছু বুঝিতে পারিলাম না । প্রথমে মনে হইল, ওয়েলিংটন
হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হইয়া, আমার নিকট আফিঙ্গ ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে । প্রথম উদ্যমে,
পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম যে, ডিউকমহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার
দেওয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যাইতে পারে না । বিশেষ অপরিমিত
লোভ ভাল নহে । ডিউক বলিল, “ মেও ! ” তখন চক্ষু চাহিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম
যে, ওয়েলিংটন নহে । একটি ক্ষুদ্র মার্জার; প্রসন্ন আমার জন্য যে দুগ্ধ রাখিয়া গিয়াছিল, তাহা
নিঃশেষ করিয়া উদরসাৎ করিয়াছে, আমি তখন ওয়াটার্লুর মাঠে ব্যূহ-রচনায় ব্যস্ত, অত দেখি নাই ।
এক্ষণে মার্জারসুন্দরী, নির্জল দুগ্ধ পানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার
অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, ‘ মেও !’
দুটোই মাদক জাতীয় । নেশার দ্রব্য । একটা খাওয়ার, আরেকটা মাজার । গুড়াখু মাঞ্জনে দাঁত মাজতে মাজতেও একরকম নেশা হয়, মাথা ঘুরে যায় ।
ঘোরের মাথায় লোকে তখন কত কী ভাবে ! কত কী অনর্গল বকে যায় ! উৎকর্ণ হয়ে শুনছি, কে কী বলছে । যেমনটা শুনছিলাম বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দালাইয়ের কথোপকথনের মধ্যে ।
সার বুঝেছিলাম – তারা এই আশপাশের মানুষজন, আদার বেপারী হলেও জাহাজের কারবার করে ।
নচেৎ ‘কনস্ট্রাকশন অব্ দী শিপ্’ নিয়ে মাথা ঘামায়? অমন ইংরাজিতে চোখা চোখা কথা বলে ? তারপর এই তো গুঁড়াখু -আকবর গুড়াখু – নিয়ে ঘরের ধারের ‘হাটুয়া’ ভাষায় –
কী যেন, কী যেন বলল ? –
‘ছাই ছাড়
গুড় কাড় ।
ছাই মোর হাতে
গু তোর দাঁতে ।।’
এমনটা কত শুনেছি হাটুয়াদের গ্রাম বড়োডাঙার ছা-ছুয়াদের মুখে !
‘ওলো ওলো শাঁখা হাতি !
তোর কাঁখে পো না নাতি?
এঙ্কর বাপো যাঙ্কর শ্বশুর
তাঙ্কর বাপো আমর শ্বশুর ।’
তবে কী তারা ‘হাটুয়া গ্রাম’ বড়োডাঙা, চঁদরপুর, থুরিয়া, মলম, ঝরিয়া, কলমাপুখুরিয়া, লাউদহ, কালরুই, ঢেরাছাড়া কী কুলবনীর লোক?
নদীধারের লোক ? নদীর মানুষ ? ডিঙি-ডোঙা-পাটিয়া-ভেলা-ভেউরি-জালিবোট-লৌকা-পানসী, এমনকি জাহাজ নিয়েও তারা কারবার করে ?
বাশুলীচকের বুদ্ধদেব লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইয়ের কথা-বার্তায় তো এতক্ষণ কলকাতার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের হাওড়া-শালিখার ‘ক্যালিডনিয়ন ডক-ইয়ার্ড’-এর ‘নক্সা জাহাজ’-এর প্রসঙ্গও উঠে আসছিল !
পুষ্করিণীর পাড় থেকে গুড়াখুমাঞ্জনকারী একজোড়া এইমাত্তর উঠে এসে আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে, তাদের দুজনের একজন, পরিষ্কার চাঁদের আলোয় কী একটা পুস্তক পড়ছিল –
‘ভোর চারটে থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা প্রায় দুপুর আন্দাজ সাগরদ্বীপে এসে পৌঁছলাম । কিছুক্ষণ পরে একখানি পানসী নৌকা এল … বেলা দুটোর সময় আমরা সকলে মিলে পানসীতে করে কলকাতা অভি-মুখে যাত্রা করলাম । পানসীতে যেতে আমার আপত্তি ছিল, কারণ বাঙলাদেশের এই বিচিত্র নৌকাটি এমনভাবে তৈরি যে তারমধ্যে সোজা হয়ে বসা যায় না, অথবা রোদবৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় না । এমনকি পা ঝুলিয়ে একটু আরাম করে বসাও সম্ভব নয় । তবু পানসীর অভিনবত্বের জন্য এই অসুবিধাটুকু আমাদের সয়ে গেল। ছ-জন ‘কালা আদমী’ খুব জোরে জোরে দাঁড় বাইছিল, পানসীও চলছিল তর্ তর্ করে দুরন্ত বেগে।’
চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম – দুজন মাথামুণ্ডহীন মানুষ । তাদের মাথার খুলিগুলো হেলমেটের মতো হাতেই ধরা ।
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৭
❤ Support Us