Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • আগস্ট ১৩, ২০২৩

চর >।পর্ব ৬।

সফর আলি অবাক হয়ে গোলামের দিকে তাকিয়ে থাকল। কী সব বলছে গোলাম ! এই সময়ে, এই যুগেও পানিপড়া, তেলপড়া নেওয়ার জন্য লোকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে গোলামের মুখে না শুনলে বিশ্বাস হতো না তার। ভাবল একদিন সে সন্ধ্যার দিকে ঘুরতে ঘুরতে ওদিকে যাবে। দেখবে কীভাবে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে.....তারপর

সাইদুর রহমান
চর >।পর্ব ৬।

অলঙ্করণ: দেব সরকার

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স

 

•১১•

পূর্ণিমার তখন চাঁদ মধ্যগগনে। রাতের ঝাপসা অন্ধকার ভেদ করে দেখা যাচ্ছে অনেকদূর পর্যন্ত। মাঝে মাঝে দূর মাঠের কোনও এক প্রান্তর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। মাঝে মাঝে সে ডাকের সাথে যুক্ত হচ্ছে একটা ভিন্ন ধরণের স্বর। এ স্বরের স্বরূপ ঠিক কেমন রহস্যময়। মনে হচ্ছে দূর মাঠের কোনও এক প্রান্তে একটা অজানা, অচেনা কোনও প্রাণীর হৃদয় নিঙড়ানো কোনও অস্ফূট যন্ত্রণা হঠাৎ ছিটকে বের হতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। না পারার যন্ত্রণা শেষে হাহাকারে পরিণত হচ্ছে। আর তার সাথে মাঝে মাঝেই একটা হিস হিস ধনি। মনে হচ্ছে গোটা মাঠ জুড়ে বিশাল কোনও এক প্রাণী তার লকলকে জিহবা বের করে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। রোজই খোঁজে। রোজই খোঁজে। খোঁজা তার শেষ হয়না।

 

সফর আলি তখনও ঘুমোয়নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল। ভাবছিল বসিরের কথা। কেন, কীসের জন্য হঠাৎ করে কোথাকার কানা ফকিরকে ডেকে নিয়ে এখানে বসিয়েছে বসির। কী এমন দরকার ছিল! নাকি তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। বলাও তো যায়না কিছু! দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে মানুষটি। ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত ক্লাসে ফাস্ট হত বসির। ফোরে গিয়ে সফর ওর থেকে এগিয়েছিল, বসির নেমে গিয়েছিল দুইয়ে। সিক্সে গিয়ে বসির আবার প্রথম। সেভেন থেকে আবার পিছোতে থাকে। মাধ্যমিক পাশ করেছিল, ভাল রেজাল্ট করতে পারেনি। কলেজে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু কোনোদিন সে কলেজে যায়নি। একদিন বসিরকে বিয়ের কথা বলতে রাজি হয়ে গেল। পারিবারিকভাবে বিয়ে হল রূপসীর সাথে। বিয়ের পর বাবা মা মারা গেল তার। তারপর দিন দিন কেমন হয়ে গেল সে। তাকে নিয়ে সামনাসামনি বসে কথা বললে কেমন হয়। মনে মনে ভাবল সফর আলি।

 

বিছানায় শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগল না সফরের। বিছানা ছেড়ে নেমে এল সে। পায়ে চটি গলিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এসে দাঁড়ালো। এখান থেকে পদ্মার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সফর আলি মাথা উঁচু করে তাকাল পূব দিকে। পূর্ণিমা রাতের ঝাপসা আলোয় দেখল পদ্মার পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বসির আর কানা ফকিরের সেই মাজারটি। মাজার না থান সফর এখনো ঠিক জানেনা। সফর আলি এখনও তো দেখতে যায়নি। লোকমুখে শুনেছে সেখানে বসির আর কানা ফকির বসে থাকে সবসময়। চাঁদ তারা মার্কা একটা পতাকা একটা বড় বাঁশের মাথায় বেঁধে পুঁতে রেখেছে।

 

সফর আলি একমনে তাকিয়েছিল মাজারের দিকে। আর কিছু ভাবছিল। এমন সময় দেখতে পেল একটি মেয়ে এদিকে হেঁটে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকল সফর। মেয়েটি কাছে এলে চিনতে পারল। রূপসী ! চমকে উঠল সফর আলি ! এত রাতে রূপসী কেন আসছে? কী হয়েছে ওর ? এ তল্লাটে ওই একটি মেয়েকেই ভালো লাগে তার। ভয়ও হয়। মেয়েটির মধ্যে কোথায় যেন আগুন লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে সেই আগুনের ঝলকানি সে অনুভব করে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। প্রকাশ করেনা। সফর আলি জানে রূপসীর সেই আগুনে সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে। তাই খুব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে সে। কী ভাগ্য করে মেয়েটিকে পেয়েছিল বসির।  কিন্তু মেয়েটিকে সে বুঝে উঠতে পারল না। বুঝার চেষ্টাও করল না। ওর হাতে রূপসী শুধু দুঃখ আর কষ্টই পেয়ে গেল।

 

রূপসী কাছে এলে সফর আলি বলল, “এত রাতে তোর কী হলরে রূপসী?”

 

“কেন? এত রাতে তোমার কাছে আসা যাবেনা ? তাহলে বলে দাও। আর আসব না।” রূপসী কিছুটা অভিমানের সুরে বলল কথাগুলো।

 

রূপসীর কথার কী উত্তর দিবে সফর আলি বুঝতে পারলনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “না রে না রূপসী। আমি সেভাবে বলিনি। তুই আসবি। যখন দরকার হবে তখনই আসবি। আমি বলছিলাম তুই একা এসেছিস? বসির আসেনি? ওকে সাথে করে আনতে পারতিস।”

 

“বসির কী ঘরে আছে যে আসবে। ওতো গাঁজা খেয়ে থানে পড়ে আছে।” উত্তর দিতে সময় নেয়না রূপসী।

 

“বসির এখন ঘরে থাকেনা? গাঁজা খায়? মাজারে পড়ে থাকে?” জিজ্ঞাসা করল সফর আলি।

 

“এখন তো দিনের বেলাতেও ঘরে কম আসে। সবসময় ওই থানে বসে আছে। জানিনা ওর মতলব কী?” রূপসী বলল।

 

সফর আলি কিছু না বলে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। এখান থেকে থানের আলো দেখা যাচ্ছে। একটা হারিকেনের মতো আলো টিম টিম করে জ্বলছে। ওখানেই একটা চৌকির উপর গাঁজা খেয়ে শুয়ে আছে বসির। আর তার সুন্দরী বউ এত রাতে এসেছে এই নদীর তীরে তার সাথে দেখা করতে। কথা বলতে।

 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রূপসী বলল, “এত রাতে নদীর ধারে বসে কী করছ সফর ভাই?”

সফর আলি নদীর দিকে মুখ করে বসেছিল। সেদিকে মুখ করেই বলল, “কেন যে বসে আছি জানিনা রূপসী! বসে থাকতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকি।”

 

“জানি। তুমি মাঝে মাঝেই রাতে এখানে এসে বসে থাক।”

 

“আমি বসে থাকি তুই জানলি কী করে ?”

 

“যেদিনই তুমি এদিকে আস, আমি তোমাকে দেখতে পাই।”

 

“আমাকে দেখতে পাস। সারারাত জেগে থাকিস নাকি তুই!” কিছুটা ঠাট্টার মতো করে বলল সফর আলি।

 

“কী করব বল ! এমন একজনকে ধরে দিল বাপ। আমার খোঁজই রাখেনা। নিজের মনে থাকে। নিজের মনে খায়। নিজের মনে শুয়ে পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। এখন তো আবার কাছেও থাকেনা। আমার যে ঘুম আসেনা সফর ভাই!” একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল রূপসী।

 

সফর আলি কী বলবে বুঝতে পারল না। এ অভিযোগ রূপসীর নতুন কিছু নয়। নতুন যেটা হল, এত রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা। অন্তরের গভীরে কত জ্বালা থাকলে একজন মেয়ে এত রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে! ভাবতেই সফরের ভয় হল। রূপসী এখানে এসেছে। গল্প করছে। কেউ দেখে ফেলেনি তো! যদি কেউ দেখে ফেলে! যদি বসিরকে বলে দেয়! যদি পাড়ায় কথাটা রটে যায়! এ নিয়ে যদি সমাজ বসে!

 

সফরের শরীরটা কেমন কেঁপে উঠল। বলল, “এখানে এসেছিস। কেউ তোকে দেখেনি তো রূপসী!”

 

“কেউ দেখেছে কী না জানিনা। আর দেখলেই বা ভয় কী? আমি কী কারও ভাতের হাঁড়িতে লাকড়ি দিতে যাচ্ছি নাকি কাওকে দেখে ভয় করব?” রূপসীর কথার মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা গেল।

 

আরও ভয় পেল সফর আলি। বলল, “নারে না রূপসী। আমি ভয়ের জন্য বলিনি ! বলছি এতরাতে আমার সাথে তোকে দেখলে লোকে কী ভাববে ? সেটা ভেবেছিস?”

 

রূপসী আগের মতোই বলল, “অত ভাবাভাবিতে কাজ নাই। যার দরকার সে ভাবুক কা। আমি ওসব লিয়ে ভাবিনা।”

 

“তুই না ভাবলেও আমাকে তো ভাবতে হবে রূপসী ! এত রাতে তোকে আর আমাকে এখানে বসে থাকতে দেখলে লোকে কত কী ভাববে জানিস ! লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারবি না। আমিও দেখাতে পারব না।” মনের অজান্তেই সফর আলির মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাগুলি।

 

কী উত্তর দিবে রূপসী বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর শান্তভাবে বলল, “আমার এখানে আসা তুমি পছন্দ করনি সফর ভাই। বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কোনোদিন তোমার কাছে এভাবে আসব না। কিন্তু সফর ভাই তোমাকে আমার একটা কথার উত্তর দিতে হবে।” রূপসী আবার সামান্য চুপ করল।

 

“ব্যাপারটা পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয় রূপসী। তুই ঠিক বুঝতে পারছিস না।”

 

“ওই হল। এতে বোঝাবুঝির কী আছে ? তোমার কাছে আসা তুমি পছন্দ করছ না। এইতো !”

 

“না তা নয়। আমি তা বলতে চাইনি।”

 

“সে তুমি যায় বলতে চাও। শুধু দুটা কথার উত্তর দাও।”

 

“বল কী বলতে চাস? কী জানতে চাস?”

 

রূপসী কিছুটা চুপ করে থাকল। তারপর বলতে শুরু করল, “তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে যেতে যেতে কোনোদিন আমার জানালার দিকে, কোনোদিন আমার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাক কেন ? কোনো কোনোদিন তুমি আমার ঘরের দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে আস কেন ? মাঝে মাঝে শুধু দূর থেকে আমার ঘরের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরে চলে যাও। তুমি কী ভাব আমি কিছু দেখতে পাইনা! আমি সব দেখতে পাই। মাঝে মাঝে জানালার ধারে বসে থাকি। আবার দরজার পাল্লায় হাত দিয়েও দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার যাওয়া আসা আমি সব দেখতে পাই।”

 

চোর ধরা পড়ার মতো ধরা পড়ে গিয়ে সফর আলি চুপ করে বসে থাকল। ভেতরে ভেতরে রূপসী এভাবে তাকে লক্ষ্য করেছে। সে ভাবত রূপসী এসব নিয়ে ভাবেনা। ভাবনার মতো মন তার নেই। কী বলবে কোনও উত্তর তার মনে এলনা। শুধু অস্ফুটে ডেকে উঠল, “রূপসী!”

 

রূপসী আবার বলে উঠল, “তুমি কী ভাব আমি কিছুই বুঝতে পারিনা। নারী হয়ে জন্মেছি। কেউ হা করলেই তার ভেতরের কথা সব বলে দিতে পারি। আল্লাহ এভাবেই নারীদের জন্ম দিয়েছে।”

 

সফর আলি আবার অস্ফুটে চাপা স্বরে বলল, “রূপসী এ সব কী বলছিস ! চুপ কর। তুই আমার কথাটা শোন।”

 

“তোমার কথা আর কী শুনব সফর ভাই। তোমার কথা শোনার আর দরকার নাই। আমারই কপাল খারাপ। না হলে নিজের স্বামী কোথাকার থানে বসে গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে? আর আমি সারারাত তার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকি!” একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রপসীর মুখ দিয়ে।

 

একটুখানি চুপ থেকে সে আবার বলল, “ঠিক আছে সফর ভাই। আর কোনোদিন তোমার কাছে আসবনা। এই শেষ। আমি চললুম।” রূপসী উঠে দাঁড়াল।

 

হঠাৎ খপ করে রূপসীর হাত চেপে ধরল সফর আলি। টেনে পাশে বসানোর চেষ্টা করল। রপসী বসতে চাইলনা। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল সে। কিন্তু এগোতে পারলনা। সফর আলি তার হাতকে কঠিনভাবে চেপে ধরেছে। হাত ছাড়ানোর জন্য রূপসী হাতে একটা মোচড় দিল। আর তাতেই সে পাক খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল সফরের গায়ের উপর। রূপসীর নরম বুকের ছোঁয়ায় সফর আলির শরীরে হঠাৎ করে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল।

 

নিজেকে সামলে নিয়ে সফর আলি বলল, “পাগলামি করিস না রূপসী! চুপ করে বস।”

 

থামল রূপসী। সফর আলি রূপসীর হাত ধরে পদ্মার পাড়ে বসল। অনেকক্ষণ কেউ কাউকে কোনও কথা বলল না। একমনে দুজনে পদ্মার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। পূর্ণিমার চাঁদ মধ্যগগণ থেকে নিচের দিকে ঝুলে গেছে। চাঁদের ঝরা আলো ঝরে পড়ছে নদীর জলে। নদীর ঢেউয়ের তালে তাল রেখে নেচে নেচে উঠছে সেই আলো। দূরে কোথাও একদল শেয়াল ডেকে উঠল। এক ফালি দখিনা বাতাস দূর থেকে ঝাপটা দিয়ে দুজনের চুল এলোমেলো করে দিয়ে সোজা উত্তর দিকে যেতে গিয়ে পূব দিকে উড়ে গেল।

 

একসময় সফর আলি বুঝতে পারল তার শরীর যেন কথা বলছে। মাঝে মাঝে শরীর পাক দিয়ে উঠছে। মনের একটা আদিম ইচ্ছে তার মনের ভেতরে জেগে উঠছে। সফর আলি জোর করে তাকে চাপা দেবার চেষ্টা করছে। আবার জেগে উঠছে। একে সে চেনে, জানে। একা একা বিছানায় কোনও কোনোদিন সে ইচ্ছে জেগে ওঠে তার। তখন সে উঠে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। নুরুকে খুঁজতে থাকে সে। কিন্তু মনের ইচ্ছে তাতে দমন হয়না। মনে মনে ভাবে একটা নতুন জীবনসঙ্গী করলে কেমন হয়। কিন্তু তার বেশি সে ভাবতে পারেনা। নুরুই তার জীবনের একমাত্র সঙ্গী। তার একমাত্র ভালোবাসা। সে বেঁচে থাকুক আর নাই থাকুক। তখন সে আর বেশি কিছু না ভেবে চুপি চুপি নদীর পাড় থেকে উঠে আসে। ঘরে এসে চাদরখানা বুকে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আশ্চর্য, বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই কখন তার ঘুম চলে আসে বুঝতে পারেনা।

 

অনেকক্ষণ চুপ থেকে নিস্তব্ধতা কাটাল সফর আলি। বলল, “রূপসী! আমার সাথে এতরাতে এভাবে বসে থাকতে তোর ভয় করছেনা ?”

 

নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রূপসী বলল, “না। আমার ভয় করছে না।”

 

সফর আলি আবার বলল, “ভয় করছেনা কেন?”

 

উত্তর তৈরিই ছিল রূপসীর। বলল, “তুমি ভয় করার মতো মানুষ নও। তাই!”

 

“তোর কথা বুঝতে পারলাম না রূপসী! আমি ভয় করার মতো মানুষ নই মানে! কী বলতে চাইছিস তুই!”

 

আবারও নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে রূপসী বলল, “না বোঝার মতো কোনও কঠিন কথা তো আমি বলিনি সফর ভাই। একজন পুরুষ মানুষের কাছ থেকে গভীররাতে একাকী নির্জনে যে ধরণের ভয় পাওয়ার কথা, সে ধরনের পুরুষ তুমি নও।”

 

চমকে উঠল সফর। বলল, “আর যদি সেটাই হয়ে যায়। তাহলে !”

 

“আমি অবাক হবনা।” এবার সফর আলির দিকে মুখ করে বলল রূপসী।

 

“অবাক হবিনা কেন?”

 

“কারণ এটাই হবার কথা।”

 

অষ্পষ্টতার কোনও আড়াল নেই। এরপর কী বলবে বুঝে উঠতে পারলনা সফর আলি। আর কি কিছু বলার আছে? কিছু জানার আছে?

 

চুপ করে দূরে থানের দিকে তাকিয়ে থাকল সফর আলি। সেখানে টিম টিম করে হারিকেনের আলো জ্বলছে। সেই আলো গিয়ে পড়ছে নদীর জলে। নদীর জলের মৃদুমন্দ ঢেউয়ের উপর সেই আলো পড়ছে আর ঝিলিমিলি করছে। সেখানে শুয়ে আছে বসির। হয়তো এখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। হয়তো গাঁজা খেয়ে ভুল ভাল কিছু বকছে। আর তার জলজ্যান্ত যুবতী বউ শরীরে একরাশ খিদে আর মনের জ্বালায় ছটফট করছে।

 

হঠাৎ করেই সফর আলির শরীরটা পাক দিয়ে উঠল। মাথার মধ্যে কোনও এক বোধ কাজ করতে শুরু করল। যে বোধের কাছে মানুষ আজও পরাজিত। যে বোধ কখনও কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন সে বনের পশুকেও হার মানায়।

 

সফর খুব আসতে করে ডাকল, “রূপসী!”

 

রূপসী নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বল সফর ভাই।”

 

সফর আলি কিছু না বলে রূপসীর দিকে তাকিয়ে আসতে করে তার হাত দুটি নিজের হাতে চেপে ধরল। রুপসী হাত ছাড়িয়ে নিলনা। শুধু দূর নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। সফর আলি রূপসীর হাত দুটি ধরে হালকা টান দিয়ে রূপসীকে নিজের দিকে টেনে নিল। এক টানে রূপসী এসে পড়ল সফর আলির বুকের উপর। রূপসীকে সামনে নিয়ে পেছন থেকে সফর তার দুই হাত তুলে নিয়ে এল রূপসীর বুকের উপর। তারপর তার গালে একটা হালকা চুমু খেতে গিয়ে দেখল, রূপসী চোখবুজে আছে। আর তার দুই চোখের কণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গাল পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে।

 

রূপসীর চোখে জল! সফর আলির হাত দুটি আপনা থেকেই থেমে গেল। মনে হল হাত দুটিকে কে যেন হঠাৎ টেনে ধরেছে। আর এক ইঞ্চিও উপরে ওঠার উপায় নেই। সফর আলির মনে হল ভালোবাসার অভিনয় করে জোর করে বনের একটা পোষা হরিণকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে তার মাংসকে সে যেন খেতে চাইছে।

 

জিজ্ঞাসা করল সফর আলি, “রূপসী! তোর চোখে জল!”

 

রূপসী চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বলল, “কিছু না সফর ভাই। এমনিই চলে এসেছে।”

 

সফর আলি বলল, “নারে রূপসী! মানুষের চোখে এমনি এমনি জল আসেনা। হঠাৎ তোর কী এমন হল!”

 

সামান্য চুপ থাকল রূপসী। তারপর বলল, “ওই যে দূরে থানে টিম টিম করে লন্ঠনের আলো জ্বলছে। ওখানে শুয়ে আছে আমার স্বামী, বসির। হয়তো গাঁজা খেয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। আর আমি! তার বৈধ বউ তার অপেক্ষায় তাকিয়ে থেকে থেকে এত রাতে অন্য পুরুষের সাথে সময় কাটাচ্ছি! এটা কত বড় কষ্ট সে তোমাকে বোঝাতে পারব না সফর ভাই!”

 

সহসা সফর আলির গালে কে যেন সপাটে একটা চড় কষাল। চমকে উঠল সফর আলি। যে আবেগ নিয়ে সে  রূপসীকে বুকে টেনে নিয়েছিল, মুহূর্তে কর্পুরের মতো উড়ে গেল সেই আবেগ। আসতে করে রূপসীর হাত ছেড়ে দিল সে। তারপর পদ্মার দিকে একদৃষ্টে চুপ করে তাকিয়ে থাকল। দেখল, পদ্মার জল কি শান্ত! স্থির! কেবল তীরের প্রান্ত থেকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছে। একটার পর আরেকটা।

 

সফর আলির এই আচরণে রূপসী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হল তোমার সফর ভাই!”

 

সফর আলি পদ্মার দিকে তাকিয়েই রূপসীকে বলল, “তুই বসিরকে ভালোবাসিস রূপসী?”

 

সাথে সাথে রূপসী বলল, “না।”

 

“মিথ্যে কথা বলছিস রূপসী! যদি ভালোই না বাসিস, তবে এত রাতে তার কথা ভেবে তোর চোখ জল আসত না!” সফর আলি পদ্মার দিক থেকে মুখ ফুরিয়ে রূপসীর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল।

 

রূপসী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তুমি ভুল বুঝছ সফর ভাই! এর সাথে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নাই। বসিরকে আমি ভালোবাসি না। ও আমার ভালোবাসা পাওয়ার মতো যোগ্য পুরুষ নয়।”

 

“তবে!”

 

“তবে সে আমার স্বামী। তাই এত রাতে এই নদীর পাড়ে যখন অন্য একজন পুরুষ মানুষের সাথে আমি সময় কাটাচ্ছি, তখন হঠাৎ করেই তার কথা মনে পড়ে গেল। এর সাথে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নাই।”

 

“তুই আমাকে অন্য পুরুষ’ মনে করিস রূপসী!” এবার কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল সফর আলি।

 

“না সফর ভাই। তুমি যে অর্থে কথাটিকে নিচ্ছ, আমি সে অর্থে কথাটা বলিনি। এই গ্রামে, এই চরে আমার সবচেয়ে আপন বলতে তুমি। সবচেয়ে নির্ভতার জায়গাও। যে কোনও বিপদে তোমার কথায় আগে মনে আসে। আমি তোমাকেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করি। আর তুমি নিজেও কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছ।”

 

সফর আলি বিস্ময়ে রূপসীর কথা শুনছিল।

 

রূপসী আবার বলতে শুরু করল, “এই যে তোমার পাশে বসে থাকতে থাকতে তোমার মধ্যে একটা কামনার গোপন ইচ্ছে জেগে উঠল, তাকে তুমি অস্বীকার করতে পারনা। আমিও না। আমার মধ্যেও সেই ইচ্ছে আছে। এই নির্জন রাতে দুজন নারী পুরুষের মধ্যে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্ত এই সময়ে যদি আমার যে বৈধ স্বামী, তার কথা মনে আসে, তাতে কী খুব অবাক হওয়ার আছে সফর ভাই! কোন নারী চাইনা তার স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে ঘর করুক।”

 

সফর আলি দেখল কোথাকার কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে। সেই তো বিয়েটা লাগিয়েছিল। তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “সবই ঠিক রূপসী। কিন্তু তোর চোখে জল দেখে আমার গোপন ইচ্ছ যে গোপনেই শেষ হয়ে গেছে। তোর চোখে জল দেখে কোথায় যে আমার মনের মধ্যে একটা বেদনা বোধ জেগে উঠেছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, একটা সদা চঞ্চল হরিণকে ফাঁদে ফেলে জোর করে তার মাংস চিবিয়ে খাচ্ছি। এটা যে আমার নীতি বিরুদ্ধ, রীতি বিরুদ্ধ তাতো তুই জানিস!”

 

“জানি বলেই তো এতো নির্ভর করি সফর ভাই। এই নির্ভরতা থেকে আজ এই সময় তোমার হাতে আমার শরীরটা সম্পূর্ণরূপে সঁপে দিতে চাই। তুমি এই শরীরকে নিয়ে যেমন খুশি ভোগ করতে পার। আমার কোনও আপত্তি নেই। তুমি আমার শরীর ভোগ করে আমাকে মুক্ত কর সফর ভাই। আমি মনে প্রাণে তোমার শরীর কামনা করছি। প্লিজ, এই রাতে, এই পদ্মার পাড়ে আমাকে বঞ্চিত করনা। এই পদ্মা সাক্ষী থাকবে, তুমি আমার ভালোবাসার ধন। তুমিই আমার দেবতা।” রূপসী সফর আলির বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে একে একে তার মনের আকুতিগুলি স্পষ্ট করতে থাকল।

 

সফর আলি চুপ করে পদ্মার দিকে তাকিয়ে ছিল। পদ্মার দিকে তাকিয়েই বলল, “শরীর জাগলেও মন জাগছেনারে রূপসী! অনেক রাত হয়েছে। চল। ঘরে চল।”

 

কোনও উত্তর করলনা রূপসী। সফর আলির বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে চুপ করে পড়ে থাকল।

 

•১২•

 

পরাণের বাড়িতে লোক ভেঙে পড়ল বিকেলের দিকে। বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা। পরাণের বড় মেয়ে সারি দশ বছর পর বাড়ি ফিরেছে। সঙ্গে ছয় বছরের বাচ্চা। সারির ছেলে। দশ বছর আগে যে মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, সে আজ ঘরে ফিরেছে। গোটা গ্রাম কৌতূহলের অন্ত নেই। একটা পরিপূর্ণ যুবতী মেয়ে হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। দশ বছর তার কেউ কোনও খোঁজ খবর রাখলনা। এতদিন পর সে হঠাৎ করেই ঘরে ফিরে এল সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে,- গ্রামের মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় বিস্ময় এই মুহূর্তে আর নেই। সবার চোখে মুখে, আড়ালে আবডালে একটা চাপা জিজ্ঞাসা। ফিস ফিস করতে করতে সেই চাপা জিজ্ঞাসা আর চাপা থাকেনা। প্রকাশ্যে আসে।

 

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেও শুরু করল, “একটা নষ্ট মেয়েকে এভাবে ঘরে তুলে নেওয়া পরাণের ঠিক হয়নি।”

 

সারি যে এমনিভাবে না জানিয়ে, কোনও খবর না দিয়ে চলে আসবে পরাণেরও জানা ছিলনা। এতদিন পরাণের কাছে সারি ছিল নিখোঁজ। কখনও মনে মনে সারিকে মৃত বলেও মনে করেছে সে। তারপরেও সারিকে নিয়ে মনের কোন এক গোপনে একটা জায়গা তৈরি করে রেখেছিল পরাণ। তার বার বার  শুধু মনে হত সারি বেঁচে আছে। কোথায় আছে সেটাই শুধু তার জানা ছিলনা। তাবলে যে সে এভাবে হঠাৎ করে চলে আসবে, তাও আবার বাচ্চা সাথে নিয়ে – সেটা সে ভাবেনি কোনোদিন। সারিকে নিয়ে মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল তার। গণগণে দুপুর বেলা ছাতা মাথায় করে ছেলেকে পাশে নিয়ে সারি যখন বাড়িতে প্রবেশ করেছিল, পরাণ বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ একটি মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিল সে। বলা নাই, কওয়া নয়, একটি মেয়ে হনহনিয়ে যে ঘরে ঢুকে যেতে পারে – ভাবনাতেই আসেনি তার।

 

সারি বাড়িতে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করেছিল পরাণ, “এই মেয়ে। কে তুমি? কোথায় বাড়ি? বলা নাই, কওয়া নাই, বাড়ি ঢুকে যাচ্ছ? কী দরকার তোমার?”

 

অলঙ্করণ: দেব সরকার

আর সারি থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “কেমন আছ বাবা ! আমাকে চিনতে পারছ না! আমি সারি!”

 

“সারি!” হঠাৎ পরাণের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিলনা। দাওয়া থেকে দাঁড়িয়ে একছুটে নীচে নেমে এসেছিল সে। মুখ থেকে অস্ফুটে ডেকে উঠেছিল, “সারি! কেমন আছিস বেটা!”

 

আর সারি বাপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেছিল, “তুমি কেমন আছ বাবা? তোমার শরীর এত খারাপ দেখাচ্ছে কেন?”

 

তারপর মা-মেয়ে আর বাবা মিলে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিল। সারির কথা থেকে বোঝা গিয়েছিল, ওপারের একটি ছেলে বিয়ে করার নাম করে তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটি তাকে বিয়ে করেনি। মুম্বাই শহরে এক পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল তাকে। তারপর সেই পতিতালয়ে সারি বছর খানেক থাকে। একদিন মেদিনীপুরের একটি ছেলে তার কাছে খরিদ্দার হিসেবে যায়। তার সাথে বাংলায় কথাবার্তা হলে ছেলেটি তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করে। পরে তার সাথেই মুম্বাইয়ের এক ঝুপড়িতে থাকতে শুরু করে। তার সাথেই এই বাচ্চাটি। এখন সে ওর সাথেই আছে। একসাথে মুম্বাই থেকে এসেছে তারা। এখন সে মেদিনীপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে গেছে। আর সারি এসেছে নিজের বাবার বাড়ি।

 

সারি আসাতে পরাণ যতটা আনন্দিত হয়েছে, ঠিক ততটাই হয়েছে শঙ্কিত। কতদিন পর মেয়ে ঘরে এসেছে। যে মেয়ের জন্য সে দিন – রাত চোখের জল ফেলেছে, দিনের পর দিন পথ চেয়ে বসে থেকেছে, রাতে স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে বউ মালতীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে, মন খারাপ করে নদীর পাড়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে – তাকে সে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে বসেছিল। আজ যখন সে ফিরে এল তখন তার মনের মধ্যে একই সাথে আকুলি ও দ্বিধা দেখা দিল। এতদিন সে কোথায় ছিল? লোকে বলত তোর মেয়ে বেশ্যালয়ে বিক্রি হয়ে গেছে। লোকের কথাকে সে পাত্তা দিতনা। কিন্তু তাকে সে মিথ্যা বলে প্রতিবাদও করতে পারতনা। তার নিজের মনের মধ্যেও ভাবনাটা যে ছিলনা, তা নয়। ভেতরে ভেতরে সে নিজেও বিশ্বাস করত। আর ভেতরে ভেতরে গুমরে মরত। তখন সে নদীর ধারে চলে যেত। ডুকরে ডুকরে কাঁদত। তারপর চোখের জল মুছে, পদ্মার জলে চোখ-মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে আসত। তবু সেগুলো ছিল কল্পনা! দুঃস্বপ্নের মতো!

 

আর আজ যখন সারি নিজের মুখে কবুল করল, খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, সে পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে সে দু বছর ছিল। সেই দু বছরে তার কোনও ব্যক্তিজীবন ছিল না। আব্রু ছিলনা। খরিদ্দারদের মন জয় করতে করতেই কখন কেটে গিয়েছিল দেড়-দুই বছর, তখন পরাণের পিতৃসত্ত্বা আরও একবার হাহাকার করে ডুকরে উঠল। মুহুর্তে ঘৃণা আর লজ্জায় নিরানন্দে ভরে গেল মেয়ের ঘরে ফিরে আসার আনন্দ। একটা লজ্জা, ঘৃণা আর অন্তর্জ্বালা তার মনকে কুরে কুরে খেতে লাগল। তার মনে হল, সারির ফিরে না আসায় ভালো ছিল। যে মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, যে মেয়েকে সে প্রায় ভুলতে বসেছিল, যে মেয়ে তার কাছে ধীরে ধীরে মৃত হয়ে গেছিল – তাকে তো সে মেনে নিয়েছিল। তার আর ফিরে আসার দরকার ছিল না। কী হল! ফিরে এসে সে নতুন করে আবার কষ্ট দিল। এ কষ্ট আবার তাকে কতদিন বইতে হবে কে জানে!

 

তাছাড়া গ্রামের মানুষ মেনে নিবে তো? এমনিতেই গ্রামের মানুষ সু্যোগ পেলেই মেয়েকে নিয়ে দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়, “তোর মাইয়াকে তো বেশ্যালয়ে বেচ্যা দিয়্যাছে।” তখন রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় চুপ করে বসে থাকে পরাণ। ইচ্ছে করে সবকিছুকে ভেঙে-চুরে তছনছ করে দেয়। কিন্তু কিছুই করতে পারেনা। চুপ করে বসে থাকে, আর মেয়ের জন্য গোপনে চোখের জল ফেলে।

 

এরমধ্যে গোলাম একবার এসে বলে গেছে, “লক্ষণ ভালো না পরাণ। গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে। ফিসফিস করছে।”

 

পরাণ সামান্য ঢোক গিলে বলেছিল, “কী বলাবালি করছে?”

 

গোলাম একটু কড়া সুরেই বলেছিল, “সত্যিই বুঝতে পারছিস না পরাণ? বাচ্চা সাথে সারির এভাবে গ্রামে ফিরে আসা মেনে নিতে পারছেনা গ্রামের লোক।”

 

পরাণও চড়া সুরে বলেছিল, “মেয়ে বাপের বাড়ি এসেছে। তাতে কার বাপের পাকা ফসলে মই পড়ল শুনি!”

 

“পাড়ার লোক তো আর সেভাবে ভাবছেনারে পরাণ। তারা ভাবছে একটা বেশ্যা মাইয়্যা কী কর‍্যা পাড়ায় ঢুকতে পারে? পাড়ার আর সব মাইয়্যারা খারাপ হইয়্যা যাবেনা? পাড়ার আর সব মাইয়্যাদের কথাও তো ভাবতে হবে! পাড়ার মানুষদের একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি! তারা তো ব্যাপারটা লিয়্যা ভাবছে। আমি শুন্যা তোকে বলতে এলাম।” গোলাম বলেছিল।

 

‘বেশ্যা! আমার মাইয়্যা বেশ্যা! চুপ কর গোলাম। আর বলিশ না। এরপর কিন্তুক মাথায় খুন চাপ্যা বসবে।” পরাণ চড়া সুরে বলেছিল।

 

গোলাম সামান্য সুর নরম করে বলেছিল, “মাথা গরম করিস না পরাণ। আমি বলিনি। পাড়ার লোকরা বলাবলি করছে। তোকে চুপিচুপি বলতে এলাম। তুই এমুন মাথা গরম করলে আর কী বলব?”

 

“সবাই বলছে? নাকি তুই বলছিস? লোককে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছিস!” পরাণ চড়া সুর সামান্য কমিয়ে বলেছিল।

 

গোলাম আর বেশি কথা বাড়ায় নি। “ঠিক আছে। আমি এখন উঠছিরে পরাণ” বলে উঠে গিয়েছিল।

 

গোলাম উঠে গেলে দাওয়ায় একা বসে অনেক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে পরাণ। গোলাম কি সত্যিই সত্যিই লোকের কথা বলতে এসেছিল? নাকি নিজের কথা! সে পাড়ায় উস্কানি দিচ্ছেনা তো? পাড়ার মেয়েরা তো দল বেঁধে আসছে। কথা বলছে সারির সাথে। সারির মায়ের সাথে। ভালোমন্দ খবর নিচ্ছে। তাহলে তারাও বলাবলি করছে? তারাও পাড়ায় পাড়ায় উস্কানি দিচ্ছে!

 

পরাণ দেখেছে মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে একটু বেশ বয়স্ক মেয়েরা মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে আসছে আর যাবার সময় কানে কানে কী সব বলছে আর চলে যাচ্ছে। হয়তো তারা এসবই বলছে।

 

অনেক ভেবে পরাণ ঠিক করল, যাই ঘটুক না কেন, সারিকে সে তাড়িয়ে দিবে না। সারি যতদিন থাকতে চাইবে, ততদিন সে এখানে তাকে রাখবে।

 

ব্যাপারটা বোঝা গেল সন্ধ্যার পর। মহিরুদ্দীর বাড়িতে। সন্ধ্যার পর মহীরুদ্দীর বৈঠকখানায় পাড়ার বেশ কিছু লোক জমা হল আলোচনা করার জন্য। কয়েকজন সফর আলির বাড়িতে বসতে চেয়েছিল। বসির আর গোলাম কিছুতেই সফর আলির ওখানে যেতে চায়নি। শেষে সবাই একমত হয়ে মহীরুদ্দীর বৈঠকখানায় জমা হয়েছে।

 

ডাক ছিল সফর আলিরও। বিকেলের দিকে আনসার গিয়ে বলেছিল, “পরাণের ব্যাপারটা নিয়ে পাড়ার লোক একটু বসতে চাইছে সফর ভাই। তোমাকেও যেতে হবে। সবার হয়ে আমাকে বলতে বলেছে তোমাকে।”

 

সফর কী ঘটেছে ভালোভাবে জানত না। সে শুধু জানত আজ দুপুরের দিকে পরাণের বড় মেয়ে সারি বাড়ি ফিরে এসেছে। সাথে বছর ছয়েকের একটি বাচ্চা ছেলে। কিন্তু এসব নিয়ে পাড়ায় যে এভাবে আলোচনা হচ্ছে সে খবর তার কাছে ছিলনা। কেউ তাকে বলেওনি।

 

সফর আলি বলেছিল, “পরাণের কোন ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হবে আনসার ভাই? আমিতো কিছুই জানিনা।”

 

“কেন তুমি কিছুই শোননি?” কিছুটা আশ্চর্যের মতো বলেছিল আনসার।

 

“কোন কথাটার কথা বলছ আনসার ভাই? আমি শুনেছি আজ দুপুরের দিকে পরাণের বড় মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। তুমি কি সেই বিষয়ে কিছু বলছ?” একটু ভেবে বলেছিল সফর আলি।

 

“হ্যাঁ। আমি সেই বিষয়েই বুলছি। মানে লোকে সে বিষয়েই বুলছে।” আনসার বলেছিল।

 

সফর কিছুটা থেমে আবার বলেছিল, “মেয়ে তার বাপের বাড়ি এসেছে। এতে গ্রামের মানুষের আলোচনার কী আছে আনসার ভাই আমি তো বুঝতে পারছিনা!”

 

“সে কথা তো আমারও। কিন্তুক গ্রামের মানুষকে বুঝায় কে? তাদের কথা হল এতে গ্রামের আর সব মাইয়্যা গুলা, বেটিগুলা সব খারাপ হয়্যা যাবে। তাদের কথাটাও তো শুনতে হবে। গ্রামের সমাজ বলে তো একটা কথা আছে নাকি!” আনসার বলেছিল।

 

আবার কিছু থেমে সফর আলি বলেছিল, “সমাজ! কোন সমাজের কথা বলছ আনসার ভাই! না। আমি এরসাথে একমত হতে পারলাম না। আমি ওই আলোচনায় গিয়ে কী করব?”

 

“তুমি তোমার কথাটায় বুলবা। গ্রামের মানুষ যখুন বসতে চাইছে, তখন তাদের কথাকেও তো অস্বীকার করা যায়না। একটা কিছু তো করতে হবে।” আনসার বলেছিল।

 

সফর আলি ভেবেছিল রাতের দিকে সে পরাণের বাড়ি যাবে। ওর মেয়েটির সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নিবে। কিন্তু তার আগেই যে তাকে বিচার সভায় বসতে হবে কে ভেবেছিল।

 
কিছুটা ভেবে বলল, “ঠিক আছে আনসার ভাই। আমি যাবো।” 
 
ক্রমশ…
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর (পঞ্চম পর্ব)

চর >।পর্ব ৫।


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
homepage vertical advertisement mainul hassan publication
Advertisement
homepage vertical advertisement mainul hassan publication
Advertisement
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!