Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১২

ওই দেওয়ালে কেউ হেঁটে গেলে যেন স্পষ্ট দেখা যাবে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের এতোটাই কাছে! এমন নৈসর্গিক দৃশ্য আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি...তারপর

ফাল্গুনী দে
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১২

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ 

♦ পর্ব ১২ ♦

শেষতম সেই উপশমের কাছে ফিরে যাওয়ার আগে, বাস্তবের হাত ছেড়ে জাদুবাস্তবের আলেয়ায় এই পৃথিবীর সব সুখ-শান্তি-মোহ-দুঃখ-আনন্দ অনুভূতি মুহূর্তের জন্য ভুলে যাওয়ার আগে, আমাকে পৌঁছাতে হবে গন্তব্যহীন এক পথের আলো-ইশারার কাছে। জীবনের ফাইনাল মঞ্চ অভিনয়ের আগে একটা ড্রেস রিহার্সালের প্রস্তুতির মতো আজ এই মাঝরাতে আমাদের গন্তব্য জংরী টপ। উচ্চতা ১৩৭৭৮ ফুট। সেখান থেকে ফিরে এসে যাবতীয় জেদ অহংকার এবং চেতনার সমস্তটুকু নিয়ে আমাদের পৌঁছে যেতে হবে গোচেলার শীর্ষে। আজকের এই পথ চলা খানিকটা ড্রেস রিহার্সাল হলেও দর্শকাসন কিন্তু ভরে উঠেছে নীরবতার আখরকথায়। প্রায় ভোর চারটে নাগাদ আমরা যখন হাঁটা শুরু করলাম।  চারপাশে জেগে আছে অজস্র নীরব সাক্ষীর অঙ্গীকার —কম্পাসের দুই মেরু বরাবর রাত জেগে শুয়ে আছে তারামণ্ডল, ঘাসের আগায় শিশিরের সোহাগ জেগে আছে তুহিনের সন্ধিক্ষণে, হেড টর্চের আলোয় অচেনা হাওয়ায় বিবাগীর ধূলো জেগে আছে পথে পথে, সর্বোপরি পশ্চিম সিকিমের এই পাহাড়ি উপত্যকা জেগে আছে আরও একটি নতুন ভোরের অপেক্ষায়। সামান্য কয়েক ঘণ্টা পরই আজকের প্রথম সূর্যের সোনালী আলোয় ভেসে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘাকে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে সুপ্রভাত জানিয়ে নেমে আসবো নিচে।
 

“It just gives us that adrenaline charge when we go on. We know we’re gonna come off two hours later, but we’re pushing it all the way, we build it right through it’s amazing how it happens. It’s sort of magical, because you couldn’t do it in a rehearsal like that you need that audience in front, and that’s really what gets us going”. (Malcolm Young)

 
“Climb High Sleep Low” বলে একটি কথা পর্বতারোহী মহলে খুব বিখ্যাত। পাহাড়ি পরিবেশে উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে (Acclimatization) অনেকটা উপরে উঠে ফের খানিকটা নিচে নেমে এসে টেন্টে রাত কাটানো একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এর ফলে মানুষের শরীর উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ধীরে ধীরে এবং খুব সহজেই উচ্চতাজনিত অসুখ বা অন্যান্য শারীরিক বাধা এড়ানো সম্ভব হয়। গোচেলার পথে সফল আরোহণের লক্ষ্যে জংরি টপ অভিযান এমনই একটি ড্রেস রিহার্সালের ভূমিকা পালন করে। আবার অন্যভাবে দেখলে যারা শারীরিকভাবে গোচেলা শীর্ষ ছুঁতে নেহাতই অক্ষম তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে এই জংরি টপ থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করে ফিরে যান।
 

পুব আকাশ রাঙিয়ে পাহাড়ের মাথায় ঝড়ে পড়লো সোনা রঙ। দু’চোখ ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম এক নির্মল বৌদ্ধিক চেতনায়। অজস্র লাল নীল হলুদ সবুজ পতাকা বাঁধনের সব দায় ছিঁড়ে উড়ে যেতে চাইছে দূর আকাশে। মেঘের সমুদ্র যেন তোলপাড় করা উথাল পাতাল ঢেউ নাচিয়ে মাতঙ্গির মতো জেগে উঠেছে সমর রঙ্গে

 
কিন্তু আমরা এগিয়ে চললাম সামনে, আরও সামনে। হাওয়ার গতিবেগ প্রত্যাশার থেকে অনেক বেশি এবং বাতাসের উষ্ণতা নেমে গেছে হিমাঙ্কের গভীর খাদে। আলো এতটাই কম এবং ঠান্ডা এতটাই বেশি আমার ডিএসএলআর ক্যামেরা অকেজো হয়ে পড়েছে। আলো ফুটতে ফুটতে প্রায় সকাল সাড়ে পাঁচটা। চোখের সামনে অন্ধকারের পর্দা উঠে যেতেই দিগন্ত জুড়ে পরিখার মতো খুলে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। পুব আকাশ রাঙিয়ে পাহাড়ের মাথায় ঝড়ে পড়লো সোনা রঙ। দু’চোখ ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম এক নির্মল বৌদ্ধিক চেতনায়। অজস্র লাল নীল হলুদ সবুজ পতাকা বাঁধনের সব দায় ছিঁড়ে উড়ে যেতে চাইছে দূর আকাশে। মেঘের সমুদ্র যেন তোলপাড় করা উথাল পাতাল ঢেউ নাচিয়ে মাতঙ্গির মতো জেগে উঠেছে সমর রঙ্গে। পাহাড়ের উপর থেকেই বাম দিকে নিচে বহুদূরে HMI এর বেসক্যাম্প যাওয়ার পথ এবং কিছু পোড়ো ছাউনি চোখে পড়ে।
 
টপের মাথায় পৌঁছে দেখি ইন্ডিয়া হাইকসের দলটি ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত। সবাই নিজের নিজের ক্যামেরায় লেন্সবন্দী করতে চায় প্রতিটি মুহুর্ত। একটু দূরে নিচে এক ডাক্তার দম্পতি সুদূর ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছেন; কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে সেলফিতে সাজিয়ে নিচ্ছেন প্রথম হানিমুনের অ্যালবাম। হায়দ্রাবাদ থেকে অফিসের ছুটি ম্যানেজ করে চার বন্ধু এসেছেন বসকে মিথ্যে গল্প শুনিয়ে। দিল্লী থেকে দুজন জিম ট্রেনার এসেছেন; তারা পেশাদার পর্বতারোহীও বটে। এক মিনি ভারতবর্ষ যেন তেঁতুল পাতায় ন’জনের মতো করে ছোট্ট এই জংরি টপের মাথায় জায়গা করে নিয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনায়। ওদিকে দলনেতা অক্ষয় আরালিকাট্টি তার ব্যাগ থেকে জাতীয় পতাকা বের করে মেলে ধরতেই সমগ্র দলটি হুল্লোড়ে লাফিয়ে উঠলো। অপরিচিতের এই গর্ব অনুভূতি দেখে আমরা কেমন অজান্তেই হাততালি দিয়ে উঠলাম। ওদের থেকে জাতীয় পতাকা ধার নিয়ে দলের সদস্যদের সামনে মেলে ধরে আমরাও হেসে উঠলাম ক্যামেরার সামনে।
 
এদের অনেকেই হয়তো এখান থেকেই সমতলে ফিরে যাবে, গোচেলার শীর্ষবিন্দু পর্যন্ত হেঁটে যাবে না, অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এই পথ চলা। তাতে কী এসে গেলো ? জীবনে কিছু কিছু ‘না পাওয়া’ থাকা ভালো, সব পেলে তো নষ্ট জীবন। কিন্তু এই উপভোগের আনন্দটুকু যেন ভরপুর থাকে। এমনই পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে নামছি ধীর পায়ে। এখানে গাছের উচ্চতা ছোট হতে হতে প্রায় কোমরের নিচে। বহুদূর অব্দি খালি চোখে দেখা যায় আকাশের সীমানা। হটাৎ অনুভব করলাম আমার পেটেও আকাশ প্রমাণ খিদে। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠলেই খিদে পাওয়া আমার এক অদ্ভুত ব্যামো। তার উপর এমন হাড়ভাঙা খাটুনি। এমন কোন অভিযান নেই যেখান থেকে ফিরে আমার ওজন তিন কিলো কমে যায়নি। বোতল বের করে জল খেলাম প্রায় এক পেট। নিচে আমাদের টেন্ট এলাকা দেখা যাচ্ছে একটি ছোট রঙিন জনবসতির মতো।
 

 
হাঁটতে হাঁটতে গায়ে গরম জামা কাপড় রাখা দায়। শিরদাঁড়া বেয়ে কলকল ঘাম বইতে থাকে। ক্যাম্পে ফিরতেই ব্যাগ জুতো এদিক ওদিকে ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে স্মৃতিচারণের মতো ফিরে তাকাই ফেলে আসা পথটির দিকে। যা কিছু আমাদের অভ্যাসের বাইরে, যা কিছু আমাদের অজানার আঁধারে, যা কিছু আমাদের সম্ভব অসম্ভবের থেকে আলোকবর্ষ দূরে, ভয়ের উৎসমুখ হয়ে জেগে থাকা সেই বিশালায়তন কঠিন কর্মকাণ্ড একবার আমাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলে সবকিছু কেমন নিমেষে সহজ বলে মনে হয়! তৃপ্তির আনন্দে মন প্রাণ আত্মা ভরে ওঠে কানায় কানায়! পাহাড়ে এসে লার্জার দ্যান লাইফ এই দর্শন কেই কি সঠিক অ্যাক্লিমাটাইজেশন বলে ?
 
আজ কিন্তু বেশ ঝলমলিয়ে রোদ উঠেছে। ঘড়িতে সময় সকাল আটটা। বাতাসের অনুভূতি জানান দিচ্ছে গায়ে গরম জামা কাপড় না রাখলেও চলে। একটা পাতলা টি শার্ট যথেষ্ট। ব্রতীন’দা তাঁবুর উপর সোলার প্যানেল রেখে উত্তাপ সংগ্রহের চেষ্টায় বেশ খানেক সফল, সে তার মুখ চোখের ভাব দেখলেই বোঝা যায়। ওদিকে প্রায় সকলেই ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলেছে। দীর্ঘ পথের কথা ভেবে সবাই জল, ওষুধ, শুকনো খাবারের টুকটাক প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে নিজস্ব খেয়ালে। রথীন’দা সব জামা কাপড় ব্যাগের বাইরে বের করে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন মাজনের টিউব থেকে মাজন বেরিয়ে পড়েছে হাত ফসকে! এখন বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে গোছাবে! ওর কাণ্ড দেখে সবাই হেসে খুন। ওদিকে গাইড ছেলেটি তার বন্ধুদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তাঁবু খুলছে জোর কদমে। ওদের দেরি হচ্ছে দেখে আমরাও হাত লাগলাম। আজকের গন্তব্য কোকচুরেন পেরিয়ে থানসিং। তাহলে আর দেরি কিসের ! লেটস স্টার্ট ওয়াকিং।
 

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১১


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!