Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মে ২৬, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৮

মানুষের কাছে ডাক্তার হিসাবে যে বিশ্বাসের আসন তৈরি করেছেন, তাকে ভাঙা গভর্নমেন্টি ফতোয়ার কম্ম নয়। কিন্তু আমরা, যারা পরের সময়ের চিকিৎসক, আমাদের জেনারেশনের আস্থা হারাব। সংকটটা আমাদের...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৮

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। কাদাকান্ড ।। 

মাঝুরাহে চন্দ্রাবলী

 
বোশেখ থেকে টানা ঘরবন্দী ছিলেন হেমশশী । রমার কড়া ধমকে । আজ মাধুকরীতে বেরোবেন, তার বড়ো ইচ্ছে । কতকিছু ঘটে গেল এই দীর্ঘ সময়টায় ।
 
বৈশাখের সে দিনে রমা হেমশশীর ঘরে ঢুকেছিল, কাঁকালে টিনভরা চাল, হাতে ধামিতে আনাজ, — রাইখা দিলাম ।
হেমশশী হাসলেন — বসো, বউমা । — রমাকে বসতেই হয় । — আমার দাদা কনে?
 
— পাশের ঘরের ভবর লগে খ্যালতাছে । ডাকুম?
 
— থাক । তোমার সাথিই কথা কব ।
 
— কও ।
 
— যা যা আনিছো, সব ঘরে নেয়ি যাও । পাক করো । আজ আমি আমার অন্নপুন্নের ভাত খাবো ।
 
রমা হঠাৎ স্তম্ভিত ! এ সে কী শুনছে ! বললো — মা, আমি যে অজাইত কুজাইতের মাইয়া । তোমার পুলাও যে…।
 
থামিয়ে দিলেন হেমশশী — তোমারে আগেও কয়িছি, জাতি বেজায়াতি তোমার শ্বশুর ঘোচায়ে দেছেন । তিনি কতেন, মানষির কোনও জাত হয়না । বানান কথা বানায়ে মানষির মাঝি ছড়ায়ে দেছে দুষ্টলোকে । মা, এই যে আমি পথি হাঁটি, পায়ের নিচি কত ধূলিকনে, ওগুলানের কোনও জাতি আছে ! আকাশের নিচি ভগবানের পায়ের তলায় মানষির কেন জাতি থাকবে ? এতদিন খাই নাই, কারণ ছেল । নিজিরি শোদ্ধ করার দরকার ছেল, মা ।
 
রমার ঘোর লাগছে । তার শ্বাশুড়ি কেমন যেন । যেন এ জগতসংসারের মানুষ না । চোখ উদ্ভাসিত করে সে হেমশশীকে দেখছে । বুকটা টনটন করে ওঠে, চোখের পাতা ভার হতে চায় । মনে হয় হেমশশীকে শীর্ণ দেখাচ্ছে, অঙ্গের গৌরাভাও যেন মলিন।
 
— একদিন শাউড়ির সিবা করার অধিকের চেয়িছেলে । সিবা কি ভিক্ষার জিনিস ! দখলের জিনিস, মা ! সিটা আপনে আপনে আসি হাজের হয় । জানো, মা, তোমার একখান ননদ ছেল । নাম সুনয়িনি । সে আমাগেরে ফাঁকি দিয়ি চলি গেল । তারে হারোইনি, বউমা । সে তোমার মাঝে ফিরি আসিছে ।
 
রমা ঠোঁট চেপে ধরেছে তখন । কাঁদবে না, কিছুতেই কাঁদবে না । বলে সে — আর নামে যাইতে দিমু না । তুমার আশীর্বাদে তুমার পুলায় তার মায়েরে দেখভাল ঠিকই করতে পারবো ।
 
— সি কি আমি জানিনে ! সাধন যে আমার পেট চেরি ছাবাল ছেল আগ জম্মে । আমারে অনেক বেশি কষ্ট দেছে ও । ও যে আমার বলরাম । তোমারে কলাম, নেত্যিদিন যাবো না । মাঝে মাঝে যাতি দিও । নয়লি পথির সাধনা থেকি দূরি পড়ি যাবো যে, মা । তিনি আমায় পথখান দেয়ে গেলেন যে । এইবারে আমারে দূরির টানে যাতি লাগবে, মা । এ পথিতে যে বাধা দিতি নাই ।
 

চারধারটা বদল হয়েছে । বাড়িতে নতুন রঙ । বোগেনভিলিয়া যেন উপরে পোক্ত ছাউনি বানিয়েছে । এখনও ফুল আসেনি । ঢোকার মুখে পাশে যে ছোট্ট বোর্ড ছিল, সেটা নেই । হেমশশী থতমত দাঁড়িয়ে রইলেন । কেষ্টঠাকুরেরা কি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন? এখানকার পাট চুকোলো?

 
রমা এবার সত্যই কেঁদে ফেলে । তার অতিতেজা মেজাজের গুহায় এমন মেঘভান্ডার ছিল, সে নিজেও বোধহয় জানতো না । বললো — মা, তোমার শরিলখান ভালো নাই । আমি কইতাছি । আমার চক্ষুরে ঠাইরাবা না । আইজই তোমারে ডাকতরের কাছে লইয়া যামু । এলুপেথিক ডাকতর । বিস্তর নামডাক । হাসপাতালের বড়ো ডাকতর । ইস্টিশনের সামনে ফারমিসি আছে । সেইখানে চ্যামবার ।
 
— ওষুধির দরকার নাই । বউমা, আমার কিছু হয়নাই গো । তোমার তেমন ইচ্ছি হলি হোমোপেথি ওষুধ আনি দিও কয়েক পুরে। তোমার ঠাকুর তো আমারে দেতেন । তেনার একখান ওষুধির বই ছেল । আসার সময় বইটারে তিনি আর পালেনই না । কুথায় যে হারায়ে গেল ! — হেমশশীর চোখ কালো হয়ে আসে ।
 
আঁচলে চোখ মুছে তেজ ফিরে পেল রমা — হুমিওপেথি ! খক কইরা কাশলাম । হ্যাচ্চো হাচি পড়লো । কাগজ থিকা ঔষধ উইড়া গেল । এয়া আবার ঔষধ ! রুগ তাড়াইবো ? কোনও কথা শুনতাছি না । আমার লগে যাইবা, সাফ কইয়া দিলাম । — রমা তম্বুলাদি নিয়ে দর্পিত পায়ে নিজের ঘরে ফিরলো ।
 
ট্রেনে উঠে পড়েছিলেন হেমশশী । গাড়ি একখান স্টেশনে এসে আর যায় না । সকল প্যাসেঞ্জার নেমে পড়লো । শেষে তাকেও নামতে হয় । ওমা এ যে চেনা স্টেশন ! গেটের টিকিটবাবুটি কিছু বললো না । তিনি পথে নামলেন । হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে…।
— কেষ্টঠাকুর ! কেষ্টঠাকুর ! তোমার দুয়েরে তোমার রাধেরানি আসিছে গো ।
 
চারধারটা বদল হয়েছে । বাড়িতে নতুন রঙ । বোগেনভিলিয়া যেন উপরে পোক্ত ছাউনি বানিয়েছে । এখনও ফুল আসেনি । ঢোকার মুখে পাশে যে ছোট্ট বোর্ড ছিল, সেটা নেই । হেমশশী থতমত দাঁড়িয়ে রইলেন । কেষ্টঠাকুরেরা কি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন? এখানকার পাট চুকোলো? এইসব ভাবছিলেন ক্ষণিকের জন্য । তখনই যেন দার্শনিক তত্বের উদয় হল মনে । মানুষ চলিষ্ণু জীব । পথের জীব । পিঁপড়ের মতো । ডিম মুখে নিয়ে সার বেঁধে একবসত ছেড়ে অন্য বসতের লক্ষ্যে রওনা দেয় । ওরাও নিশ্চয়ই ফেলে যায় কোনও স্মৃতি, কোনও চিহ্ন, কোনও বেদনার করুণ স্ফটিক, হাজার হাজার বছর মাটির তলায় যেভাবে পড়ে থাকে উদ্ভিদ, কয়লা হয়ে যায়, ফসিল হয়ে যায় । সেগুলিরও তো কিছু গান আছে, অন্তরের আকুতি, দীর্ঘশ্বাস যাতে সুর লাগায়, তানিম বসায়, লয় জোড়ে ! মুক্তোকান্দিতে মৃত্তিকার কোমল আঁচল ছিল, প্রাণকণাকে মুখে নিয়ে চন্দ্রমোহন ও সাধনের সঙ্গে পায়ে পায়ে অজানায় ভেসেছিলেন, তারপর রিফিউজি ক্যাম্পের নরকজীবনবাস, চন্দ্রমোহন সইতে পারলেন না, তাকে ফেলে চলে গেলেন — একা । সাধন রমা হেমশশীকে নিয়ে গেল জবরদখল কলোনিতে । কোথায় মুক্তোকান্দি, কোথায় নতুন বসত ! কত ক্রোশ ! শ্রীরাধা জানতেন না, মথুরা নগরী কত যোজন দূরে কোন অভিমুখে । তাই তো বৃন্দাকে সঙ্গে নিতে হয়েছিল । হেমশশীও একা নন । কেউই একা নয় । বুকের ভিতরে আছে প্রাণের উৎসস্রোত। সেই তার বৃন্দাসখী । সবসময় সাথে আছে । রোদ্দুরটা এখন একটু চড়া, মাথায়, চোখের পাতায় পড়ছে, পড়ুক, সে যে পরীক্ষা নিচ্ছে হেমশশীর, জানতে চাইছে পথের সাধনায় কতখানি জীবনসর্বস্ব পণ করেছেন । শ্রীরাধার যাত্রায় পথে কন্টক ছিল, স্বফণা বিষধরীর আস্ফালন ছিল, আকাশ থেকে ঘন ঘন বজ্রনিপাতের ক্রোধাক্ত তিরস্কার ছিল । রাধা নিস্কম্প ছিলেন । সাধনায় এমনই একাগ্রমনা থাকতে হয় । এপথের সাধনায় সিদ্ধি নেই । আছে পথান্তে আত্মসমর্পণ । আজ প্রব্রজ্যাচরে সুখ পাচ্ছেন হেমশশী । হুঁশ ফিরলো । আবার ডাকলেন — কেষ্টঠাকুর, গো ।
 
— এই তো, এসে দাঁড়িয়ে আছি, দিদি । — শশধরের কন্ঠ বাজে, সঙ্গে হেমশশীর কেষ্টঠাকুরটি — আসুন । কতদিন আসেন না, বলুনতো ! — আজ হেমশশীকে ঘরের ভিতরে বৈঠকখানায় যেতে হচ্ছে, বসতে হবে চেয়ারে, — এখন এখানে থাকেন না ?
 
— না, দাদা । আছি চরগাঙপুর কলুনিতে । আমার চাঁড়াল ছেলি আর ধোপার মেয়ি বউমা, আমারে টান্যে নেয়ি গেছে সিথায় । আমার ঘরেও একখান গোপাল ঠাকুর আছে । কেষ্টঠাকুরির চেয়ি বয়সিতে একটু ছোটো ।
 
— বেশ, বেশ । তা সেই জায়গাটা কোথায়? কাছাকাছি?
 
— এখান থেকি গাড়িতে উঠি পাঁচখানমতো ইষ্টিশান যাতি লাগবে । সিখানে নামই পশ্চিম পানে হাঁটতি লাগবে । একখান বড়ো বিল আছে । মজি গিছে এখন পিরায় । তারই ধারে চরজমিতি । ক্যাম্পির লোকিরা জবরদখল করি নেছে ।
 
— বউমা — শশধর হাঁক পাড়লেন ।
 
— হ্যাঁ, বাবা, দেখেছি । আসছি এক্ষুণি ।
 
— দিদির কেষ্টঠাকুরের বাবাকে পাঠিয়ে দাও তো ।
 
— শুনছো — ভিতর থেকে আওয়াজ এলো ।
একটি যুবক বৈঠকখানায় ঢোকে, হেমশশী দেখে অবাক হয় । ঘন কালোচুল, সুঠাম স্বাস্থ্য । তফাত এটুকুই যেন শশধরই দাঁড়িয়ে ।
 
— আমার ছেলে, দিদি, ভাস্কর । লখনউয়ে গেছিল গানের তালিম নিতে । দুসপ্তাহ হলো ফিরেছে । রেডিওতে গায় । আমার স্কুলটা এবার ওকে ধরতে হবে । আমার যে বয়স হচ্ছে । — ছেলের মুখে ফিরলেন, — খোকা, এঁর কথা তোমাকে লিখেছিলাম । মনে আছে, নিশ্চয়ই । এমন কীর্তন গান, এমন টোনাল রেঞ্জ তোমাদের রেডিও আর্টিস্টদের মধ্যেও পাইনি ।
 
— ঠাকুমা, গান করবে না? — শশধরের নাতির তর সয়না ।
 
— এই তো আমার আদেশ আসিছে — আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হেমশশী, পুত্রবধূর হাতে জল বাতাসা এলো, গলা শীতল হলো । হেমশশী গান ধরলেন —

 
কেন ধাঁধায় জড়াও কেন কেন অপথে সরানো কেন কেন আমারই উপর এত ক্রুর হলে কেন দয়াল হে, এত ক্রুর হলে
কী তুমি চাও কি কথা আমারে বলাও কেন পথে আমার ভুল করি দিলে
কেন সুজন হে, এত নিঠুর হলে…।

 
পরপর গেয়ে যাচ্ছেন হেমশশী, ক্লান্তি নেই, ক্ষান্তি নেই ।
 
— বাবা — ভাস্কর শশধরের কানে কানে বললো —উনি সত্যিই বড়ো শিল্পী । আমাদের রেডিও সেন্টারের দুর্ভাগ্য, ওনাকে পায়নি । আচ্ছা, বাবা, আমাদের অ্যানুয়েল কনফারেন্সে ওনাকে যদি…
 
— সেটা তুমিই বলো । পিসি বলে ডেকো । ঠাকরুনপিসি ।
ভাস্কর বললো — ঠাকরুনপিসি, প্রত্যেক বছরে আমাদের স্কুলে অ্যানুয়েল কনফারেন্স হয় । এই নভেম্বরেই হবে । সামনে ওই যে মাঠটা দেখছেন, ওখানে বড়ো প্যান্ডেল হবে । গুণিজনেরা আসবেন । গানবাজনা হবে । সেমিনার ওয়ার্কশপ হবে । প্রত্যেকবার আমরা একজন গুণীকে সম্বর্ধনা দিই । বাবার ইচ্ছা, আমারও, সেটা আপনাকে দিতে চাই । আপনি আপত্তি করবেন না তো?
 
— কী দেবা, বাবা? বদ্ধনা? সিটা কী, বাবা? বেশি করি মাধুকরী?
এবার প্রাণ খুলে হাসে ভাস্কর — না,না, ঠাকরুনপিসি । একজন মানুষের জীবনভর কীর্তিকে স্বীকৃতি দেয়া । এজন্য ফুলের তোড়া, মেমেন্টো, মানপত্র, একখানা শাল— এই আর কী ।
 
— ওসব যে নিতি পারবো না বাবা । আমার গুরু কয়ে গেছেন যে পথের রজ, আর হাতের মাধুকরী ছাড়া আর কিছু নিবার নাই । — হেমশশী আবার গানে ডুব দিলেন—

 
বজরে বজরে আলোক দেখাও
বজরে বজরে আঁধার আনাও
ভাবো বুঝি তুমি তরাসেতে আমি
পথ ভুলি যাবো…আমি
এমন সাধিকা হবো না হবো না..
ঝুলিতে ভারী পরিমাণ সিধে জমা হলো ।

 
শশধর বললেন — দিদি, আজ আর ঘুরবেন না । রোদটা ভালো নয় । কাঁচা আশ্বিন মাস । ভাস্কর সঙ্গে যাচ্ছে, আপনাকে ট্রেনে তুলে দেবে । সোজা বাড়ি ফিরে যাবেন । আশীর্বাদ করুন, দিদি, পরজন্মে যেন আপনার মতো সাধনায় সিদ্ধি পাই । — শশধর যেন প্রণামই করতে চান ।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২৭

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৭


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!